স্মৃতির দর্পণে জাদুঘর
বিশ্বের সব জাদুঘরে প্রদর্শিত নিদর্শনগুলো বিভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। তবে তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ওই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সমাজ-জাতি ও গণমানুষের মনে অতীতের স্মৃতিময় ঐতিহ্যনির্ভর নিদর্শনগুলো দেখে মনে যে প্রশ্ন জেগে ওঠে, তার মূল্য আছে। এই নিদর্শনগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে অতীত চলে আসে কাছে, হূদয়ে ইতিহাসের জ্ঞানের বীজ বপন করা হয় এবং নিজ সমাজে একান্তে তথ্যানুসন্ধানকারীর জিজ্ঞাসু মনোভাবকে জাগিয়ে তোলে। জাদুঘরে যে দর্শকেরা আসেন, তাঁরা প্রদর্শিত নিদর্শনগুলো একান্তে পর্যবেক্ষণের মধ্যে সম্প্রদায় বা কমিউনিটি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারেন। নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডার ঋদ্ধ করার সুযোগ পেয়ে যান তাঁরা। জাদুঘরে সাধারণত নিদর্শন প্রদর্শন করার বেলায় কোনো জাতি-ধর্ম, সমাজ-সম্প্রদায় বিশেষ অগ্রাধিকার পায় না।
১৯৭৭ সাল থেকে ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস পালন করা হয়ে থাকে। জাদুঘর কোনো দেশের নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফোকলোরবিষয়ক উপাদান সংরক্ষণ গ্যালারি উপস্থাপন করে থাকে এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে বিস্তারের অনুকূলে গবেষণা ও প্রকাশনা করে থাকে। এবারের জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য শিরোনাম ‘স্মৃতির দর্পণে জাদুঘর’ (Museum and Memory)।
মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজেকে পরখ করার সুযোগ পায়, তেমনই জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শনগুলোর কাছে গেলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাক্ষ্য অনুধাবন করতে পারে। জাদুঘরে দৃশ্যমান নিদর্শনের সঙ্গে বর্তমান সমাজব্যবস্থার সাযুজ্য আছে কি না, তার তুলনামূলক বিচার করতে পারে। এর পাশাপাশি নিজ জ্ঞান-ভান্ডারকে বাড়িয়ে নিতে পারে। জাদুঘরগুলোতে দৃশ্যমান ও স্পর্শনীয় ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হয়। অন্যদিকে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, যার প্রসারিত বিরাট এলাকা নিয়ে—এসব ঐতিহ্য আমাদের অতীত ইতিহাসের জীবন্ত স্বাক্ষর।
আধুনিক পশ্চিমা জগৎ অভ্যন্তরীণ জাদুঘর ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের মিলনের উন্মুক্ত জাদুঘর বা ওপেন এয়ার মিউজিয়াম স্থাপন করেছে। সেখানে দর্শকেরা জাদুঘরের ভেতরে ও বাইরে স্থাপিত নিদর্শনগুলো পরিদর্শন করতে পারে। ভারতে মধ্য প্রদেশের ভূপালে সিমলা হিলে একটি ওপেন এয়ার মিউজিয়াম রয়েছে, যা পরিদর্শন করলে ভারতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি, নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য আমাদের দেশে সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরটি কিছুটা হলেও ওপেন এয়ার মিউজিয়ামের আবহ রক্ষা করছে।
ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে সমাজ-সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চিন্তাচেতনা উৎসব-পার্বণ, আনন্দ-বিনোদন সমানুপাতে বিকশিত হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির চলনে যদিও তারতম্য হয়, তার পরও ঐতিহ্যের সংস্পর্শে তা এই গতিময়তা বাড়া-কমায় অনুকূল ভূমিকা রাখে। নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে মানবজাতি স্পর্শনীয় দৃশ্যনীয় ঐতিহ্যকে উৎসবের মধ্যে লালন-পালন করে চিত্তে সুখ অনুভব করে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে এমন নিদর্শন সংগ্রহ করার তাগিদ দিয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়।
বর্তমানে জাদুঘরগুলোতে কেউ কেউ স্পর্শনীয় ও দৃশ্যনীয় ঐতিহ্যনির্ভর নিদর্শনগুলো সংগ্রহ করে স্টোরের মজুদ বৃদ্ধিতে তৃপ্ততা অন্বেষণ করার পথ খোঁজেন, কিন্তু সমাজে বসবাসরত দর্শক ও অভ্যাগতদের জ্ঞানদানের উপযুক্ত গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রচার না থাকায় মজুদঘরেই অনাবিষ্কৃত থাকে জাতির অজ্ঞাত ইতিহাস। আর এভাবে বঞ্চিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বাংলাদেশে নবতর জাদুঘর স্থাপন, বিনির্মাণ, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হলেও ঐতিহ্যের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করার পথ রুদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি ঐতিহ্য পরিদর্শন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জাদুঘরগুলোতে দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি, নিদর্শনবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, পুরাকীর্তির গুরুত্ব অনুধাবন, পুরাকীর্তি অঙ্গনের আধুনিকায়ন, নিদর্শন সংগ্রহকরণে উৎসাহ-প্রণোদনা সৃষ্টি, উপযুক্ত গবেষণা প্রকাশনা এবং ব্যাপক প্রচার-প্রসার করার কাজে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে এবং এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে। জাদুঘর ও দর্শকদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা নিদর্শন ও দর্শকদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি নিদর্শনের নিজ নিজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য দর্শকদের মধ্যে অনুধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
