অন্য মুর্তজা বশীর
তিনি দেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের একজন। তিনি লেখক-কবি। তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে। জড়িত ছিলেন বাম রাজনীতিতে। কিন্তু এর বাইরেও তিনি অন্য আরেকজন। সেই অজানা মুর্তজা বশীরকে নিয়ে লিখেছেন নিজাম বিশ্বাস
১৯৯৭ সালের ৩০ জুন এবং ১ জুলাইয়ের সন্ধিক্ষণে প্রকাশিত ব্রিটিশ হংকং ও চীনা হংকংয়ের উদ্ভোবধনী খাম শিল্পী মুতর্জা বশীরকে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর চীনা বন্ধু এলেন টো।
বড় একটি টেবিল—দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি ড্রয়ার। ড্রয়ারের কাগজপত্র নাড়তে গিয়ে চোখে পড়ল চিঠির খাম। খাম থেকে ছিঁড়ে নিল ডাকটিকিট। বাবার লাইব্রেরিতে শিল্পী মুর্তজা বশীরের শৈশবের কোনো এক বিকেলের দৃশ্য।
১৯৩২ সালে তাঁর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের ব্যবহূত জিনিসপত্র ফেলা হতো ঢাকার নয়াবাজারে। নয়াবাজার ছিল তখন নিচু বিরান ভূমি, আশপাশে দালানকোঠা তেমন ছিল না। বালক মুর্তজা বশীর সেখানে ডাকটিকিট কুড়াতে যেতেন। সেই নেশা সঙ্গী হয়ে যায় চিরকালের।
কিন্তু মাঝখানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতি, ১৯৫০ সালে কারাভোগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্লোরেন্স গমনসহ জীবনের বহুমুখী ব্যস্ততায়—ইজেলে ক্যানভাসের ভিড়ে শিল্পী যেন ভুলেই গেলেন কোন সেই ডাকটিকিটের কথা!
তারপর ১৯৭০ সালে বড় মেয়ে মুনিরা বশীরের ষষ্ঠ জন্মদিনে বাবা মুর্তজা বশীর উপহার দিলেন বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটে গড়া একটি অ্যালবাম। ডাকটিকিটগুলোর বিষয়বস্তু ছিল জীবজন্তু। মেয়ের জন্য ডাকটিকিটের চিড়িয়াখানা বানাতে গিয়ে শিল্পীর মনে শখের পুনর্জন্ম হলো। তারপর হয়ে গেল নেশা। একটি, দুটি, তিনটি করে দিনে দিনে অ্যালবামের সংখ্যা বাড়তেই থাকল। ঢাকা, করাচি, লাহোর, প্যারিস, লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করলেন অসংখ্য ডাকটিকিট। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিল্পী প্রতিষ্ঠিত হলেন বিশিষ্ট ফিলাটেলিস্ট হিসেবে। ১৯৮৪ সালে ‘প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় ডাকটিকিট প্রদর্শনী’র বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন ফিলাটেলিস্ট মুর্তজা বশীর।
সংগ্রহবৈচিত্র্য
শিল্পী মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের নেশা শুধু ডাকটিকিট, দিয়াশলাইয়ের খাপে সীমাবদ্ধ থাকেনি, কালে তাঁর সংগ্রহের তালিকায় যোগ হয়েছে বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ, দুর্লভ পুস্তক আর মুদ্রা। ডাকটিকিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি বিষয়ভিত্তিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন, এ সংগ্রহের ক্ষেত্রে শিল্পী বেছে নিয়েছেন পেইন্টিংস, জীবজন্তু, ওভারপ্রিন্ট, ডাকটিকিটে ডাকটিকিট, ধর্মীয় স্থাপত্য এবং তাঁর মার্ক্সবাদের গুরু লেনিন। পেইন্টিংসের ডাকটিকিটগুলো সাজানো হয়েছে দেশভিত্তিক ছয়টি অ্যালবামে। এ-ই, এফ-আই, জে-পি, আর-ভি, ওয়াই-জেড এবং আরেকটি অ্যালবামে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পেইন্টিংসের ওপর প্রকাশিত ডাকটিকিট।
