তিনটি জন্মদিন ও দৈনিক অপরের দেশ by শফিক রেহমান
দৈনিক ‘আমার দেশ’ সংবাদপত্রটির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে দু’জন বিখ্যাত সাংবাদিকের নাম জড়িয়ে আছে। একজন আমেরিকান এবং আরেকজন ইওরোপিয়ান। দু’জনই প্রয়াত। দু’জনারই জন্ম হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বরে, যেটি আমার দেশ-এরও জন্মদিন। তাই আমার দেশ-এর পঞ্চম বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবেচনা করা যেতে পারে ওই দুই সাংবাদিকের কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারা এবং সেখান থেকে পত্রিকাটির মালিক, ম্যানেজমেন্ট ও সাংবাদিকদের কিছু শেখার আছে।
আমেরিকান সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ওয়াল্টার লিপম্যান-এর জন্ম হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৮৯-এ আজ থেকে ১১০ বছর আগে নিউইয়র্কের একটি জার্মান-ইস্লদি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার মৃত্যু হয়েছিল ৮৫ বছর বয়সে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৪-এ। ‘টুডে অ্যান্ড টুমরো’ (আজ এবং আগামীকাল) নামে একটি সিন্ডিকেটেড কলাম লেখার জন্য তিনি পুলিত্জার প্রাইজ পেয়েছিলেন দু’বার ১৯৫৮ ও ১৯৬২-তে।
১৭ বছর বয়সে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ফিলোসফি ও ল্যাংগুয়েজেস-এ মাত্র তিন বছরের মধ্যে ডিগ্রি অর্জন করেন। ছোটবেলা থেকে তার পরিবারের সঙ্গে তিনি প্রায়ই যেতেন ইওরোপ ভ্রমণে। তখন প্লেন ছিল না—ভ্রমণ ও সমুদ্র পাড়ি দেয়া সহজ ছিল না। লিপম্যান ভাষা বিষয়ে পড়াশোনা এবং এসব ভ্রমণের ফলে ফেদ্ধঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ব্যুত্পত্তি লাভ করেছিলেন যা তার সাংবাদিক জীবনে ইওরোপিয়ান রাজনীতি বুঝতে সাহায্য করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন যুবক লিপম্যানকে তার উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। ফলে সাংবাদিক জীবনের সূচনালগ্ন থেকে লিপম্যান আমেরিকান উঁচু মহলে ঘোরাফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। সিনিয়র পলিটিশিয়ান ও প্রশাসনের সিনিয়র অফিসারদের মনমানসিকতা জানার পথ খুলে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তিনি হন ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় আমেরিকা ও তার মিত্র পশ্চিম ইওরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সভিয়েট ইউনিয়ন ও তার মিত্র পূর্ব ইওরোপিয়ান দেশগুলোর তীব্র আদর্শিক দ্বন্দ্ব, যার ফলে তৃতীয় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় বিশ্ববাসী ভীত ছিল। এই অবস্থার নাম লিপম্যান দিয়েছিলেন ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধ। বাংলায় কেউ কেউ একে ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা শীতল লড়াইও বলেন। লিপম্যান গভীরভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি একদলীয় শাসন ও স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী ছিলেন।
লিপম্যানই প্রথম শনাক্ত করেন যে, সাধারণ মানুষের মনে এবং সাংবাদিকদের নিজেদের মনে যে প্রচলিত ধারণা আছে তাদের ওপর ভিত্তি করে সাংবাদিকরা ঢালাওভাবে লেখেন। তিনি বলেন, এর ফলে সাংবাদিকদের লেখাতে ভুল থেকে যায়। পাঠকরা এসব ভুল তথ্য পড়ে কিছু শিখতে উত্সাহী হয় না। সাধারণ পাঠকরা আত্মকেন্দ্রিক এবং তারা শুধু তাদের স্থানীয় সংবাদেই উত্সাহী থাকে।
