চট্টগ্রামে মাদকঃ মাদকের নিরাপত্তায় পুলিশ, খুচরা বিক্রেতাদের সহায়তায় আইনজীবী! by একরামুল হক ও প্রণব বল

ট্টগ্রামে মাদক পরিবহন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। আর আটক খুচরা বিক্রেতাদের জামিন পেতে নিয়মিত সহায়তা দিয়ে থাকেন কয়েকজন আইনজীবী। এর বাইরে নিয়মিত টাকার বিনিময়ে একাধিক স্থানীয় রাজনীতিক এবং বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা পায় মাদক ব্যবসায়ীরা।
গুরুতর সব অভিযোগ সত্ত্বেও চট্টগ্রামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রতিদিন গড়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম জেলা ও নগর পুলিশ এক হাজার ৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এদের মধ্যে বড় কোনো মাদক ব্যবসায়ী, নিয়ন্ত্রক বা তাদের পৃষ্ঠপোষক নেই। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা মূলত মাদক বহনকারী ও মাদকসেবী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ছয়-সাত হাত ঘুরে মাদক যায় খুচরা বিক্রেতা ও মাদকসেবীর কাছে। এ কারণে মূল হোতারা ধরা পড়ে না।
তবে চট্টগ্রাম কারাগারে মাদক আইনে বন্দী অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় অপরাধী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা না পেলে যেকোনো এলাকায় মাদক ব্যবসা করা কঠিন। এ ছাড়া একাধিক রাজনীতিক, কয়েকজন আইনজীবী এমনকি কয়েকজন সাংবাদিকও চট্টগ্রামে মাদক ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আসছেন বলে দাবি করেছে তারা। সম্প্রতি আদালত প্রাঙ্গণে কথা বললে আসামিরা এই প্রতিবেদককে বলে, পুলিশ বেছে বেছে কেবল দুর্বল লোকজনকে আসামি করে এবং গ্রেপ্তার করে।
জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, যাদের কাছে মাদক পাওয়া যায় তাদেরকে পুলিশ ধরছে। এরপর তদন্তে যাদের নাম আসছে, তারাও ধরা পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাদক উদ্ধার ও গ্রেপ্তারে পুলিশের সাফল্য বেশি বলে দাবি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. সগির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত আগস্ট মাসে ৪১৭, সেপ্টেম্বর মাসে ৩০২ ও অক্টোবর মাসে ৩৬৭ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. জুলফিকার আলী মজুমদার বলেন, মাদকের যে বিস্তার ঘটছে, তা অস্বীকার করা যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালীদের মদদ ছাড়া মাদক ব্যবসার বিস্তার সম্ভব নয়। অনেকের নামও শোনা যায়। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া তাদের নাম আমরা বলতে চাই না।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (গোয়েন্দা) এ কে এম শওকত ইসলাম বলেন, ‘আমার ১৪ বছরের কর্মজীবনে অনেক চেষ্টা করেও গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে কোনো গডফাদারের নাম বের করতে পারিনি। কারণ, খুচরা বিক্রেতারা মাদক মাফিয়াদের চেনেই না। ওরা বলবে কোত্থেকে?’
মামলা চালান নির্দিষ্ট আইনজীবী: চট্টগ্রাম আদালতের তিন-চারজন আইনজীবী মাদকসংক্রান্ত বেশির ভাগ মামলা পরিচালনা করেন। মাদক আইনের মামলার একাধিক আসামি প্রথম আলোকে তাঁদের আইনজীবী হিসেবে শিব শঙ্কর দাশগুপ্তের নাম বলেছেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিব শঙ্কর বলেন, ‘আসলে শর্ষের মধ্যে ভূত আছে। এই ভূত না তাড়ালে মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’ তিনি দাবি করেন, ‘পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্য ছাড়া মাদকের ব্যবসা চলতে পারে না।’ নির্দিষ্ট কারও নাম বলবেন কি না—জানতে চাইলে শিব শঙ্কর বলেন, ‘আমাদের মক্কেলদের (আসামি) সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা ওদের নাম-ঠিকানা বলে দেবেন।’
মাদক আইনের মামলার আরেক আসামির আইনজীবী মানিক দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তদন্তের গভীরে গেলে মূল হোতাদের নাম উদ্ঘাটন সম্ভব। আমাদের মক্কেলরা খুচরা বিক্রেতা কিংবা সেবনকারী। তারা জীবননাশের আশঙ্কায় মূল হোতাদের নাম বলে না।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, মূল হোতারা তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতাদের জামিনে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে।
মূল ব্যবসায়ীদের কারও মামলা পরিচালনা করেছেন কি না বা কাউকে চেনেন কি না—জানতে চাইলে মানিক দত্ত বলেন, ‘পুলিশ তদন্ত করলেই নাম বের করা সম্ভব। আমাদের মক্কেলরা ওদের নাম বলে না।’
জড়িত পুলিশ: চট্টগ্রাম কারাগারের বন্দী মাদক মামলার আসামি মোহাম্মদ মাসুমের বাড়ি নগরের এনায়েতবাজার এলাকায়। গত ১২ রমজানে তিনি গ্রেপ্তার হন। কারাগার থেকে আদালতে যাতায়াতের সময় গত ২৮ আগস্ট তাঁর শরীর তল্লাশি করে কারারক্ষীরা ২৬টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে।
মাসুম দাবি করেন, নগরের এনায়েতবাজার, গোয়ালপাড়া, জামতলী বস্তি, বিআরটিসি ও স্টেশন রোডে প্রতিদিন মাদকের হাট বসে। এ জায়গায় ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা বড়ি ও হেরোইন পাওয়া যায়।
মোহাম্মদ মাসুম আদালত ভবনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মাদক ব্যবহারকারী। পুলিশ আমাদের ধরে। মূল ব্যবসায়ীদের ধরে না।’ কেন ধরে না জানতে চাইলে মাসুম বলেন, ‘কোতোয়ালি থানার এসআই হারুন ওদের কাছ থেকে মাসোহারা নেন। টাকা পেলে পুলিশ কেন তাদের ধরবে?’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই হারুন অর রশিদ বলেন, ‘১০ মাসে আমি স্টেশন রোড, জামতলী বস্তি, এনায়েতবাজারসহ আশপাশের এলাকা থেকে ৩২-৩৩ জন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছি। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পাঁচ-ছয়টি করে মামলা হয়েছে। যে ব্যক্তি আমার নাম বলেছে, তাকেও নিশ্চয়ই আমি গ্রেপ্তার করেছি। নইলে আমার নাম বলবে কেন? আসলে আমি মাদক ব্যবসায়ীদের রোষানলে পড়েছি, যা আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানেন।’
জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, হারুনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সঠিক নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে কেউ অভিযানকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১৬ মার্চ ৯৯০ বোতল ফেনসিডিলসহ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে হীরা (২৮) নামের এক যুবককে পুলিশ নগরের ওয়াসার মোড় থেকে গ্রেপ্তার করে। আদালত ওই ফেনসিডিল ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কোতোয়ালি থানার পুলিশ তা ধ্বংস না করে বাইরে বিক্রি করে দেয়।
এ বিষয়ে পুলিশের উপকমিশনার (সদর) ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ফেনসিডিল বাইরে পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই দারোগার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। শাস্তির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আমরা পুলিশ সদর দপ্তরে সুপারিশ পাঠিয়েছি।’
২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর জব্দ করা ফেনসিডিলের একটা অংশ গায়েবের অভিযোগে পাহাড়তলী থানার পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আসলাম সিকদার সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।
মাদকের নিরাপত্তায় কারা: মাদকের বিভিন্ন মামলার বেশ কয়েকজন আসামির দাবি, মাদক পরিবহন ও বিক্রির সময় একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তা একধরনের নিরাপত্তা দেন। আর খুচরা পর্যায়ে সরবরাহের সময় পাহারার দায়িত্বে থাকে এলাকার সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, কদমতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল এবং শুভপুর বাসস্ট্যান্ড ঘিরেই মাদকের মূল ব্যবসা বলে জানানো হয়। এসব জায়গা থেকেই নগরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মাদক।
ধরা পড়া খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, মাদক ব্যবসায় কয়েক স্তরের পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে। একটি স্তরের দায়িত্বে থাকেন পুলিশের কিছু সদস্য। বিশেষ করে, কুমিল্লা ও ফেনীর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে রেলে পরিবহনের সময় পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত জুনের প্রথম সপ্তাহে গ্রেপ্তার হওয়া মাদক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউসুফ এবং পাচারকাজের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নয়নও এমন তথ্য পুলিশ ও সাংবাদিকের সামনে প্রকাশ করে।
গত জুন মাসে ডবলমুরিং থানা পুলিশের কাছে মাদক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নয়ন দাবি করেছিল, একাধিক রাজনীতিবিদের পাশাপাশি তিনটি সংবাদপত্রের তিন সাংবাদিক এবং ঢাকার একটি দৈনিকের এক আলোকচিত্রীকেও নিয়মিত টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে দুজন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীকে নগদ টাকার সঙ্গে ফেনসিডিলও দিতে হয়। নিজেই এই টাকা সরবরাহ করে বলে নয়নের দাবি।
মোহাম্মদ নয়ন তখন দাবি করেছিল, চট্টগ্রাম বিএনপির সাবেক এক নেতার ব্যক্তিগত সহকারীকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা দিতে হয়। কোনো মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ওই সহকারী আসামিদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম বলেন, ‘সব দোষ পুলিশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আইনজীবীদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? তাঁরা মাদক মামলা পরিচালনা বন্ধ করলেই তো মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

No comments

Powered by Blogger.