স্কুলে ভূগোল পরীক্ষায় ভারতবর্ষের মানচিত্র আঁকতে হতো—উত্তরে নেপাল, দক্ষিণে সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) আঁকার মধ্য দিয়ে আগ্রহ জন্মে ব্রিটিশ ভারত, বার্মাসহ (মিয়ানমার) এ অঞ্চলের ডাকটিকিটের প্রতি। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা (মিয়ানমার), বাংলাদেশ; তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন সংগ্রহ করেছেন। চীনের ডাকটিকিট তেমনভাবে জমাতেন না, পেলে রাখতেন। হংকং যখন চীনের অধীনে চলে যায়, তখন তিনি ব্রিটিশ হংকং সংগ্রহ শুরু করেন।
ডাকটিকিটের চিড়িয়াখানা
বড় মেয়ের জন্য বানানো চিড়িয়াখানায় শিল্পী এখনো নতুন নতুন প্রাণী এনে জড়ো করেন অ্যালবামের খাঁচায়। ডাকটিকিটগুলোর বিন্যাসে এখন অনেক বৈচিত্র্য: মাছ, কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, জলজ কাঁকড়া একটি পুরু অ্যালবামে আর সরীসৃপ গোত্রের প্রাণীগুলো বেঁধে রেখেছেন স্বচ্ছ সেলোফেনের ফিতায়। এ রকম অর্ধডজন অ্যালবামে বন্দী আছে প্রাণিকুলের এত সব ডাকটিকিট।
লেনিনিয়ানা
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতিহাসের প্রথম মহান সোভিয়েত রাষ্ট্রের উদ্যোক্তা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৩) সর্বপ্রথম ডাকটিকিটে বিষয়বস্তু হন ১৯২৪ সালে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই নয়, সোভিয়েত সমমনা প্রতিটি দেশই প্রকাশ করেছে লেনিনের ডাকটিকিট। আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, বুরুন্ডি, মিসর, লেবানন, মালি, মৌরিতানিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়া, নাইজার, গিনি, নিকারাগুয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের ডাকটিকিটে বিষয়বস্তু হয়েছেন এই সোভিয়েত মহানায়ক। শিল্পী মুর্তজা বশীরের বিষয়ভিত্তিক সংগ্রহের অন্যতম আকর্ষণ ডাকটিকিটে লেনিন। শুধু লেনিনকেন্দ্রিক ডাকটিকিট সংগ্রহ করেই তৃপ্ত নন এই ফিলাটেলিস্ট। লেনিনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত শহর, সড়ক, কোনো প্রতিষ্ঠান, স্থাপত্য, লেনিন নামের কোনো জাহাজ কিংবা লেনিনের নামে উৎসর্গীকৃত কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সবই তাঁর আগ্রহের ও সংগ্রহের বিষয়। শিল্পী দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন ডাকটিকিটগুলো। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ডাকটিকিট একটি অ্যালবামে এবং লেনিনিয়ানা নামের একটি অ্যালবামজুড়ে আছে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লেনিনের ওপর প্রকাশিত ডাকটিকিট।
অ্যাস্ট্রো ও মোফিলা
গত শতকের চল্লিশের দশকে দেশলাইয়ের খাপ জমানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে, ফিলাটেলির স্বর্ণযুগ পেরিয়ে, আজ প্রযুক্তিবিপ্লবের নাতিশীতোষ্ণ দিনেও তিনি একজন আধুনিক ফিলাটেলিস্ট। সংগ্রহের বিষয় হিসেবে ‘অ্যাস্ট্রোফিলাটেলি’ অন্তর্ভুক্ত করা তারই বড় ইঙ্গিত। সোভিয়েত স্পেস ডাকটিকিটের সিংহ ভাগই জমে গেছে অ্যালবামে, ইউরো-মেরিকার ডাকটিকিটসহ অন্য অনেক দেশের ডাকটিকিটে ছুটছে তাঁর শখের রকেট।
