গণমাধ্যম-নিরপেক্ষতার পক্ষপাত বনাম তালগাছ by ওয়াসি আহমেদ
একটি গাছ, ধরা যাক সেটি যদি হয় ঢ্যাঙা আবলুস তালগাছ, তাহলে নিরপেক্ষতার উদাহরণ হিসেবে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বেশ পার পেয়ে যাবে। আকাশ ছোঁয়ার উচ্চাশা নিয়ে সে আশপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেসবের সাত-পাঁচে নিজের ঝাঁকড়া মাথাটা ঘামাতে যাবে না। এমনকি তার মাথায় চিল না শকুন ঘর বাঁধছে,
এ নিয়েও বেচারার কোনো মাথাব্যথা বা পক্ষপাত নেই। বিলকুল নিরপেক্ষ। নিচ থেকে আমাদের তা-ই মনে হয়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু দ্বিমত পোষণ করতেন কি না, এখন আর জানার উপায় নেই।
উদাহরণটা এ জন্য, মানুষকে যখন নিরপেক্ষ হতে বলা হয়, বিশেষ করে মিডিয়াকে—তখন তাকে তালগাছের মতোই ঢ্যাঙা, সঙ্গী-সাথিহীন, বিকারহীন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু মুশকিল হলো, মিডিয়া বলতে যেহেতু মানুষ—ঢ্যাঙা হোক বা বামন হোক—তার চরিত্রের অন্যতম জেনেটিক বৈশিষ্ট্য এই—সে বিকারপ্রবণ। রি-অ্যাকশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল না হয়েও প্রতিক্রিয়াপ্রবণ। তার প্রতিক্রিয়ায় বেছে নেওয়ার ব্যাপার থাকবে, পছন্দ-অপছন্দের বিচারেই কাজটি সে করবে, এ তো অবধারিত। সে যখন ভালোকে ভালো বলবে, সে মূলত তার পক্ষপাতকেই জাহির করবে। আবার দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে—ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত—এক পক্ষের কাছে যা সংগত, অন্যপক্ষের কাছে তা ভিন্নতর হওয়ারও যুক্তিপূর্ণ কারণ থাকতে পারে। তালগাছ নয় বলেই এমনটা হয়।
তার পরও তথাকথিত নিরপেক্ষতার বাণী জোরেশোরে অহরহ আমাদের কানে আছড়ে পড়ে কেন? উন্নয়নশীল বিশ্বে তো বটেই, উন্নত বিশ্বের অবাধ মত প্রকাশের সংস্কৃতিও এর শাব্দিক দোষমুক্ত নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, মিডিয়াকে নিখাদ নিরপেক্ষ হতে বলে যাঁরাই যেখানে শোরগোল তোলেন, নিদেন বাণী দেন, তাঁরা প্রথমত একগোত্রীয়—তাঁরা ক্ষমতাসীন এবং সরকার নামক রাষ্ট্রপরিচালন যন্ত্রের ভারে ভারী। দূরে যাব না, কাছের দেশ ভারতের উত্তর প্রদেশের সদ্য সাবেক মারকাটারি মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী প্রতিবছর জন্মদিন পালন করতেন মহাসমারোহে। স্তাবক পরিবৃত মুখ্যমন্ত্রী চোখঝলসানো হিরে-জহরত আর তোড়াবাঁধা হাজার টাকার নোটের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপসহ যখন অনাবিল হাসি নিয়ে ক্যামেরার মুখোমুখি হতেন, তিনি নিশ্চয় ভাবতেন, এত উপকার জনগণের পরম ভালোবাসার অর্ঘ্য। অন্যদিকে, যখন খবরের কাগজের পাতায় এ ঘটনাকে চরম অশ্লীল বলে আখ্যা দেওয়া হতো, তিনি এই লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতাকে শায়েস্তা করতে পোষা পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিতে কসুর করতেন না। জন্মদিন পালনের মতো নির্দোষ অনুষ্ঠানকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে না পারাকে পত্রপত্রিকার ঈর্ষাকাতর, কুচক্রী স্বভাবকেই দায়ী করতেন। মায়াবতীর কথা থাক। তাঁকে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচিত শাসককুলের প্রতিনিধি ভাবতে অনেকের বাধো-বাধো ঠেকবে; বরং পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভালো মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। দীর্ঘ তিন যুগ ধরে বাম শাসন আমলের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও তাঁর মাথা বরাবর উঁচুতেই ছিল এবং তা সর্বভারতীয় বিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ফসলি জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একের পর এক মহাঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ হতে হতে তিনি শেষমেশ আরেক মারকাটারি নেত্রীর কাছে গদি হারালেন। এর মূলে প্রধানত মিডিয়ার দূরদৃষ্টিকে এবং একপর্যায়ে নিরপেক্ষতাকে খারিজ করাই কারণ। নির্বাচনে হেরে যাওয়া বড় কথা নয়, মূল বিষয়টি হলো, পত্রপত্রিকায় সেই গোড়া থেকেই নানা সাবধানবাণী উচ্চারিত হওয়ার পরও তিনি বা তাঁর দল সেসব আমলে নেননি। তিনি অটল থেকেছেন তাঁর কর্মকাণ্ডে, যেন জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা আর হারমানা একই কথা। তাঁর মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিকও মিডিয়াকে কংগ্রেস ও তৃণমূলপন্থী বিবেচনা করেছেন, ঘোর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছেন। বিষয়টি যেমন পরিতাপের, তেমনি অন্যভাবে দেখলে, শাসকের ভূমিকায় যাঁরাই থাকবেন, তাঁদের অসহিষ্ণুতা কোনো না কোনো পর্যায়ে বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়াকেও পক্ষপাতদুষ্ট এবং কার্যত প্রতিপক্ষ ধরে নেবে—এ যেন চিরাচরিত প্রথা বৈ কিছু নয়।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেশে বর্তমানে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় মুক্তকণ্ঠ ও সম্প্রসারমাণ। কথাটি একদিক দিয়ে যেমন সত্য, তেমনি এ-ও ঘোরতর সত্য যে এই বিপুল মিডিয়ার কাছে সরকার পবিত্র ‘গঠনমূলক’ প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করে। মজা হলো, গঠনমূলক শব্দটি একই সাবজেকটিভ, সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এর মর্মও পাল্টায়। শব্দটির খোলসে একটি মেকি আদর্শিক ভাঁওতাও লুকিয়ে আছে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যত স্বল্পোন্নতই হোক, আদর্শিকভাবে যেহেতু উন্নয়নকামী—ধ্যান-ধারণায়-কর্মে উন্নয়নই সারাক্ষণ অন্তরে ডুগডুগি বাজাচ্ছে—এই উন্নয়ন-ভাবনায় তাল ঠুকতে গঠনমূলক হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী! পাতিনেতা থেকে শুরু করে পশ্চাদ্দেশসমৃদ্ধ গতিমসৃণ ফ্ল্যাগ-কার হাঁকানো মন্ত্রীরা যখন যত্রতত্র ‘গঠনমূলক’ তত্ত্বের অবতারণা করেন, তাঁরা তখন খুব নিরুদ্বেগে ও মসৃণভাবে শব্দটির নিরাপদ ভাঁওতায়ই আশ্রয় নেন। ভাবখানা এমন, একটি বাড়ি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর একে কী করে আবার গড়ে তোলা যায়, সেটাই প্রকৃত গঠনমূলক হওয়ার একমাত্র নমুনা। তাহলে কী করে পুড়ল, আগুনটা ছড়াল কী করে, লাগিয়েছে কী কেউ—এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা এবং খুঁজে বের করার কাজটি কি ধ্বংসাত্মক? বস্তুতপক্ষে, নির্বিচার ধ্বংসের এ পৃথিবীতে পুনর্গঠন-ভাবনার আগে প্রতিনিয়ত ধ্বংস ঠেকানোই একমাত্র অর্থবহ কাজ। ফোর্থ এস্টেট আখ্যা দিয়ে মিডিয়াকে মিছেমিছি গুরুত্বপূর্ণ করা হয়নি—স্বপ্নচারী ইচ্ছাপূরণের সহগামী হতে তো নয়ই।
