মৃত্যুর খাতায় লেখালেখি by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
খাতায় যাঁদের নাম লেখা রয়েছে, তাঁরা কেউ আর এ পৃথিবীতে নেই। যাঁরা খাতায় নাম লেখেন, তাঁরা জীবিত হলেও সারা দিন তাঁদের মুখ থাকে মলিন, শোকার্ত মানুষের মতো। ভুলেও সারা দিন তাঁদের মুখে হাসির রেখা দেখা যায় না। মনে হয় হাসলে পাপ হবে। কথা বলতে হয় ভেজা গলায়। মানুষের সামাজিক অভ্যাস হচ্ছে অন্যকে হাসিমুখে গ্রহণ করা।
কিন্তু এ খাতাটি যে কার্যালয়ে থাকে, সেখানে সবাই ঢোকেন চোখে পানি নিয়ে। কেউ কেউ আসেন বুকফাটা কান্না নিয়ে। কেউ আসেন বিলাপ করতে করতে। তাঁরা আসেন সেই খাতায় নাম লেখাতে। যাঁরা এই লেখার কাজ করেন, তাঁদের এ অবস্থা দেখে এঁদেরও চোখ ভিজে ওঠে। পুরোনোদের অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেলেও তাঁদের থাকতে হয় মলিন মুখেই।
এটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টারের কার্যালয়। এখানেই একটি টেবিলের ওপর পড়ে থাকে সেই খাতা। ওয়ার্ড মাস্টারের অধীনে তিনজন কর্মচারী—বাসির উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা ও আলফোনস বিশ্বাস—পালা করে এই খাতায় মৃতের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি লিখে নেন। এতে লিখতে হয় রোগীর নাম-ঠিকানা, হাসপাতালে ভর্তির তারিখ, মৃত্যুর তারিখ, লিঙ্গ, বয়স, দেশ, জাতি, ধর্ম, পেশা, মৃত্যুর কারণ, কোন চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁর নাম, ওয়ার্ডের নাম, মৃত্যুর সময়। ভর্তির ছয় ঘণ্টা অথবা ১৪ ঘণ্টা অথবা তার পরে মারা গেছেন কি না তার বিবরণ, কে লাশ গ্রহণ করছেন তাঁর নাম। সব শেষ ঘরটি মন্তব্যের। এই ঘরে যাঁরা লাশ গ্রহণ করেন, তাঁরা স্বাক্ষর করেন।
এই কার্যালয়ে খাতাপত্র ও রেজিস্টার রাখার জন্য রয়েছে আলমারি। অন্যান্য প্রমাণপত্র রাখার জন্য রয়েছে ফাইল কেবিনেট। এর একটি ড্রয়ারে রাখা হয়েছে পুলিশ কেসের কাগজপত্র, একটিতে মৃত্যুর প্রমাণপত্র, একটিতে রোগীর ভর্তি-সংক্রান্ত ও অন্যান্য কাগজ সংরক্ষণ করা হয়। একে একে কার্যালয়ের সবকিছু খুঁটে খুঁটে দেখলে মনের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। যাঁরা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন, তাঁরা বিদায়ের প্রমাণপত্র এখানে রেখে গেছেন। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ...এসেছিলে তবু আসো নাই/ জানায়ে গেলে...।
সম্প্রতি এই কার্যালয়ে গিয়ে বাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা তিনজন মিলে ২০১১ সালে ছয় হাজার ১৪০ জন মৃতের নাম লিখেছেন। গড়ে প্রতিদিন ১৬ জনের বেশি মানুষের নাম এই খাতায় তুলতে হয়েছে। বলতে বলতে বাসির উদ্দিন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘সকালে এসেই খাতায় হাত দিতেই বুক কেঁপে ওঠে। এসে বসতেই মনে হয়, আজ যদি খাতায় হাত দিতে না হতো, কিন্তু এমন কোনো দিন নেই যে এই খাতায় তাঁদের হাত দিতে হয় না। দরজার সামনে মানুষের পায়ের শব্দ পেলেই বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। মনে হয় কোন মায়ের বুক যে খালি হলো। একদিনের অভিজ্ঞতার কথা খুবই মনে পড়ে। একটি ছেলে চোখ মুছতে মুছতেই আমার সামনে এসে বলে, “স্যার, আপনি এখানে!” ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না। চোখের পানি মুছতে মুছতে ছেলেটি নিজের পরিচয় দিল। ছেলেটির বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। ছোটবেলায় ছেলেটার হাতেখড়ি হয়েছিল আমার কাছে। কে মারা গেছে বলতেই ছেলেটি ডুকরে কেঁদে ওঠে। মারা গেছে ওর প্রথম সন্তান। রক্ত-মাংসের মানুষ। যতই এই লেখার কাজটাকে চাকরি মনে করি। মৃত্যুকে সারা দিনে বারবার কাছে থেকে দেখতে হয়।’
ওয়ার্ড মাস্টার মোশাররফ হোসেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, এই কার্যালয়ে চাকরিতে যোগদান করার পরে দুই মাস তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি। মনের মধ্যে কেমন একটা খারাপ লাগা নিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে হয়। দিনে দিনে একটু করে গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাও যখন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কোনো লাশ আসে, তাদের ময়নাতদন্ত করাতে হয়। মৃতের স্বজনেরা কিছুতেই ময়নাতদন্ত করাতে চান না। পুলিশ কেস হিসেবে এটা বাধ্যতামূলক। সেই সময় স্বজনদের আহাজারি দেখে কিছুতেই মন ভালো রাখা যায় না।
বাসির উদ্দিন একদিনের অভিজ্ঞতার কথা বললেন, ‘গত জানুয়ারি মাসে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার একটি পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের তৈরি কবিরাজি ওষুধ সেবন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মারা যান। পরিবারের অন্য সদস্যরা কিছুতেই ময়নাতদন্তের জন্য লাশের গায়ে ছুরি ধরতে দেবেন না। বিভিন্ন লোকজনকে ধরাধরি করে সেদিন সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁরা লাশ নিয়ে চলে যান। হঠাৎ রাতে দেখি, পুলিশ আবার সেই লাশ নিয়ে হাজির। ময়নাতদন্ত শেষে গভীর রাতে তাঁরা লাশ নিয়ে চলে গেলেন। এমন সব হূদয়বিদারক ঘটনা এখানে বসেই দেখতে হয়। বাসির উদ্দিন আরও বলেন, কখন নিজের নামটা এই খাতায় ওঠে—প্রতিদিন এই উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।’
No comments