‘মোফিলা’ বা ‘মডার্ন ফিলাটেলির প্রতি তুমুল আগ্রহ রয়েছে এ শিল্পীর। নেপালের ডাকটিকিট সংগ্রহ করেছেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ডাকটিকিটের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ৫০ বছরের ডাকটিকিট সংগ্রহ করছেন। গ্রেট ব্রিটেন ২০০৩ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করে অ্যালবাম বন্ধ করেছেন। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কার স্যুভেনির শিট সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রেট ব্রিটেনের সব এসএস রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।
নিউমিসম্যাটিকস
১৯৮৯-৯৩ বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অব দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়াতে প্রাক-মোগল যুগে বাংলার সুলতানদের শাসন আমলে প্রচলিত মুদ্রাবিষয়ক গবেষণাধর্মী একাধিক মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশ করেন নিউমিসম্যাটিস্ট মুর্তজা বশীর। ২০০৪ সালে তাঁর মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ গ্রন্থটি তুমুল আগ্রহ সৃষ্টি করে।
শিল্পী মুর্তজা বশীর এই ভিন্নধর্মী গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, ‘...ভৌগোলিক পরিবেশ ও ঐতিহাসিক পটভূমি সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটায়। এই উপমহাদেশের প্রবহমান সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও লোকজ ও বিদেশি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে বাংলার শিল্পকলায় যে রূপান্তর লক্ষ করা যায়, তা-ই ছিল আমার অন্বেষণ। সেই উৎস অন্বেষায় এই উপমহাদেশের প্রাচীন শিল্পকলা ছাড়াও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসপাঠ যেমন একদিকে অতি আবশ্যকীয় ছিল, তেমনি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, জাতক এবং হিন্দু-বৌদ্ধ স্মৃতি ও শ্রুতিশাস্ত্র প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে।
‘এই অনুসন্ধানের এক পর্বে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের স্থাপত্য, মুদ্রা ও শিলালিপির প্রতি মনঃসংযোগ ঘটে। প্রসঙ্গক্রমে আবিসিনিয়া থেকে আসা হাবশিদের দাসরূপে ছয় বছর রাজত্বকাল সম্পর্কে ঔৎসুক্য জাগে। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাসগ্রন্থগুলোর যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত আমার অন্তর্নিহিত জিজ্ঞাসাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিতুষ্ট করতে পারেনি। এগুলো ছিল সুলতানদের উত্থান-পতনের ইতিবৃত্ত, রোমাঞ্চিত ইতিকথা। ইতিহাস আমার কাছে রাজ-রাজড়াদের ধারাবাহিক বর্ণনা নয়, সংঘটিত ঘটনার ব্যাখ্যা। তাই সুলতানি আমলের ইতিহাস হলো বহিরাগত রাজশক্তির একতন্ত্র। রাজপরিবারে আত্মকলহ, দরবার রাজনীতি ও ক্ষমতায় দ্বন্দ্ব, শ্রেণীগত ও বর্ণবিদ্বেষ এবং পারসিক তুর্ক-আফগান আরব অভিজাতদের স্বার্থ সংঘাত।’
কাগুজে মুদ্রা
২০১০ সাল থেকে তাঁর শখের দুনিয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে দেশ-বিদেশের কাগুজে মুদ্রা। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অন্তত একটি নোট চাই-ই চাই। বিশেষ করে, যেসব দেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, সেসব দেশের কাগুজে মুদ্রা সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁর বেশি তোড়জোড়। ইন্দোচীন, ডাচ-ইন্ডিস কিংবা জাঞ্জিবারের একটি কাগুজে মুদ্রা এখনো শিল্পীকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাঁর কৈশোরে।
