বিনিয়োগ মিথ ও উন্নয়ন ভাবনা by সাইফুর রহমান তারিক
নিজের পকেট ভারি হোক, এটা সবাই চায়। পকেট ভারি হওয়া মানে অর্থের আগমন। তাই বলে কেবলই পকেট ভারি হওয়াটাকে উন্নয়ন বলে না, উন্নয়নে অর্থের আগমনের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও। কথাটা ভদ্রস্থ করে বললে দাঁড়ায়_ আয় বাড়ুক এটা সবাই চায়। মানুষ মাত্রেই উন্নয়নকামী। ফলে না ভেবেচিনেস্ন মানুষকে উন্নয়নবিরোধী বলাটাই উন্নয়ন বিরোধিতার বড় লক্ষণ। যারা এসব কথা বলেন তারা উন্নয়নের নামে নিজেদের পকেট ভারি করতে চান।
নিজের অভিজ্ঞতায় যতগুলো সরকার দেখেছি, তাদের সবাই কোনো না কোনো মাত্রায় প্রতিপক্ষকে এবং তার বিন্দুমাত্র সমালোচনাকারীকে উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দিয়েছেন। মজার বিষয় হলো, আমাদের মিডিয়াও তাদের গলাবাজির ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে। সুশীলদের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, বিনিয়োগ মানেই উন্নয়ন। বিনিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হবে_ দক্ষযজ্ঞের মতো। তাতে কর্মসংস্থান হবে, জাতীয় আয় বাড়বে এবং তারা এই বিনিয়োগ চুক্তি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের মোক্তার সাজলেন।
টেংরাটিলায় আগুন জ্বললে বা কানসাটে বিদ্রোহ হলে বা ফুলবাড়ীতে মরণবাজি অবরোধ তৈরি হলে তারা সাবধান হতে চেষ্ঠা করেন, কিন্তু বিনিয়োগ মিথের আচ্ছন্নতায় বুঁদ বলে সরকারকে নীতিগতভাবে সমালোচনার দায় নিতে বলে না_ পাছে বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। আফটার অল জেনে-শুনে 'উন্নয়নবিরোধী' হওয়া যায় না। প্রকল্প এলাকার মানুষের প্রতি তাদের মহামানবসুলভ দরদও আছে। ফাঁকে সরকার তার জনস্বার্থবিরোধী 'উন্নয়ন যজ্ঞ' অব্যাহত রাখে। তার জন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন পড়লে তাও করা হয়। মধুপুরে ইকোপার্ক উপাখ্যান আমরা জানি।
অবস্থার ইতিবাচক পরির্বতনের বাসনা থেকেই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে কোনো জনগোষ্ঠী। নিজস্ব সম্পদের জোগানের ভরসা থাকলে সে উৎসাহ দ্বিগুণিত বা বহুগুণিত হয়। তদুপরি উন্নয়ন কথাটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিষয় নয়, এটা একটা নির্দিষ্ঠ ভৌগোলিক অঞ্চলের জনসমষ্টির বিষয়। ফলে কিভাবে বিষয়টি ঘটবে তার জন্য জনসমষ্টির একটি ঐকমত্যের দরকার হয়। সাধারণত তা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ঘটে থাকে।
যে কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্ঠায় অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়টি কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও উন্নয়ন ভাবনা এখন বিবিধ মাত্রা লাভ করেছে। কেবলই প্রবৃদ্ধি অর্জন উন্নয়ন বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। এটা 'পকেট ভারি' করার নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০/৩০ বছরে আরো অনেক অভিধা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন_ সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, যোগাযোগ উন্নয়ন, পরিবেশ-প্রতিবেশের উন্নয়ন ইত্যাদি। মধ্য আশির দশক থেকে উন্নয়নের প্যারাডাইসই বদলে যেতে থাকে।
এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে বড় বড় যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে তাতে ষাটের দশকের বা তারও আগের প্রবৃদ্ধি মডেলের প্রয়োগই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবুজ বিপ্লবের 'স্বপম্ন'ই থেকে যাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও সেপথে যাচ্ছে না, কারণ হয়তো এই_ দক্ষযজ্ঞ চালানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তারা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজ উন্নয়ন নিয়ে আছে, নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। প্রয়োজনে বিকল্প ভাবনাগুলো তারা কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন নীতিতে যেসবের অনুসরণের তাগিদ নেই বললেই চলে।
