রাজনীতির হাত ধরে বদলাচ্ছে রাজধানী by সামসুল ওয়ারেস
কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতি, ভাবমূর্তিসহ সার্বিক অবস্থা নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ওপর। আর এসব বিষয় এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের পার্থক্য সৃষ্টি করে। প্রতিটি জনপদ যা রাষ্ট্রের মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, জীবনবোধ, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ধরন-ধারণের ওপর নির্ভর করে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে দার্শনিক এবং আধ্যাত্দি্মক অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তাভাবনা তাদের সমাজকে গোছাতেও নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
৪০০-৫০০ বছর আগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পশ্চিমা রাষ্ঠ্রগুলো রেনেসাঁ অর্থাৎ নবজাগরণের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্য রাষ্ঠ্রগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে যায়। এ রেনেসাঁর প্রভাবে ইউরোপিয়ানরা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে জীবনযাপনে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আধুনিকতার পথে ধাবিত হয়। আজ থেকে ২৫০ বছর আগের শিল্প বিপ্লব তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। ফলে যন্ত্র এবং প্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক সভ্যতার বিকাশ হয়। এরই পথ ধরে আবার একটি ঔপনিবেশিক পৃথিবীর সৃষ্ঠ হয়। এ সময় পশ্চিমা উন্নত রাষ্ঠ্রগুলো পৃথিবীর অনুন্নত রাষ্ঠ্রগুলোকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। উপনিবেশগুলোর সম্পদ তারা নিজ দেশে নিয়ে যায় এবং এখানকার মানুষদের তারা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা সবকিছুতেই পশ্চিমা সভ্যতার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। এভাবেই প্রথম দিকের আধুনিক পৃথিবী গড়ে ওঠে।
উপনিবেশিক শাসনের এক পর্যায়ে ব্রিটিশরা বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কাজ শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের শাসন কাজে সহায়তার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে করা ছিল যাতে শিক্ষিত শ্রেণী শাসকগোষ্ঠীকে সমীহ করে চলে। এরই ধারাবাহিকতায় এ সময়ও আমাদের সমাজে একটি সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণীর দেখা মেলে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে উন্নয়ন কাজে শামিল হয়। তবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ ও এখানকার মানুষের প্রতি শোষণ-নিপীড়নের কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয় হয়। অবশ্য এজন্য এ দেশের মানুষকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম প্রকৃত স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ঠ্রীয় উন্নয়নের সুযোগ পায়।
তবে আমাদের নবজাগরণের যে ধারা তার সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসনকালেই। এ ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মানুষের জন্য ছিল একটি বড় ঘটনা। ফলে এখানকার মানুষের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম হয়। অনেক শিক্ষিত এবং জ্ঞানী-গুণী সৃষ্টির সূতিকাগারে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাৎকালীন পূর্ববাংলার অনেক শিক্ষিত বাঙালি বিশেষ বিশেষক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সুনাম অর্জন করে। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার অল্পকালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের মানুষের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ নোভেল পুরস্কার পায়নি। গত ২ হাজার বছরের যে সভ্যতার বিকাশ তাতে আমাদের অবদান একেবারে নিচের দিকে। সামান্য যেটুকু আছে তা বৃহৎ পরিসরে বলার মতো কোনো বিষয় নয়। পরাধীন অবস্থার মধ্যে আমাদের মতো বাঙালি হয়ে রবীন্দ্রনাথ নোভেল পুরস্কার পেলেন। কিন্তু আজকে আমরা ওই অবস্থারও পেছনে চলে গেছি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষিতা, স্বার্থপরতা এবং সম্পদ পুঁজি করার সাধারণ মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে কিছু অসৎ রাজনীতিবিদের ২০-৩০ বছরে নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন তা আমাদের সমগ্র জাতিকে পেছনের দিকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। ২৫ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় লোক দুর্নীতির বিষয়টি শিখে নিয়েছে। পাকিস্তান মানসিকতার এসব লোক আজ রাজনীতিতে কোলো টাকা, পেশিশক্তি আর দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটিয়েছে। আর এসবের দাপটে সাধারণ মানুষের কল্যাণে যারা রাজনীতি করে বা করতে চায় তারা পিছিয়ে পড়ছে। জনকল্যাণমূলক রাজনীতিতে মূলত নেতৃত্ব দিয়েছে বামপন্থিরা। কিন্তু ডানপন্থিদের দাপটে তারা অনেকটা কোণঠাসা। ডান রাজনীতি সবসময়ই একটি বিত্তশালী শ্রেণীর পক্ষে কাজ করে। এ কারণেই ডানপন্থিরা ক্ষমতায় এসে যায়। দেশের গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে সবকিছু চরমভাবে পরির্বতন করে, যাতে তাদের পক্ষে সুবিধা হয়। আমাদের শুরুটা কিন্তু ছিল অনেকটা সমাজতান্ত্রিক একটি গঠনতন্ত্র নিয়ে। এ গঠনতনে্পর ৪টি মৌলিক বিষয়ের দুটিকে অর্থাৎ সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজনের ফলে একটি বিশেষ ধর্মের জন্য গঠনতন্ত্র কিছুটা পক্ষপাতিত্ব করছে, যা আমরা প্রথম দিকে চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ হলেও এটি হবে সতি্যকারের একটি সুন্দর দেশ। মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকাররা ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই চেয়েছিল এটি এমন একটি দেশ হবে, যেখানে মানবতাই হবে সবচেয়ে বড় ধর্ম। যেখানে সবাই সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার পাবে। এ ধরনের পদক্ষেপে প্রথম শহৃন্যতা সৃষ্টি হলো মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে রাজাকাররা আমাদের বদুিব্দজীবীদের মেরে ফেললে। এ বদুিব্দজীবী ঘাটতি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ শহৃন্যতার কারণে কিছু স্বার্থাল্পে্বষী দুর্বৃত্ত এদেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। এসব দুর্বৃত্ত রাজনীতিকে ব্যক্তিগত উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে বিভিন্ন দুর্ভোগ নেমে এসেছে। তবে সাধারণ মানুষ ক্রমেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ওপর খেপে উঠছে। আশা করা যায়, গণমানুষের আন্দোলনেই একদিন অস্থির সময়ের অবসান হবে এবং আমাদের রাজনীতিতে একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকষরাউর এ সময়টিতে পৃথিবীর সব জায়গায় সভ্যতা অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পার্থক্যটা রয়ে গেছে। ধরা যাক, সব মানুষই আজকাল বিয়ে করে ঘরসংসার করে। কিন্তু বিয়ে করার রীতি কিন্তু সব জায়গায় এক নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে মেয়েদের বিয়ের পোশাক হলো_ সাদা আর আমাদের দেশে লাল। আবার আমাদের দেশের বিধবারা এক সময় সাদা পোশাক পরতেন (এখনো অনেকে এ নিয়ম পালন করেন)। সভ্যতার দিক থেকে একই হলেও রঙের ভিন্নতার কারণে তফাতটা থেকে যাচ্ছে সংস্কৃতিতে। আমাদের মননের নিজস্বতা ফুটে উঠে আমাদের সংস্কৃতি দিয়েই। আবার রাজনৈতিকভাবেও ধরা যায় পৃথিবীর সর্বত্র মোটামুটি গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র_ এ দু'ধরনের শাসনব্যবস্থা চলছে। এভাবে সভ্যতার সবগুলো বিষয় একই রকম যা কাছাকাছি। তবে সংস্কৃতির ভিন্নতার প্রধান মাধ্যম হলো একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-্টীপ এবং সমতলভূমি। ভারত থেকে আসা ৪২টি নদী এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। র্বষাকালে এসব নদী হিমালয় থেকে পানি বয়ে নিয়ে এসে আমাদের এখানে বন্যার সৃষ্টি করে, যা এক-দুই মাস ধরে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালের আগে আমাদের জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। জামা-কাপড় কম লাগত। একটি ঘড়ি, একটি কলম দিয়ে জীবন চলে যেত। কিন্তু র্বতমান জীবনধারা সম্পূর্ণ বিপরীত। পশ্চিমারা তাদের ব্যবসায়িক পলিসির কারণে আমাদের মধ্যে অপচয়বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ঠ হচ্ছে। হঠাৎ করেই আমাদের এখানে ৯-১০টি টিভি চ্যানেল হয়ে গেল। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারণে। এটা দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বা সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য হয়নি। ফলে বেশকিছু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এগুলো আমাদের সমাজের জন্য দরকার কিনা তা ভাবা হয়নি। অন্যদিকে খুব কম সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল হয়েছে। এগুলো করার সময় তেমন কোনো সরকারি নীতিমালা ছিল না। ইদানীং আমরা যে শিক্ষানীতি পেয়েছি তাতে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করা হয়েছে। এ নীতি ধনীদের জন্য অনুকূল হলেও দরিদ্রদের জন্য প্রতিকূল। এ বৈষম্রাজ্যের কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা শুধু ধনী শ্রেণীই ভোগ করছে। তবে আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ লোকই অল্পতেই সন্তুষ্ঠ থাকে। তারা লোভী নয় এবং তাদের মধ্যে আছে সাম্যবাদী জীবনধারার ছাপ। এ গুণটি অনেক দেশের মানুষের মধ্যে নেই। আশা করা যায় সুস্থ-সুন্দর সমাজ গঠনে এ ব্যাপারটি বাংলাদেশের জন্য একটি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে কাজ করবে।
পাল শাসনামলে বেশিরভাগ বাঙালি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শ্রেণী বিভাজনের কারণে নিগৃহীত নিন্মবণরাউর হিন্দুরা সে সময় একটি প্রতিবাদ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেন আমলে আবার এটি একটি কট্টর হিন্দুপন্থি দেশে পরিণত হয়। এরপর আবার ইসলামের প্রচার শুরু হলে অত্যাচারিত নিন্মবণরাউর হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। র্বতমানে আমরা ওই রকম একটি আর্বতন লক্ষ্য করছি। এটি অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এরই অংশ হিসেবে আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন-শোষণ আর লুটপাটের রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম। আশা করা যায়, '৭১ সালের মতো আরেকটি প্রজন্ম উঠে আসবে, যারা এ সময়ের গণতান্ত্রিক স্টৈ্বরশাসন আর পারিবারিক নেতৃত্বকে বড় একটি ধাক্কা দিতে পারবে। এটি সম্পন্ন হলেই বাংলাদেশ খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে উঠতে পারবে। এক্ষেত্রে সুুবিধা হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামো আছে। আছে পর্যাপ্ত লোকবল। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সুন্দর আইন আছে যদিও তার অপপ্রয়োগ আছে। আর কিছু আইন যুগের চাহিদা অনুযায়ী পরির্বতন করা দরকার, যদিও তা করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমাদের শিল্পের একটি ভালো অবকাঠামো আছে। এ কারণেই কম সময়ের মধ্যে ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও শিক্ষকের কোনো সংকট হয়নি। তবে আমাদের এই অবকাঠামোকে নিজেদের স্বার্থে ধ্বংস করার চেষ্ঠায় আছে রাজনীতিকরা। নিন্ম মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মেধাবী ছাত্ররা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর বেতন বৃদ্ধি বা বেসরকারিকরণের ষড়যন্ত্র চলছে।
একটি আদর্শ শহরের জন্য দরকারি জিনিস হলো সুন্দর রাস্তাঘাট এবং পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। শহরটি থাকবে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এই যেমন_ আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা এবং অফিস-আদালতপাড়া। সবকিছুর সমল্প্বয় এমনভাবে হতে হবে, যাতে একজন মানুষ আধাঘণ্টা হাঁটলে স্কুল-কলেজ, বাসা, অফিস, হাসপাতাল, মসজিদের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পপৌঁছতে পারে। স্কুলগুলো এমন স্থানে হবে যাতে বাচ্চারা হেঁটে পপৌঁছুতে পারে এবং কোনো প্রধান সড়ক পার হতে না হয়। সব মিলিয়ে নগরবাসী সারাদিনের কাজকর্মে, আসা-যাওয়ায় এক ঘণ্টা হাঁটার সুযোগ পেলে তাদের স্বাস্টে্থ্যর জন্য তা ভালো হবে। একটি শহরে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং বিশদুব্দ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। থাকবে পরিকল্কিপ্পত পয়ঃনালার ব্যবস্থা। এসবের ব্যবস্থা না করে শুধু আকাশচুম্বী ভবন তৈরি করলেই হবে না। ঢাকার মূল সমস্যা '৭১-এর পর প্রচুর লোক ঢাকায় চলে আসে। প্রতিদিন যারা এ নগরে আসছে তারা আর ফেরত যাচ্ছে না। ফলে ঢাকার জনসংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। এজন্য ঢাকা শহরের মানুষদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি এবং পরিবহনসহ সবক্ষেত্রেই বিভিন্নভাবে