‘...আর ছিল প্রচণ্ড নেশার/ টান ডাকটিকিটের; খুঁজেছি হারানো স্বর্ণযুগ/ ডুবুরির মতো আমি কালের অতল গর্ভ থেকে/ রৌপ্য মুদ্রার লিপিতে’ (আত্মপ্রতিকৃতি ১৯৯১)
ফিলাটেলি ও নিউমিসম্যাটিকসের প্রতি নেশাতুর কবি মুর্তজা বশীর প্রকাশ পায় এই শব্দ বুননে।
বড় একটি টেবিল—দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি ড্রয়ার। ড্রয়ারের কাগজপত্র নাড়তে গিয়ে চোখে পড়ল চিঠির খাম। খাম থেকে ছিঁড়ে নিল ডাকটিকিট। বাবার লাইব্রেরিতে শিল্পী মুর্তজা বশীরের শৈশবের কোনো এক বিকেলের দৃশ্য।
১৯৩২ সালে তাঁর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের ব্যবহূত জিনিসপত্র ফেলা হতো ঢাকার নয়াবাজারে। নয়াবাজার ছিল তখন নিচু বিরান ভূমি, আশপাশে দালানকোঠা তেমন ছিল না। বালক মুর্তজা বশীর সেখানে ডাকটিকিট কুড়াতে যেতেন। সেই নেশা সঙ্গী হয়ে যায় চিরকালের।
কিন্তু মাঝখানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতি, ১৯৫০ সালে কারাভোগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্লোরেন্স গমনসহ জীবনের বহুমুখী ব্যস্ততায়—ইজেলে ক্যানভাসের ভিড়ে শিল্পী যেন ভুলেই গেলেন কোন সেই ডাকটিকিটের কথা!
তারপর ১৯৭০ সালে বড় মেয়ে মুনিরা বশীরের ষষ্ঠ জন্মদিনে বাবা মুর্তজা বশীর উপহার দিলেন বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটে গড়া একটি অ্যালবাম। ডাকটিকিটগুলোর বিষয়বস্তু ছিল জীবজন্তু। মেয়ের জন্য ডাকটিকিটের চিড়িয়াখানা বানাতে গিয়ে শিল্পীর মনে শখের পুনর্জন্ম হলো। তারপর হয়ে গেল নেশা। একটি, দুটি, তিনটি করে দিনে দিনে অ্যালবামের সংখ্যা বাড়তেই থাকল। ঢাকা, করাচি, লাহোর, প্যারিস, লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করলেন অসংখ্য ডাকটিকিট। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিল্পী প্রতিষ্ঠিত হলেন বিশিষ্ট ফিলাটেলিস্ট হিসেবে। ১৯৮৪ সালে ‘প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় ডাকটিকিট প্রদর্শনী’র বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন ফিলাটেলিস্ট মুর্তজা বশীর।
সংগ্রহবৈচিত্র্য
শিল্পী মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের নেশা শুধু ডাকটিকিট, দিয়াশলাইয়ের খাপে সীমাবদ্ধ থাকেনি, কালে তাঁর সংগ্রহের তালিকায় যোগ হয়েছে বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ, দুর্লভ পুস্তক আর মুদ্রা। ডাকটিকিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি বিষয়ভিত্তিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন, এ সংগ্রহের ক্ষেত্রে শিল্পী বেছে নিয়েছেন পেইন্টিংস, জীবজন্তু, ওভারপ্রিন্ট, ডাকটিকিটে ডাকটিকিট, ধর্মীয় স্থাপত্য এবং তাঁর মার্ক্সবাদের গুরু লেনিন। পেইন্টিংসের ডাকটিকিটগুলো সাজানো হয়েছে দেশভিত্তিক ছয়টি অ্যালবামে। এ-ই, এফ-আই, জে-পি, আর-ভি, ওয়াই-জেড এবং আরেকটি অ্যালবামে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পেইন্টিংসের ওপর প্রকাশিত ডাকটিকিট।
স্কুলে ভূগোল পরীক্ষায় ভারতবর্ষের মানচিত্র আঁকতে হতো—উত্তরে নেপাল, দক্ষিণে সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) আঁকার মধ্য দিয়ে আগ্রহ জন্মে ব্রিটিশ ভারত, বার্মাসহ (মিয়ানমার) এ অঞ্চলের ডাকটিকিটের প্রতি। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা (মিয়ানমার), বাংলাদেশ; তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন সংগ্রহ করেছেন। চীনের ডাকটিকিট তেমনভাবে জমাতেন না, পেলে রাখতেন। হংকং যখন চীনের অধীনে চলে যায়, তখন তিনি ব্রিটিশ হংকং সংগ্রহ শুরু করেন।
