জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে সহিষ্ণুতা বাঞ্ছনীয় by ডা. ওয়াহিদ নবি

আত্মশক্তি' গ্রন্থে 'নেশন কী' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, ইংরজি 'নেশন' শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তিনি বলেছেন যে ইংরেজি 'রেস' (ৎধপব) বা 'বর্ণ' (পধংঃব) শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ জাতি হতে পারে।


এসব কারণে তিনি 'নেশন' শব্দটিই ব্যবহার করেছেন এবং এর কোনো বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করেননি। এসব এবং অন্যান্য কারণে জাতীয়তাবাদ বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এ কারণে জাতীয়তাবাদ বিষয়টি ধৈর্যের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
ফরাসি দার্শনিক আর্নেস্ট রেনাঁ ১৮৮২ সালে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটি সারগর্ভ ভাষণ দেন। ছাপার অক্ষরে মাত্র ৭২ লাইনের এই ভাষণ একটি মহামূল্য দলিল। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যখন পণ্ডিত ব্যক্তিরা আলোচনা করেন, তখন তাঁরা এই ভাষণের কথা উল্লেখ করেন। রেনাঁ বলেছিলেন, 'মানুষ তার গোত্র বা তার ভাষার দাস নয়, তার ধর্মেরও দাস নয়। মানুষ নদীর গতিধারা বা পর্বতশ্রেণীরও দাস নয়। একটি বিশাল মানবগোষ্ঠী যখন সুস্থ মস্তিষ্ক আর উষ্ণ হৃদয় নিয়ে একটি নৈতিক চেতনা গড়ে তোলে, তখন একটি জাতি গড়ে ওঠে।' তিনি আরো বলেছিলেন যে অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে বীরত্বপূর্ণ গৌরবগাথা সৃষ্টি করেছিলেন, তা-ই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি। বর্তমানে আমরা যখন অতীতের সেই গৌরবের কথা স্মরণ করে সমষ্টিগতভাবে ভবিষ্যতে মহৎ কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করব, তখন আমরা একটি প্রকৃত জাতি গড়ে তুলব।
অনেকে মনে করেন, একটি জাতির জন্য একটি দেশের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে বিভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই। কুর্দরা একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃত। এরা একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। এরা বাস করে তুরস্ক, ইরাক ও ইরানের মাটিতে। এদের নিজেদের কোনো দেশ নেই। কিন্তু যেখানে তারা বাস করে, সেটি তাদের জন্মভূমি। ইসরায়েল সৃষ্টির আগে ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করত। তারা নিজেদের দেশে বাস করত না। নিজেদের জন্মভূমিতে তারা বাস করত না। এ-জাতীয় জাতিকে 'ডায়াসপোরা' বলা হয়। ফিলিস্তিনিদের একটি অংশ এখন নিজেদের জন্মভূমিতে বাস করলেও অনেকে ডায়াসপোরা হিসেবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফিলিস্তিনিদের একটি অংশ 'সংখ্যালঘু জাতি' হিসেবে ইসরায়েলে বাস করছে। কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাভাষী দুটি জাতি বাস করে। বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডে একাধিক বংশোদ্ভূত জাতি বাস করে। লেবাননে মুসলিম ও খ্রিস্টান দুই ধর্মের অনুসারীরা বাস করে। সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ এখন নেই, যেখানে একই বংশোদ্ভূত জাতি বাস করে, যারা একই ভাষায় কথা বলে বা একই ধর্ম অনুসরণ করে। এ ছাড়া শরণার্থীদের বিষয়টি তো রয়েছেই। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে 'জোহান' হারডার বর্ণিত 'এথনিক জাতি' হয়তো কোনো দেশে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মার্কিন লেখক 'বেনেডিক্ট এন্ডারসন' তাঁর বিখ্যাত বই 'ইমাজিনড কমিউনিটি'তে একটি নতুন ধারণার (কনসেপ্ট) কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে কমিউনিটি বলতে জনপদ বোঝালেও তিনি এখানে জাতি বুঝিয়েছেন। তিনি জাতিগুলোকে কল্পিত বলেছেন এ জন্য যে একটি জাতির মানুষ মাত্র স্বল্পসংখ্যক মানুষকে চেনে। প্রায় সব মানুষ তার কাছে অপরিচিত, যাদের সে কোনো দিন চোখে দেখেনি বা কোনো দিন তাদের সঙ্গে তার কথাও হয়নি। এন্ডারসন প্রশ্ন করেছেন, 'তবে সেই জাতির জন্য সে প্রাণ বিসর্জন দিতে যায় কেন?'
