খেতুরী ধামের মহোৎসবঃ সেকাল-একাল by তিতুমীর ঋষভ
প্রেমভক্তি মহারাজ ঠাকুর শ্রী নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি স্মরণ মহোৎসব, বৈষ্ণবীয় প্রেম ঔদার্যে মিলনমেলা শুরু হয় গত ২২ আশ্বিন ১৪১৬, ৯ অক্টোবর ২০০৯ শুক্রবার রাজশাহী জেলার তীর্থভূমি প্রেমতলির শ্রীপাট খেতুরী ধামে। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। বৈষ্ণব ধর্মমতে এই স্রষ্টা কৃষ্ণ আর সৃষ্টি রাধা। স্রষ্টার আরাধনা আর কৃষ্ণ নাম জপের মধ্য দিয়ে শুভ অধিবাস, তারক ব্রহ্মনাম সংকীর্তন, ভোগ-আরতি ও মহন্ত বিদায়ের মধ্য দিয়ে পালিত হয় তিন দিন ব্যাপী তিরোভাব তিথি স্মরণ মহোৎসব।
রাজশাহী জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে গোদাগাড়ী উপজেলাধীন প্রেমতলি-বসন্তপুর রুটের মধ্যভাগে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের ভাবশিষ্য এবং বৈষ্ণব ধর্মযাজক মহাকবি শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুরের জন্মস্থান ও কীর্তনলীলা ক্ষেত্র বিখ্যাত গৌরাঙ্গবাড়ি খেতুরী নামক স্থানে অবস্থিত। ইতিহাসবিদদের মতে, উত্তরবঙ্গের এই খেতুরী ধাম ভারতের গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমার সমতুল্য বলে হিন্দু ভক্তরা মনে করেন। বাংলার গৌড়দেশ গড়েরহাট পরগনার অর্ন্তগত এক বিস্তৃত ভূখন্ডের ভূস্বামী ছিলেন শ্রী কৃষ্ণানন্দ দত্ত। তার পরমা ভক্তিবতী সত্রী নারায়ণী দেবীর গর্ভে শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের আবির্ভাব ঘটে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্ধে। মহাপ্রভু শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণের আগে নবদ্বীপ থেকে পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যাওয়ার সময় পদ্মাবতী তীরে বেশ কিছুদিন বসবাস করেছিলেন বলে কথিত আছে। একদিন মহাপ্রভু কৃপা করে পদ্মাবতীর কাছে 'প্রেমধন' গচ্ছিত রেখে 'নরোত্তম' নামের একজন প্রিয়ভক্ত জন্মগ্রহণ করলে তাকে এই গুপ্তধন প্রদান করতে পদ্মাবতীকে বলেন। সেই থেকে পদ্মাবতী মহাপ্রভূর প্রদত্ত প্রেমধন স্বীয় বক্ষে ধারণ করে উৎকণ্ঠায় দিন গুনতে লাগলেন যে কবে নরোত্তম আসবেন। এরপর আবার যখন মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব রূপ-সনাতনকে কৃপা করার উদ্দেশ্যে গৌড়ের রাজধানীর কাছে রামকেলী গ্রামের সন্নিকটে আসেন তখনও আবার পদ্মাবতীকে দেখে খেতুরী গ্রামের দিকে চেয়ে 'নরু' 'নরু' বলে কাকে যেন সম্বোধন করে ডেকেছিলেন। সে আকর্ষণেই নরোত্তমের জন্ম হয়। বাল্যকাল থেকে নরোত্তম উদাসীন প্রকৃতির ছিলেন। সংসার বিবাগী এ মানুষটির জীবনে পিতার ধনৈশ্বর্যলি�া বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। একই গ্রাম খেতুরীতে অবস্থানকারী পরম ভাগবদ এক ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদাসের সংসপর্শে এসে নরোত্তম তার কাছ থেকে গৌরকথা ও শ্রী নিবাস আচার্য প্রসঙ্গ কথা শুনে প্রেমাশ্রু বর্ষণ করতেন এবং মহাপ্রভুর দর্শন অপেক্ষায় বিভোর হয়ে পদ্মা নদীর কাছে তমাল বৃক্ষ তলে বসে চিন্তামগ্ন হতেন। নিত্যানন্দের দ্বিতীয় কলেবর নরোত্তম। নিত্যানন্দ প্রভু একদিন রাতে স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে নরোত্তমকে সকালে পদ্মায় স্নান করতে বলেন। সে স্বপ্নাদেশানুযায়ী পদ্মায় স্নানকালে