ধর নির্ভয় গান-সময় এসেছে একটু ভাবার by আলী যাকের
এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, আজকে কেন এত অসহনীয় মনে হয় সবকিছু? এর কারণ কি এই যে, জীবন আমাদের আজ অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে পড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য, যা আমাদের বিদ্যুৎহীনতা, গ্যাস এবং পানির স্বল্পতার জন্য দায়ী। আমরা সুরম্য ভবন তৈরি করছি, হনন করছি আমাদের সবুজ নিসর্গকে।
অবলীলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ু, পানি এবং আবহাওয়া দূষণ এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের জীবনের মান হুহু করে পড়ে যাচ্ছে নিচে। সময় এসেছে একটু ভাবার, কী করে আমাদের উত্তরণ ঘটতে পারে সার্বিকভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে?
আমি গ্রামে গেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণত ঘরের বাইরে থাকি। গ্রীষ্মের তাপদাহ তত তীব্র না হলে আমার সময় কাটে গ্রাম থেকে গ্রামে, কিংবা আমাদের গাং-যমুনার পাড় ধরে, শ্মশান ঘাট হয়ে দক্ষিণে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে আবার গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘুরেফিরে বাড়িতে ফেরায়। আর গরম যখন খুব বেশি পড়ে, প্রাণ হাঁসফাঁস, তখন আমি আমার গ্রামের বাড়ির পুকুরের ঈশান কোণে একটি বিশাল নিমগাছের তলায় বসে বই পড়ি, লেখালেখি করি, গ্রামের মানুষদের সঙ্গে গল্পসল্প করি কিংবা কিছুই করি না। এই সেদিন প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আমি প্রথাসিদ্ধভাবে আমার গ্রামের বাড়ির ওই ঈশান কোণে নিমগাছের তলায় বসে গল্প করছিলাম আমার বন্ধু, গাঁয়ের ডাক্তার বরকতউল্লাহর সঙ্গে। বরকতউল্লাহ রসিক লোক। কথায় কথায় তার রস ঝরে পড়ে। নানা কথার মাঝখানে হঠাৎ করেই বরকত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, 'দিলি ক্যান? আর দিলি যদি, তো নিলি ক্যান?' এই আকস্মিক উক্তিতে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি ঈষৎ হেসে ওর এই বাক্যটি উপভোগ করার চেষ্টা করতে থাকলাম। গল্প করতে করতে কখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে লক্ষ্য করিনি। আস্তে আস্তে চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কোথাও আলোর কোনো লেশমাত্র নেই। আবার মনে পড়ল আমার বন্ধুর সেই অমোঘ বাক্য তিনখানা। বেশ তো ছিলাম এই গাঁয়ে-গঞ্জে। সকালে উঠে পুকুরে স্নান করতাম। দুপুরে অতি সাধারণ খাবারে ক্ষুনি্নবৃত্তি করে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। ছাত্ররা যেত স্কুলে। সাধারণ মানুষ যেত মাঠে। গৃহিণীরা ঘরের কাজে ব্যস্ত হতো। সন্ধ্যাবেলা এক এক করে হারিকেন কিংবা কুপি জ্বলে উঠত প্রতিটি বাড়িতে। খেলাধুলা থেকে বাড়িতে ফিরত তরুণরা। ফসলের ক্ষেত থেকে প্রাপ্ত বয়স্করা। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কালজয়ী গানের চরণ_ 'ওমা দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে/তখন খেলাধুলা সকল ফেলে তোমার কোলে ছুটে আসি।' বেশ তো ছিল সেই গ্রামীণ, প্রায় নিষ্কলুষ এবং শান্তিময় জীবন। কেন দিলে বিদ্যুৎ? অভ্যস্ত করলে আমাদের এমন এক জীবনের সঙ্গে, যে জীবনের ওপরে নিয়ন্ত্রণই ফেললাম হারিয়ে?
