বিশাল মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে by ড.রেজোয়ান সিদ্দিকী
সরাসরি ভূমি আগ্রাসনের বদলে পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তত্ত্ব দিয়েছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা, সেই ষাটের দশকে। আগ্রাসনের লক্ষ্য যেখানে অর্থনৈতিক শোষণ, সে শোষণ যদি বিনা রক্তপাতে প্রায় নিখরচায় নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এত সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, হাঁক-ডাকের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে আগ্রাসী বা আগ্রাসিত কেউই লাভবান হয়নি। জয়ী ও বিজিত উভয়েরই বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লেগেছে উভয় পক্ষেরই। কোনো কোনো দেশ এখনও সে ধাক্কা সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর শোষণ ধারা অব্যাহতই রাখতে হবে। কোনো কোনো উন্নত দেশ উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। তাদের যা জনবল ও প্রযুক্তি রয়েছে তা দিয়ে আরও অধিকতর উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফলে এসব দেশ বিশ্বব্যাংকে সুদে টাকা খাটায় এবং ওই সুদের পয়সায় জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ঘটায়। এও আগ্রাসন। কত কৌশলে যে তারা টাকা ধার দিয়ে শোষণ করে নেয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইরাক ও আফগানিস্তান ছাড়া পৃথিবীর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় শক্তিমানদের যে শোষণ বা আগ্রাসন চলছে তার সবটাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এর জন্য প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের চিহ্নিত দেশগুলোতে এক শ্রেণীর দালাল সৃষ্টি করে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে এই দালাল শ্রেণীর প্রধান কাজ হলো শোষক দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে জনমত গড়ে তোলা। কখনও কখনও আগ্রাসী দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো কুষ্ঠ নিরাময়ের জন্য দুই টাকা অনুদান দেয়। কিন্তু নানা কৌশলে তারা ২০০ টাকা তুলে নেয়। ওই দুই টাকা অনুদানকে বড় বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে বিশাল কল্যাণকর কাজ বলে ঢাক পেটাতে থাকে দালাল শ্রেণী। এই ঢাক বাদকদের কাতারে তারা যুক্ত করেছে আর এক উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণী। এগুলো এনজিও। এ থেকে তাদের পরিকল্পনাও অত্যন্ত চমত্কার। এতে কোনো রাখঢাকও নেই। ওইসব শোষিত সমাজের এক শ্রেণীর দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী যখন গণপ্রতিনিধিত্বের কথা বলেন, গণতন্ত্রের ঢালের কথা বলেন, তখন শোষক দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতি কৌতুক-বিদ্রূপ করতে থাকে। তারা অহঙ্কার করে বলে, তোমাদের দেশটিকে আমরা এমনভাবে এনজিও’র জাল দিয়ে ঢেকে দেব যে, তার ফাঁক গলিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা নির্বাচিত হয়েও আসতে পারবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যাদের চাইব শুধু তারাই নির্বাচিত হয়ে আসবে। ফলে তোমরা গণতন্ত্রের নামে যে প্রতিনিধিত্বের স্বপম্ন দেখছ সে স্বপম্ন স্বপম্নই থেকে যাবে। গরিব দেশে শোষণের ধারা অব্যাহতভাবে কাজ করবে। এই ব্যবস্থা চমত্কার, ফলদায়ী হয়েই আসছিল। কিন্তু অতি ব্যবহারে ক্রমেই এ অস্ত্র ভোঁতা হয়ে আসতে থাকে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রক্রিয়া যদিও এখনও সক্রিয় আছে তবুও বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীরা সে ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। সে কৌশল মিডিয়ার ওপর আধিপত্য। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও ক্রমেই শিক্ষার হার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পত্রিকার পাঠক ও রেডিও-টেলিভিশনের শ্রোতা-দর্শক। সাম্রাজ্যবাদীদের শত কৌশল সত্ত্বেও সামান্যতম সুযোগ পেলেও মানুষ তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়। খবরের কাগজের পাঠক সংখ্যা বাড়ে। সাধারণ মানুষ রেডিও-টিভি কেনার সাধ্য অর্জন করে। রেডিওতে খবর শোনে, আলোচনা শোনে। টিভিতে খবর দেখে, আলোচনা শোনে। আর সাম্রাজ্যবাদীদের ধোঁকা-প্রক্রিয়া সহজ হয়। আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাদের শতসহস্র এনজিও’র পেছনে পয়সা ঢালতে হয় না। তখন তারা মিডিয়া বা প্রচার মাধ্যমের ওপর ভর করে। ভর কেন করে? সেটাও শোষণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই। উগান্ডার ৬০ শতাংশ মানুষ এইডসে উজাড় হয়ে গেছে। পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদারগুলো উগান্ডার দিকে ফিরেও তাকায়নি। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিভূ মিডিয়ায় সে সংবাদ প্রচার করেছে। ‘বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার জন্য দু’চারখান কভার সেল্টারি রচনা করেছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এনজিও বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে এইডস সংক্রমণ রোধের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ, মৃত্যুই তাদের নিয়তি। উগান্ডানরা এইডসে সাবাড় হয়ে গেলে সেখানে থাকবে শুধু ঊষর বিরানভূমি। আর কোনো সম্পদ নেই। লুণ্ঠনের জন্য আর কিছু নেই। উর্বর জমি নেই। সম্ভাবনার সমুদ্র নেই। সমৃদ্ধ বনভূমি নেই। তেল-গ্যাস নেই। ফলে উগান্ডা চ্যাপ্টার ওই পর্যন্তই। তাহলে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে বাংলাদেশ হঠাত্ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? আমি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ভ্রমণ করেছি। প্রায় সব জায়গায় সাধারণ মানুষকে মানচিত্র এঁকে আমার বাংলাদেশকে চেনাতে হয়েছে। পৃথিবীর সাধারণ মানুষদের মধ্যে বাংলাদেশ যারা চেনেন, তাদের সকলেই জানেন, বাংলাদেশ একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। ঘূর্ণিঝড়-বন্যা-খরা এদেশের মানুষের প্রাকৃতিক নিয়তি। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই বাংলাদেশকে সাহায্যের নামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও দানবাক্স খোলে। সে দানের টাকা বিতরণের নামে তাদের লোকদের কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করে। একশ’ টাকা ত্রাণ পেলে তাদের কর্মীদের মাধ্যমে সত্তর টাকা হাতিয়ে নেয়। এটুকু লুণ্ঠন চলছিল। বাংলাদেশ এসব অপমান সহ্য করেও তা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে মহাবিপত্তি বাধল নব্বইয়ের দশকে। যখন দেখা গেল যে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে বিপুল তেল-গ্যাস সম্পদ। সারা বিশ্ব এখন তেল-গ্যাস ক্ষুধার্ত। পৃথিবীর যেখানে জ্বালানি সম্পদ আছে, সেখানেই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী দেশগুলোর থাবা বিস্তৃত আছে। ওই জ্বালানি সম্পদের জন্য আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নজরে পড়ল বাংলাদেশ। লুণ্ঠন করা চাই বাংলাদেশের ওই জ্বালানি সম্পদ। সে সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য চারদলীয় জোট সরকার অনুকূল ছিল না। তার জন্য ভিন্ন এক সরকার চাই। শুরু হলো সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের ষড়যন্ত্র। প্রথমত, দরকার ছিল জোট সরকারকে যেভাবে পারা যায় হেয়প্রতিপন্ন করা। তার জন্য তাদের ব্যর্থ বলে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের দুর্নীতিবাজ বলে প্রতিপন্ন করতে হবে। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলেও আর কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে না পারে জোট। একই সঙ্গে জনগণকে ধোঁকা দেয়া আর ভবিষ্যতের সরকারকে পঙ্গু অবস্থায় ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য দরকার ছিল সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে তোলা। সম্ভব হলে ধ্বংস করে দেয়া। সে প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেল একই সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে তুলতে হবে, যাতে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণ সম্পূর্ণরূপে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। আর পাশাপাশি ধ্বংস করে দিতে হবে দেশের আইন-শৃগ্ধখলা। আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে করে ফেলতে হবে দুর্বল। সেসব আয়োজন চলল পুরোদমে। এর জন্য তৈরি করা হলো নতুন নতুন এনজিও। এসব এনজিওকে কাজ দেয়া হলো, তারা এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করবে। এনজিওগুলো মাঠে নেমে গেল। সত্ লোকের সন্ব্দানে তারা বেরিয়ে পড়ল। সারাদেশ থেকে সত্ লোক খুঁজে বের করে তারা এক আজগুবি সরকার গঠনের পাঁয়তারা শুরু করে দিল। কোথাও কোথাও জনগণের ধাওয়া খেয়ে তারা ফিরে এল। কোথাও কোথাও তারা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার কাজ শুরু করল। এক্ষেত্রেও সবচেয়ে যা জরুরি হয়ে দেখা দিল, তা হলো এই অপপ্রচার ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। সে কাজটা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মিডিয়া যেভাবে পারবে, অন্য কেউ সেভাবে পারবে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো মিডিয়ার ওপর ভর করার চেষ্টা করল। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার মিডিয়ার অভাব বরাবরই ছিল। এখনও তার খুব একটা ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর জন্য তাঁবেদার মিডিয়া জোগাড় করা কঠিন হয়নি। নগদ অর্থ যেমন তারা ঢালতে শুরু করল, তেমনি সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের প্রতিষ্ঠান বস্লজাতিক কোম্পানিগুলো ওইসব মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ করতে শুরু করল। ফলে মিডিয়াগুলোও জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ওই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের গুণকীর্তন শুরু করল। একই সঙ্গে তারা চেষ্টা করতে থাকলো কিভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেয়া যায়। এই রাষ্ট্রঘাতী অপপ্রয়াসে তারা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রশ্নহীন। এসব সংবাদ মাধ্যমে হক না-হক নানা ধরনের অপপ্রচারের জোয়ার বয়ে যেতে থাকল। আর তাদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কোনো শক্তি বা মাধ্যম তখন ছিল না। তাতে যে যা হবার তাই হয়ে গেছে। দু’বছর পরীক্ষামূলক সামরিক শাসন চালু রাখা হলো প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নে। তারপর সমঝোতার মাধ্যমে এমন এক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হলো, যাদের সব কর্মকাণ্ড সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের স্বার্থের অনুকূলে প্রবাহিত হতে থাকল। ঠিক এ সময়ই মালিকানার হাতবদল হলো দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার। এই হাতবদলের ফলে আমার দেশ পত্রিকা সত্যানুসন্ব্দানে ব্যাপৃত হয়ে অপপ্রচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য প্রকাশ করে দিতে থাকল। আমরা আগেই বলেছি, মিডিয়ার শক্তি এখন বেড়েছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে মানুষের সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস বেড়েছে। তারা সত্য জানতে শুরু করল ধীরে ধীরে। যদিও ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও দৈনিক আমার দেশ সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সত্য প্রকাশ শুরু করে দিয়েছে। এই সত্য প্রকাশের ধারায় এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ। আমার দেশ-এর বর্ষপূর্তিতে তাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আর সেই সঙ্গে কামনা, ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থেকে টিকে থাকুক আমার দেশ অনন্তকাল ধরে। অবদান রাখুক বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও উন্নয়নের ধারায়।
No comments