নাজেহাল হয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে কেন এত লোক আসে সে কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া ঢাকাকে সবকিছুর কেন্দ্র না করে মূল কেন্দ্র করে আরো অনেক উপকেন্দ্র গড়তে হবে। তাহলে ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। দেখা যায় জার্মানির রাজধানী বালর্িন হলেও ওই শহরটি মূলত কালচারাল সেন্টার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। মিডিয়ার লোকজন থাকে কোলনে। কারণ সব ধরনের মিডিয়ার অফিস ওখানে। ফদ্ধাঙ্কফুর্ট হলো জার্মানির ব্যবসা কেন্দ্র। আমাদের এখানেও সবকিছুকে এ রকম বিভাজিত করতে হবে। এই যেমন_ ঢাকার ভেতরে ক্যান্টনমেন্ট থাকার কোন ািদরকার নেই। এরকম কেন্দ্রীয় জেলখানা, বিডিআর, ট্যানারিএগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া ঢাকার চাপ কমানোর জন্য এর আশপাশে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে টঙ্গী এবং সাভার দিয়ে শুরু করা যায়। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের সামরিক খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। অথচ যুদ্ধ বা দেশ দখলের কোনো উচ্চাশা আমাদের নেই। এজন্য সামরিক খাতে ব্যয় কমাতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর পরিসর আরো ছোট করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সবাই আর্মি হিসেবে কাজ করবে। '৭১ সালে যেমন সবাই যুদ্ধ করেছে।
এ শহরের পরিবেশ বাঁচাতে হলে দেশের দক্ষ দলপতিদের দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তবে পরিকল্পনা করলেই হবে না, এসব বাস্তবায়নে শাসকগোষ্ঠীর আন্তরিকতা থাকতে হবে। কারণ আমাদের রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুতে মনোযোগী হন না। যেমন ঢাকা শহরে ৪০০টি রাস্তা করার পরিকল্পনা আছে রাজউকের। এগুলো তৈরি হলে শহরের যানজট অনেকটা কমে যেত। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে আঘাত লাগে বলেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
হঠাৎই মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর উন্নত হয়ে গেল। এর পেছনে অবদান রেখেছেন ভালো কিছু রাজনৈতিক নেতা। মালয়েশিয়া পেছনে ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ এবং তার আগে টেঙ্কু আবদুর রহমানের মতো নেতা।
এমনকি মাহাথিরের সময়কার অর্থমন্ত্রীর স্ত্রী আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। এখন উল্টো আমাদের ছেলেরাই মালয়েশিয়ায় পড়তে যাচ্ছে।
এক সময় ঢাকা শহরে চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল খাল। আস্টেস্ন আস্টেস্ন সবকিছুতে রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। সে সময় ঢাকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সবুজ শহর। সে ঢাকা আজ কংক্রিটের মরুময়তায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রণীত আইনে ভবন তৈরির সময় নির্দিষ্ঠ পরিমাণ জায়গা খালি রাখতে বলা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে ঢাকার প্রকৃতির জন্য খুব ভালো হবে। এজন্য প্রয়োজন শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ইদানীং গার্মেন্টস কর্মীদের মালিকপক্ষের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের এখানে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক শাসক আর শোষিতের, সহযোগিতামূলক নয়। এজন্য অবশ্য মালিকপক্ষ দায়ী। এটা আমাদের শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে মূল সমস্যা হলো আমরা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এটাকে তাই শিল্প বলা চলে না। একটি শিল্পের ৮০ ভাগ দ্রব্য নিজেদের থাকতে হবে। এজন্য আমাদের কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে হবে। আমাদের উচ্চ শিক্ষিত কৃষিবিদদের কাজে লাগিয়ে এর বাস্তবায়নের পথ সুগম করা যাবে। তবে মূল কথা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আমাদের অনেক সম্ভাবনা নষ্ঠ করে দিচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে দমন-পীড়নের কাজে ব্যস্ত থাকে। দেশের উন্নয়নের কথা ভাবে না। র্বতমান সরকারের কথাই ধরা যাক। তারা দেশের উন্নতির বদলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব ধরনের নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ছে। আইন-আদালত