দর্শন থেকে দৃষ্টি ফেরাই এখন বাস্তবতার দিকে। আমি বিশ্বাস করি যে, নীতিগতভাবে আমরা কখনোই আমাদের বিদ্যুতের অপ্রতুলতা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলাম না। আমরা শুরু থেকেই জানতাম যে, এমন একটি দিন হয়তো আসবে, যখন আমরা সম্পূর্ণ আঁধারে নিমজ্জিত হবো। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো বেশিরভাগ সময় সুদূরপ্রসারী কোনো ব্যবস্থা কিংবা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চায়নি। যখন কোনো সমস্যা ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন তারা ঝটিতি একটি পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এর কারণ অবশ্য খুবই সহজ। এ রকম পরিকল্পনাহীন সমস্যা সমাধানকল্পে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে দুর্নীতির বিস্তর সম্ভাবনা বিদ্যমান। যখন আমার কোনো উপায় থাকে না সৎ পথে কোনো কাজ সমাধান করার, তখনই আমি অসৎ পথ অবলম্বন করি এবং এই অসৎ পথ অবলম্বন করে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি নিদ্বর্িধায় বাড়িয়ে চলি। তখন সাধারণ মানুষেরও কিছু বলার থাকে না। কেননা তারা বাস্তব অবস্থা জানে এবং বোঝে যে, সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যেনতেন প্রকারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ। আমার মনে পড়ে ১৯৯৩ সালের একটি কথোপকথন। ওই সময় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির ভারপ্রাপ্ত এক অতি উচ্চপদে আসীন আমলার সঙ্গে আমায় একটি কাজে সাক্ষাৎ করতে হয়েছিল। সব কথা শেষে আমি তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, আমার বাসস্থান যেখানে, উত্তরা, সেখানে কেন প্রতি সন্ধ্যায়, ৬টা-সাড়ে ৬টায়, আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তিনি একজন বন্ধু হিসেবে আমায় বলেছিলেন যে, একটু অপেক্ষা করুন, এই বিদ্যুৎহীনতা এক কি আধঘণ্টা থেকে বেড়ে আট কি বারো ঘণ্টায় দাঁড়াবে এবং হয়তো এমনও হতে পারে যে, আমরা প্রায় স্থায়ীভাবেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারি। কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমায় বলেছিলেন, বছরের পর বছর তার মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। না ক্ষয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রগুলোকে সার্ভিসিং করা হচ্ছে, না নতুন কোনো যন্ত্র ক্রয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আজ সারাদেশ বিরাট সময় ধরে বিদ্যুৎহীনতায় ভুগছে। আমার সেই বন্ধুর '৯৩-এর হুশিয়ারবাণী আমায় আতঙ্কিত করে তুলছে। এখন অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। তখন তিন কি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটে দেশ সন্তুষ্ট থাকত। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত হাজারে। ঠিক যেমন বিদ্যুতের আইনি সংযোগের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি বেড়ে গেছে বেআইনি সংযোগের সংখ্যা। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে দালানকোঠা, কল-কারখানা, গ্যাসচালিত যন্ত্র এবং গাড়ি, কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা। আমি আমার পাঠকদের নজর ফেরাতে বলব এই ঢাকা শহরের দিকে। আমরা তো জানি যে, ঢাকার সর্বত্র প্রায় কোথাও খালি জায়গা আর নজরে পড়ে না। সর্বত্রই ইট, পাথর আর লোহা-লক্কড়ের জঙ্গল। আর এসব ভবনে বিদ্যুতের প্রয়োজন হুহু করে বেড়ে চলেছে। এই চাহিদার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে কে? বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যে খনিজ পদার্থের প্রয়োজন পড়ে, তারও অপ্রতুলতা রয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের গ্যাসের এখনকার উৎপাদন যা, তা দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে পড়েছে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। আমাদের কয়লা বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতি উৎকৃষ্ট মানের কয়লা, নিদ্রায় মগ্ন এখনও মাটির নিচে। মাটি খুঁড়ে তা তুলতে গেলে প্রচণ্ড রাজনৈতিক সমস্যায় পড়ব আমরা। কেউ বলবেন, যারা মাটি খুঁড়ছে তারা চোর। কেউবা বলবেন, যারা বাধা দিচ্ছে তারা অসৎ। অতএব, কোথায় যাই? কিন্তু কথা থেকে যাচ্ছে যে, আমার দেশের খনিজ পদার্থ খুঁড়ে তোলার জ্ঞান আমার নেই। বিদেশের ওপর আমায় নির্ভর করতেই হবে। কিন্তু বিদেশি কাউকে যদি নিয়োগ দেওয়া হয় এই কাজ করার জন্য, তবে আমরা সেটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। আমরা এই ভয়ঙ্কর বৃত্তে ঘুরে মরি আর দেশ এগিয়ে যাক আলো থেকে অন্ধকারের দিকে। এসব ভাবলে একেক সময় হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছা করে। অতএব, আমি ফিরে যাই আমার বন্ধুর দর্শনে, 'দিলি ক্যান? আর দিলি যদি, তো নিলি ক্যান?'