আমরা এভাবে ধীরে ধীরে কতিপয় নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি বা হচ্ছে। যেমন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা পারটিসিপেটরি ডেভেলপমেন্ট প্রসেস ইত্যাদি। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই উন্নয়নের এসব পরিবর্তিত ধারণা ভিত্তি পেয়েছে। সাসটেইনেবল বা টেকসই উন্নয়ন তেমন একটি ধারণা, যা উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে পরিবেশ, সমাজ, জনসমষ্টির কৃষ্টি-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়কে জুড়ে দিয়েছে। এগুলোর অবনতি ঘটলে যতই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হোক না কেন তাকে খাঁটি উন্নয়ন বলে আর মানা হচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দারিদ্র্য হ্রাস ইত্যাদি উন্নয়নের সূচক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কেবলই র্বতমানের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ মজদু শেষ করে ফেলাটাকে উন্নয়ন নামে আর স্বীকার করা হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের 'ভবিষ্যৎ' নষ্ঠ না করে কোনো নির্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠী কি করে তার মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, মানসম্মত জীবনযাপনের উপায় বের করতে পারে_ তাই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেনাউটর প্রতিপদ্যো বিষয়। এ ধারণাটা ব্যাপকমাত্রায় জনপ্রিয় ধারণায় পরিণত হয় ১৯৯২ সালে ধরিত্রী সম্মেলনে। এটি জনগোষ্ঠীর সক্রিয়তায় বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন নীতির সমালোচনা করে। মূলত একটি নির্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তার চাহিদা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে কীভাবে উন্নয়ন কর্মকা- চালাবে তার ওপরই জোর দেওয়া হয় টেকসই উন্নয়ন ভাবনায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকারগুলোর মগজে এ বিষয়টি এখনো ঢুকেনি, তারা প্রবৃদ্ধি মডেলেই পড়ে আছেন। অর্থাৎ যেনতেনভাবে আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাসনায় তারা উদগ্রীব। তাতে অন্য বিষয়ের কি হলো তা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই।
তিন
প্রবৃদ্ধিমূলক উন্নয়ন ভাবনায় প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, বনাঞ্চল, জলাশয়, খনিজ) লাগামহীন ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো সাবধানতা নেই বরং যত দ্রুত, যত বেশি করে এসব সম্পদ ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে সারাবেলা ব্যস্ত থাকতে হয়। টেকসই উন্নয়নের ধারণা এ জায়গায় বাদ সাধে। কেননা এতে কেবল র্বতমান জনগোষ্ঠী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থটাকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরান নয়। আর তার মূল্য নিরূপণেরও আবশ্যকতা রয়েছে।
ষাটের দশকে বা পঞ্চাশের দশকের শেষে সবুজ বিপ্লব বা কৃষি বিপ্লবের ধারণাটি বৈশি্বক হয়ে ওঠে। কিন্তু দেখা গেলে, বিপ্লবের মূল অনুষ্পগ কৃত্রিমসার। এটি না হলে বিপ্লবটা হচ্ছে না। কিন্তু ২০/২৫ বছর পর দেখা গেল ফসলের রকমারি জাতের বিলুপ্তি ঘটছে, মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। কোথাও দেখা গেছে, এসবের যৌগিক ফলাফল ইতিবাচক নয় বরং নেতিবাচক।
মধুপুর গড়ে বা শ্রীম্পগলের খাসিয়াপুঞ্জিতে ইকোপার্কের বাহানা চলছে ইকোটু্যরিজম প্রসার করার জন্য। তাতে আলফ্রেড সরেন খুন হয়ে গেলেও কিছু যায়-আসে না সরকারের। যাদের ভূমিতে উন্নয়ন, উন্নয়নে তাদেরই কোনো ভূমিকা থাকছে না বরং তারা উ্টাস্থু হচ্ছে। সেখানে সরকার বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে_ মূলত কিছু জোদ্দারের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে কিছু লুটেরার সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নকশা আমরা দেখেছি। তাদের মনে হয়েছে লালনের আখড়ায় তিনতলা একটা ভবন তোলে দিতে পারলেই দেশের সংস্কৃতির বিশাল উন্নয়ন ঘটে যাবে। একই বাসনায় শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ীতে বহুতল টু্যরিজম কমপ্লেক্স বানানো শুরু হয়ে গেল। এগুলোকে শেষ বিচারে উন্নয়ন বলা যায় না। এ হচ্ছে সাংস্কৃতিক অবনমন। জাতিসংঘের হেরিটেজ রক্ষা বিষয়ক বিধানে এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলা হলেও সরকারগুলো তা মানছে না। কারণ তার স্থানীয় পেটোয়া বাহিনীর উন্নয়ন তো হচ্ছে, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদ ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করবে।
