পাকিস্তান-আদালতের কাঠগড়ায় সেনাবাহিনী ও আইএসআই by মশিউল আলম
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান রাজ্যে প্রায় তিন বছর ধরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও জাতি-গোষ্ঠীগত সহিংসতায় অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে অনেক মানুষ। সর্বশেষ কয়েক মাসে রাজ্যটিতে টার্গেটেড কিলিং, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ, গুম ইত্যাদি বেড়ে গেছে উদ্বেগজনক মাত্রায়।
বেলুচিস্তান রাজ্য সংসদের একজন এমপি বখতিয়ার দমকির স্ত্রী ও কিশোরী কন্যাকে গুলি করে মারা, জোহাইব নামের এক ব্যবসায়ী হত্যা, হামজা শাহওয়ানি নামে এক আইনজীবী অপহরণসহ কতগুলো হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনায় রাজ্যটিতে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। পৃথক পৃথকভাবে অনেক হত্যা ও অপহরণের মামলা হয়েছে। রাজ্যটিতে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়া ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে উচ্চ আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন বালুচ হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি হাদি শাকিল।
রাজ্যটির অ্যাডভোকেট জেনারেল আমানুল্লাহ কিরনানি একটি মামলার শুনানিকালে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, রাজ্যটিতে এ পর্যন্ত ২০৪ জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে, ৮০ ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে, যাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রধান বিচারপতি এতে সন্তুষ্ট না হয়ে তাঁকে আদেশ দিয়েছেন, রাজ্যের প্রতিটি জেলায় গত তিন বছরে মোট কতজন মানুষ খুন হয়েছেন, কতজন অপহূত হয়েছেন, নিরুদ্দেশ আছেন কতজন, তার জেলাভিত্তিক বিশদ প্রতিবেদন দাখিল করতে। অ্যাডভোকেট জেনারেল আদালতকে জানিয়েছেন, ওই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হত্যার শিকার হচ্ছেন। বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা রাস্তা থেকে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর নির্যাতন করে তাদের মেরে ফেলে লাশ গুম করে দিচ্ছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের বিবরণ অনুযায়ী বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে দেশটির প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে নানা রকম আদেশ দিতে ও মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি তিনি মন্তব্য করেছেন, বেলুচিস্তানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, মনে হচ্ছে সেখানে কোনো সরকার নেই। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় চরম হতাশা ব্যক্ত করে প্রধান বিচারপতি চড়াও হয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর।
পাকিস্তানের মর্যাদাবান ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক নাজাম শেঠি ২৩ মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে জানাচ্ছেন, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী সম্প্রতি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনাদের মন থেকে এই ধারণা দূর করা দরকার যে আপনারাই সুপিরিয়র, বাকি সবাই ইনফিরিয়র...লোকজনের পেছনে ধাওয়া করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? আপনাদের কারণে যেসব পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছে, তাদের দুঃখ-বেদনার প্রতি আপনারা অসংবেদনশীল। আপনাদের বিরুদ্ধে এটা একটা গুরুতর অভিযোগ, সারা দেশে শোরগোল চলছে যে আপনারা লোকজনকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, তারপর তাদের লাশ পুঁতে ফেলছেন...আপনারা আগুনদাতা, বেলুচিস্তানে আপনারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন...আপনারা মনে করেন, আপনারা এই দেশের অনুগত, কিন্তু আমরা সম্ভবত আপনাদের চেয়ে বেশি অনুগত। একজন বিচারক যদি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করতে না পারেন, তাহলে তিনি কেন আপনাদের তা ভঙ্গ করতে দেবেন..।’
সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের হাতে মানুষের খুন-গুম হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি গর্জন করে বলেন, ‘আমরা বারবার আপনাদের কাছে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাই, আর আপনারা আমাদের কাহিনি শোনান। আমরা কি এখানে আছি আপনাদের কাহিনি শোনার জন্য?’