ও পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এমনকি বদুিব্দজীবীদেরও তারা হেনস্তা করছে। শাহরিয়ার কবির বা মুনতাসির মামুনের মতো ব্যক্তিত্বদের যারা হয়রানি করতে পারে তাদের দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। অনেকে বলে আমাদের সম্পদ নেই। এটা ঠিক নয়। মানুষ আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যা অনেক দেশে নেই। এ মানবসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আছে নদী, মাছ, তেল, গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি। এগুলোর যথাযথ ব্যবহার আমাদের উন্নতির পথ সুগম করতে পারে। তেল-গ্যাস নিয়ে যে দেশের প্রধান দু'দলের নির্লজ্জ বিবাদ হয় সেদেশ উন্নতি করবে কীভাবে? বড় দু'দলের মতো সাধারণ মানুষ বাংলাদেশকে অন্দকারের দিকে যেতে দেবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষই এক সময় একটা ভালো রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়।
উপনিবেশিক শাসনের এক পর্যায়ে ব্রিটিশরা বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কাজ শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের শাসন কাজে সহায়তার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে করা ছিল যাতে শিক্ষিত শ্রেণী শাসকগোষ্ঠীকে সমীহ করে চলে। এরই ধারাবাহিকতায় এ সময়ও আমাদের সমাজে একটি সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণীর দেখা মেলে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে উন্নয়ন কাজে শামিল হয়। তবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ ও এখানকার মানুষের প্রতি শোষণ-নিপীড়নের কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয় হয়। অবশ্য এজন্য এ দেশের মানুষকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম প্রকৃত স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ঠ্রীয় উন্নয়নের সুযোগ পায়।
তবে আমাদের নবজাগরণের যে ধারা তার সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসনকালেই। এ ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মানুষের জন্য ছিল একটি বড় ঘটনা। ফলে এখানকার মানুষের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম হয়। অনেক শিক্ষিত এবং জ্ঞানী-গুণী সৃষ্টির সূতিকাগারে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাৎকালীন পূর্ববাংলার অনেক শিক্ষিত বাঙালি বিশেষ বিশেষক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সুনাম অর্জন করে। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার অল্পকালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের মানুষের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ নোভেল পুরস্কার পায়নি। গত ২ হাজার বছরের যে সভ্যতার বিকাশ তাতে আমাদের অবদান একেবারে নিচের দিকে। সামান্য যেটুকু আছে তা বৃহৎ পরিসরে বলার মতো কোনো বিষয় নয়। পরাধীন অবস্থার মধ্যে আমাদের মতো বাঙালি হয়ে রবীন্দ্রনাথ নোভেল পুরস্কার পেলেন। কিন্তু আজকে আমরা ওই অবস্থারও পেছনে চলে গেছি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষিতা, স্বার্থপরতা এবং সম্পদ পুঁজি করার সাধারণ মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে কিছু অসৎ রাজনীতিবিদের ২০-৩০ বছরে নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন তা আমাদের সমগ্র জাতিকে পেছনের দিকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। ২৫ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় লোক দুর্নীতির বিষয়টি শিখে নিয়েছে। পাকিস্তান মানসিকতার এসব লোক আজ রাজনীতিতে কোলো টাকা, পেশিশক্তি আর দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটিয়েছে। আর এসবের দাপটে সাধারণ মানুষের কল্যাণে যারা রাজনীতি করে বা করতে চায় তারা পিছিয়ে পড়ছে। জনকল্যাণমূলক রাজনীতিতে মূলত নেতৃত্ব দিয়েছে বামপন্থিরা। কিন্তু ডানপন্থিদের দাপটে তারা অনেকটা কোণঠাসা। ডান রাজনীতি সবসময়ই একটি বিত্তশালী শ্রেণীর পক্ষে কাজ করে। এ কারণেই ডানপন্থিরা ক্ষমতায় এসে যায়। দেশের গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে সবকিছু চরমভাবে পরির্বতন করে, যাতে তাদের পক্ষে সুবিধা হয়। আমাদের শুরুটা কিন্তু ছিল অনেকটা সমাজতান্ত্রিক একটি গঠনতন্ত্র নিয়ে। এ গঠনতনে্পর ৪টি মৌলিক বিষয়ের দুটিকে অর্থাৎ সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজনের ফলে একটি বিশেষ ধর্মের জন্য গঠনতন্ত্র কিছুটা পক্ষপাতিত্ব করছে, যা আমরা প্রথম দিকে চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ হলেও এটি হবে সতি্যকারের একটি সুন্দর দেশ। মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকাররা ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই চেয়েছিল এটি এমন একটি দেশ হবে, যেখানে মানবতাই হবে সবচেয়ে বড় ধর্ম। যেখানে সবাই সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার পাবে। এ ধরনের পদক্ষেপে প্রথম শহৃন্যতা সৃষ্টি হলো মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে রাজাকাররা আমাদের বদুিব্দজীবীদের মেরে ফেললে। এ বদুিব্দজীবী ঘাটতি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ শহৃন্যতার কারণে কিছু স্বার্থাল্পে্বষী দুর্বৃত্ত এদেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। এসব দুর্বৃত্ত রাজনীতিকে ব্যক্তিগত উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে বিভিন্ন দুর্ভোগ নেমে এসেছে। তবে সাধারণ মানুষ ক্রমেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ওপর খেপে উঠছে। আশা করা যায়, গণমানুষের আন্দোলনেই একদিন অস্থির সময়ের অবসান হবে এবং আমাদের রাজনীতিতে একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকষরাউর এ সময়টিতে পৃথিবীর সব জায়গায় সভ্যতা অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পার্থক্যটা রয়ে গেছে। ধরা যাক, সব মানুষই আজকাল বিয়ে করে ঘরসংসার করে। কিন্তু বিয়ে করার রীতি কিন্তু সব জায়গায় এক নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে মেয়েদের বিয়ের পোশাক হলো_ সাদা আর আমাদের দেশে লাল। আবার আমাদের দেশের বিধবারা এক সময় সাদা পোশাক পরতেন (এখনো অনেকে এ নিয়ম পালন করেন)। সভ্যতার দিক থেকে একই হলেও রঙের ভিন্নতার কারণে তফাতটা থেকে যাচ্ছে সংস্কৃতিতে। আমাদের মননের নিজস্বতা ফুটে উঠে আমাদের সংস্কৃতি দিয়েই। আবার রাজনৈতিকভাবেও ধরা যায় পৃথিবীর সর্বত্র মোটামুটি গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র_ এ দু'ধরনের শাসনব্যবস্থা চলছে। এভাবে সভ্যতার সবগুলো বিষয় একই রকম যা কাছাকাছি। তবে সংস্কৃতির ভিন্নতার প্রধান মাধ্যম হলো একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-্টীপ এবং সমতলভূমি। ভারত থেকে আসা ৪২টি নদী এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। র্বষাকালে এসব নদী হিমালয় থেকে পানি বয়ে নিয়ে এসে আমাদের এখানে বন্যার সৃষ্টি করে, যা এক-দুই মাস ধরে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালের আগে আমাদের জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। জামা-কাপড় কম লাগত। একটি ঘড়ি, একটি কলম দিয়ে জীবন চলে যেত। কিন্তু র্বতমান জীবনধারা সম্পূর্ণ বিপরীত। পশ্চিমারা তাদের ব্যবসায়িক পলিসির কারণে আমাদের মধ্যে অপচয়বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ঠ হচ্ছে। হঠাৎ করেই আমাদের এখানে ৯-১০টি টিভি চ্যানেল হয়ে গেল। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারণে। এটা দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বা সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য হয়নি। ফলে বেশকিছু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এগুলো আমাদের সমাজের জন্য দরকার কিনা তা ভাবা হয়নি। অন্যদিকে খুব কম সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল হয়েছে। এগুলো করার সময় তেমন কোনো সরকারি নীতিমালা ছিল না। ইদানীং আমরা যে শিক্ষানীতি পেয়েছি তাতে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করা হয়েছে। এ নীতি ধনীদের জন্য অনুকূল হলেও দরিদ্রদের জন্য প্রতিকূল। এ বৈষম্রাজ্যের কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা শুধু ধনী শ্রেণীই ভোগ করছে। তবে আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ লোকই অল্পতেই সন্তুষ্ঠ থাকে। তারা লোভী নয় এবং তাদের মধ্যে আছে সাম্যবাদী জীবনধারার ছাপ। এ গুণটি অনেক দেশের মানুষের মধ্যে নেই। আশা করা যায় সুস্থ-সুন্দর সমাজ গঠনে এ ব্যাপারটি বাংলাদেশের জন্য একটি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে কাজ করবে।
পাল শাসনামলে বেশিরভাগ বাঙালি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শ্রেণী বিভাজনের কারণে নিগৃহীত নিন্মবণরাউর হিন্দুরা সে সময় একটি প্রতিবাদ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেন আমলে আবার এটি একটি কট্টর হিন্দুপন্থি দেশে পরিণত হয়। এরপর আবার ইসলামের প্রচার শুরু হলে অত্যাচারিত নিন্মবণরাউর হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। র্বতমানে আমরা ওই রকম একটি আর্বতন লক্ষ্য করছি। এটি অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এরই অংশ হিসেবে আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন-শোষণ আর লুটপাটের রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম। আশা করা যায়, '৭১ সালের মতো আরেকটি প্রজন্ম উঠে আসবে, যারা এ সময়ের গণতান্ত্রিক স্টৈ্বরশাসন আর পারিবারিক নেতৃত্বকে বড় একটি ধাক্কা দিতে পারবে। এটি সম্পন্ন হলেই বাংলাদেশ খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে উঠতে পারবে। এক্ষেত্রে সুুবিধা হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামো আছে। আছে পর্যাপ্ত লোকবল। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সুন্দর আইন আছে যদিও তার অপপ্রয়োগ আছে। আর কিছু আইন যুগের চাহিদা অনুযায়ী পরির্বতন করা দরকার, যদিও তা করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমাদের শিল্পের একটি ভালো অবকাঠামো আছে। এ কারণেই কম সময়ের মধ্যে ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও শিক্ষকের কোনো সংকট হয়নি। তবে আমাদের এই অবকাঠামোকে নিজেদের স্বার্থে ধ্বংস করার চেষ্ঠায় আছে রাজনীতিকরা। নিন্ম মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মেধাবী ছাত্ররা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর বেতন বৃদ্ধি বা বেসরকারিকরণের ষড়যন্ত্র চলছে।
একটি আদর্শ শহরের জন্য দরকারি জিনিস হলো সুন্দর রাস্তাঘাট এবং পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। শহরটি থাকবে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এই যেমন_ আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা এবং অফিস-আদালতপাড়া। সবকিছুর সমল্প্বয় এমনভাবে হতে হবে, যাতে একজন মানুষ আধাঘণ্টা হাঁটলে স্কুল-কলেজ, বাসা, অফিস, হাসপাতাল, মসজিদের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পপৌঁছতে পারে। স্কুলগুলো এমন স্থানে হবে যাতে বাচ্চারা হেঁটে পপৌঁছুতে পারে এবং কোনো প্রধান সড়ক পার হতে না হয়। সব মিলিয়ে নগরবাসী সারাদিনের কাজকর্মে, আসা-যাওয়ায় এক ঘণ্টা হাঁটার সুযোগ পেলে তাদের স্বাস্টে্থ্যর জন্য তা ভালো হবে। একটি শহরে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং বিশদুব্দ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। থাকবে পরিকল্কিপ্পত পয়ঃনালার ব্যবস্থা। এসবের ব্যবস্থা না করে শুধু আকাশচুম্বী ভবন তৈরি করলেই হবে না। ঢাকার মূল সমস্যা '৭১-এর পর প্রচুর লোক ঢাকায় চলে আসে। প্রতিদিন যারা এ নগরে আসছে তারা আর ফেরত যাচ্ছে না। ফলে ঢাকার জনসংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। এজন্য ঢাকা শহরের মানুষদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি এবং পরিবহনসহ সবক্ষেত্রেই বিভিন্নভাবে নাজেহাল হয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে কেন এত লোক আসে সে কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া ঢাকাকে সবকিছুর কেন্দ্র না করে মূল কেন্দ্র করে আরো অনেক উপকেন্দ্র গড়তে হবে। তাহলে ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। দেখা যায় জার্মানির রাজধানী বালর্িন হলেও ওই শহরটি মূলত কালচারাল সেন্টার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। মিডিয়ার লোকজন থাকে কোলনে। কারণ সব ধরনের মিডিয়ার অফিস ওখানে। ফদ্ধাঙ্কফুর্ট হলো জার্মানির ব্যবসা কেন্দ্র। আমাদের এখানেও সবকিছুকে এ রকম বিভাজিত করতে হবে। এই যেমন_ ঢাকার ভেতরে ক্যান্টনমেন্ট থাকার কোন ািদরকার নেই। এরকম কেন্দ্রীয় জেলখানা, বিডিআর, ট্যানারিএগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া ঢাকার চাপ কমানোর জন্য এর আশপাশে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে টঙ্গী এবং সাভার দিয়ে শুরু করা যায়। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের সামরিক খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। অথচ যুদ্ধ বা দেশ দখলের কোনো উচ্চাশা আমাদের নেই। এজন্য সামরিক খাতে ব্যয় কমাতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর পরিসর আরো ছোট করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সবাই আর্মি হিসেবে কাজ করবে। '৭১ সালে যেমন সবাই যুদ্ধ করেছে।
এ শহরের পরিবেশ বাঁচাতে হলে দেশের দক্ষ দলপতিদের দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তবে পরিকল্পনা করলেই হবে না, এসব বাস্তবায়নে শাসকগোষ্ঠীর আন্তরিকতা থাকতে হবে। কারণ আমাদের রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুতে মনোযোগী হন না। যেমন ঢাকা শহরে ৪০০টি রাস্তা করার পরিকল্পনা আছে রাজউকের। এগুলো তৈরি হলে শহরের যানজট অনেকটা কমে যেত। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে আঘাত লাগে বলেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
হঠাৎই মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর উন্নত হয়ে গেল। এর পেছনে অবদান রেখেছেন ভালো কিছু রাজনৈতিক নেতা। মালয়েশিয়া পেছনে ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ এবং তার আগে টেঙ্কু আবদুর রহমানের মতো নেতা।
এমনকি মাহাথিরের সময়কার অর্থমন্ত্রীর স্ত্রী আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। এখন উল্টো আমাদের ছেলেরাই মালয়েশিয়ায় পড়তে যাচ্ছে।
এক সময় ঢাকা শহরে চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল খাল। আস্টেস্ন আস্টেস্ন সবকিছুতে রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। সে সময় ঢাকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সবুজ শহর। সে ঢাকা আজ কংক্রিটের মরুময়তায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রণীত আইনে ভবন তৈরির সময় নির্দিষ্ঠ পরিমাণ জায়গা খালি রাখতে বলা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে ঢাকার প্রকৃতির জন্য খুব ভালো হবে। এজন্য প্রয়োজন শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ইদানীং গার্মেন্টস কর্মীদের মালিকপক্ষের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের এখানে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক শাসক আর শোষিতের, সহযোগিতামূলক নয়। এজন্য অবশ্য মালিকপক্ষ দায়ী। এটা আমাদের শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে মূল সমস্যা হলো আমরা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এটাকে তাই শিল্প বলা চলে না। একটি শিল্পের ৮০ ভাগ দ্রব্য নিজেদের থাকতে হবে। এজন্য আমাদের কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে হবে। আমাদের উচ্চ শিক্ষিত কৃষিবিদদের কাজে লাগিয়ে এর বাস্তবায়নের পথ সুগম করা যাবে। তবে মূল কথা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আমাদের অনেক সম্ভাবনা নষ্ঠ করে দিচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে দমন-পীড়নের কাজে ব্যস্ত থাকে। দেশের উন্নয়নের কথা ভাবে না। র্বতমান সরকারের কথাই ধরা যাক। তারা দেশের উন্নতির বদলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব ধরনের নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ছে। আইন-আদালত ও পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এমনকি বদুিব্দজীবীদেরও তারা হেনস্তা করছে। শাহরিয়ার কবির বা মুনতাসির মামুনের মতো ব্যক্তিত্বদের যারা হয়রানি করতে পারে তাদের দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। অনেকে বলে আমাদের সম্পদ নেই। এটা ঠিক নয়। মানুষ আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যা অনেক দেশে নেই। এ মানবসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আছে নদী, মাছ, তেল, গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি। এগুলোর যথাযথ ব্যবহার আমাদের উন্নতির পথ সুগম করতে পারে। তেল-গ্যাস নিয়ে যে দেশের প্রধান দু'দলের নির্লজ্জ বিবাদ হয় সেদেশ উন্নতি করবে কীভাবে? বড় দু'দলের মতো সাধারণ মানুষ বাংলাদেশকে অন্দকারের দিকে যেতে দেবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষই এক সময় একটা ভালো রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়।
No comments