এই কারণেই আমেরিকার সাধারণ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিদেশের খবর থাকে না বললেই চলে। তাই ২০০০-এ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য জর্জ ডাবলিউ বুশ যখন ক্যামপেইন করেছিলেন তখন পররাষ্ট্র বিষয়ে তার চূড়ান্ত অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছিল। লিপম্যান বিশ্বাস করতেন সাংবাদিকতার লক্ষ্য হচ্ছে এক ধরনের ‘ইনটেলিজেন্স ওয়ার্ক’ করা। সাংবাদিকরা এই ভূমিকায় নীতিনির্ধারক ও পাবলিকের মধ্যে সংযোগ রূপে কাজ করেন। একজন সাংবাদিকের কাজ হলো একজন নীতিনির্ধারক বা পলিসি মেকারের কাছ থেকে ফ্যাক্ট বের করে সেটা সাধারণ ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়া, যারা তা জেনে জনমত তৈরি করবে। এর ফলে সাংবাদিকের সংগৃহীত তথ্যে পলিসি মেকারদের জবাবদিহিতা বাড়বে। নিজে সাংবাদিক হলেও লিপম্যান ধারণা করতেন, সাংবাদিকরা অনেক সময়ে সংবাদ (নিউজ) ও সত্য (ট্রুথ)-কে গুলিয়ে ফেলেন। তিনি লেখেন, সংবাদের কাজটি হচ্ছে একটি ঘটনাকে চিহ্নিত করা। আর সত্যের কাজটি হচ্ছে গোপন ফ্যাক্টগুলোকে প্রকাশ করা। সাংবাদিকের কাজটি হলো সংবাদ ও সত্যকে পাশাপাশি তুলে ধরে বাস্তবের এমন একটি ছবি তৈরি করা যা থেকে পাঠক তার মতামত সৃষ্টি করতে এবং কাজ করতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, সাংবাদিক তার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবাদ তৈরি করেন। সুতরাং এ ধরনের সংবাদ অসম্পূর্ণ ও দুর্বল। এ ধরনের সংবাদ গণতন্ত্রের উপকারে আসে না। .... গণতন্ত্রের প্রধান দু’টি সমস্যা হলো, নির্ভুল তথ্য পাওয়া এবং এসব তথ্যের সোর্সকে (সূত্র) রক্ষা করা। ওয়াল্টার লিপম্যান তার সুদীর্ঘ জীবনে আমেরিকার অনেক প্রেসিডেন্টের ঘোষিত-অঘোষিত উপদেষ্টা রূপে কাজ করেছিলেন। তারা তাকে প্রকৃত জ্ঞানী, গুণী ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তি রূপে বিশ্বাস করতেন। লিপম্যান ছিলেন ভিয়েত্নাম যুদ্ধের বিপক্ষে এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন সরকারের ভিয়েত্নাম নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে ইওরোপে সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি চেক সাংবাদিক জারোস্লাভ সিফার্ট-এর। তবে তিনি কবি হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯৮৪’র নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। সিফার্ট-এর জন্ম হয়েছিল একটি খেটে খাওয়া পরিবারে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯০১-এর চেক প্রজাতন্ত্রের জিজকভ শহরের উপকণ্ঠে। শহরের দারিদ্র্য তাকে কমিউনিস্ট হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ১৯২১-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু তাদের বলশেভিক চিন্তাধারার সমালোচনা তিনি করতে থাকেন এবং আট বছর পরে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি একাধিক কমিউনিস্ট পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের (রভনস্ট, স্রাসাতেক, রিফ্লেকটর) সম্পাদনা করতেন। সিফার্ট সাংবাদিকতায় লেগে থাকেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট সরকারের কঠিন সমালোচনা করায় তিনি প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হন। সরকারের প্রতিবন্ব্দকতার মুখে সিফার্ট ১৯৪৯-এ এক পর্যায়ে সাংবাদিকতাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি তার একক সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি বস্ল রকমের লেখায়, বিশেষত কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু কমিউনিস্ট সরকার তার লেখালেখির ওপর কড়া নজর রাখে এবং তার অনেক লেখা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ১৯৭৭-তে চার্টার ৭৭ মানব অধিকার