ক্রসফায়ার নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগঃ দেশের মানুষ গণতন্ত্র নিয়েই উদ্বিগ্ন
আওয়ামী মহাজোট সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর ঘটনায় বিদেশিরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক দূতদের কাছে অনেকটা জবাবদিহির মতো করেই প্রধানমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত কাজের বিরোধিতা করেছেন এবং মানবাধিকার লগ্ধঘনের ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীও একই ধরনের কথা বলেছেন।
ক্ষমতাসীনদের মুখের এসব কথার সঙ্গে দেশের বাস্তব অবস্থার যে বিন্দুমাত্র মিল নেই সেটা দেশবাসী যেমন জানে, তেমনি মিডিয়ার কল্যাণে বিদেশিদেরও অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও সরকারপ্রধানসহ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বক্তব্যের কার্যকারিতা দেখার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করা যেতেই পারে। কারণ বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। সন্ত্রাসীদের খুনখারাবিতে আতঙ্কিত মানুষের যখন থানা-পুলিশি ব্যবস্থার ওপর থেকে ভরসা কমে আসছিল, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গঠিত হয়েছিল এলিট ফোর্স—র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব। সময়টি ছিল বিএনপি জোট সরকারের আমল। র্যাবের অভিযানে সন্ত্রাসীরা ধরা পড়তে শুরু করল, অনেকেই আটক অবস্থায় অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার সময় গোলাগুলিতে মারাও গেল। এসব নিয়ে নানা কথা উঠতে থাকলেও ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা এভাবেই শুরু হয়েছিল। সে সময় মানুষ কিছুটা স্বস্তিই পেয়েছিল আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের নিধনে। মানুষ অনেকটা নিরাপদ বোধ করেছিল। তখন উত্থাপিত মানবাধিকার লগ্ধঘনের অভিযোগ তেমন গুরুত্ব পায়নি সাধারণ মানুষের কাছে। তবে স্বাভাবিক আইন-শৃগ্ধখলার অবনতির প্রেক্ষিতেই যে এই বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল সেটি অস্বীকার করা যাবে না এবং এটা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবেই ধরে নেয়া হয়েছিল। কিছু কিছু বিষয়ের মতোই স্বাভাবিকতার ওপর অস্বাভাবিকতাই যে মাঝেমধ্যে স্থায়ীভাবে চেপে বসে ক্রসফায়ারের ব্যাপারটিও তেমনই হয়ে উঠেছে। শুরুতে যারা এর বিরোধিতায় সোচ্চার ছিল তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মধ্য-বাম ঘরানার জোট সরকার গঠনের পর কথাটি ভুলে গেছে বলেই মনে হয়। তারাও সাবেক সরকারের পথকেই পছন্দ করছে। পতিত স্বৈরাচারী এরশাদ মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক হিসেবে প্রকাশ্যেই ক্রসফায়ারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সরকার নিরুপায় হয়েই ক্রসফায়ার করছে বলে তিনি যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা শুধু হাস্যকর বা নির্বোধের মতো বলাটা কম বলা হয়। ৩০ লাখ লোকের শান্তির জন্য যদি একশ’ সন্ত্রাসীকে কিছু করা হয়, তাহলে তা বোধহয় খারাপ নয়—এরকম কথা যে বলে তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগাই স্বাভাবিক। তিনি অবশ্যই দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনকানুন ভুলে গেছেন। অবশ্য তার স্বৈরাচারী শক্তিতে দীর্ঘদিন দেশ শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখলে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু যখন খোদ আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরাও ক্রসফায়ার ছাড়া আইন-শৃগ্ধখলা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয় জাতীয় মন্তব্য করেন তখন বিস্ময়ের বাকি থাকে না। এ থেকে অবশ্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যের দাবিদার, স্বাধীন বাংলাদেশ ও সংবিধান রচনায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দলটির স্বরূপই নতুন করে উন্মোচিত হয়। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই গণতন্ত্র হত্যা ও সংবিধানের চরিত্র হননের ঘটনা মানুষ কীভাবে ভুলে যাবে! বঙ্গবন্ব্দুর আমলেই যে এসবের সূচনা সে কথা কে না জানে। এখন তার কন্যার শাসনামলেও সেসব সমানতালে চলছে। রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার তুলনায় আজকের ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর ঘটনা সহনীয়ই বটে। কিন্তু বিদেশি শক্তির প্রতিনিধিদের কাছে সত্য স্বীকারের বিপদ থেকেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি মানুষের আইনি সহায়তা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে তাদের জানিয়েছেন। সংবিধানেও এমনটাই উল্লেখ রয়েছে। এসবের প্রতিফলন কি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে? তাহলে কেন প্রতিনিয়ত ক্রসফায়ারে ক্রমবর্ধমান হারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে! সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী বলে যাদের গুলি করে মারা হচ্ছে তারা কি সংবিধানমতে আইন ও বিচার লাভের অধিকারের বাইরে? আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার কথা বলে গুলি করে মানুষ মারার পক্ষে যারা খোঁড়া যুক্তি তোলেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন জাগে। তারা কি আদৌ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রপন্থী? এ প্রশ্ন এখন মহাজোট সরকার সম্পর্কেই উঠতে শুরু করেছে। মাত্র দশ মাসের সরকার সম্পর্কে মানুষের মনে এরকম ধারণা বিপজ্জনকই বটে।
No comments