তবে হ্যাঁ, কথা ওঠে বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে। এটি যেমন দীর্ঘদিনের চর্চা ও সাধনার বিষয়, তেমনি এর প্রধান শর্ত শিক্ষা। আমাদের এখানে অল্প দিনে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যে প্রসার ও পসার ঘটেছে, তাতে এ দুয়ের যথাযথ মিশেল ঘটেছে বলা যাবে না; বরং কিছু ভালো জিনিসের সঙ্গে বিস্তর জঞ্জালও জুটেছে। ঘাটতি অবশ্যই ব্যাপক; যে কারণে প্রতিক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে অতিক্রিয়ায় রূপ নিচ্ছে। আবার খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা বা প্রচারিত সংবাদের সারবত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এ তো গেল খামতির কথা। তবে বাস্তবতা হলো, ভালো জিনিসের প্রসার যত ঘটবে, দুর্বল জিনিসের খুঁতগুলো তত বেশি বেশি চোখে পড়বে। মূল কথাটি কিন্তু ভালো-মন্দ নিয়ে নয়; বরং যে সম্ভাবনা নিয়ে, শক্তি নিয়ে মিডিয়া আজ অবতীর্ণ, সেই সম্ভাবনা ও শক্তির যথাযথ মূল্যায়নে কুণ্ঠা কেন? হার মানার অপরিণতমনস্ক ভয়ে, না নিজের ভুল অন্যে দেখিয়ে দিল—এ লজ্জায়? নাকি খাস কথা এই, সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত ও দেশপ্রেমহীনতা সমার্থক তো বটেই, এক দড়িতে ফাঁসিযোগ্য অপরাধও? ব্যাপারটির এখানেই শেষ নয়, এতটা একপেশেও নয়। আজ যে মিডিয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষে পড়ছে এবং হাস্যকরভাবে বিরোধী দলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠছে, কাল যদি পালাবদলে অবস্থানের ওলট-পালট ঘটে যায়, তখন ক্ষমতার স্বাদ-গন্ধে বিভোর-বিবশ সেই প্রাক্তন বিরোধী দলই প্রাক্তন সরকারি দলের পদাঙ্ক হুবহু অনুসরণ করবে এবং ডাইস ভার্সনে। বিগত কয়েকটি সরকারের অদল-বদলে আমরা এর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় লক্ষ করিনি। বস্তুতপক্ষে, এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনভাব নয়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটি আমাদের সংস্কৃতিরই প্রায় অবিভাজ্য একটি বৈশিষ্ট্য।
ঘুরেফিরে চর্চার কথায়ই আসতে হয়। ব্যবহারে ব্যবহারে যত ক্লিষ্টই হোক, একে সতেজ, চাঙা ও অর্থময় রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সহনশীলতা কাপুরুষতা নয়, অন্যের মতামত শোনা দুর্বলতা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বিরল গুণ—কথাটির অকাট্যতা প্রমাণ করতে প্রয়োজন করে দেখানো। এর জন্য বিশেষজ্ঞ-বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন নেই। করে দেখাতে হবে তাদেরই, যাঁরা দেশ ও মানুষের কথা বলেন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের এপাশে-ওপাশে থাকেন—রাজনীতিবিদদের।
অলীক নিরপেক্ষতার দোহাই পেড়ে মতভিন্নতা খারিজ করার যে সংস্কৃতি আমরা লালন করছি, তা সীমিত অর্থে সরকার বনাম মিডিয়াতেই আটকে নেই; মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যক্তিক ও সামাজিক আচরণে, লেনদেনে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাত নানাভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
গোড়ার কথায় ফিরি। নিরপেক্ষতা নিয়ে তর্কে শামিল হওয়া নির্বোধদেরই মানায়। হ্যাঁ, পক্ষ নেব না, এত দূর ঠিক আছে। কিন্তু পক্ষ বলতে কি কেবলি ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল? সত্য-মিথ্যা, সাদা-কালোর মতো অদৃশ্য কিন্তু পরাক্রমী বিষয়-আশয়, যা সারাক্ষণ সমাজে চরকি কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেসবের বাছবিচার করতে গেলে তালগাছের নিরপেক্ষতা কোনোই কাজে আসে না। মানুষকে তখন তার চারিত্রিক ও আত্মিক তাগিদেই পক্ষ অবলম্বন করতে হয় সত্য প্রতিষ্ঠার সাহসের প্রয়োজনে। পক্ষপাতী বলার পরিবর্তে তাকে তখন পক্ষপাতশুদ্ধ বলাই সংগত।