ম্যানিফেস্টোতে সই দেয়ার জন্য তিনি ব্ল্যাক লিস্টেড (কালো তালিকাভুক্ত) হন। তার কবিতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৮৪-তে তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান। এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র চেক যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। অসুস্থ থাকার ফলে তিনি পুরস্কারটি নিতে যেতে পারেননি। তার পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ খুব ছোট করে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে জানানো হয়। কিছুকাল পরে চেক সরকার কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিফার্টের লেখা সম্পাদিত ও ছোট করে প্রকাশের অনুমতি দেয়। সিফার্টের কবিতাগুলোর গুণগত মান নোবেল বিজয়ের যোগ্য ছিল কিনা, সে বিষয়ে সাহিত্য সমালোচকরা তর্ক করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন হাল্কা ওজনের কবি, যিনি কমিউনিস্ট সরকার বিরোধী ছিলেন এই বিবেচনায় পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। অর্থাত্, সাহিত্যের জন্য নয়, রাজনৈতিক কারণে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। কিন্তু চেক জনগণের কাছে সিফার্ট এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। চেক জনগণ মনে করে তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও প্রতিবাদী লেখক যিনি তার নীতির সঙ্গে আপস করেননি এবং যিনি ভালো কবিতা লিখতেন ৮৪ বছর বয়সে ১০ জানুয়ারি ১৯৮৬-তে সিফার্ট পরলোক গমন করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪-এ দৈনিক আমার দেশ-এর জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। রাজধানীর ট্রাফিক জ্যাম রোড বা এয়ারপোর্ট রোডে স্টিল ভবনের উঁচুতলা থেকে আমার দেশ তার যাত্রা শুরু করে। কারওয়ানবাজারের অনাধুনিক বাজার এলাকা থেকে প্রকাশিত হয় সিটিপি (কম্পিউটার টু প্লেট যন্ত্র)সহ বস্ল আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই দৈনিক। টিভি ও বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন ব্লিটসের ফলে এবং দাম কম রাখার প্রাথমিক সুবিধায় আমার দেশ দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন শুরু করে। এই পাঠকপ্রিয়তা স্থায়িত্ব লাভ শুরু করে পত্রিকাটির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
পাঠকরা বুঝতে আরম্ভ করেন আমার দেশ সত্যিই আমাদের দেশ বাংলাদেশের কথা বলছে। এজন্য বিশেষত তাদের উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ ও সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীর বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। এদের সঙ্গে নিয়মিত কলাম লেখকরা আমার দেশ-এর একটি দেশপ্রেমিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা নেন। পত্রিকাটির এই স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় রিপোর্টাররা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে পত্রিকাটির নিউজ ট্রিটমেন্ট হয় ভিন্ন।
কিন্তু বছর তিনেক পরেই বড় কয়েকটি বিপর্যয় নেমে আসে আমার দেশ-এর ওপর। স্টিল ভবনে আগুন লাগার ফলে পত্রিকা অফিসের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাময়িকভাবে পত্রিকার অফিস স্থানান্তরিত হয় তেজগাঁও শিল্প এলাকায় লাভ রোডে তাদের প্রেস ভবনে। এই সময়ে পাশের ভবনে অবস্থিত দৈনিক যায়যায়দিন থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই আগুন বিপর্যয়ের পাশাপাশি পত্রিকাটির মালিকপক্ষ গভীর রাজনৈতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে যান। অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে আগুন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পত্রিকাটি আবার সিল্টল ভবনের অফিসে ফিরে যেতে পারলেও রাজনৈতিক দুর্যোগ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এসব প্রচণ্ড বাধা-বিপত্তির মুখে পড়লেও আমার দেশ তার প্রকাশনার পঞ্চম বছরে অনেকটাই সামলে উঠতে পারে। তবে পাঠকরা এখন লক্ষ্য করছেন আমার দেশ ভবিষ্যতে সাধারণ বিপদ নয়—মহাবিপদের আশঙ্কায় রয়েছে। পত্রিকাটির রিপোর্টিং-সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় কলামে তাদের এই আশঙ্কাই ফুটে উঠছে। তারা আশঙ্কা করছেন, আমাদের দেশ কি অপরের দেশ হয়ে যাবে? আর তাই যদি হয়, অর্থাত্ আমাদের দেশ বাংলাদেশ যদি সত্যিই অপরের দেশ হয়ে যায় এবং নাম বদলের ম্যানিয়াগ্রস্ত (হসপিটাল থেকে নভোসেন্টার, কনফারেন্স হল থেকে বর্ডার রক্ষাবাহিনী) আওয়ামী লীগ সরকার যদি তখনও ক্ষমতাসীন থাকে তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগ ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার নিষ্পাপ ইচ্ছা ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে। সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি অপরের দেশ হয়ে যায় তাহলে দৈনিক আমার দেশ-এর নাম বদলে দৈনিক অপরের দেশ হয়ে যাবে কি?
সম্ভবত এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরই এখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন আমার দেশ-এর লেখক-কর্মীবৃন্দ। ট্রানজিট-করিডোর, চিটাগং পোর্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর অপসারণ, সমুদ্রসীমা, এশিয়ান হাইওয়ে, তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ প্রভৃতি ইসুতে দৈনিক আমার দেশ সাহসী, দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকা রাখছে।
এই ভূমিকায় আমার দেশ নিশ্চিত বিজয়ী হবে যদি পত্রিকাটির সাংবাদিকরা ওয়াল্টার লিপম্যান ও জারোস্লাভ সিফার্ট-এর জীবন থেকে কিছু লেসন নেন। যেমন, লিপম্যানের মতোঃ-
এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করা। এই কাজে সহায়ক রূপে সাংবাদিকদের নিউজ ও ফ্যাক্টের মধ্যে তফাত্ বুঝে কাজ করা।
দুই. ঢালাও প্রশংসা অথবা ঢালাও নিন্দা না করা।
তিন. সরকারকে উপদেশ দেয়া এবং সমালোচনাও করা।
চার. প্রচুর পড়াশোনা ও ভ্রমণ করা।
এবং সিফার্টের মতো সাহসী, প্রতিবাদী ও আপসহীন হওয়া।
১৭ বছর বয়সে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ফিলোসফি ও ল্যাংগুয়েজেস-এ মাত্র তিন বছরের মধ্যে ডিগ্রি অর্জন করেন। ছোটবেলা থেকে তার পরিবারের সঙ্গে তিনি প্রায়ই যেতেন ইওরোপ ভ্রমণে। তখন প্লেন ছিল না—ভ্রমণ ও সমুদ্র পাড়ি দেয়া সহজ ছিল না। লিপম্যান ভাষা বিষয়ে পড়াশোনা এবং এসব ভ্রমণের ফলে ফেদ্ধঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ব্যুত্পত্তি লাভ করেছিলেন যা তার সাংবাদিক জীবনে ইওরোপিয়ান রাজনীতি বুঝতে সাহায্য করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন যুবক লিপম্যানকে তার উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। ফলে সাংবাদিক জীবনের সূচনালগ্ন থেকে লিপম্যান আমেরিকান উঁচু মহলে ঘোরাফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। সিনিয়র পলিটিশিয়ান ও প্রশাসনের সিনিয়র অফিসারদের মনমানসিকতা জানার পথ খুলে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তিনি হন ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় আমেরিকা ও তার মিত্র পশ্চিম ইওরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সভিয়েট