প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে মন্তব্য করেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব বিষয়ে অসংবেদনশীল; তারা তাদের এখতিয়ারের সীমার মধ্যে থেকে কাজ করছে না, তারাই দেশের সবচেয়ে বড় আইনভঙ্গকারী। কিন্তু তারা তো আইনের ঊর্ধ্বে নয়; রাষ্ট্রের স্বার্থে আমরা এ বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারি না।’
দুই
১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনীতিকদের আইএসআইয়ের অর্থ দেওয়ার অভিযোগে আসগর খানের দায়ের করা মামলার নতুন করে শুরু হওয়া শুনানির তৃতীয় দিন, গত ৯ মার্চ আইনজীবীসহ আদালতে হাজির হন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ। ব্যাংকার ইউনুস হাবিবের দেওয়া হলফনামার প্রতিবাদে একটি পাল্টা হলফনামা তিনি আদালতে দাখিল করেন। সে হলফনামার একটি অনুচ্ছেদে তিনি পরিহাসের সুরে লেখেন, সুপ্রিম কোর্টে তাঁর এই হাজিরার মধ্য দিয়ে তিনি হ্যাটট্রিক করলেন। এর আগে অন্য দুজন প্রধান বিচারপতির সময় তাঁকে দুবার এখানে হাজিরা দিতে হয়েছে। এটা তার জন্য এক বিরল ‘সম্মানের বিষয়, সম্ভবত আর কোনো সেনাপ্রধানই এমন সম্মানের দাবি করতে পারেন না। কিন্তু আমি স্মরণে আসে না কী অপরাধে আমাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ জেনারেল আসলাম বেগের এই বক্তব্যের ভাষাকে আদালতের জন্য অবমাননাকর ঘোষণা করে তাঁর আইনজীবী আকরাম শেখকে ভর্ৎসনা করেন। প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, এই ধরনের ভাষা আদালতে ব্যবহার করা যায়?’ তিনি অ্যাডভোকেট আকরাম শেখকে বলেন, তিনি যেন তাঁর মক্কেল জেনারেল আসলাম বেগকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেন। প্রধান বিচারপতি জেনারেল বেগের আইনজীবীকে বলেন, ‘এক্ষুনি লিখিত আকারে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং হলফনামা থেকে ১৪ নং অনুচ্ছেদ বাদ দিন, নইলে আমরা আপনার মক্কেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ অ্যাডভোকেট আকরাম শেখ তাঁর মক্কেল সাবেক সেনাপ্রধান আসলাম বেগকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বললে জেনারেল বেগ সেখানে দাঁড়িয়ে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁর দাখিল করা লিখিত হলফনামার ১৪ নং অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে তা গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে আদালত পরে তা গ্রহণ করে। জেনারেল বেগ কাঠগড়ায় দাঁড়ালে বেঞ্চের আরেক সদস্য বিচারপতি খিলজি আরিফ হোসেন তাঁর আদালতে আসায় হ্যাটট্রিক করার প্রসঙ্গে উল্লেখ করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি আদালতে এসেছেন গলফ খেলতে?’ তিনি আরও মন্তব্য করেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মানসিকতা এমন হয়ে গেছে যে, ‘আমরা সুপিরিয়র, আর তারা (বেসামরিক লোকজন) ইনফিরিয়র।...আমরা জানি, তাঁদের কেউ কেউ ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ কথাটা ব্যবহার করেন।’
আসগর খান মামলার ১৪ মার্চের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন সব কাজ করে, যেগুলো তাদের এখতিয়ারের বাইরে।’ বিচারপতি আরিফ হুসেইন খিলজি বলেন, ‘তারা (গোয়েন্দা সংস্থাগুলো) মনে করে, একমাত্র তারাই দেশ চালাতে পারে; বাকি সব মানুষ ভয়ংকর।’
তিন
বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর আসগর খান মামলায় রাজনীতিকদের অর্থ দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে যে কঠোর জবাবদিহির মুখে দাঁড় করিয়েছেন, দেশটির সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে বেশ উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি এসব দেখেশুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েক দিন আগে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা করা হচ্ছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এমনটি করা হয় না।’ তিনি মনে করেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। সমালোচকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও আইএসআইকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হোক, অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হোক।
কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগ ও পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের বৃহত্তর অংশ তাদের কথাবার্তা, লেখালেখি বন্ধ করতে রাজি নয়। যেমন, নাজাম শেঠি মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সময় ও প্রেক্ষাপট এখন সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে, সেনাবাহিনী এতটা কাল ধরে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য গেছে মোল্লাদের কাছে, আর্থিক-বৈষয়িক সুবিধা-সমর্থনের জন্য নির্ভর করেছে আমেরিকার ওপর। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ এখন অনেক সচেতন ও পরিপক্ব হয়েছে, মোল্লাদের ভাবনা আর তাদের প্রভাবিত করে না; তারা আমেরিকার ওপরও আর নির্ভরশীল থাকতে চায় না।