চার
শেষ বিচারে আমার যদি লাভ না-ই হয় তাহলে উন্নয়ন কেন। লোকসান গুনে উন্নয়নযজ্ঞ ঘটানোর উদাহরণ অন্যত্রও আছে। তবে আমরা বোধহয় এ ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছি। ফুলবাড়ীর ঘটনার বিষয়টি দিবালোকের মতো সঙ্ষ্ঠ হয়। হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেছে, এখানকার কয়লা তোলার যে কসরত এশিয়া এনার্জি করেছিল তাতে সাকুল্য হিসাবে আমাদের আর্থিক ক্ষতি তো আছেই_ একশ' বছরের (খুব কম হয়ে গেল) জন্য গোটা এলাকাটাই শ্বাপদকুলের কাছে বেহাত হয়ে যাবে। তিরিশ বছরে আমাদের লোকসান গুনতে হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। ৩টি নদী স্বাভাবিক প্রবাহ হারাবে। সড়ক ও রেলপথ পরির্বতন করতে হবে। ৫টি উপজেলার মানুষ শরণার্থী হবে। তার জের কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে বলে বিস্তারিত হিসাবে গেলাম না। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ, প্রতিবেশগত মানবিক ক্ষতির বিনিময়ে তাহলে কেমন উন্নতি হবে আমাদের?
এসব প্রস্তাবিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে বড় বড় মাল্কিল্ট ন্যাশনালের মাধ্যমে। সরকারগুলো তাদের তাঁবেদার। এত টাকার লেনদেনে অবশ্যই কিছু লোকের পকেট দারুণ ভারি হবে। তাদের ৭/৮ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে কিন্তু বিশাল জনপদ উবে যাবে। এ নিয়ে তাদের ভাবনা নেই।
মূলত 'জাতীয় স্বার্থ' বিবেচনার কেন্দ্রে না থাকলে টাকার স্রোতে ভেসে যাবে সব। মানুষ অহেতুক উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দেওয়ার চেয়ে উন্নয়ন তথা বিনিয়োগ জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কি-না সেদিকেই সরকার ও মিডিয়ার নজর দেওয়া দরকার। মধ্যবিত্তীয় বিনিয়োগ ও উন্নয়ন মিথ (সার্টিরফিকেটেড চাকরির লোভ) ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিলে জাতীয় স্বার্থরক্ষার কবচ নির্মাণ করা যাবে না। উন্নয়ন মানে সতি্যই উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা নয়, শ্যামলভূমি বিরান করা নয়। ইকোপার্কের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ নয়। আয় বৃদ্ধি, সামর্থ্য বৃদ্ধিই উন্নয়ন। কতিপয়ের পকেট ভারি করার নাম উন্নয়ন নয়। ফুলবাড়ী উপখ্যানের এটাই শিক্ষা।
টেংরাটিলায় আগুন জ্বললে বা কানসাটে বিদ্রোহ হলে বা ফুলবাড়ীতে মরণবাজি অবরোধ তৈরি হলে তারা সাবধান হতে চেষ্ঠা করেন, কিন্তু বিনিয়োগ মিথের আচ্ছন্নতায় বুঁদ বলে সরকারকে নীতিগতভাবে সমালোচনার দায় নিতে বলে না_ পাছে বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। আফটার অল জেনে-শুনে 'উন্নয়নবিরোধী' হওয়া যায় না। প্রকল্প এলাকার মানুষের প্রতি তাদের মহামানবসুলভ দরদও আছে। ফাঁকে সরকার তার জনস্বার্থবিরোধী 'উন্নয়ন যজ্ঞ' অব্যাহত রাখে। তার জন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন পড়লে তাও করা হয়। মধুপুরে ইকোপার্ক উপাখ্যান আমরা জানি।
অবস্থার ইতিবাচক পরির্বতনের বাসনা থেকেই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে কোনো জনগোষ্ঠী। নিজস্ব সম্পদের জোগানের ভরসা থাকলে সে উৎসাহ দ্বিগুণিত বা বহুগুণিত হয়। তদুপরি উন্নয়ন কথাটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিষয় নয়, এটা একটা নির্দিষ্ঠ ভৌগোলিক অঞ্চলের জনসমষ্টির বিষয়। ফলে কিভাবে বিষয়টি ঘটবে তার জন্য জনসমষ্টির একটি ঐকমত্যের দরকার হয়। সাধারণত তা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ঘটে থাকে।