আজকে এই বিশাল এক সমস্যার সম্মুখীন আমরা সবাই। সুতরাং আমার এ ধরনের কথাকে হয়তো বালখিল্যতা মনে হতে পারে। কিন্তু চরম সত্য এই যে, যখন আমাদের জীবনে আমরা কঠিনতম সময়ের সম্মুখীন হই, তখন আমরা চাই বা না চাই অসংলগ্নতাই হয়ে পড়ে আমাদের একমাত্র বর্ম। তখন আমরা বিমূর্ত এবং অসংলগ্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দেই। আমার বন্ধু বরকতের ওই কথাগুলো আমায় পেছন ফিরে তাকাতে আহ্বান করে। আমি ফিরে যাই আমার ছেলেবেলায় আবার। যখন আমার বাস ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহরে। সে সময় একই ধরনের গরম পড়ত। কিন্তু আমাদের সারা বাড়িতে কেবল আমার বাবা-মার ঘরে একটা ফ্যান কোনোমতে তাদের বাতাস দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেত। আমরা গ্রীষ্মে বিছানার ওপর এপাশ-ওপাশ করতাম প্রায় সারারাত ধরে। আমার বড় বোন নিরন্তর হাতপাখা ঘুরিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতেন। আমাদের গরম লাগত, আবার গরম লাগতও না। হয়তো কষ্ট হতো কিন্তু আমরা কখনোই কোনো অভিযোগ করতাম না। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম ওই গ্রীষ্মে। সেই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আমরা দিনাতিপাত করতাম। আমার বাবা, যিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, তিনি ওই সময় প্রখ্যাত ইংরেজি কবি 'পারসি বিশি শেলী' থেকে তার বিখ্যাত এক কবিতার উদ্ধৃতি আমাদের আবৃত্তি করে শোনাতেন_ 'যদি শীত আসেই বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে?' তারপর নিজের মতো করে বলতেন, 'গ্রীষ্ম যদি উত্ত্যক্ত করেই, ঐ চেয়ে দেখো বর্ষার আগমন বার্তা সে নিয়ে এসেছে।' আমরা সবাই খুশি হয়ে যেতাম। বর্ষার আগমনের অপেক্ষায় থাকতাম সানন্দে।
এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, আজকে কেন এত অসহনীয় মনে হয় সবকিছু? এর কারণ কি এই যে, জীবন আমাদের আজ অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে পড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য, যা আমাদের বিদ্যুৎহীনতা, গ্যাস এবং পানির স্বল্পতার জন্য দায়ী। আমরা সুরম্য ভবন তৈরি করছি, হনন করছি আমাদের সবুজ নিসর্গকে। অবলীলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ু, পানি এবং আবহাওয়া দূষণ এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের জীবনের মান হুহু করে পড়ে যাচ্ছে নিচে। সময় এসেছে একটু ভাবার, কী করে আমাদের উত্তরণ ঘটতে পারে সার্বিকভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে?
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমি গ্রামে গেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণত ঘরের বাইরে থাকি। গ্রীষ্মের তাপদাহ তত তীব্র না হলে আমার সময় কাটে গ্রাম থেকে গ্রামে, কিংবা আমাদের গাং-যমুনার পাড় ধরে, শ্মশান ঘাট হয়ে দক্ষিণে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে আবার গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘুরেফিরে বাড়িতে ফেরায়। আর গরম যখন খুব বেশি পড়ে, প্রাণ হাঁসফাঁস, তখন আমি আমার গ্রামের বাড়ির পুকুরের ঈশান কোণে একটি বিশাল নিমগাছের তলায় বসে বই পড়ি, লেখালেখি করি, গ্রামের মানুষদের সঙ্গে গল্পসল্প করি কিংবা কিছুই করি না। এই সেদিন প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আমি প্রথাসিদ্ধভাবে আমার গ্রামের বাড়ির ওই ঈশান কোণে নিমগাছের তলায় বসে গল্প করছিলাম আমার বন্ধু, গাঁয়ের ডাক্তার বরকতউল্লাহর সঙ্গে। বরকতউল্লাহ রসিক লোক। কথায় কথায় তার রস ঝরে পড়ে। নানা কথার মাঝখানে হঠাৎ করেই বরকত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, 'দিলি ক্যান? আর দিলি যদি, তো নিলি ক্যান?' এই আকস্মিক উক্তিতে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি ঈষৎ হেসে ওর এই বাক্যটি উপভোগ করার চেষ্টা করতে থাকলাম। গল্প করতে করতে কখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে লক্ষ্য করিনি। আস্তে আস্তে চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কোথাও আলোর কোনো লেশমাত্র নেই। আবার মনে পড়ল আমার বন্ধুর সেই অমোঘ বাক্য তিনখানা। বেশ তো ছিলাম এই গাঁয়ে-গঞ্জে। সকালে উঠে পুকুরে স্নান করতাম। দুপুরে অতি সাধারণ খাবারে ক্ষুনি্নবৃত্তি করে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। ছাত্ররা যেত স্কুলে। সাধারণ মানুষ যেত মাঠে। গৃহিণীরা ঘরের কাজে ব্যস্ত হতো। সন্ধ্যাবেলা এক এক করে হারিকেন কিংবা কুপি জ্বলে উঠত প্রতিটি বাড়িতে। খেলাধুলা থেকে বাড়িতে ফিরত তরুণরা। ফসলের ক্ষেত থেকে প্রাপ্ত বয়স্করা। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কালজয়ী গানের চরণ_ 'ওমা দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে/তখন খেলাধুলা সকল ফেলে তোমার কোলে ছুটে আসি।' বেশ তো ছিল সেই গ্রামীণ, প্রায় নিষ্কলুষ এবং শান্তিময় জীবন। কেন দিলে বিদ্যুৎ? অভ্যস্ত করলে আমাদের এমন এক জীবনের সঙ্গে, যে জীবনের ওপরে নিয়ন্ত্রণই ফেললাম হারিয়ে?
