লিবিয়া: নতুন প্রজন্মের লড়াই by ইশতিয়াক আহমদ
লিবিয়া প্রসঙ্গে গত ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোতে সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ ‘সভ্য দুনিয়ার কী কাজ’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। তাঁর কিছু বক্তব্য সম্পর্কে একনাগাড়ে ১০ বছর লিবীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফার্মাসিস্টের দায়িত্বে থাকার সুবাদে পাঠক সাধারণের সুবিধার্থে কিছু বলা উচিত এবং দায়িত্ব বলে মনে করি।
জনাব ওয়াসিফ ‘মেন মেড গ্রেট রিভার’ সম্পর্কে অন্যের মুখে শোনা আজগুবি এক তথ্য দিয়েছেন তাঁর লেখায়—এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। গাদ্দাফি লিবিয়ার দক্ষিণের মরুভূমির (কুফরা) বালুর নিচ থেকে সুমিষ্ট পানি বিশাল সুড়ঙ্গপথে বেনগাজি শহরে আনার ব্যবস্থা করার এক দক্ষযজ্ঞ শুরু করেন আশির দশকে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নাহার সিনাই আদিম’—অর্থ, ‘মেন মেড গ্রেট রিভার’—মানুষের তৈরি বিশাল নদী। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই পানির কিয়দংশ যখন লিবিয়ার বেনগাজির সুলুক শহরের বিশাল রিজার্ভারে পৌঁছায়, হিসাব করে দেখা গেছে, এক পেয়ালা পানির দাম পড়েছে তিন ডলার। এই জলাধার থেকে নদীবিহীন দেশ লিবিয়াকে সুজলা-সুফলা করার কষ্টকল্পনা গাদ্দাফি এরপর আর করেননি।
লেখক লিখেছেন, বাস্তবতা নাকি ভাড়াটে লোকের হাতে বিদেশিরা অস্ত্র তুলে দিয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। গাদ্দাফির অভিযোগ আরও মজার, তিনি বলছেন, এসব আল-কায়েদার কাজ। আফ্রিকার সব আল-কায়েদা একজোট হয়ে বিদেশি অস্ত্র নিয়ে লিবিয়ায় ঢুকে পড়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফিমুক্ত এলাকায় (বেনগাজি, বেদা, আজদাবিয়া ইত্যাদি) আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, স্কাই টিভিসহ দুনিয়ার প্রায় সব বিখ্যাত নিউজ মিডিয়া গাদ্দাফির দাবি এবং জনাব ওয়াসিফের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে কি? নিতান্ত নিরুপায় হয়ে শেষে বিদ্রোহীরা ন্যাটো কমান্ডের কাছে অস্ত্র চেয়েছে, যখন গাদ্দাফি জনগণ ও তাঁর রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের আরশোলা, ইঁদুর বলে সম্বোধন করে এদের ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়ে পিষে মারার জন্য মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছেন। বিদ্রোহীরা তাদের সঙ্গে গ্রাউন্ডে এক কাতারে যুদ্ধ করতে এখনো ন্যাটো বাহিনীকে ডাকেনি। বেনগাজি লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখানকার অস্ত্রভান্ডার বিদ্রোহী সেনা ও এই এলাকার জনগণ হাতে তুলে নিয়েছে গাদ্দাফির হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে। লিবিয়ার প্রত্যেক বয়োপ্রাপ্ত মানুষকে দুই বছর বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং এদের প্রত্যেকেই আধুনিক অস্ত্র চালাতে জানে।
লেখক তিউনিসিয়া ও মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার জনগণের আন্দোলনকে তুলনা করে বলেছেন, এখানে (লিবিয়ায়) জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন করছে না এবং লিবিয়ার বিদ্রোহীরা শুরু থেকেই নাকি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। বিশাল আয়তনের লিবিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ। আরব জাগরণের আগে নিরস্ত্র লিবিয়ান জনগণের বহু আন্দোলন গাদ্দাফি নিষ্ঠুর হাতে দমন করেছেন। তা ছাড়া মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো বেন আলী বা মোবারক তাঁদের জনগণের ওপর অস্ত্র নিয়ে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, যেভাবে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর পড়েছিল। তখন আমাদেরও যেমন অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না, তেমনই লিবিয়ার জনগণেরও সে রকম আর কোনো উপায় ছিল না।
জনাব ওয়াসিফের মতো অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রায় সবকিছুতেই ইসরায়েলি জুজুকে খুঁজে পান, আরব নবজাগরণেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি (লেখক) লিখেছেন, পশ্চিমা দুনিয়া আরবের এই জাগরণ নাকি ধামাচাপা না দিলে ইসরায়েলি দুর্গে শেষমেশ তা আঘাত হানবে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই জাগরণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আরব জাগরণ কায়েমি স্বার্থবাদী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের বিদ্রোহ—এটা আরব সভ্যতার (সিভিলাইজেশনের) কোনো উত্থান নয়।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, এই আন্দোলনে আরব শাসক চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন হওয়ার নয়, আরবের রাজনৈতিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হবে না। নেতানিয়াহুর এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ আরব নবজাগরণ কোন দিকে ধাবিত হবে, তা নির্ভর করবে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ওপর। জনাব ওয়াসিফ নিশ্চয়ই মানবেন, আজ সিরিয়ায় সেই ১৯৬৬ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসাদের মরহুম পিতা হাফেজ আল আসাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জারি করা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে, অথচ ইসরায়েলে ১৯৬৬ সালের পর কতবার গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। চরম দুঃসময়েও তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। অথচ ১৯৪৫ সালের পর আরব বিশ্বের কোনো দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে কি? এই প্রথম আরব বিশ্বে নবজাগরণ শুরু হয়েছে প্রাথমিকভাবে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে—একের পর এক আরব রাষ্ট্রে এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। গণজাগরণের শক্তি এত বিধ্বংসী যে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তা দাবিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
