উপেক্ষিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কঃ অগ্রাধিকারের কথা কি শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ?
দেশের আমদানি-রফতানির সিংহভাগ যে সড়ক পথে আনা-নেয়া হয় সেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্তমান বেহালদশা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলা বাড়াবাড়ি হবে না। দীর্ঘ ২০ বছরের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির এমন বিপন্ন অবস্থা আর কখনও দেখা যায়নি। ফলে এ পথে চলাচলকারীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পণ্য পরিবহন খরচ ৫ থেকে ৭ ভাগ বেশি হওয়ায় দ্রব্যমূল্যে সেটা গুনতে হচ্ছে ক্রেতা-সাধারণকে।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির এমন দশা অগ্রাধিকার নির্ধারণে সরকারের উদাসীনতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়কটি প্রায় ৫০০ বছর আগে দিল্লির পাঠান সম্রাট শের শাহ্ নির্মিত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডেরই শেষাংশ। সড়কটির এক-তৃতীয়াংশ বা ১০০ কিলোমিটার পথই এখন খানাখন্দে চলার অযোগ্য। এর ২৭টি স্পটে প্রায় সব সময়ই যানজট লেগে থাকে। ১৫টি এলাকায় রাস্তা একেবারেই যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর আগে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতে বরাদ্দের বেশিরভাগই লুটপাট হয়েছে। নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে লোক দেখানো সংস্কারের পরপরই আবারও সেই আগের দশা হয়েছে সড়কটির। খানাখন্দে পড়ে প্রায়ই বাস-ট্রাক বিকল হয়। চাকা ফেটে উল্টে পড়ে। দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের, যা কখনও কখনও ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে পড়ে। তার পরও প্রতিদিন ২০ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করছে সড়কটি দিয়ে। কোনো কোনো সময় এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সড়কের বর্তমান অবস্থার কারণে আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে যেখানে ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন সেখানে লাগছে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। কোনো কারণে যানজট বা দুর্ঘটনায় রাস্তা বন্ধ থাকলে এ সময় বেড়ে ১৮-২০ ঘণ্টা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফলে যাত্রীবাহী বাসগুলোর টাইম শিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। যাত্রীরা দুঃসহ বিড়ম্বনায় পড়ে। পণ্য পরিবহনে শুধু খরচই বাড়ে না, প্রায়ই জাহাজে রফতানির ক্ষেত্রে শিপমেন্ট মিস হয়। ফলে রফতানিকারকরা এয়ার শিপমেন্ট করে ব্যবসা ধরে রাখতে গিয়ে প্রতি কেজি পণ্যে ৪ ডলার অতিরিক্ত হিসেবে এক কন্টেইনার পণ্য রফতানি করতে ৪০ হাজার ডলার ক্ষতির মুখে পড়েন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজমান দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলার পেছনে অন্য কারণের মতো এটাও একটা বড় কারণ—অস্বীকার করা যাবে না। সড়ক অবকাঠামো ঠিক থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরও উন্নত ও সাবলীল হতো।
সরকারের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় পদ্মা সেতুসহ নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে যতটা তত্পর, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ব্যাপারে তেমনটি হলে আজকের দশায় পড়তে হতো না। এখন শোনা যাচ্ছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সড়কটি চার লেন করার কাজ শুরু হবে। অবশ্য এখনই যাত্রাবাড়ী থেকে দাউদকান্দি (মেঘনা-গোমতী সেতু) পর্যন্ত সড়কটি চার লেন অর্থাত্ ৪৮ ফুট চওড়া। আর দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দুই লেন বা ২৮ ফুট চওড়া। এই অংশটুকুই যদি আগামীতে চার লেনে উন্নীত হয় তবে মহাসড়কের পরিস্থিতির কতটুকুইবা পরিবর্তন ঘটবে! সংশ্লিষ্টদের দাবি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীত করা হোক। সেই সঙ্গে সড়ক নির্মাণ বা সংস্কার কাজে দুর্নীতি, লুটপাট ও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা না গেলে তা মোটেই টেকসই হবে না। দেশজুড়ে যেভাবে টেন্ডারবাজি শুরু হয়েছে তাতে এক্ষেত্রেও নিশ্চিত কিছু বলা কঠিন বৈকি। মহাসড়কটির বিদ্যমান অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না হলে আসন্ন ঈদে পরিস্থিতি কী মারাত্মক হবে সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই স্বীকার করবেন। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে জাতীয় অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির কথা মুখেই সীমাবদ্ধ থাকবে—এটা জোর দিয়ে বলা যায়।
No comments