দর্শন থেকে দৃষ্টি ফেরাই এখন বাস্তবতার দিকে। আমি বিশ্বাস করি যে, নীতিগতভাবে আমরা কখনোই আমাদের বিদ্যুতের অপ্রতুলতা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলাম না। আমরা শুরু থেকেই জানতাম যে, এমন একটি দিন হয়তো আসবে, যখন আমরা সম্পূর্ণ আঁধারে নিমজ্জিত হবো। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো বেশিরভাগ সময় সুদূরপ্রসারী কোনো ব্যবস্থা কিংবা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চায়নি। যখন কোনো সমস্যা ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন তারা ঝটিতি একটি পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এর কারণ অবশ্য খুবই সহজ। এ রকম পরিকল্পনাহীন সমস্যা সমাধানকল্পে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে দুর্নীতির বিস্তর সম্ভাবনা বিদ্যমান। যখন আমার কোনো উপায় থাকে না সৎ পথে কোনো কাজ সমাধান করার, তখনই আমি অসৎ পথ অবলম্বন করি এবং এই অসৎ পথ অবলম্বন করে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি নিদ্বর্িধায় বাড়িয়ে চলি। তখন সাধারণ মানুষেরও কিছু বলার থাকে না। কেননা তারা বাস্তব অবস্থা জানে এবং বোঝে যে, সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যেনতেন প্রকারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ। আমার মনে পড়ে ১৯৯৩ সালের একটি কথোপকথন। ওই সময় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির ভারপ্রাপ্ত এক অতি উচ্চপদে আসীন আমলার সঙ্গে আমায় একটি কাজে সাক্ষাৎ করতে হয়েছিল। সব কথা শেষে আমি তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, আমার বাসস্থান যেখানে, উত্তরা, সেখানে কেন প্রতি সন্ধ্যায়, ৬টা-সাড়ে ৬টায়, আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তিনি একজন বন্ধু হিসেবে আমায় বলেছিলেন যে, একটু অপেক্ষা করুন, এই বিদ্যুৎহীনতা এক কি আধঘণ্টা থেকে বেড়ে আট কি বারো ঘণ্টায় দাঁড়াবে এবং হয়তো এমনও হতে পারে যে, আমরা প্রায় স্থায়ীভাবেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারি। কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমায় বলেছিলেন, বছরের পর বছর তার মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। না ক্ষয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রগুলোকে সার্ভিসিং করা হচ্ছে, না নতুন কোনো যন্ত্র ক্রয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আজ সারাদেশ বিরাট সময় ধরে বিদ্যুৎহীনতায় ভুগছে। আমার সেই বন্ধুর '৯৩-এর হুশিয়ারবাণী আমায় আতঙ্কিত করে তুলছে। এখন অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। তখন তিন কি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটে দেশ সন্তুষ্ট থাকত। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত হাজারে। ঠিক যেমন বিদ্যুতের আইনি সংযোগের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি বেড়ে গেছে বেআইনি সংযোগের সংখ্যা। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে দালানকোঠা, কল-কারখানা, গ্যাসচালিত যন্ত্র এবং গাড়ি, কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা। আমি আমার পাঠকদের নজর ফেরাতে বলব এই ঢাকা শহরের দিকে। আমরা তো জানি যে, ঢাকার সর্বত্র প্রায় কোথাও খালি জায়গা আর নজরে পড়ে না। সর্বত্রই ইট, পাথর আর লোহা-লক্কড়ের জঙ্গল। আর এসব ভবনে বিদ্যুতের প্রয়োজন হুহু করে বেড়ে চলেছে। এই চাহিদার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে কে? বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যে খনিজ পদার্থের প্রয়োজন পড়ে, তারও অপ্রতুলতা রয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের গ্যাসের এখনকার উৎপাদন যা, তা দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে পড়েছে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। আমাদের কয়লা বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতি উৎকৃষ্ট মানের কয়লা, নিদ্রায় মগ্ন এখনও মাটির নিচে। মাটি খুঁড়ে তা তুলতে গেলে প্রচণ্ড রাজনৈতিক সমস্যায় পড়ব আমরা। কেউ বলবেন, যারা মাটি খুঁড়ছে তারা চোর। কেউবা বলবেন, যারা বাধা দিচ্ছে তারা অসৎ। অতএব, কোথায় যাই? কিন্তু কথা থেকে যাচ্ছে যে, আমার দেশের খনিজ পদার্থ খুঁড়ে তোলার জ্ঞান আমার নেই। বিদেশের ওপর আমায় নির্ভর করতেই হবে। কিন্তু বিদেশি কাউকে যদি নিয়োগ দেওয়া হয় এই কাজ করার জন্য, তবে আমরা সেটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। আমরা এই ভয়ঙ্কর বৃত্তে ঘুরে মরি আর দেশ এগিয়ে যাক আলো থেকে অন্ধকারের দিকে। এসব ভাবলে একেক সময় হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছা করে। অতএব, আমি ফিরে যাই আমার বন্ধুর দর্শনে, 'দিলি ক্যান? আর দিলি যদি, তো নিলি ক্যান?'
আজকে এই বিশাল এক সমস্যার সম্মুখীন আমরা সবাই। সুতরাং আমার এ ধরনের কথাকে হয়তো বালখিল্যতা মনে হতে পারে। কিন্তু চরম সত্য এই যে, যখন আমাদের জীবনে আমরা কঠিনতম সময়ের সম্মুখীন হই, তখন আমরা চাই বা না চাই অসংলগ্নতাই হয়ে পড়ে আমাদের একমাত্র বর্ম। তখন আমরা বিমূর্ত এবং অসংলগ্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দেই। আমার বন্ধু বরকতের ওই কথাগুলো আমায় পেছন ফিরে তাকাতে আহ্বান করে। আমি ফিরে যাই আমার ছেলেবেলায় আবার। যখন আমার বাস ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহরে। সে সময় একই ধরনের গরম পড়ত। কিন্তু আমাদের সারা বাড়িতে কেবল আমার বাবা-মার ঘরে একটা ফ্যান কোনোমতে তাদের বাতাস দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেত। আমরা গ্রীষ্মে বিছানার ওপর এপাশ-ওপাশ করতাম প্রায় সারারাত ধরে। আমার বড় বোন নিরন্তর হাতপাখা ঘুরিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতেন। আমাদের গরম লাগত, আবার গরম লাগতও না। হয়তো কষ্ট হতো কিন্তু আমরা কখনোই কোনো অভিযোগ করতাম না। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম ওই গ্রীষ্মে। সেই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আমরা দিনাতিপাত করতাম। আমার বাবা, যিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, তিনি ওই সময় প্রখ্যাত ইংরেজি কবি 'পারসি বিশি শেলী' থেকে তার বিখ্যাত এক কবিতার উদ্ধৃতি আমাদের আবৃত্তি করে শোনাতেন_ 'যদি শীত আসেই বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে?' তারপর নিজের মতো করে বলতেন, 'গ্রীষ্ম যদি উত্ত্যক্ত করেই, ঐ চেয়ে দেখো বর্ষার আগমন বার্তা সে নিয়ে এসেছে।' আমরা সবাই খুশি হয়ে যেতাম। বর্ষার আগমনের অপেক্ষায় থাকতাম সানন্দে।
এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, আজকে কেন এত অসহনীয় মনে হয় সবকিছু? এর কারণ কি এই যে, জীবন আমাদের আজ অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে পড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য, যা আমাদের বিদ্যুৎহীনতা, গ্যাস এবং পানির স্বল্পতার জন্য দায়ী। আমরা সুরম্য ভবন তৈরি করছি, হনন করছি আমাদের সবুজ নিসর্গকে। অবলীলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ু, পানি এবং আবহাওয়া দূষণ এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের জীবনের মান হুহু করে পড়ে যাচ্ছে নিচে। সময় এসেছে একটু ভাবার, কী করে আমাদের উত্তরণ ঘটতে পারে সার্বিকভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে?
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments