স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ-একজন লিয়াকত, অসহায় মনীষা ও শেয়ারবাজার by সুজয় মহাজন
কাজী লিয়াকত আলী। বয়স ৪০। স্থায়ী নিবাস মানিকগঞ্জের হরিরামপুর। অস্থায়ী আবাস রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোড। এটুকু পরিচয় হয়তো লিয়াকতকে দেশজুড়ে পরিচিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা (আত্মহত্যা) লিয়াকতকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। লিয়াকতের পরিবারের দাবি, আত্মহত্যার কারণ ‘শেয়ারবাজার’।
প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন শেয়ারবাজার তথা বাজারের উত্থান-পতন লিয়াকতের আত্মহত্যার কারণ হলো? উত্তরটা হলো, লিয়াকত ছিলেন এই বাজারের একজন বিনিয়োগকারী। নিজের সঞ্চয় ও ধারের টাকা এনে তিনি বাজারে খাটিয়েছেন। ভেবেছিলেন, শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা করবেন। আর সে টাকা দিয়ে নিজেদের, বিশেষত ছোট্ট মেয়ে কাজী মনীষার জীবনের সচ্ছলতা নিশ্চিত করবেন। কিন্তু সেটি আর হলো কই? জীবন থেকে নিজে তো পালিয়ে গেলেন লিয়াকত। মনীষার সামনে রেখে গেলেন অনিশ্চিত ও অসহায় এক জীবন।
গত বুধবার লিয়াকতের বাসায় গিয়ে জানা গেল, মনীষার স্কুলে যাওয়া আপাতত বন্ধ। পরিবারের সবাই এখন লিয়াকতের মৃত্যশোকে মূহ্যমান। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো শক্তিটুকুও হারিয়েছেন লিয়াকতের স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী তাহমিনা আকতার। মৃত্যুর খবরে আগত অতিথিরাই এখন পরিবারটির দেখভাল করছেন।
বাবা নেই, এই সত্যের গভীর উপলব্ধির বয়স এখনো হয়নি মনীষার। তাই এখনো স্বভাব চঞ্চলতায় সে ঘরের মধ্যে একা একাই দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ায়। দরজা খোলার আগমনী সংকেতে (কলবেল) ছুটে আসে দ্বারে। বাবার ঘরে ফেরার আকুলতা চোখে।
বাবার হাত ধরেই রোজ স্কুলে যাওয়া-আসা করত সাড়ে চার বছরের মনীষা। আত্মহত্যার দিন সকালেও মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেছিলেন লিয়াকত। সেটাই শেষ বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া ওর। লিয়াকতের শাশুড়ি মমতাজ বেগম জানান, ‘প্রতিদিনের মতো গত সোমবার (৩০ জানুয়ারি, ২০১২) সকালেও মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায় লিয়াকত। এরপর বাসায় ফিরে আসে। তবে মনীষাকে স্কুল থেকে আনার সময় হলে আমাকে পাঠাল। বলল, তার কী যেন জরুরি কাজ আছে। সে জন্য বাইরে যাবে। তাই মনীষাকে আনতে স্কুলে যেতে পারবে না।’ কিন্তু মনীষাকে নিয়ে বাসায় ফিরেই মমতাজ বুঝতে পারলেন লিয়াকতের জরুরি কাজটা কী। মনীষার বাবার নিথর দেহটি যে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে গলায় দঁড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলছিল!
লিয়াকতের বাসা থেকে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দূরত্ব সামান্যই। সেই বাজারেরই আলাদা দুটি ব্রোকারেজ হাউসের দুটি বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন লিয়াকত। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ঋণ ও নিজের পুঁজি মিলিয়ে শেয়ারবাজারে লিয়াকতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে নিজের ছিল ৭৮ লাখ টাকা। বাকিটা ঋণ। টানা দরপতনে লিয়াকত ৬১ লাখ টাকা পুঁজি খুঁইয়েছেন। আত্মহত্যা করার দিনের হিসাব এটি।
ফুলেফেঁপে ওঠা সময়ে নয়, ২০১১ সালের শেষার্ধে লিয়াকত এই বিনিয়োগ করেন যখন বাজারের মূল্যসূচক ছয় হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। আবার লিয়াকতের পত্রকোষ বা পোর্টফোলিওর যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, তাঁর কেনা বেশির ভাগ শেয়ারই ছিল ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন। তার পরও কেন লিয়াকতকে এই বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হলো?
শেয়ারবাজার সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকসানের জন্য লিয়াকতের দায় যতটুকু তার চেয়ে বেশি দায় বাজার নিয়ন্ত্রকদের। কারণ তাঁরা বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেননি। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ বাজারের অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে। তাঁদের অদূরদর্শিতা ও কর্মকাণ্ড বাজারকে অস্বাভাবিক এক উচ্চতায় টেনে তুলেছিল, তাঁদের কথাবার্তা ও পদক্ষেপ লাখ লাখ মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল এই বাজারে ছুটে আসার জন্য।
অস্বাভাবিক উচ্চতা থেকে বাজারের পতনটা অনিবার্য ছিল। কিন্তু সেই পতনের বেলায়ও বাজারের ওপর চলল নানা হস্তক্ষেপ। তাতে স্বাভাবিক পতন বা সংশোধনের চেয়ে অস্বাভাবিকতা দেখা দিল। কিছুদিন পরপরই পতন ঠেকানোর নামে এলোমেলো পদক্ষেপ নিয়ে আরও পতন অনিবার্য করা হলো।
বাজার সংশ্লিষ্ট সবাই প্রায়ই বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সঠিক সময়ে ভালো শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে লোকসানের ঝুঁকি কম। লিয়াকতের পরিবার হয়তো এখন প্রশ্ন করতে পারে, ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও কেন লিয়াকতকে এতটা লোকসানের মুখে পড়তে হলো? জানা গেছে, লিয়াকত প্রতিদিন লেনদেন করতেন না। তার মানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের চিন্তা থেকেই এই বাজারে এসেছিলেন। কেনাবেচার পরিবর্তে শেয়ার ধরে রেখেছিলেন লাভের আশায়।
হ্যাঁ, লিয়াকতের একটি বড় ভুল ছিল, তিনি ধারদেনার টাকা এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। শেয়ারবাজার এ রকম ধারদেনা করে বিনিয়োগের জায়গা নয়। এটি জানা-বোঝার বিনিয়োগের একটি জায়গা। আবার শেয়ারবাজারে জেনে-বুঝে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভের সম্ভাবনা যেমন থাকে তেমনি লোকসানের ঝুঁকিও কম নয়। তবে উপযুক্ত সময়ে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের পরামর্শটি ঠিকই আছে। সমস্যা হলো, একটি স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ বাজারের অভাব। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নীতি-নির্ধারক ও বাজার পরিচালকদের।
আবার এ কথাও ঠিক যে আমাদের শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীরা অনেক সময়ই যৌক্তিক আচরণ করেন না। এ দায় বিনিয়োগকারীদের মেনে নেওয়া উচিত। লোকসান দিয়েই তাঁরা তাদের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিয়ে থাকেন। কিন্তু নীতি-নির্ধারক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের ব্যর্থতার দায় কতটা মেনে নেয়?
আমাদের বিনিয়োগকারীদের আচরণ যেমন বিশ্বের সুশৃঙ্খল কোনো শেয়ারবাজারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না, ঠিক তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নীতি-নির্ধারকদের আচরণেরও কি তুলনা চলে? বিশ্বের কোনো দেশের শেয়ারবাজারে কি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হয়? বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কিছু হলেই মন্ত্রীর কাছে ছুটতে হয়? শেয়ারবাজার কি রাজনীতির ময়দানে পরিণত হয়? অথচ সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায়ই বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের উদাহরণ দেন। সেই আলোকে নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা তাদের করা উচিৎ।
বিনিয়োগকারীর আচরণ যেমন তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে নীতি-নির্ধারক—কারও আচরণই বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে মেলে না। আর মেলে না বলেই এ দেশে শেয়ারবাজারে মৌলিক কাঠামোর কোনো সূত্রই কাজ করে না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলোও খুব কাজে লাগে না। আর তাই নীতি-নির্ধারক থেকে বিনিয়োগকারী সবারই দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার পরিবর্তন দরকার। তা না হলে বাজারের বড় খেলোয়াড়রা বড় পুঁজির প্রভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বোকা শুধু বানাবে না, পুঁজি হারিয়ে হাহাকার করার দিকে ঠেলে দেবে।
শেয়ারবাজার নিয়ে লিয়াকতের জ্ঞান কতটুকু তা অজানা থেকে গেল। এখন শুধু জানা গেল, মনীষা পিতৃহীন হয়েছে। তবে যে কাজটি লিয়াকত করলেন তা কখনো সমর্থন করা যায় না। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকেও মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সব হারিয়েও নতুন করে জীবন সাজায়। সেই তুলনায় লিয়াকত তো শুধু টাকা হারিয়েছেন। আর সবই তো তাঁর ছিল। সাড়ে চার বছরের ফুটফুটে এক কন্যাশিশু, স্ত্রী, পরিবার-পরিজন—সবই। আর একেকটি জীবন মানে তো একেকটি আলাদা জগৎ। এতগুলো জগৎ থাকতে শুধু অর্থের জন্য জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে লিয়াকত কি সত্যি পালাতে পারলেন? এই দুঃসহ স্মৃতির ভার মনীষাসহ পরিজন যে আজীবন বয়ে বেড়াবে, তা থেকে তিনি তাঁদের কীভাবে মুক্ত করবেন?