ইউনিয়ন ও তার মিত্র পূর্ব ইওরোপিয়ান দেশগুলোর তীব্র আদর্শিক দ্বন্দ্ব, যার ফলে তৃতীয় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় বিশ্ববাসী ভীত ছিল। এই অবস্থার নাম লিপম্যান দিয়েছিলেন ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধ। বাংলায় কেউ কেউ একে ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা শীতল লড়াইও বলেন। লিপম্যান গভীরভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি একদলীয় শাসন ও স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী ছিলেন।
লিপম্যানই প্রথম শনাক্ত করেন যে, সাধারণ মানুষের মনে এবং সাংবাদিকদের নিজেদের মনে যে প্রচলিত ধারণা আছে তাদের ওপর ভিত্তি করে সাংবাদিকরা ঢালাওভাবে লেখেন। তিনি বলেন, এর ফলে সাংবাদিকদের লেখাতে ভুল থেকে যায়। পাঠকরা এসব ভুল তথ্য পড়ে কিছু শিখতে উত্সাহী হয় না। সাধারণ পাঠকরা আত্মকেন্দ্রিক এবং তারা শুধু তাদের স্থানীয় সংবাদেই উত্সাহী থাকে।
এই কারণেই আমেরিকার সাধারণ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিদেশের খবর থাকে না বললেই চলে। তাই ২০০০-এ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য জর্জ ডাবলিউ বুশ যখন ক্যামপেইন করেছিলেন তখন পররাষ্ট্র বিষয়ে তার চূড়ান্ত অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছিল। লিপম্যান বিশ্বাস করতেন সাংবাদিকতার লক্ষ্য হচ্ছে এক ধরনের ‘ইনটেলিজেন্স ওয়ার্ক’ করা। সাংবাদিকরা এই ভূমিকায় নীতিনির্ধারক ও পাবলিকের মধ্যে সংযোগ রূপে কাজ করেন। একজন সাংবাদিকের কাজ হলো একজন নীতিনির্ধারক বা পলিসি মেকারের কাছ থেকে ফ্যাক্ট বের করে সেটা সাধারণ ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়া, যারা তা জেনে জনমত তৈরি করবে। এর ফলে সাংবাদিকের সংগৃহীত তথ্যে পলিসি মেকারদের জবাবদিহিতা বাড়বে। নিজে সাংবাদিক হলেও লিপম্যান ধারণা করতেন, সাংবাদিকরা অনেক সময়ে সংবাদ (নিউজ) ও সত্য (ট্রুথ)-কে গুলিয়ে ফেলেন। তিনি লেখেন, সংবাদের কাজটি হচ্ছে একটি ঘটনাকে চিহ্নিত করা। আর সত্যের কাজটি হচ্ছে গোপন ফ্যাক্টগুলোকে প্রকাশ করা। সাংবাদিকের কাজটি হলো সংবাদ ও সত্যকে পাশাপাশি তুলে ধরে বাস্তবের এমন একটি ছবি তৈরি করা যা থেকে পাঠক তার মতামত সৃষ্টি করতে এবং কাজ করতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, সাংবাদিক তার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবাদ তৈরি করেন। সুতরাং এ ধরনের সংবাদ অসম্পূর্ণ ও দুর্বল। এ ধরনের সংবাদ গণতন্ত্রের উপকারে আসে না। .... গণতন্ত্রের প্রধান দু’টি সমস্যা হলো, নির্ভুল তথ্য পাওয়া এবং এসব তথ্যের সোর্সকে (সূত্র) রক্ষা করা। ওয়াল্টার লিপম্যান তার সুদীর্ঘ জীবনে আমেরিকার অনেক প্রেসিডেন্টের ঘোষিত-অঘোষিত উপদেষ্টা রূপে কাজ করেছিলেন। তারা তাকে প্রকৃত জ্ঞানী, গুণী ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তি রূপে বিশ্বাস করতেন। লিপম্যান ছিলেন ভিয়েত্নাম যুদ্ধের বিপক্ষে এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন সরকারের ভিয়েত্নাম নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে ইওরোপে সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি চেক সাংবাদিক জারোস্লাভ সিফার্ট-এর। তবে তিনি কবি হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯৮৪’র নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। সিফার্ট-এর জন্ম হয়েছিল একটি খেটে খাওয়া পরিবারে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯০১-এর চেক প্রজাতন্ত্রের জিজকভ শহরের উপকণ্ঠে। শহরের দারিদ্র্য তাকে