যে কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্ঠায় অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়টি কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও উন্নয়ন ভাবনা এখন বিবিধ মাত্রা লাভ করেছে। কেবলই প্রবৃদ্ধি অর্জন উন্নয়ন বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। এটা 'পকেট ভারি' করার নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০/৩০ বছরে আরো অনেক অভিধা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন_ সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, যোগাযোগ উন্নয়ন, পরিবেশ-প্রতিবেশের উন্নয়ন ইত্যাদি। মধ্য আশির দশক থেকে উন্নয়নের প্যারাডাইসই বদলে যেতে থাকে।
এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে বড় বড় যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে তাতে ষাটের দশকের বা তারও আগের প্রবৃদ্ধি মডেলের প্রয়োগই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবুজ বিপ্লবের 'স্বপম্ন'ই থেকে যাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও সেপথে যাচ্ছে না, কারণ হয়তো এই_ দক্ষযজ্ঞ চালানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তারা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজ উন্নয়ন নিয়ে আছে, নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। প্রয়োজনে বিকল্প ভাবনাগুলো তারা কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন নীতিতে যেসবের অনুসরণের তাগিদ নেই বললেই চলে।
আমরা এভাবে ধীরে ধীরে কতিপয় নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি বা হচ্ছে। যেমন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা পারটিসিপেটরি ডেভেলপমেন্ট প্রসেস ইত্যাদি। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই উন্নয়নের এসব পরিবর্তিত ধারণা ভিত্তি পেয়েছে। সাসটেইনেবল বা টেকসই উন্নয়ন তেমন একটি ধারণা, যা উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে পরিবেশ, সমাজ, জনসমষ্টির কৃষ্টি-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়কে জুড়ে দিয়েছে। এগুলোর অবনতি ঘটলে যতই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হোক না কেন তাকে খাঁটি উন্নয়ন বলে আর মানা হচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দারিদ্র্য হ্রাস ইত্যাদি উন্নয়নের সূচক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কেবলই র্বতমানের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ মজদু শেষ করে ফেলাটাকে উন্নয়ন নামে আর স্বীকার করা হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের 'ভবিষ্যৎ' নষ্ঠ না করে কোনো নির্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠী কি করে তার মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, মানসম্মত জীবনযাপনের উপায় বের করতে পারে_ তাই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেনাউটর প্রতিপদ্যো বিষয়। এ ধারণাটা ব্যাপকমাত্রায় জনপ্রিয় ধারণায় পরিণত হয় ১৯৯২ সালে ধরিত্রী সম্মেলনে। এটি জনগোষ্ঠীর সক্রিয়তায় বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন নীতির সমালোচনা করে। মূলত একটি নির্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তার চাহিদা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে কীভাবে উন্নয়ন কর্মকা- চালাবে তার ওপরই জোর দেওয়া হয় টেকসই উন্নয়ন ভাবনায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকারগুলোর মগজে এ বিষয়টি এখনো ঢুকেনি, তারা প্রবৃদ্ধি মডেলেই পড়ে আছেন। অর্থাৎ যেনতেনভাবে আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাসনায় তারা উদগ্রীব। তাতে অন্য বিষয়ের কি হলো তা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই।
তিন
প্রবৃদ্ধিমূলক উন্নয়ন ভাবনায় প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, বনাঞ্চল, জলাশয়, খনিজ) লাগামহীন ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো সাবধানতা নেই বরং যত দ্রুত, যত বেশি করে এসব সম্পদ ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে সারাবেলা ব্যস্ত থাকতে হয়। টেকসই উন্নয়নের ধারণা এ জায়গায় বাদ সাধে। কেননা এতে কেবল র্বতমান জনগোষ্ঠী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থটাকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরান নয়। আর তার মূল্য নিরূপণেরও আবশ্যকতা রয়েছে।
ষাটের দশকে বা পঞ্চাশের দশকের শেষে সবুজ বিপ্লব বা কৃষি বিপ্লবের ধারণাটি বৈশি্বক হয়ে ওঠে। কিন্তু দেখা গেলে, বিপ্লবের মূল অনুষ্পগ কৃত্রিমসার। এটি না হলে বিপ্লবটা হচ্ছে না। কিন্তু ২০/২৫ বছর পর দেখা গেল ফসলের রকমারি জাতের বিলুপ্তি ঘটছে, মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। কোথাও দেখা গেছে, এসবের যৌগিক ফলাফল ইতিবাচক নয় বরং নেতিবাচক।
মধুপুর গড়ে বা শ্রীম্পগলের খাসিয়াপুঞ্জিতে ইকোপার্কের বাহানা চলছে ইকোটু্যরিজম প্রসার করার জন্য। তাতে আলফ্রেড সরেন খুন হয়ে গেলেও কিছু যায়-আসে না সরকারের। যাদের ভূমিতে উন্নয়ন, উন্নয়নে তাদেরই কোনো ভূমিকা থাকছে না বরং তারা উ্টাস্থু হচ্ছে। সেখানে সরকার বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে_ মূলত কিছু জোদ্দারের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে কিছু লুটেরার সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নকশা আমরা দেখেছি। তাদের মনে হয়েছে লালনের আখড়ায় তিনতলা একটা ভবন তোলে দিতে পারলেই দেশের সংস্কৃতির বিশাল উন্নয়ন ঘটে যাবে। একই বাসনায় শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ীতে বহুতল টু্যরিজম কমপ্লেক্স বানানো শুরু হয়ে গেল। এগুলোকে শেষ বিচারে উন্নয়ন বলা যায় না। এ হচ্ছে সাংস্কৃতিক অবনমন। জাতিসংঘের হেরিটেজ রক্ষা বিষয়ক বিধানে এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলা হলেও সরকারগুলো তা মানছে না। কারণ তার স্থানীয় পেটোয়া বাহিনীর উন্নয়ন তো হচ্ছে, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদ ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করবে।
চার
শেষ বিচারে আমার যদি লাভ না-ই হয় তাহলে উন্নয়ন কেন। লোকসান গুনে উন্নয়নযজ্ঞ ঘটানোর উদাহরণ অন্যত্রও আছে। তবে আমরা বোধহয় এ ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছি। ফুলবাড়ীর ঘটনার বিষয়টি দিবালোকের মতো সঙ্ষ্ঠ হয়। হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেছে, এখানকার কয়লা তোলার যে কসরত এশিয়া এনার্জি করেছিল তাতে সাকুল্য হিসাবে আমাদের আর্থিক ক্ষতি তো আছেই_ একশ' বছরের (খুব কম হয়ে গেল) জন্য গোটা এলাকাটাই শ্বাপদকুলের কাছে বেহাত হয়ে যাবে। তিরিশ বছরে আমাদের লোকসান গুনতে হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। ৩টি নদী স্বাভাবিক প্রবাহ হারাবে। সড়ক ও রেলপথ পরির্বতন করতে হবে। ৫টি উপজেলার মানুষ শরণার্থী হবে। তার জের কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে বলে বিস্তারিত হিসাবে গেলাম না। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ, প্রতিবেশগত মানবিক ক্ষতির বিনিময়ে তাহলে কেমন উন্নতি হবে আমাদের?
এসব প্রস্তাবিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে বড় বড় মাল্কিল্ট ন্যাশনালের মাধ্যমে। সরকারগুলো তাদের তাঁবেদার। এত টাকার লেনদেনে অবশ্যই কিছু লোকের পকেট দারুণ ভারি হবে। তাদের ৭/৮ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে কিন্তু বিশাল জনপদ উবে যাবে। এ নিয়ে তাদের ভাবনা নেই।
মূলত 'জাতীয় স্বার্থ' বিবেচনার কেন্দ্রে না থাকলে টাকার স্রোতে ভেসে যাবে সব। মানুষ অহেতুক উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দেওয়ার চেয়ে উন্নয়ন তথা বিনিয়োগ জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কি-না সেদিকেই সরকার ও মিডিয়ার নজর দেওয়া দরকার। মধ্যবিত্তীয় বিনিয়োগ ও উন্নয়ন মিথ (সার্টিরফিকেটেড চাকরির লোভ) ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিলে জাতীয় স্বার্থরক্ষার কবচ নির্মাণ করা যাবে না। উন্নয়ন মানে সতি্যই উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা নয়, শ্যামলভূমি বিরান করা নয়। ইকোপার্কের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ নয়। আয় বৃদ্ধি, সামর্থ্য বৃদ্ধিই উন্নয়ন। কতিপয়ের পকেট ভারি করার নাম উন্নয়ন নয়। ফুলবাড়ী উপখ্যানের এটাই শিক্ষা।
No comments