ইশতিয়াক আহমদ: সভাপতি, ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ।
sattuka@gmail.com
জনাব ওয়াসিফ ‘মেন মেড গ্রেট রিভার’ সম্পর্কে অন্যের মুখে শোনা আজগুবি এক তথ্য দিয়েছেন তাঁর লেখায়—এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। গাদ্দাফি লিবিয়ার দক্ষিণের মরুভূমির (কুফরা) বালুর নিচ থেকে সুমিষ্ট পানি বিশাল সুড়ঙ্গপথে বেনগাজি শহরে আনার ব্যবস্থা করার এক দক্ষযজ্ঞ শুরু করেন আশির দশকে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নাহার সিনাই আদিম’—অর্থ, ‘মেন মেড গ্রেট রিভার’—মানুষের তৈরি বিশাল নদী। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই পানির কিয়দংশ যখন লিবিয়ার বেনগাজির সুলুক শহরের বিশাল রিজার্ভারে পৌঁছায়, হিসাব করে দেখা গেছে, এক পেয়ালা পানির দাম পড়েছে তিন ডলার। এই জলাধার থেকে নদীবিহীন দেশ লিবিয়াকে সুজলা-সুফলা করার কষ্টকল্পনা গাদ্দাফি এরপর আর করেননি।
লেখক লিখেছেন, বাস্তবতা নাকি ভাড়াটে লোকের হাতে বিদেশিরা অস্ত্র তুলে দিয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। গাদ্দাফির অভিযোগ আরও মজার, তিনি বলছেন, এসব আল-কায়েদার কাজ। আফ্রিকার সব আল-কায়েদা একজোট হয়ে বিদেশি অস্ত্র নিয়ে লিবিয়ায় ঢুকে পড়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফিমুক্ত এলাকায় (বেনগাজি, বেদা, আজদাবিয়া ইত্যাদি) আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, স্কাই টিভিসহ দুনিয়ার প্রায় সব বিখ্যাত নিউজ মিডিয়া গাদ্দাফির দাবি এবং জনাব ওয়াসিফের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে কি? নিতান্ত নিরুপায় হয়ে শেষে বিদ্রোহীরা ন্যাটো কমান্ডের কাছে অস্ত্র চেয়েছে, যখন গাদ্দাফি জনগণ ও তাঁর রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের আরশোলা, ইঁদুর বলে সম্বোধন করে এদের ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়ে পিষে মারার জন্য মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছেন। বিদ্রোহীরা তাদের সঙ্গে গ্রাউন্ডে এক কাতারে যুদ্ধ করতে এখনো ন্যাটো বাহিনীকে ডাকেনি। বেনগাজি লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখানকার অস্ত্রভান্ডার বিদ্রোহী সেনা ও এই এলাকার জনগণ হাতে তুলে নিয়েছে গাদ্দাফির হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে। লিবিয়ার প্রত্যেক বয়োপ্রাপ্ত মানুষকে দুই বছর বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং এদের প্রত্যেকেই আধুনিক অস্ত্র চালাতে জানে।
লেখক তিউনিসিয়া ও মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার জনগণের আন্দোলনকে তুলনা করে বলেছেন, এখানে (লিবিয়ায়) জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন করছে না এবং লিবিয়ার বিদ্রোহীরা শুরু থেকেই নাকি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। বিশাল আয়তনের লিবিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ। আরব জাগরণের আগে নিরস্ত্র লিবিয়ান জনগণের বহু আন্দোলন গাদ্দাফি নিষ্ঠুর হাতে দমন করেছেন। তা ছাড়া মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো বেন আলী বা মোবারক তাঁদের জনগণের ওপর অস্ত্র নিয়ে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, যেভাবে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর পড়েছিল। তখন আমাদেরও যেমন অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না, তেমনই লিবিয়ার জনগণেরও সে রকম আর কোনো উপায় ছিল না।
জনাব ওয়াসিফের মতো অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রায় সবকিছুতেই ইসরায়েলি জুজুকে খুঁজে পান, আরব নবজাগরণেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি (লেখক) লিখেছেন, পশ্চিমা দুনিয়া আরবের এই জাগরণ নাকি ধামাচাপা না দিলে ইসরায়েলি দুর্গে শেষমেশ তা আঘাত হানবে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই জাগরণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আরব জাগরণ কায়েমি স্বার্থবাদী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের বিদ্রোহ—এটা আরব সভ্যতার (সিভিলাইজেশনের) কোনো উত্থান নয়।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, এই আন্দোলনে আরব শাসক চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন হওয়ার নয়, আরবের রাজনৈতিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হবে না। নেতানিয়াহুর এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ আরব নবজাগরণ কোন দিকে ধাবিত হবে, তা নির্ভর করবে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ওপর। জনাব ওয়াসিফ নিশ্চয়ই মানবেন, আজ সিরিয়ায় সেই ১৯৬৬ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসাদের মরহুম পিতা হাফেজ আল আসাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জারি করা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে, অথচ ইসরায়েলে ১৯৬৬ সালের পর কতবার গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। চরম দুঃসময়েও তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। অথচ ১৯৪৫ সালের পর আরব বিশ্বের কোনো দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে কি? এই প্রথম আরব বিশ্বে নবজাগরণ শুরু হয়েছে প্রাথমিকভাবে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে—একের পর এক আরব রাষ্ট্রে এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। গণজাগরণের শক্তি এত বিধ্বংসী যে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তা দাবিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
ইশতিয়াক আহমদ: সভাপতি, ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ।
sattuka@gmail.com
No comments