ইংরেজি ‘নিউট্রাল’ শব্দটি এসেছে ‘নিউটার’ থেকে, অর্থাৎ লিঙ্গ বিবেচনায় যা ক্লীব। মানুষ আর যা-ই হতে চাক, ক্লীব হতে চায় না। চলনশক্তিরহিত গাড়ির গিয়ারও (নিউট্রাল) নয়।
ওয়াসি আহমেদ: কথাসাহিত্যিক।
উদাহরণটা এ জন্য, মানুষকে যখন নিরপেক্ষ হতে বলা হয়, বিশেষ করে মিডিয়াকে—তখন তাকে তালগাছের মতোই ঢ্যাঙা, সঙ্গী-সাথিহীন, বিকারহীন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু মুশকিল হলো, মিডিয়া বলতে যেহেতু মানুষ—ঢ্যাঙা হোক বা বামন হোক—তার চরিত্রের অন্যতম জেনেটিক বৈশিষ্ট্য এই—সে বিকারপ্রবণ। রি-অ্যাকশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল না হয়েও প্রতিক্রিয়াপ্রবণ। তার প্রতিক্রিয়ায় বেছে নেওয়ার ব্যাপার থাকবে, পছন্দ-অপছন্দের বিচারেই কাজটি সে করবে, এ তো অবধারিত। সে যখন ভালোকে ভালো বলবে, সে মূলত তার পক্ষপাতকেই জাহির করবে। আবার দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে—ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত—এক পক্ষের কাছে যা সংগত, অন্যপক্ষের কাছে তা ভিন্নতর হওয়ারও যুক্তিপূর্ণ কারণ থাকতে পারে। তালগাছ নয় বলেই এমনটা হয়।
তার পরও তথাকথিত নিরপেক্ষতার বাণী জোরেশোরে অহরহ আমাদের কানে আছড়ে পড়ে কেন? উন্নয়নশীল বিশ্বে তো বটেই, উন্নত বিশ্বের অবাধ মত প্রকাশের সংস্কৃতিও এর শাব্দিক দোষমুক্ত নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, মিডিয়াকে নিখাদ নিরপেক্ষ হতে বলে যাঁরাই যেখানে শোরগোল তোলেন, নিদেন বাণী দেন, তাঁরা প্রথমত একগোত্রীয়—তাঁরা ক্ষমতাসীন এবং সরকার নামক রাষ্ট্রপরিচালন যন্ত্রের ভারে ভারী। দূরে যাব না, কাছের দেশ ভারতের উত্তর প্রদেশের সদ্য সাবেক মারকাটারি মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী প্রতিবছর জন্মদিন পালন করতেন মহাসমারোহে। স্তাবক পরিবৃত মুখ্যমন্ত্রী চোখঝলসানো হিরে-জহরত আর তোড়াবাঁধা হাজার টাকার নোটের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপসহ যখন অনাবিল হাসি নিয়ে ক্যামেরার মুখোমুখি হতেন, তিনি নিশ্চয় ভাবতেন, এত উপকার জনগণের পরম ভালোবাসার অর্ঘ্য। অন্যদিকে, যখন খবরের কাগজের পাতায় এ ঘটনাকে চরম অশ্লীল বলে আখ্যা দেওয়া হতো, তিনি এই লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতাকে শায়েস্তা করতে পোষা পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিতে কসুর করতেন না। জন্মদিন পালনের মতো নির্দোষ অনুষ্ঠানকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে না পারাকে পত্রপত্রিকার ঈর্ষাকাতর, কুচক্রী স্বভাবকেই দায়ী করতেন। মায়াবতীর কথা থাক। তাঁকে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচিত শাসককুলের প্রতিনিধি ভাবতে অনেকের বাধো-বাধো ঠেকবে; বরং পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভালো মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। দীর্ঘ তিন যুগ ধরে বাম শাসন আমলের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও তাঁর মাথা বরাবর উঁচুতেই ছিল এবং তা সর্বভারতীয় বিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ফসলি জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একের পর এক মহাঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ হতে হতে তিনি শেষমেশ আরেক মারকাটারি নেত্রীর কাছে গদি হারালেন। এর মূলে প্রধানত মিডিয়ার দূরদৃষ্টিকে এবং একপর্যায়ে নিরপেক্ষতাকে খারিজ করাই কারণ। নির্বাচনে হেরে যাওয়া বড় কথা নয়, মূল বিষয়টি হলো, পত্রপত্রিকায় সেই গোড়া থেকেই নানা সাবধানবাণী উচ্চারিত হওয়ার পরও তিনি বা তাঁর দল সেসব আমলে নেননি। তিনি অটল থেকেছেন তাঁর কর্মকাণ্ডে, যেন জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা আর হারমানা একই কথা। তাঁর মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিকও মিডিয়াকে কংগ্রেস ও তৃণমূলপন্থী বিবেচনা করেছেন, ঘোর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছেন। বিষয়টি যেমন পরিতাপের, তেমনি অন্যভাবে দেখলে, শাসকের ভূমিকায় যাঁরাই থাকবেন, তাঁদের অসহিষ্ণুতা কোনো না কোনো পর্যায়ে বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়াকেও পক্ষপাতদুষ্ট এবং কার্যত প্রতিপক্ষ ধরে নেবে—এ যেন চিরাচরিত প্রথা বৈ কিছু নয়।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেশে বর্তমানে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় মুক্তকণ্ঠ ও সম্প্রসারমাণ। কথাটি একদিক দিয়ে যেমন সত্য, তেমনি এ-ও ঘোরতর সত্য যে এই বিপুল মিডিয়ার কাছে সরকার পবিত্র ‘গঠনমূলক’ প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করে। মজা হলো, গঠনমূলক শব্দটি একই সাবজেকটিভ, সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এর মর্মও পাল্টায়। শব্দটির খোলসে একটি মেকি আদর্শিক ভাঁওতাও লুকিয়ে আছে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যত স্বল্পোন্নতই হোক, আদর্শিকভাবে যেহেতু উন্নয়নকামী—ধ্যান-ধারণায়-কর্মে উন্নয়নই সারাক্ষণ অন্তরে ডুগডুগি বাজাচ্ছে—এই উন্নয়ন-ভাবনায় তাল ঠুকতে গঠনমূলক হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী! পাতিনেতা থেকে শুরু করে পশ্চাদ্দেশসমৃদ্ধ গতিমসৃণ ফ্ল্যাগ-কার হাঁকানো মন্ত্রীরা যখন যত্রতত্র ‘গঠনমূলক’ তত্ত্বের অবতারণা করেন, তাঁরা তখন খুব নিরুদ্বেগে ও মসৃণভাবে শব্দটির নিরাপদ ভাঁওতায়ই আশ্রয় নেন। ভাবখানা এমন, একটি বাড়ি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর একে কী করে আবার গড়ে তোলা যায়, সেটাই প্রকৃত গঠনমূলক হওয়ার একমাত্র নমুনা। তাহলে কী করে পুড়ল, আগুনটা ছড়াল কী করে, লাগিয়েছে কী কেউ—এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা এবং খুঁজে বের করার কাজটি কি ধ্বংসাত্মক? বস্তুতপক্ষে, নির্বিচার ধ্বংসের এ পৃথিবীতে পুনর্গঠন-ভাবনার আগে প্রতিনিয়ত ধ্বংস ঠেকানোই একমাত্র অর্থবহ কাজ। ফোর্থ এস্টেট আখ্যা দিয়ে মিডিয়াকে মিছেমিছি গুরুত্বপূর্ণ করা হয়নি—স্বপ্নচারী ইচ্ছাপূরণের সহগামী হতে তো নয়ই।
তবে হ্যাঁ, কথা ওঠে বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে। এটি যেমন দীর্ঘদিনের চর্চা ও সাধনার বিষয়, তেমনি এর প্রধান শর্ত শিক্ষা। আমাদের এখানে অল্প দিনে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যে প্রসার ও পসার ঘটেছে, তাতে এ দুয়ের যথাযথ মিশেল ঘটেছে বলা যাবে না; বরং কিছু ভালো জিনিসের সঙ্গে বিস্তর জঞ্জালও জুটেছে। ঘাটতি অবশ্যই ব্যাপক; যে কারণে প্রতিক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে অতিক্রিয়ায় রূপ নিচ্ছে। আবার খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা বা প্রচারিত সংবাদের সারবত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এ তো গেল খামতির কথা। তবে বাস্তবতা হলো, ভালো জিনিসের প্রসার যত ঘটবে, দুর্বল জিনিসের খুঁতগুলো তত বেশি বেশি চোখে পড়বে। মূল কথাটি কিন্তু ভালো-মন্দ নিয়ে নয়; বরং যে সম্ভাবনা নিয়ে, শক্তি নিয়ে মিডিয়া আজ অবতীর্ণ, সেই সম্ভাবনা ও শক্তির যথাযথ মূল্যায়নে কুণ্ঠা কেন? হার মানার অপরিণতমনস্ক ভয়ে, না নিজের ভুল অন্যে দেখিয়ে দিল—এ লজ্জায়? নাকি খাস কথা এই, সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত ও দেশপ্রেমহীনতা সমার্থক তো বটেই, এক দড়িতে ফাঁসিযোগ্য অপরাধও? ব্যাপারটির এখানেই শেষ নয়, এতটা একপেশেও নয়। আজ যে মিডিয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষে পড়ছে এবং হাস্যকরভাবে বিরোধী দলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠছে, কাল যদি পালাবদলে অবস্থানের ওলট-পালট ঘটে যায়, তখন ক্ষমতার স্বাদ-গন্ধে বিভোর-বিবশ সেই প্রাক্তন বিরোধী দলই প্রাক্তন সরকারি দলের পদাঙ্ক হুবহু অনুসরণ করবে এবং ডাইস ভার্সনে। বিগত কয়েকটি সরকারের অদল-বদলে আমরা এর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় লক্ষ করিনি। বস্তুতপক্ষে, এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনভাব নয়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটি আমাদের সংস্কৃতিরই প্রায় অবিভাজ্য একটি বৈশিষ্ট্য।
ঘুরেফিরে চর্চার কথায়ই আসতে হয়। ব্যবহারে ব্যবহারে যত ক্লিষ্টই হোক, একে সতেজ, চাঙা ও অর্থময় রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সহনশীলতা কাপুরুষতা নয়, অন্যের মতামত শোনা দুর্বলতা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বিরল গুণ—কথাটির অকাট্যতা প্রমাণ করতে প্রয়োজন করে দেখানো। এর জন্য বিশেষজ্ঞ-বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন নেই। করে দেখাতে হবে তাদেরই, যাঁরা দেশ ও মানুষের কথা বলেন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের এপাশে-ওপাশে থাকেন—রাজনীতিবিদদের।
অলীক নিরপেক্ষতার দোহাই পেড়ে মতভিন্নতা খারিজ করার যে সংস্কৃতি আমরা লালন করছি, তা সীমিত অর্থে সরকার বনাম মিডিয়াতেই আটকে নেই; মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যক্তিক ও সামাজিক আচরণে, লেনদেনে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাত নানাভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
গোড়ার কথায় ফিরি। নিরপেক্ষতা নিয়ে তর্কে শামিল হওয়া নির্বোধদেরই মানায়। হ্যাঁ, পক্ষ নেব না, এত দূর ঠিক আছে। কিন্তু পক্ষ বলতে কি কেবলি ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল? সত্য-মিথ্যা, সাদা-কালোর মতো অদৃশ্য কিন্তু পরাক্রমী বিষয়-আশয়, যা সারাক্ষণ সমাজে চরকি কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেসবের বাছবিচার করতে গেলে তালগাছের নিরপেক্ষতা কোনোই কাজে আসে না। মানুষকে তখন তার চারিত্রিক ও আত্মিক তাগিদেই পক্ষ অবলম্বন করতে হয় সত্য প্রতিষ্ঠার সাহসের প্রয়োজনে। পক্ষপাতী বলার পরিবর্তে তাকে তখন পক্ষপাতশুদ্ধ বলাই সংগত।
ইংরেজি ‘নিউট্রাল’ শব্দটি এসেছে ‘নিউটার’ থেকে, অর্থাৎ লিঙ্গ বিবেচনায় যা ক্লীব। মানুষ আর যা-ই হতে চাক, ক্লীব হতে চায় না। চলনশক্তিরহিত গাড়ির গিয়ারও (নিউট্রাল) নয়।
ওয়াসি আহমেদ: কথাসাহিত্যিক।
No comments