কমিউনিস্ট হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ১৯২১-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু তাদের বলশেভিক চিন্তাধারার সমালোচনা তিনি করতে থাকেন এবং আট বছর পরে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি একাধিক কমিউনিস্ট পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের (রভনস্ট, স্রাসাতেক, রিফ্লেকটর) সম্পাদনা করতেন। সিফার্ট সাংবাদিকতায় লেগে থাকেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট সরকারের কঠিন সমালোচনা করায় তিনি প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হন। সরকারের প্রতিবন্ব্দকতার মুখে সিফার্ট ১৯৪৯-এ এক পর্যায়ে সাংবাদিকতাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি তার একক সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি বস্ল রকমের লেখায়, বিশেষত কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু কমিউনিস্ট সরকার তার লেখালেখির ওপর কড়া নজর রাখে এবং তার অনেক লেখা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ১৯৭৭-তে চার্টার ৭৭ মানব অধিকার ম্যানিফেস্টোতে সই দেয়ার জন্য তিনি ব্ল্যাক লিস্টেড (কালো তালিকাভুক্ত) হন। তার কবিতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৮৪-তে তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান। এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র চেক যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। অসুস্থ থাকার ফলে তিনি পুরস্কারটি নিতে যেতে পারেননি। তার পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ খুব ছোট করে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে জানানো হয়। কিছুকাল পরে চেক সরকার কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিফার্টের লেখা সম্পাদিত ও ছোট করে প্রকাশের অনুমতি দেয়। সিফার্টের কবিতাগুলোর গুণগত মান নোবেল বিজয়ের যোগ্য ছিল কিনা, সে বিষয়ে সাহিত্য সমালোচকরা তর্ক করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন হাল্কা ওজনের কবি, যিনি কমিউনিস্ট সরকার বিরোধী ছিলেন এই বিবেচনায় পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। অর্থাত্, সাহিত্যের জন্য নয়, রাজনৈতিক কারণে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। কিন্তু চেক জনগণের কাছে সিফার্ট এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। চেক জনগণ মনে করে তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও প্রতিবাদী লেখক যিনি তার নীতির সঙ্গে আপস করেননি এবং যিনি ভালো কবিতা লিখতেন ৮৪ বছর বয়সে ১০ জানুয়ারি ১৯৮৬-তে সিফার্ট পরলোক গমন করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪-এ দৈনিক আমার দেশ-এর জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। রাজধানীর ট্রাফিক জ্যাম রোড বা এয়ারপোর্ট রোডে স্টিল ভবনের উঁচুতলা থেকে আমার দেশ তার যাত্রা শুরু করে। কারওয়ানবাজারের অনাধুনিক বাজার এলাকা থেকে প্রকাশিত হয় সিটিপি (কম্পিউটার টু প্লেট যন্ত্র)সহ বস্ল আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই দৈনিক। টিভি ও বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন ব্লিটসের ফলে এবং দাম কম রাখার প্রাথমিক সুবিধায় আমার দেশ দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন শুরু করে। এই পাঠকপ্রিয়তা স্থায়িত্ব লাভ শুরু করে পত্রিকাটির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
পাঠকরা বুঝতে আরম্ভ করেন আমার দেশ সত্যিই আমাদের দেশ বাংলাদেশের কথা বলছে। এজন্য বিশেষত তাদের উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ ও সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীর বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। এদের সঙ্গে নিয়মিত কলাম লেখকরা আমার দেশ-এর একটি দেশপ্রেমিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা নেন। পত্রিকাটির এই স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় রিপোর্টাররা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে পত্রিকাটির নিউজ ট্রিটমেন্ট হয় ভিন্ন।
কিন্তু বছর তিনেক পরেই বড় কয়েকটি বিপর্যয় নেমে আসে আমার দেশ-এর ওপর। স্টিল ভবনে আগুন লাগার ফলে পত্রিকা অফিসের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাময়িকভাবে পত্রিকার অফিস স্থানান্তরিত হয় তেজগাঁও শিল্প এলাকায় লাভ রোডে তাদের প্রেস ভবনে। এই সময়ে পাশের ভবনে অবস্থিত দৈনিক যায়যায়দিন থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই আগুন বিপর্যয়ের পাশাপাশি পত্রিকাটির মালিকপক্ষ গভীর রাজনৈতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে যান। অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে আগুন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পত্রিকাটি আবার সিল্টল ভবনের অফিসে ফিরে যেতে পারলেও রাজনৈতিক দুর্যোগ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এসব প্রচণ্ড বাধা-বিপত্তির মুখে পড়লেও আমার দেশ তার প্রকাশনার পঞ্চম বছরে অনেকটাই সামলে উঠতে পারে। তবে পাঠকরা এখন লক্ষ্য করছেন আমার দেশ ভবিষ্যতে সাধারণ বিপদ নয়—মহাবিপদের আশঙ্কায় রয়েছে। পত্রিকাটির রিপোর্টিং-সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় কলামে তাদের এই আশঙ্কাই ফুটে উঠছে। তারা আশঙ্কা করছেন, আমাদের দেশ কি অপরের দেশ হয়ে যাবে? আর তাই যদি হয়, অর্থাত্ আমাদের দেশ বাংলাদেশ যদি সত্যিই অপরের দেশ হয়ে যায় এবং নাম বদলের ম্যানিয়াগ্রস্ত (হসপিটাল থেকে নভোসেন্টার, কনফারেন্স হল থেকে বর্ডার রক্ষাবাহিনী) আওয়ামী লীগ সরকার যদি তখনও ক্ষমতাসীন থাকে তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগ ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার নিষ্পাপ ইচ্ছা ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে। সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি অপরের দেশ হয়ে যায় তাহলে দৈনিক আমার দেশ-এর নাম বদলে দৈনিক অপরের দেশ হয়ে যাবে কি?
সম্ভবত এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরই এখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন আমার দেশ-এর লেখক-কর্মীবৃন্দ। ট্রানজিট-করিডোর, চিটাগং পোর্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর অপসারণ, সমুদ্রসীমা, এশিয়ান হাইওয়ে, তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ প্রভৃতি ইসুতে দৈনিক আমার দেশ সাহসী, দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকা রাখছে।
এই ভূমিকায় আমার দেশ নিশ্চিত বিজয়ী হবে যদি পত্রিকাটির সাংবাদিকরা ওয়াল্টার লিপম্যান ও জারোস্লাভ সিফার্ট-এর জীবন থেকে কিছু লেসন নেন। যেমন, লিপম্যানের মতোঃ-
এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করা। এই কাজে সহায়ক রূপে সাংবাদিকদের নিউজ ও ফ্যাক্টের মধ্যে তফাত্ বুঝে কাজ করা।
দুই. ঢালাও প্রশংসা অথবা ঢালাও নিন্দা না করা।
তিন. সরকারকে উপদেশ দেয়া এবং সমালোচনাও করা।
চার. প্রচুর পড়াশোনা ও ভ্রমণ করা।
এবং সিফার্টের মতো সাহসী, প্রতিবাদী ও আপসহীন হওয়া।
No comments