বক্সিং-বাণিজ্যের অন্দরমহলে
বেশির ভাগ বিশ্লেষণে তিনিই গত শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও মোহাম্মদ আলীর আবেদন অন্য রকম। নিজের উত্থান-পতন, লড়াই-সংগ্রামের গল্প আলী শুনিয়েছেন 'দ্য গ্রেটেস্ট মাই ওন স্টোরি' বইয়ে। কালের কণ্ঠ পাঠকদের জন্য সেটার অনুবাদ ছাপা হচ্ছে প্রতি সোমবার১৯৭০ সালের গোটা ডিসেম্বরজুড়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াল আমার ম্যানেজার জাবির হার্বার্ট মোহাম্মদ। সব বড় বড় শহরের আয়োজকদের তরফ থেকেই আমার সঙ্গে ফ্রেজিয়ারের লড়াই আয়োজনের প্রস্তাব আসছিল।
লন্ডনের এক প্রমোটার বলেছিল চার লাখ মার্কিন ডলারের কথা, টোকিও থেকে এসেছিল ছয় লাখ ডলারের প্রস্তাব। হিউস্টনের অ্যাস্ট্রোডোম, নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনসহ অনেক জায়গাতেই এই লড়াইটা আয়োজন করতে চায় প্রমোটাররা। সম্প্রচারস্বত্বের জন্য এনবিসি ২০ লাখ ডলার দিতেও রাজি। আমরা সব প্রস্তাবই দেখতে থাকলাম। একসময় সব মিলিয়ে গোটা ম্যাচটার মূল্য গিয়ে ঠেকল পাঁচ মিলিয়ন ডলারে। আমি তো বেশ খুশি, সামনে মোটা টাকা কামানোর সুযোগ!
কথায় কথায় হার্বার্টকে খুশির কথাটা বলতেই সে যা শোনাল তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম, 'তুমি কি ভাবছো গোটা টাকাটাই তোমার? এটা তো তোমার আর ফ্রেজিয়ারের মধ্যে ভাগ হবে।' 'তার পরও তো আড়াই মিলিয়ন ডলার থাকছে।' 'সেখান থেকে শুরুতেই কেন্দ ীয় সরকার ছোঁ মেরে দেড় মিলিয়ন নিয়ে যাবে। ওখানে হাতই ছোঁয়াতে পারবে না। এরপর ভাগ বসাবে নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সরকার, তাদের করের টাকা কেটেছেঁটে ছয় লাখ ডলার থাকবে। অনুশীলনের জন্য খরচ হবে আরো লাখ দুয়েক। সব বাদ দিয়ে লাখ চারেক ডলার হাতে থাকবে।' সব শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। তখন হার্বার্ট আমায় বোঝাল, 'এই পাঁচ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটা হচ্ছে প্রচারণার জন্য, এই কথাটাই রেডিওতে ঘোষকরা বলবে। সংবাদপত্রে এই কথাটাই ছাপা হবে।'
যদিও অঙ্কটা নেহায়েত কম ছিল না। 'হলিউড এঙ্ট্রাভ্যাগেঞ্জা' নামের একটি বিনোদন পত্রিকার সম্পাদক মিল্টন গ্রস তো অবাক হয়েই লিখেছিলেন, 'হলিউডের কোনো তারকাও তো এক শটের জন্য এত টাকা নেয় না!' গোটা ব্যাপারটা নিয়ে মাতামাতিও হচ্ছিল বেশ। একদিন তো পত্রিকায় আড়াই মিলিয়ন ডলারের দুটো চেকের ছবিও ছাপা হয়ে গেল! একটাতে লেখা আমার নাম, অন্যটায় ফ্রেজিয়ারের। হার্বার্টই আমাকে বুঝিয়ে বলছিল বক্সিংয়ের বাণিজ্যের কথা, 'দেখো, তোমার আর ফ্রেজিয়ারের লড়াই। তোমরা হচ্ছ এমন দুজন হেভিওয়েট বঙ্ার, যারা দুজনেই চ্যাম্পিয়ন এবং অপরাজিত। তোমাদের এর আগে কখনো দেখা হয়নি, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে না। তোমাদের দ্বৈরথটা হতে যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসের বিরলতম। এমন কোনো অভিনেতা, শিল্পী কিংবা রাজা নেই, যাঁকে দেখতে এর চেয়ে বেশি ভিড় হবে। তুমি হয়তো বেশি হলে আর তিন বছর খেলার মতো অবস্থায় থাকবে। আমি চাই এই তিন বছরের ভেতরে তুমি যতটা সম্ভব করে নাও।' তখন বললাম, 'আচ্ছা, আরো অনেকেই তো বেশি টাকার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। তাদের সঙ্গে চুক্তি না করে জ্যাক কেন্ট আর জেরি পারেঞ্চিওর সঙ্গে কেন?' তখন হার্বার্ট আমাকে বোঝাল, 'দেখো, ফাঁকা বুলিতে কাজ হয় না। আমি আসলে চিন্তা করি এই খেলায় দর্শক কেমন হবে, এই দুই প্রতিযোগীর অতীত, তারা কে কেমন_এসব নিয়ে। এরপর প্রমোটারদের বলি। অনেকেই প্রতিশ্রুতি দেয়, সম্মত হয়। কিন্তু এই ব্যবসায় সব অচল। যে নগদ টাকা নিয়ে প্রথমে আসবে, চুক্তি তার সঙ্গেই হবে। জ্যাক ও জেরি তোমার এবং ফ্রেজিয়ারের নামে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছে, তাই চুক্তিটা ওদের সঙ্গেই হয়েছে।' এসব কারণেই তাকে আমি পছন্দ করতাম। শুধু আমি নই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বক্সিং নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করতেন তাঁরাও একবাক্যে মেনে নিয়েছিলেন হার্বার্টই সেরা বক্সিং ম্যানেজার।
অনুবাদ : সামীউর রহমান
No comments