বিচার ব্যবস্থা নিয়ে দুদক চেয়ারম্যানের গুরুতর প্রশ্নঃ দুর্নীতি নির্মূলের ফয়সালা জরুরি
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বর্তমান বিচার ব্যবস্থার কারণে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে যে মন্তব্য করেছেন তাতে অনেকের মনের কথার প্রতিফলন ঘটেছে; যদিও ওই মনের কথাগুলো নানান কারণে আলোর মুখ দেখে না। গত বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, দুদক একটি দন্তহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। তবে এর থাবা এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।
থাবার নখগুলোও এখন কেটে নেয়ার চেষ্টা চলছে। বিচারকরা যদি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত না হন, তাহলে দুর্নীতি আরও বাড়বে। তিনি বলেছেন, আমাদের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে যদি বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করা না যায়, তাহলে দেশ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা অসম্ভব। আইন অনুযায়ী আদালতে প্রমাণ না হলে কাউকে দোষী বা দুর্নীতিবাজ বলা যায় না। কিন্তু দুর্নীতির বিষয়টি আদালতে প্রমাণিত হচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘তাহলে কি দেশে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি খুব একটা নেই? আদালত যদি শাস্তি না দেন, দুর্নীতিপরায়ণ লোক যদি শাস্তি না পায়, তাহলে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বন্ব্দ করা সম্ভব নয়। তবে আশার বাণী শুনিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতিকে দুর্নীতিবাজ ছাড়া কেউ পছন্দ করে না। আমি বিশ্বাস করি, দেশে দুর্নীতিবিরোধী লোকের সংখ্যাই বেশি। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন।’ দুদক চেয়ারম্যানের সার্বিক বক্তব্যে যে এক ধরনের হতাশা ব্যক্ত হয়েছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দুদকের প্রথম চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশস্লদ চৌধুরী সরে দাঁড়ানোর পর গত জুলাই মাসে তিনি এ সংস্থার দায়িত্ব নেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে থেকেই দুদক নামের বাঘটির দাঁত খসে পড়তে শুরু করেছিল। তাই দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে হাসান মশস্লদ চৌধুরী যেভাবে গোটা দেশ দাবড়িয়ে বেড়িয়েছিলেন সে সুযোগ গোলাম রহমান সাহেব কখনও পাননি। তাই হয়তো তিনি দুদককে দন্তহীন বাঘ মনে করছেন। দেশের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন সংস্থাটিকে সরকারের তল্পিবাহক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয় বরং নিন্দনীয়। কিন্তু দুদক যদি বাঘ হয়ে গোটা জাতিকে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভয় দেখাতে থাকে এবং অদৃশ্য ইঙ্গিতে যখন যাকে খুশি ধরে নিয়ে রিমান্ডের দাঁতের কামড়ে ও যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে তাহলে সেটাকে স্বাভাবিকতা বলে মেনে নেয়া যায় না। দুদকের অতীত বাড়াবাড়িই প্রতিষ্ঠানটির আজকের শ্রীহীন দশার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তবে দুদক চেয়ারম্যান বর্তমান বিচার ব্যবস্থা নিয়ে যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তা যথাযথ মূল্যায়নের দাবি রাখে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের ওপর সরকারের স্থূল হস্তক্ষেপ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায়ের পর এ হস্তক্ষেপ বন্ব্দের আশা যারা করেছিলেন, তাদের চরমভাবে হতাশ হতে হয়েছে; বরং এ হস্তক্ষেপ যেন দিন দিন বাড়ছে। দেশে আইনের শাসন যথাযথভাবে চললে অবশ্যই একথা উঠত না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা ‘গণতান্ত্রিক’ শাসন অনির্বাচিতদের মাতব্বরির চেয়ে উত্তম—এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এখন যেভাবে দেশ চলছে এ অবস্থা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে মানুষ হয়তো মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অশুভ কোয়ালিশনকেই ‘কম মন্দ’ বলে সার্টিফিকেট দিতে শুরু করবে। একমাত্র বিচার ব্যবস্থার বলিষ্ঠতাই পারে জাতিকে সে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করতে।
No comments