চারদিক-মনু নদের বালুচরে by আকমল হোসেন

পানি কমে গেলে মনু নদে চর ভেসে ওঠে। সেই চরে শহর, শহরতলি ও নদীপারে গড়ে ওঠা বস্তির শিশুরা মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলে, ক্রিকেট খেলে, ঘুড়ি ওড়ায়, অকারণেই ছোটাছুটি করে। যারা নদীতীরে বাস করে, যারা নদীর পাড় ধরে আসা-যাওয়া করে, হয়তো এ রকম দৃশ্য তাদের চোখে কখনো পড়তেই পারে।


কিন্তু এই দৃশ্যটি এখন আর আগের মতো নেই। ক্রমশ তা হারিয়ে যেতে বসেছে।
তবে কোনো এক সকালে যখন শহরের একটি পাড়ার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ঘর ছেড়ে চরে এসে নামে, চরের বুকে উড়ে রঙিন পতাকা, অনেক মানুষের আনন্দ-চিৎকার বাতাসে রং ছড়ায়, তখন চরের বুকে নতুন কিছু যে হচ্ছে, তার গন্ধ টের পাওয়া যায়। তখন তো একটু কৌতূহল হতেই পারে। একটু থমকে দাঁড়াতে হয়, একটু চোখ মেলে তাকাতে হয়। আর এ রকম তাকানোর কাজটা করেছিল মৌলভীবাজার শহরের শান্তিবাগ এলাকার বসবাসকারী নাগরিকেরা। এ যেন নিজেদের অতীতকে ছুঁয়ে যাওয়া, শিকড়কে ছুঁয়ে যাওয়া, শৈশব-কৈশোরকে ছুঁয়ে যাওয়া। আর শিশুদের দালানকোঠার চার দেয়ালের বাইরে একটুখানি আনন্দজগৎ দেখানো। যেন শুধুই ঘর, বই, কম্পিউটার, মুঠোফোন—এসবই জীবনের একমাত্র উপাদান নয়, এর বাইরেও দুনিয়া আছে। মুক্ত হাওয়া আছে। প্রাণখোলা হইচই আছে। সবকিছু নিয়েই একটা জীবন।
শান্তিবাগবাসী গত ১৬ মার্চ মনু নদের বালুচরে এক প্রাণখোলা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেছিল। সেই সকাল থেকে বিকেল অবধি পাড়ার (শান্তিবাগ) নানা বয়সী মানুষ ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুটে এসেছিল বালুচরে। তারা বাসাবাড়ির দালানের এক টুকরো দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে এত দিন যে বালুচর দেখেছে, সেই বালুচরে পা ছুঁয়ে মাটির সুখটুকু যাতে তারা টের পায়। এ উপলক্ষে সকালবেলায় বেরিয়েছিল একটি রঙিন শোভাযাত্রা। শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরেছে শোভাযাত্রাটি। বালুচরে দেখা হতেই কেউ কেউ যখন বলেন, ‘অমন শোভাযাত্রা অনেক দিন দেখি না’, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, নিজের পাড়ার আয়োজন। নিজের শৈশব-কৈশোরকে ফিরে দেখার আয়োজন। কতটা দোলা দিয়েছে সবাইকে। এরপর ছিল বালুচরের বুকের ওপর নানা রকমের খেলা। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, চকলেট দৌড়, যোগাযোগ দৌড়, বস্তা দৌড়, দীর্ঘ লাফ, মোরগ লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো, বিচ ফুটবল বা সৈকত ফুটবল খেলা। এই উৎসব ঘিরে এর আগেই হয়েছে আরও অনেক রকম প্রতিযোগিতা। এসবের মধ্যে ছিল ক্যারম বোর্ড ও দাবা, স্মৃতি পরীক্ষা, হাতের লেখা, দেশের গান, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্য প্রতিযোগিতা। ছিল পিঠা প্রদর্শনী। পাড়ার লোকজনই এই প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় ঘরে তৈরি নানা পদের পিঠা নিয়ে এসেছিলেন।
শান্তিবাগের বাসিন্দা সলিল শেখর দত্ত বলেন, ‘আমরা দেখছি খেলাধুলার প্রতি নতুন প্রজন্মের তেমন আগ্রহ নেই। অনেকের সুযোগও কমে গেছে। সবাই পড়ালেখা, কম্পিউটার এসব নিয়ে ব্যস্ত। এ রকম অবস্থায় একটা সুস্থ ও সুন্দর সমাজের আশা করা যায় না। তাই পাড়ার সবাই মিলে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার এমন কেউ নেই, যে এই উদ্যোগে সাড়া দেয়নি। অংশগ্রহণ করেনি। শহরের বিভিন্ন পাড়ায় এ রকম উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে শিশু-কিশোর ও যুবকেরা ভালো কিছুর সঙ্গে পরিচিত হবে। তেমনি পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে বন্ধনটিও শক্ত হবে।’ তিনি জানান, শুধু খেলাধুলা আর গানই নয়। এই পাড়ার যাঁরা যেখানে যে পদে অবস্থান করছেন, তাঁদেরও উৎসব উপলক্ষে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংক মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক ও এই পাড়ার বাসিন্দা এইচ এম মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা এই বালুচরে খেলতাম। কিন্তু বালুচরের এই খেলা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এটাকে ধরে রাখতেই সবাই মিলে এ রকম একটি উদ্যোগ।’ যাঁদের অনেকের সারা দিনই ব্যস্ত সময় কাটে, কাজের বাইরে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই, তাঁদের অনেকেই সেদিন ছুটে এসেছেন। স্মৃতিকাতর হয়েছেন। সেই ঘুড়ি ওড়ানো, সেই চরজুড়ে হুল্ল্ল্লোড়, সেই ফুটবল... কত কিছুই না এখন মনে পড়ছে। তাই উৎসবের মাঝে শুধু ছুটে আসা নয়, অনেকেই উৎসবকে প্রাণ দিতে সক্রিয় থেকেছেন। বালুচরে দেখা হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিলিমেষ ঘোষ বলু, ব্যবসায়ী মুন্না রায়, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন নজরুল, ব্যবসায়ী সুমেশ দাশ যিশু, আইনজীবী দীপ্তেন্দু দাশগুপ্ত কাজল, আবদুল মান্নান—অনেকের সঙ্গেই। শান্তিবাগের বাসিন্দা এবং হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. ফজলুল আলী বললেন, ‘বালুচরের এই উৎসব এত ভালো লাগছে। যেন শৈশব-কৈশোরের আমেজ পাচ্ছি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।’
সন্ধ্যায় শান্তিবাগ এলাকায় অবস্থিত আলী আমজদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো স্মৃতিচারণা, পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এই উৎসব হয়তো অনেককেই মনে করিয়ে দিয়েছে পাড়া-প্রতিবেশীর বন্ধনটা এখনো ছিঁড়ে যায়নি। এখনো মরে যায়নি উৎসবের প্রাণ। শুধু একটু নাড়া দেওয়া, একটুখানি জাগিয়ে দেওয়া। তাতেই আনন্দ জীবন পায় অন্তরে ও বাইরে।
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.