ডাকটিকিটের চিড়িয়াখানা
বড় মেয়ের জন্য বানানো চিড়িয়াখানায় শিল্পী এখনো নতুন নতুন প্রাণী এনে জড়ো করেন অ্যালবামের খাঁচায়। ডাকটিকিটগুলোর বিন্যাসে এখন অনেক বৈচিত্র্য: মাছ, কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, জলজ কাঁকড়া একটি পুরু অ্যালবামে আর সরীসৃপ গোত্রের প্রাণীগুলো বেঁধে রেখেছেন স্বচ্ছ সেলোফেনের ফিতায়। এ রকম অর্ধডজন অ্যালবামে বন্দী আছে প্রাণিকুলের এত সব ডাকটিকিট।
লেনিনিয়ানা
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতিহাসের প্রথম মহান সোভিয়েত রাষ্ট্রের উদ্যোক্তা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৩) সর্বপ্রথম ডাকটিকিটে বিষয়বস্তু হন ১৯২৪ সালে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই নয়, সোভিয়েত সমমনা প্রতিটি দেশই প্রকাশ করেছে লেনিনের ডাকটিকিট। আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, বুরুন্ডি, মিসর, লেবানন, মালি, মৌরিতানিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়া, নাইজার, গিনি, নিকারাগুয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের ডাকটিকিটে বিষয়বস্তু হয়েছেন এই সোভিয়েত মহানায়ক। শিল্পী মুর্তজা বশীরের বিষয়ভিত্তিক সংগ্রহের অন্যতম আকর্ষণ ডাকটিকিটে লেনিন। শুধু লেনিনকেন্দ্রিক ডাকটিকিট সংগ্রহ করেই তৃপ্ত নন এই ফিলাটেলিস্ট। লেনিনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত শহর, সড়ক, কোনো প্রতিষ্ঠান, স্থাপত্য, লেনিন নামের কোনো জাহাজ কিংবা লেনিনের নামে উৎসর্গীকৃত কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সবই তাঁর আগ্রহের ও সংগ্রহের বিষয়। শিল্পী দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন ডাকটিকিটগুলো। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ডাকটিকিট একটি অ্যালবামে এবং লেনিনিয়ানা নামের একটি অ্যালবামজুড়ে আছে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লেনিনের ওপর প্রকাশিত ডাকটিকিট।
অ্যাস্ট্রো ও মোফিলা
গত শতকের চল্লিশের দশকে দেশলাইয়ের খাপ জমানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে, ফিলাটেলির স্বর্ণযুগ পেরিয়ে, আজ প্রযুক্তিবিপ্লবের নাতিশীতোষ্ণ দিনেও তিনি একজন আধুনিক ফিলাটেলিস্ট। সংগ্রহের বিষয় হিসেবে ‘অ্যাস্ট্রোফিলাটেলি’ অন্তর্ভুক্ত করা তারই বড় ইঙ্গিত। সোভিয়েত স্পেস ডাকটিকিটের সিংহ ভাগই জমে গেছে অ্যালবামে, ইউরো-মেরিকার ডাকটিকিটসহ অন্য অনেক দেশের ডাকটিকিটে ছুটছে তাঁর শখের রকেট।
‘মোফিলা’ বা ‘মডার্ন ফিলাটেলির প্রতি তুমুল আগ্রহ রয়েছে এ শিল্পীর। নেপালের ডাকটিকিট সংগ্রহ করেছেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ডাকটিকিটের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ৫০ বছরের ডাকটিকিট সংগ্রহ করছেন। গ্রেট ব্রিটেন ২০০৩ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করে অ্যালবাম বন্ধ করেছেন। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কার স্যুভেনির শিট সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রেট ব্রিটেনের সব এসএস রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।
নিউমিসম্যাটিকস
১৯৮৯-৯৩ বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অব দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়াতে প্রাক-মোগল যুগে বাংলার সুলতানদের শাসন আমলে প্রচলিত মুদ্রাবিষয়ক গবেষণাধর্মী একাধিক মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশ করেন নিউমিসম্যাটিস্ট মুর্তজা বশীর। ২০০৪ সালে তাঁর মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ গ্রন্থটি তুমুল আগ্রহ সৃষ্টি করে।
শিল্পী মুর্তজা বশীর এই ভিন্নধর্মী গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, ‘...ভৌগোলিক পরিবেশ ও ঐতিহাসিক পটভূমি সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটায়। এই উপমহাদেশের প্রবহমান সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও লোকজ ও বিদেশি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে বাংলার শিল্পকলায় যে রূপান্তর লক্ষ করা যায়, তা-ই ছিল আমার অন্বেষণ। সেই উৎস অন্বেষায় এই উপমহাদেশের প্রাচীন শিল্পকলা ছাড়াও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসপাঠ যেমন একদিকে অতি আবশ্যকীয় ছিল, তেমনি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, জাতক এবং হিন্দু-বৌদ্ধ স্মৃতি ও শ্রুতিশাস্ত্র প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে।
‘এই অনুসন্ধানের এক পর্বে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের স্থাপত্য, মুদ্রা ও শিলালিপির প্রতি মনঃসংযোগ ঘটে। প্রসঙ্গক্রমে আবিসিনিয়া থেকে আসা হাবশিদের দাসরূপে ছয় বছর রাজত্বকাল সম্পর্কে ঔৎসুক্য জাগে। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাসগ্রন্থগুলোর যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত আমার অন্তর্নিহিত জিজ্ঞাসাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিতুষ্ট করতে পারেনি। এগুলো ছিল সুলতানদের উত্থান-পতনের ইতিবৃত্ত, রোমাঞ্চিত ইতিকথা। ইতিহাস আমার কাছে রাজ-রাজড়াদের ধারাবাহিক বর্ণনা নয়, সংঘটিত ঘটনার ব্যাখ্যা। তাই সুলতানি আমলের ইতিহাস হলো বহিরাগত রাজশক্তির একতন্ত্র। রাজপরিবারে আত্মকলহ, দরবার রাজনীতি ও ক্ষমতায় দ্বন্দ্ব, শ্রেণীগত ও বর্ণবিদ্বেষ এবং পারসিক তুর্ক-আফগান আরব অভিজাতদের স্বার্থ সংঘাত।’
কাগুজে মুদ্রা
২০১০ সাল থেকে তাঁর শখের দুনিয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে দেশ-বিদেশের কাগুজে মুদ্রা। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অন্তত একটি নোট চাই-ই চাই। বিশেষ করে, যেসব দেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, সেসব দেশের কাগুজে মুদ্রা সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁর বেশি তোড়জোড়। ইন্দোচীন, ডাচ-ইন্ডিস কিংবা জাঞ্জিবারের একটি কাগুজে মুদ্রা এখনো শিল্পীকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাঁর কৈশোরে।
‘...আর ছিল প্রচণ্ড নেশার/ টান ডাকটিকিটের; খুঁজেছি হারানো স্বর্ণযুগ/ ডুবুরির মতো আমি কালের অতল গর্ভ থেকে/ রৌপ্য মুদ্রার লিপিতে’ (আত্মপ্রতিকৃতি ১৯৯১)
ফিলাটেলি ও নিউমিসম্যাটিকসের প্রতি নেশাতুর কবি মুর্তজা বশীর প্রকাশ পায় এই শব্দ বুননে।
No comments