আরও যাঁরা এই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের অনুরোধ করব, লিয়াকতের মতো চিন্তা ভুলেও করবেন না। জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সংগ্রাম করে শত দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে পারাটাই জীবনের বড় সার্থকতা। নিজের পরিবার-পরিজনের প্রিয় মুখগুলোকে বারবার মনে করুন। তাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবনের সার্থকতার স্বাদটুকু ফেলে কিছু অর্থের জন্য জীবনকে ব্যর্থ করে দেবেন না।
সুজয় মহাজন: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো।
sujoy017@gmail.com
গত বুধবার লিয়াকতের বাসায় গিয়ে জানা গেল, মনীষার স্কুলে যাওয়া আপাতত বন্ধ। পরিবারের সবাই এখন লিয়াকতের মৃত্যশোকে মূহ্যমান। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো শক্তিটুকুও হারিয়েছেন লিয়াকতের স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী তাহমিনা আকতার। মৃত্যুর খবরে আগত অতিথিরাই এখন পরিবারটির দেখভাল করছেন।
বাবা নেই, এই সত্যের গভীর উপলব্ধির বয়স এখনো হয়নি মনীষার। তাই এখনো স্বভাব চঞ্চলতায় সে ঘরের মধ্যে একা একাই দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ায়। দরজা খোলার আগমনী সংকেতে (কলবেল) ছুটে আসে দ্বারে। বাবার ঘরে ফেরার আকুলতা চোখে।
বাবার হাত ধরেই রোজ স্কুলে যাওয়া-আসা করত সাড়ে চার বছরের মনীষা। আত্মহত্যার দিন সকালেও মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেছিলেন লিয়াকত। সেটাই শেষ বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া ওর। লিয়াকতের শাশুড়ি মমতাজ বেগম জানান, ‘প্রতিদিনের মতো গত সোমবার (৩০ জানুয়ারি, ২০১২) সকালেও মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায় লিয়াকত। এরপর বাসায় ফিরে আসে। তবে মনীষাকে স্কুল থেকে আনার সময় হলে আমাকে পাঠাল। বলল, তার কী যেন জরুরি কাজ আছে। সে জন্য বাইরে যাবে। তাই মনীষাকে আনতে স্কুলে যেতে পারবে না।’ কিন্তু মনীষাকে নিয়ে বাসায় ফিরেই মমতাজ বুঝতে পারলেন লিয়াকতের জরুরি কাজটা কী। মনীষার বাবার নিথর দেহটি যে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে গলায় দঁড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলছিল!
লিয়াকতের বাসা থেকে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দূরত্ব সামান্যই। সেই বাজারেরই আলাদা দুটি ব্রোকারেজ হাউসের দুটি বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন লিয়াকত। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ঋণ ও নিজের পুঁজি মিলিয়ে শেয়ারবাজারে লিয়াকতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে নিজের ছিল ৭৮ লাখ টাকা। বাকিটা ঋণ। টানা দরপতনে লিয়াকত ৬১ লাখ টাকা পুঁজি খুঁইয়েছেন। আত্মহত্যা করার দিনের হিসাব এটি।
ফুলেফেঁপে ওঠা সময়ে নয়, ২০১১ সালের শেষার্ধে লিয়াকত এই বিনিয়োগ করেন যখন বাজারের মূল্যসূচক ছয় হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। আবার লিয়াকতের পত্রকোষ বা পোর্টফোলিওর যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, তাঁর কেনা বেশির ভাগ শেয়ারই ছিল ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন। তার পরও কেন লিয়াকতকে এই বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হলো?
শেয়ারবাজার সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকসানের জন্য লিয়াকতের দায় যতটুকু তার চেয়ে বেশি দায় বাজার নিয়ন্ত্রকদের। কারণ তাঁরা বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেননি। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ বাজারের অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে। তাঁদের অদূরদর্শিতা ও কর্মকাণ্ড বাজারকে অস্বাভাবিক এক উচ্চতায় টেনে তুলেছিল, তাঁদের কথাবার্তা ও পদক্ষেপ লাখ লাখ মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল এই বাজারে ছুটে আসার জন্য।
অস্বাভাবিক উচ্চতা থেকে বাজারের পতনটা অনিবার্য ছিল। কিন্তু সেই পতনের বেলায়ও বাজারের ওপর চলল নানা হস্তক্ষেপ। তাতে স্বাভাবিক পতন বা সংশোধনের চেয়ে অস্বাভাবিকতা দেখা দিল। কিছুদিন পরপরই পতন ঠেকানোর নামে এলোমেলো পদক্ষেপ নিয়ে আরও পতন অনিবার্য করা হলো।
বাজার সংশ্লিষ্ট সবাই প্রায়ই বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সঠিক সময়ে ভালো শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে লোকসানের ঝুঁকি কম। লিয়াকতের পরিবার হয়তো এখন প্রশ্ন করতে পারে, ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও কেন লিয়াকতকে এতটা লোকসানের মুখে পড়তে হলো? জানা গেছে, লিয়াকত প্রতিদিন লেনদেন করতেন না। তার মানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের চিন্তা থেকেই এই বাজারে এসেছিলেন। কেনাবেচার পরিবর্তে শেয়ার ধরে রেখেছিলেন লাভের আশায়।
হ্যাঁ, লিয়াকতের একটি বড় ভুল ছিল, তিনি ধারদেনার টাকা এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। শেয়ারবাজার এ রকম ধারদেনা করে বিনিয়োগের জায়গা নয়। এটি জানা-বোঝার বিনিয়োগের একটি জায়গা। আবার শেয়ারবাজারে জেনে-বুঝে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভের সম্ভাবনা যেমন থাকে তেমনি লোকসানের ঝুঁকিও কম নয়। তবে উপযুক্ত সময়ে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের পরামর্শটি ঠিকই আছে। সমস্যা হলো, একটি স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ বাজারের অভাব। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নীতি-নির্ধারক ও বাজার পরিচালকদের।
আবার এ কথাও ঠিক যে আমাদের শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীরা অনেক সময়ই যৌক্তিক আচরণ করেন না। এ দায় বিনিয়োগকারীদের মেনে নেওয়া উচিত। লোকসান দিয়েই তাঁরা তাদের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিয়ে থাকেন। কিন্তু নীতি-নির্ধারক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের ব্যর্থতার দায় কতটা মেনে নেয়?
আমাদের বিনিয়োগকারীদের আচরণ যেমন বিশ্বের সুশৃঙ্খল কোনো শেয়ারবাজারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না, ঠিক তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নীতি-নির্ধারকদের আচরণেরও কি তুলনা চলে? বিশ্বের কোনো দেশের শেয়ারবাজারে কি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হয়? বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কিছু হলেই মন্ত্রীর কাছে ছুটতে হয়? শেয়ারবাজার কি রাজনীতির ময়দানে পরিণত হয়? অথচ সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায়ই বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের উদাহরণ দেন। সেই আলোকে নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা তাদের করা উচিৎ।
বিনিয়োগকারীর আচরণ যেমন তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে নীতি-নির্ধারক—কারও আচরণই বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে মেলে না। আর মেলে না বলেই এ দেশে শেয়ারবাজারে মৌলিক কাঠামোর কোনো সূত্রই কাজ করে না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলোও খুব কাজে লাগে না। আর তাই নীতি-নির্ধারক থেকে বিনিয়োগকারী সবারই দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার পরিবর্তন দরকার। তা না হলে বাজারের বড় খেলোয়াড়রা বড় পুঁজির প্রভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বোকা শুধু বানাবে না, পুঁজি হারিয়ে হাহাকার করার দিকে ঠেলে দেবে।
শেয়ারবাজার নিয়ে লিয়াকতের জ্ঞান কতটুকু তা অজানা থেকে গেল। এখন শুধু জানা গেল, মনীষা পিতৃহীন হয়েছে। তবে যে কাজটি লিয়াকত করলেন তা কখনো সমর্থন করা যায় না। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকেও মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সব হারিয়েও নতুন করে জীবন সাজায়। সেই তুলনায় লিয়াকত তো শুধু টাকা হারিয়েছেন। আর সবই তো তাঁর ছিল। সাড়ে চার বছরের ফুটফুটে এক কন্যাশিশু, স্ত্রী, পরিবার-পরিজন—সবই। আর একেকটি জীবন মানে তো একেকটি আলাদা জগৎ। এতগুলো জগৎ থাকতে শুধু অর্থের জন্য জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে লিয়াকত কি সত্যি পালাতে পারলেন? এই দুঃসহ স্মৃতির ভার মনীষাসহ পরিজন যে আজীবন বয়ে বেড়াবে, তা থেকে তিনি তাঁদের কীভাবে মুক্ত করবেন?
আরও যাঁরা এই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের অনুরোধ করব, লিয়াকতের মতো চিন্তা ভুলেও করবেন না। জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সংগ্রাম করে শত দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে পারাটাই জীবনের বড় সার্থকতা। নিজের পরিবার-পরিজনের প্রিয় মুখগুলোকে বারবার মনে করুন। তাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবনের সার্থকতার স্বাদটুকু ফেলে কিছু অর্থের জন্য জীবনকে ব্যর্থ করে দেবেন না।
সুজয় মহাজন: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো।
sujoy017@gmail.com
No comments