আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭০)-স্বতন্ত্র, পবিত্র সুর by আলী যাকের

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরিয়েই বড় যে রাজপথ তার নাম লোয়ার সার্কুলার রোড। এই লোয়ার সার্কুলার রোড সোজা চলে গেছে উত্তর কলকাতার দিকে। কিছু দূরে গিয়ে নাম বদলে হয়েছে আপার সার্কুলার রোড। অন্তে গিয়ে মিশে গেছে শ্যামবাজারে পাঁচ মাথায়।


শিয়ালদহের সামনেই লোয়ার সার্কুলার রোড থেকে আরেকটি রাস্তা হ্যারিসন রোড, চলে গেছে একেবারে হাওড়া স্টেশনে। এসব রাস্তার নামই দেশজকরণ হয়েছে। যেমন আচার্য জগদীশচন্দ্র রোড, প্রফুল্লচন্দ্র রোড, মহাত্মা গান্ধী রোড ইত্যাদি।
পার্ক সার্কাস এলাকায় আমার নানার বাড়ি। ঠিকানা ১০৪, নিউ পার্ক স্ট্রিট। নানা মারা গেছেন অনেক দিন হলো। এখন ওই বাড়ির অধিকাংশই ভাড়াটেদের দখলে। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে এক বিধবা খালা থাকেন আর তাঁর ছেলেরা। আমি আর আমার ৯ সঙ্গী পার্ক স্ট্রিটের ওই বাড়িতে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। কলকাতায় তখন বিকেল ৫টা। অফিস ছুটির সময়। শেয়ালদহের ভেতরে-বাইরে যেমন ভিড়, তেমনি ট্রাম-বাসের টার্মিনালে। ভিড় ঠেলে, ঠেলে এগিয়ে যাই আমরা। হঠাৎ পাশের এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন, 'আপনারা কি জয় বাংলা থেকে আসছেন?' সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি আমি। সব কিছু অনেক সহজ হয়ে আসে আমাদের জন্য। ওই প্রচণ্ড ভিড়ে কর্মক্লান্ত মানুষগুলো যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে বাড়ির দিকে শান্তির আশায়, একটি শব্দ, 'জয় বাংলা' তাদের যেন ভুলিয়ে দেয় সব কষ্ট, পরিশ্রম, সংগ্রাম। দুপাশে সরে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। ট্রামে ওঠা সহজতর হয়ে যায়। এই একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি আমি। সেই বর্ডার পার হওয়ার পর থেকেই 'জয় বাংলা থেকে আসছি' শুনলেই কেমন যেন রূপান্তর ঘটে যায় ভারত নিবাসী বাঙালিদের চেহারায়। সসম্ভ্রমে, আদরে, হার্দিক উষ্ণতায় জায়গা ছেড়ে দেয়। অনেকে বলে, 'আপনারা বাংলার জন্য যা করলেন, আমরা তা কক্ষনো পারব না।' একবার আমি একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, 'আচ্ছা, আমাদের দেশটার নাম তো বাংলাদেশ। আপনারা জয় বাংলা বলেন কেন?' জবাব এসেছিল, 'আপনারা জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যে লড়ছেন, তাকে কেবল বাংলাদেশ বললে মনে হয় না যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হচ্ছে আপনাদের। জয় বাংলা বললে বুকটা ভরে যায়।'
পার্ক স্ট্রিটে সেই খালার বাড়িতে গিয়ে উঠি আমরা। ওই ছোট্ট বাড়িতে ছয়জন মানুষের বাস। আরো দশজন এসে ওঠে এখন। বুঝতে পারি, এ যেন বোঝার ওপর শাকের আঁটি। তবে এই অনুমান যে ভুল তা প্রমাণিত হয় অচিরেই। এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ ৯ মাস বাংলাদেশের শরণার্থীদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। বসার ঘরে চাদর পেতে প্রতি রাতেই পনেরো-কুড়িজন লোক নির্বিঘ্নে ঘুমায়। রোজ সকালে নাশ্তা খেয়ে বেরিয়ে যায় সুদূর কোনো মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্দেশে।