এন্ডারসন জাতিসত্তার সৃষ্টির কথা আলোচনা করেছেন তাঁর বইতে। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে। এই সময়ে ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার প্রভাব কমে যায়। একই সঙ্গে রাজশক্তির প্রতাপ হ্রাস পায়। এর আগে সমাজের মহাবিক্রমশালী প্রধান ছিলেন রাজা। গির্জা ছিল ভয়ংকর প্রতাপশালী। বিধাতার প্রতিনিধি হিসেবে রাজা রাজ্য শাসন করতেন বলে প্রজাদের বোঝাতেন। সমাজ ছিল কঠোরভাবে শ্রেণীবিভক্ত। রাজ্য ছিল রাজধানীভিত্তিক। রাজধানীর বাইরে রাষ্ট্রের বিশেষ প্রভাব ছিল না। রাষ্ট্রের সীমানা নিয়ে রাজন্যবর্গের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। প্রায় ইউরোপজুড়ে ধর্মের ভাষা ছিল লাতিন। এই ভাষা সামান্য কিছু মানুষ জানত। এই 'পবিত্র ভাষার' মাধ্যমে ক্ষমতাবানরা অক্ষরজ্ঞানহীন প্রজাদের শাসন করতেন। শিক্ষায়তনে লাতিন ভাষাই একমাত্র ভাষা, যা শিক্ষা দেওয়া হতো।
আমাদের দেশও এ অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে। একসময় আমাদের দেশেও আরবি ছাড়া বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা করা যাবে না। কয়েক শ বছর আগে কবি সৈয়দ সুলতান লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন, 'বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইবো। বাখানি আরব ভাষা এ বুঝাইতে নারিব। যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন, সেই ভাষা তাহার অমূল্য সেই ধন।' কিংবা কবি বদিউদ্দিনের ভাষায়_'দিন ইসলামের কথা শুন দিয়া মন, দেশী ভাষে রচিলে বুঝিব সর্বজন।'
ইউরোপে রেনেসাঁর ফলে মানুষ পার্থিবমনা হয়ে ওঠে। রাজন্যবর্গ প্রভাব হারিয়ে ফেলেন। গির্জার প্রভাব কমে যায়। আমাদের নিজের দেশের দিকে আবার তাকানো যাক। একে একে এসেছে মৌর্য, গুপ্ত, পাল আর সেনরা। একেকটা সময় গেছে, যখন হিন্দু আর বৌদ্ধদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। পালরা বাঙালি ছিল, কিন্তু তাদের প্রধান কর্মস্থল ছিল বিহার। কৃষকের সন্তান দিব্যক তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। এরপর এলেন তুর্কিরা, সঙ্গে ইরানিরা। রাজাদের সঙ্গে প্রজাদের সম্পর্ক ছিল ক্ষীণ। ইউরোপের মতো রাজ্য ছিল রাজধানীকেন্দ্রিক। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমলে ১৪০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সব বাংলা একীভূত হলো। বাংলা যখন গৌড়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ইত্যাদি জনপদে বিভক্ত ছিল, তখন তাদের শাসক ছিল আলাদা আলাদা। শাসক আলাদা থাকলেও বিভিন্ন মানুষের সংস্কৃতি আলাদা হতে পারে না। এরপর এল ইংরেজ। ইংরেজ আমলে বহু যুগ ধরে একত্রে বাস করা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেখা দিল বিভেদ। ফলে আমরা পাকিস্তানি হয়ে গেলাম। ওরা আমাদের মুখের ভাষাটিও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। ভাষা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার ফলে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই এক সেনা কর্মকর্তা আমাদের জাতীয় পরিচয় বদলে দিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থনলাভের আশায়। ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলল তারা, যাদের নিজেদের জীবনযাত্রায় ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। ফলে জাতীয়তা নিয়ে জাতি হলো বিভক্ত। বাঙালি জাতীয়তাবিরোধীরা ২০০১ সালে বিশাল রক্তপাতের মাধ্যমে জাতির মুখে কলঙ্কের কালিমা মেখে দিল।
জাতি, জনগণ, জাতীয়তা, দেশ, রাষ্ট্র, সরকার ইত্যাদি বিষয় বেশ জটিল। এগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। জন ডেউই তাঁর 'পিপল অ্যান্ড ইটস প্রবলেম' বইয়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। আরো আলোচনার প্রয়োজন আমাদের। আরো অনেক সহ্যশক্তির প্রয়োজন এসব সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। মাইকেল সিমর আধুনিক সামাজিক-রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে কথা বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে আমাদের বক্তব্য শেষ করব, 'জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সংখ্যালঘুর সমন্বয় সাধন করাই হচ্ছে আধুনিক জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য।'

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.