দেখলেন গৌর বর্ণ এক মহাপুরুষ হাসতে হাসতে তার হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গায়ের শ্যামবর্ণ পরিবর্তন হয়ে উজ্জ্বল গৌর বর্ণ ধারণ করল। নরোত্তমের দেহস্মৃতি যেন লোপ পায় এবং পদ্মাবতী মহাপ্রভু শ্রী গৌরাঙ্গের গচ্ছিত 'প্রেমধন' নিজে নরোত্তমকে প্রদান করেন। এভাবে জীবনের নতুন অধ্যায় সূচনার প্রাক্কালে মাত্র ষোল বছর বয়সে পিতার ধন-ঐশ্বর্য ছেড়ে দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে শ্রী চৈতন্য দেবের চরণ আশ্রয়ের উদ্দেশে বৃন্দাবন গমন করেন। কিন্তু সেখানে ততদিনে চৈতন্য দেব শিষ্য শ্রী লোকনাথ গোস্বামীকে রেখে অন্যত্র যাওয়ার ফলে শ্রীচৈতন্য চরণ সপর্শ হয়নি নরোত্তম ঠাকুরের। বিধায় লোকনাথ গোস্বামীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে গুরুর আদেশে তা প্রচারের উদ্দেশ্যে গৌড়দেশ স্বগ্রাম খেতুরীতে গমন করেন। নরোত্তম দাস ঠাকুরের সর্বাপেক্ষা কর্মকীর্তি হলো স্বগ্রাম প্রেমতলী খেতুরী ধামে বিখ্যাত বৈষ্ণব মেলা মহোৎসব অনুষ্ঠান। এই মেলা শুরু হয়েছিল আনুমানিক ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্ধে (মতভেদ রয়েছে)। প্রেমভক্ত মহারাজ শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের তিরোধান তিথি স্মরণে মহোৎসবে বৈষ্ণবীয় ঔদার্যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনসমাগম ঘটে। সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার প্রেমের সম্পর্কই বৈষ্ণব ধর্মের মূল ভাব। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ছাড়াও তার দ্বিতীয় প্রধান অবদান বৈষ্ণব সমাজে পদাবলী কীর্তন প্রবর্তন করা। বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় তিনি অসাধারণ কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই রসকীর্তন প্রায় চারশ' বছর ধরে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে সর্বত্রই সমানভাবে প্রবহমান। তিনি তিরোভাবি, তাই তার সমাধি বলে কিছু নেই। কৃষ্ণ পঞ্চমী তিথিতে পদ্মাবতীর গর্ভোৎপত্তি থেকে গঙ্গাগর্ভে শেষে দেহ লীন হয়ে যায় সাদা দুধের রূপে ১৬১১ সালে। স্রষ্টার প্রেমে সৃষ্টি কাঙাল, তাই লংফেলোর ভাষায়------ এমন অতৃপ্তির আদলে বার বার ঘুরে আসে গৌরাঙ্গবাড়ির ভক্তসম্মিলন। গত বছর প্রায় পঞ্চাশটি দেশের ভক্ত এই মহাসম্মিলনে অংশ নেন। দুই লক্ষাধিক ভক্তের এই সমাবেশের প্রাঙ্গণে কোনো (ভালো-মন্দ) ধরনের আবাসন ব্যবস্থা নেই। নেই পানি, বিদ্যুৎ এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টিতে এখানে পর্যটন মোটেলসহ পর্যটন এলাকা গড়ে উঠতে পারে। শ্রী খেতুরী ধাম থেকে ১ কিলোমিটার দূরত্বে প্রেমতলী নামক স্থানে পদ্মাতীরবর্তী শ্রী শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের ধ্যান স্থান বলে পরিচিত সাতশ' বছরের পুরনো চিরহরিৎ জীবন্ত তমাল বৃক্ষ যা এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তমালতলা মন্দির থেকে কিছু দূরে রয়েছে সিলেটের মণিপুরী উপজাতির রাজা মণিচূড়ার সমাধিস্থল। আরেক দিকে রয়েছে ভোজনতলী মন্দির। বৈষ্ণব ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম তীর্থস্থানটি রাস্তা-ঘাট উন্নয়নসহ আধুনিক পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠুক-এলাকাবাসীর এমনটাই দাবি।
No comments