আবার পরের দিন নতুন সব মানুষ এসে জড়ো হয় ওই ঘরে। আমি একেক সময় ভাবি এই যে দিনের পর দিন একটা বাড়ির ওপর, একটা পরিবারের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এটা কিভাবে নেওয়া সম্ভব? কোনো কোনো দিন কথাটা তোলার চেষ্টা করেছি আমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। স্মিত হেসে সে জবাব দিয়েছিল, 'সে বিষয়ে তোর না ভাবলেও চলবে।' একেবারে নীরবে ৯টি মাস ধরে এই অঘোষিত পুনর্বাসনকেন্দ্র চালিয়ে গেছে পার্ক স্ট্রিটের এই বাড়িটি। আমি ভেবেছি তখন, ভেবেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও। অনেক রথী-মহারথীই তো ১০৪-এর এই ফ্ল্যাটটিতে একাধিক রাত্রি যাপন করেছেন? আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন? তাঁদের কেউ কি মনে রাখবে বা রেখেছে এই ফ্ল্যাটটির কথা? কিংবা এই ফ্ল্যাটের অধিবাসীদের কথা? কোনো উল্লেখ থাকবে কি বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাড়িটির?
ছোটবেলায় কলকাতায় নানাবাড়িতে এলেই আমার কাজ ছিল পার্ক সার্কাস ময়দানে ছুটে যাওয়া। ময়দান সংলগ্ন পার্কে বড় বড় গাছের নিচে ঘুরে বেড়ানো, তারপর এক ছুটে চলে যাওয়া পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো সংলগ্ন মনোহারি দোকানগুলোতে। সেখানে শোভিত রং-বেরঙের জিনিসগুলোর ওপর চোখ বোলানো। তারপর চার আনা দিয়ে কোকাকোলা কম্পানির তৈরি একটা অরেঞ্জ ড্রিংক খেয়ে সুখে বুঁদ হয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফেরা। আজ তিন-চার দিনের ট্রেনের ধকল শরীর না চাইলেও মন তাকে যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল পার্ক সার্কাস ময়দানে। একটু শ্রীহীন হয়ে পড়েছে পার্কটা। গাছপালার যত্নে খামতি দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যায় পার্কে অনেক মানুষের ভিড়। বাচ্চারা চেঁচামেচি করছে। যুবক-যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় বসে গল্প করছে, কী ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সান্ধ্য ভ্রমণে ব্যস্ত। পার্কের ঠিক মাঝখানে ছোট জলাটির পাশে ক্ষুদ্রতর টিলাটি আমার বড় প্রিয়। আমি টিলাটির ওপর গিয়ে বসি। ভাবতে থাকি গত দুই মাসের কথা। কোনো ভয় নেই এখানে, এই কলকাতায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াবহতা থেকে অনেক দূরে নিরাপদে বসে আছি আমি এখন। অথচ আমার প্রিয় শহর ঢাকা এখন ক্ষত-বিক্ষত, আগুনের হলকায় ছাই হয়ে যাওয়া এক বিকৃত চেহারার নগরী।
তবু ভাবি আমি। ভেবে চলি। আসলেই কোনো কারণ কি ছিল আমার দেশ ছেড়ে আসার? মোটামুটি ভালো একটা চাকরি ছিল। একটা বাসা ছিল। এমনকি একটা গাড়িও ছিল। চাকরি করতাম একটা পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানে। চাইলে আমার ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে সম্মত হতো নিশ্চই। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না। তবে হ্যাঁ, বাঙালি শব্দটা উচ্চারিত হলেই বুকের কোনো এক কোণে যেন একটা সুর বেজে উঠত। একটা স্বতন্ত্র, প্রায় পবিত্র সুর। আপন মনেই হেসে উঠলাম। এসব ভাবালুতাশ্রয়িতার কোনো মানে হয় এখন? তবু প্রায় ইনারশিয়ার মতো মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে সেই প্রশ্ন- কেন আমি কলকাতায়?
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.