পাকিস্তানের ছয় দশকের ইতিহাসে সেনাবাহিনী সবচেয়ে প্রবল রাজনৈতিক খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করে এসেছে; সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জবাবদিহির প্রয়োজন আছে—এমনটি তারা ভাবেননি। রাজনীতিকেরা তাদের সঙ্গে কখনোই পেরে ওঠেননি। সম্প্রতি বিচার বিভাগের অতি সক্রিয় আচরণ লক্ষ করে অনেকে বলছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে বিচার বিভাগ। আর রাজনৈতিক খেলোয়াড় হলে যা হয়, নিজের সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার অভিযোগও উচ্চারিত হচ্ছে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী, যিনি পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়ে আবার তা বাতিল করে নিজেও বাতিল হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর অতি-উৎসাহী, অতি-সক্রিয় আচরণকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। তবে মানতেই হবে, লড়াইটা বেশ তীব্র, এবং সম্ভবত বিপজ্জনক। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পাকিস্তান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রক্ষাকর্তার ভূমিকা খুব সহজে ছেড়ে দেবে—এটা ভাবা বোধ হয় ঠিক হবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হাতে সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এই নাকানি-চুবানির পরিণতি কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
রাজ্যটির অ্যাডভোকেট জেনারেল আমানুল্লাহ কিরনানি একটি মামলার শুনানিকালে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, রাজ্যটিতে এ পর্যন্ত ২০৪ জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে, ৮০ ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে, যাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রধান বিচারপতি এতে সন্তুষ্ট না হয়ে তাঁকে আদেশ দিয়েছেন, রাজ্যের প্রতিটি জেলায় গত তিন বছরে মোট কতজন মানুষ খুন হয়েছেন, কতজন অপহূত হয়েছেন, নিরুদ্দেশ আছেন কতজন, তার জেলাভিত্তিক বিশদ প্রতিবেদন দাখিল করতে। অ্যাডভোকেট জেনারেল আদালতকে জানিয়েছেন, ওই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হত্যার শিকার হচ্ছেন। বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা রাস্তা থেকে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর নির্যাতন করে তাদের মেরে ফেলে লাশ গুম করে দিচ্ছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের বিবরণ অনুযায়ী বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে দেশটির প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে নানা রকম আদেশ দিতে ও মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি তিনি মন্তব্য করেছেন, বেলুচিস্তানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, মনে হচ্ছে সেখানে কোনো সরকার নেই। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় চরম হতাশা ব্যক্ত করে প্রধান বিচারপতি চড়াও হয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর।
পাকিস্তানের মর্যাদাবান ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক নাজাম শেঠি ২৩ মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে জানাচ্ছেন, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী সম্প্রতি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনাদের মন থেকে এই ধারণা দূর করা দরকার যে আপনারাই সুপিরিয়র, বাকি সবাই ইনফিরিয়র...লোকজনের পেছনে ধাওয়া করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? আপনাদের কারণে যেসব পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছে, তাদের দুঃখ-বেদনার প্রতি আপনারা অসংবেদনশীল। আপনাদের বিরুদ্ধে এটা একটা গুরুতর অভিযোগ, সারা দেশে শোরগোল চলছে যে আপনারা লোকজনকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, তারপর তাদের লাশ পুঁতে ফেলছেন...আপনারা আগুনদাতা, বেলুচিস্তানে আপনারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন...আপনারা মনে করেন, আপনারা এই দেশের অনুগত, কিন্তু আমরা সম্ভবত আপনাদের চেয়ে বেশি অনুগত। একজন বিচারক যদি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করতে না পারেন, তাহলে তিনি কেন আপনাদের তা ভঙ্গ করতে দেবেন..।’
সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের হাতে মানুষের খুন-গুম হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি গর্জন করে বলেন, ‘আমরা বারবার আপনাদের কাছে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাই, আর আপনারা আমাদের কাহিনি শোনান। আমরা কি এখানে আছি আপনাদের কাহিনি শোনার জন্য?’
প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে মন্তব্য করেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব বিষয়ে অসংবেদনশীল; তারা তাদের এখতিয়ারের সীমার মধ্যে থেকে কাজ করছে না, তারাই দেশের সবচেয়ে বড় আইনভঙ্গকারী। কিন্তু তারা তো আইনের ঊর্ধ্বে নয়; রাষ্ট্রের স্বার্থে আমরা এ বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারি না।’
দুই
১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনীতিকদের আইএসআইয়ের অর্থ দেওয়ার অভিযোগে আসগর খানের দায়ের করা মামলার নতুন করে শুরু হওয়া শুনানির তৃতীয় দিন, গত ৯ মার্চ আইনজীবীসহ আদালতে হাজির হন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ। ব্যাংকার ইউনুস হাবিবের দেওয়া হলফনামার প্রতিবাদে একটি পাল্টা হলফনামা তিনি আদালতে দাখিল করেন। সে হলফনামার একটি অনুচ্ছেদে তিনি পরিহাসের সুরে লেখেন, সুপ্রিম কোর্টে তাঁর এই হাজিরার মধ্য দিয়ে তিনি হ্যাটট্রিক করলেন। এর আগে অন্য দুজন প্রধান বিচারপতির সময় তাঁকে দুবার এখানে হাজিরা দিতে হয়েছে। এটা তার জন্য এক বিরল ‘সম্মানের বিষয়, সম্ভবত আর কোনো সেনাপ্রধানই এমন সম্মানের দাবি করতে পারেন না। কিন্তু আমি স্মরণে আসে না কী অপরাধে আমাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ জেনারেল আসলাম বেগের এই বক্তব্যের ভাষাকে আদালতের জন্য অবমাননাকর ঘোষণা করে তাঁর আইনজীবী আকরাম শেখকে ভর্ৎসনা করেন। প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, এই ধরনের ভাষা আদালতে ব্যবহার করা যায়?’ তিনি অ্যাডভোকেট আকরাম শেখকে বলেন, তিনি যেন তাঁর মক্কেল জেনারেল আসলাম বেগকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেন। প্রধান বিচারপতি জেনারেল বেগের আইনজীবীকে বলেন, ‘এক্ষুনি লিখিত আকারে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং হলফনামা থেকে ১৪ নং অনুচ্ছেদ বাদ দিন, নইলে আমরা আপনার মক্কেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ অ্যাডভোকেট আকরাম শেখ তাঁর মক্কেল সাবেক সেনাপ্রধান আসলাম বেগকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বললে জেনারেল বেগ সেখানে দাঁড়িয়ে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁর দাখিল করা লিখিত হলফনামার ১৪ নং অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে তা গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে আদালত পরে তা গ্রহণ করে। জেনারেল বেগ কাঠগড়ায় দাঁড়ালে বেঞ্চের আরেক সদস্য বিচারপতি খিলজি আরিফ হোসেন তাঁর আদালতে আসায় হ্যাটট্রিক করার প্রসঙ্গে উল্লেখ করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি আদালতে এসেছেন গলফ খেলতে?’ তিনি আরও মন্তব্য করেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মানসিকতা এমন হয়ে গেছে যে, ‘আমরা সুপিরিয়র, আর তারা (বেসামরিক লোকজন) ইনফিরিয়র।...আমরা জানি, তাঁদের কেউ কেউ ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ কথাটা ব্যবহার করেন।’
আসগর খান মামলার ১৪ মার্চের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন সব কাজ করে, যেগুলো তাদের এখতিয়ারের বাইরে।’ বিচারপতি আরিফ হুসেইন খিলজি বলেন, ‘তারা (গোয়েন্দা সংস্থাগুলো) মনে করে, একমাত্র তারাই দেশ চালাতে পারে; বাকি সব মানুষ ভয়ংকর।’
তিন
বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর আসগর খান মামলায় রাজনীতিকদের অর্থ দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে যে কঠোর জবাবদিহির মুখে দাঁড় করিয়েছেন, দেশটির সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে বেশ উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি এসব দেখেশুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েক দিন আগে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা করা হচ্ছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এমনটি করা হয় না।’ তিনি মনে করেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। সমালোচকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও আইএসআইকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হোক, অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হোক।
কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগ ও পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের বৃহত্তর অংশ তাদের কথাবার্তা, লেখালেখি বন্ধ করতে রাজি নয়। যেমন, নাজাম শেঠি মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সময় ও প্রেক্ষাপট এখন সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে, সেনাবাহিনী এতটা কাল ধরে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য গেছে মোল্লাদের কাছে, আর্থিক-বৈষয়িক সুবিধা-সমর্থনের জন্য নির্ভর করেছে আমেরিকার ওপর। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ এখন অনেক সচেতন ও পরিপক্ব হয়েছে, মোল্লাদের ভাবনা আর তাদের প্রভাবিত করে না; তারা আমেরিকার ওপরও আর নির্ভরশীল থাকতে চায় না।
পাকিস্তানের ছয় দশকের ইতিহাসে সেনাবাহিনী সবচেয়ে প্রবল রাজনৈতিক খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করে এসেছে; সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জবাবদিহির প্রয়োজন আছে—এমনটি তারা ভাবেননি। রাজনীতিকেরা তাদের সঙ্গে কখনোই পেরে ওঠেননি। সম্প্রতি বিচার বিভাগের অতি সক্রিয় আচরণ লক্ষ করে অনেকে বলছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে বিচার বিভাগ। আর রাজনৈতিক খেলোয়াড় হলে যা হয়, নিজের সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার অভিযোগও উচ্চারিত হচ্ছে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী, যিনি পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়ে আবার তা বাতিল করে নিজেও বাতিল হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর অতি-উৎসাহী, অতি-সক্রিয় আচরণকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। তবে মানতেই হবে, লড়াইটা বেশ তীব্র, এবং সম্ভবত বিপজ্জনক। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পাকিস্তান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রক্ষাকর্তার ভূমিকা খুব সহজে ছেড়ে দেবে—এটা ভাবা বোধ হয় ঠিক হবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হাতে সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এই নাকানি-চুবানির পরিণতি কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments