হিমাগারের ৯ লাখ টন আলু নিয়ে বিপাকে জয়পুরহাটের কৃষক by আলমগীর চৌধুরী,

ক্রমাগত মূল্যপতনের পাশাপাশি বাজারে চাহিদা না থাকায় হিমাগারে সংরক্ষিত আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জয়পুরহাটের কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা। সংরক্ষণের প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেলেও লোকসানের কারণে তাঁরা হিমাগার থেকে আলু সংগ্রহ না-করায় জেলার ১৩টি হিমাগারে এখনো আলুর মজুদ রয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন। হিমাগার মালিকদের আশঙ্কা, অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে সময়মতো হিমাগার খালি করা সম্ভব হবে না। এতে আগামী মৌসুমে আলু উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অনুকূল আবহাওয়া আর সারের মূল্য কম থাকায় বিগত আলু মৌসুমে জেলায় আলু উৎপাদন হয় ৯ লাখ ২২ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ টন বেশি। উৎপাদন বেশি হলেও ভরা মৌসুমে আলু (গ্যানোলা জাতের) মণপ্রতি বিক্রি হয়, সর্বোচ্চ ১০০ টাকা আর ডায়মন্ড, কার্ডিনালসহ অন্যান্য জাতের আলু বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মণ দরে। ফলে আশাতীত মুল্য না পেয়ে অধিক মুনাফার আশায় কৃষকরা আলু সংরক্ষণে ঝুঁকে পড়ে স্থানীয় হিমাগারগুলোয়। সে সময় আলুর ক্রমাগত মূল্যপতনে কৃষকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও মুনাফা লাভে আলু সংরক্ষণ করে জেলার বিভিন্ন হিমাগারে। ফলে সংরক্ষণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ নেন হিমাগারের মালিকরা। গত মৌসুমে বস্তাপ্রতি (৮৪ কেজি) হিমাগার ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হলেও এ মৌসুমে দাম বাড়িয়ে তা করা হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। ভাড়া বেশি হলেও চাহিদার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই জেলার ১৩টি হিমাগারই চাহিদার অতিরিক্ত আলু সংরক্ষণ সম্পন্ন করে। জেলার ১৩টি হিমাগারে আলুর সংরক্ষণ ক্ষমতা এক লাখ সাড়ে তিন শ টন হলেও কৃষকদের অনুরোধে আলু সংরক্ষণ করা হয় এক লাখ ১০ হাজার টন। চুক্তি অনুযায়ী মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করার নিয়ম থাকলেও প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই হিমাগারের ৪০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়। কিন্তু এবার মূল্য ও চাহিদা কম থাকায় কৃষকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও আলু সংগ্রহে হিমাগারে আসছেন না। ফলে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আলু সরবরাহ করতে পারছেন না। বর্তমানে জেলার প্রতিটি হিমাগারেই এখনো মজুদ রয়েছে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আলু। এ অবস্থায় আগামী দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে এসব আলু হিমাগার থেকে বিক্রি করা আদৌ সম্ভব হবে কি-না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন হিমাগারের মালিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার কালাই উপজেলার মোলামগাড়িহাট নর্থপোল কোল্ডস্টোরেজের ধারণক্ষমতা এক লাখ পাঁচ হাজার বস্তা হলেও ব্যাপক চাহিদার কারণে এ বছর আলু সংরক্ষণ করা হয় এক লাখ ৩৫ হাজার বস্তা। গত মৌসুমে এ সময় হিমাগার থেকে প্রায় ৪০ হাজার বস্তা আলু বের হলেও এ বছর সেখানে বেরিয়েছে মাত্র ১৫ হাজার বস্তা। একই অবস্থা ক্ষেতলাল উপজেলার ভাশিলা মোল্লা কোল্ডস্টোরেজ, বটতলীর হিমাদ্রি, বৈরাগীহাটের সাউথপোল হিমাগার, নিশ্চিন্তার পল্লী হিমাগার, পুনট কোল্ডস্টোরেজসহ জেলার প্রায় সব হিমাগারেরই। এ সময় যেখানে প্রতিটি হিমাগারে আলু কেনাবেচার সমারোহ থাকার কথা, সেখানে দাম না থাকায় কোনো হিমাগারেই আশাতীত কৃষক বা ব্যবসায়ী আলু কেনাবেচা করতে আসছেন না। আর দিন যতই গড়াচ্ছে, আলুর দাম ততই কমছে।
আগস্টে যেখানে এক বস্তা গ্যানোলা আলু বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬০০ টাকায়, এখন সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকায়; তাও আবার ক্রেতাই মিলছে না। একইভাবে কার্ডিনাল ৭০০ টাকার স্থলে ৫০০, ডায়মন্ড ৬৫০ টাকার পরিবর্তে ৪৬০ এবং গুটি আলু এক হাজার ১০০ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়। বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হিমাগার ভাড়া দিয়ে বর্তমান মূল্যে আলু বিক্রি করে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছেন ২০০-৩০০ টাকা।
কালাই উপজেলার করিমপুর গ্রামের আলু ব্যবসায়ী শেখ মজিবর রহমান বাবু জানান, এ বছর তিনি সাত লাখ টাকার আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেছেন। বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা লোকসান দিয়েও বর্তমানে তা বিক্রি করতে পারছেন না। ক্ষেতলালের শিশি নাজিরপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল মোমিন জানান, প্রায় দেড় মাস আগে বস্তাপ্রতি ৭৭০ টাকা দরে ২৬০ বস্তা আলু কিনে বর্তমানে তা বিক্রি করেছেন ৪৩০ টাকা দরে। এতে তাঁর মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান হলেও দাম কমতে থাকায় তিনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। কালাই উপজেলার মোলামগাড়ির কৃষক আবদুল বারিক জানান, ১০ বিঘা জমি চাষ করে উৎপাদিত আলু হিমাগারে রেখে এবার তাঁর লোকসান হয়েছে বস্তাপ্রতি ১৫০ টাকা। গতবারে সারের দাম কম থাকায় উৎপাদন খরচ ছিল কিছুটা কম; কিন্তু এবার সারের মূল্য বেশি হওয়ায় আলুর উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি। সেই হিসাবে বারবার লোকসান হলে কৃষকরা বাঁচবে কিভাবে।
একই অভিযোগ করলেন, কালাইয়ের কাদিরপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম, ক্ষেতলালের শাখারুঞ্জ গ্রামের ফরিদ উদ্দিন, মহব্বত চৌধূরী, মুন্দাইল গ্রামের সালাউদ্দিন আহম্মেদ, মাঝহারুল ইসলাম, ইটাখোলা গ্রামের নয়ন চৌধুরীসহ শতাধিক কৃষক। তাঁদের দাবি, বিভিন্ন কল-কারখানার মাধ্যমে সরকার যদি ভবিষ্যতে আলুর বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিদেশি আলু রপ্তানির ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে না দেয়, তাহলে অব্যাহত লোকসানের কারণে আলু উৎপাদনে কৃষকরা তাঁদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। মোলামগাড়ী নর্থপোল কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, 'এ বছর তাঁদের হিমাগারে এক লাখ ৪০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছেন এলাকার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। গত বছর এ মৌসুমে যেখানে সংরক্ষণের প্রায় অর্ধেক আলু হিমাগার থেকে বিক্রি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সেখানে এ বছর কেউ আলুই বিক্রি বা কিনতে আসছেন না। এমনকি হিমাগার খালি করার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মিলছে না। এ অবস্থায় তাঁরা হিমাগারভর্তি আলু নিয়ে খুব বিপদে আছেন।' 

No comments

Powered by Blogger.