নিদর্শনগুলো অতীতের কথা বলে। জাতির গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস-স্মারক, সমাজের মূলযোগ ঐতিহ্য। জাতিতাত্ত্বিক উপাত্তের শিকড়, যা দেখলে নিজেদের জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি পায়, এমন নিদর্শনের উপযুক্ত প্রকাশনা ও গবেষণা করে সুলভ মূল্যে বিপণন, বিতরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
১৯৭৭ সাল থেকে ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস পালন করা হয়ে থাকে। জাদুঘর কোনো দেশের নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফোকলোরবিষয়ক উপাদান সংরক্ষণ গ্যালারি উপস্থাপন করে থাকে এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে বিস্তারের অনুকূলে গবেষণা ও প্রকাশনা করে থাকে। এবারের জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য শিরোনাম ‘স্মৃতির দর্পণে জাদুঘর’ (Museum and Memory)।
মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজেকে পরখ করার সুযোগ পায়, তেমনই জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শনগুলোর কাছে গেলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাক্ষ্য অনুধাবন করতে পারে। জাদুঘরে দৃশ্যমান নিদর্শনের সঙ্গে বর্তমান সমাজব্যবস্থার সাযুজ্য আছে কি না, তার তুলনামূলক বিচার করতে পারে। এর পাশাপাশি নিজ জ্ঞান-ভান্ডারকে বাড়িয়ে নিতে পারে। জাদুঘরগুলোতে দৃশ্যমান ও স্পর্শনীয় ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হয়। অন্যদিকে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, যার প্রসারিত বিরাট এলাকা নিয়ে—এসব ঐতিহ্য আমাদের অতীত ইতিহাসের জীবন্ত স্বাক্ষর।
আধুনিক পশ্চিমা জগৎ অভ্যন্তরীণ জাদুঘর ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের মিলনের উন্মুক্ত জাদুঘর বা ওপেন এয়ার মিউজিয়াম স্থাপন করেছে। সেখানে দর্শকেরা জাদুঘরের ভেতরে ও বাইরে স্থাপিত নিদর্শনগুলো পরিদর্শন করতে পারে। ভারতে মধ্য প্রদেশের ভূপালে সিমলা হিলে একটি ওপেন এয়ার মিউজিয়াম রয়েছে, যা পরিদর্শন করলে ভারতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি, নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য আমাদের দেশে সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরটি কিছুটা হলেও ওপেন এয়ার মিউজিয়ামের আবহ রক্ষা করছে।
ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে সমাজ-সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চিন্তাচেতনা উৎসব-পার্বণ, আনন্দ-বিনোদন সমানুপাতে বিকশিত হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির চলনে যদিও তারতম্য হয়, তার পরও ঐতিহ্যের সংস্পর্শে তা এই গতিময়তা বাড়া-কমায় অনুকূল ভূমিকা রাখে। নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে মানবজাতি স্পর্শনীয় দৃশ্যনীয় ঐতিহ্যকে উৎসবের মধ্যে লালন-পালন করে চিত্তে সুখ অনুভব করে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে এমন নিদর্শন সংগ্রহ করার তাগিদ দিয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়।
বর্তমানে জাদুঘরগুলোতে কেউ কেউ স্পর্শনীয় ও দৃশ্যনীয় ঐতিহ্যনির্ভর নিদর্শনগুলো সংগ্রহ করে স্টোরের মজুদ বৃদ্ধিতে তৃপ্ততা অন্বেষণ করার পথ খোঁজেন, কিন্তু সমাজে বসবাসরত দর্শক ও অভ্যাগতদের জ্ঞানদানের উপযুক্ত গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রচার না থাকায় মজুদঘরেই অনাবিষ্কৃত থাকে জাতির অজ্ঞাত ইতিহাস। আর এভাবে বঞ্চিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বাংলাদেশে নবতর জাদুঘর স্থাপন, বিনির্মাণ, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হলেও ঐতিহ্যের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করার পথ রুদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি ঐতিহ্য পরিদর্শন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জাদুঘরগুলোতে দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি, নিদর্শনবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, পুরাকীর্তির গুরুত্ব অনুধাবন, পুরাকীর্তি অঙ্গনের আধুনিকায়ন, নিদর্শন সংগ্রহকরণে উৎসাহ-প্রণোদনা সৃষ্টি, উপযুক্ত গবেষণা প্রকাশনা এবং ব্যাপক প্রচার-প্রসার করার কাজে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে এবং এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে। জাদুঘর ও দর্শকদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা নিদর্শন ও দর্শকদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি নিদর্শনের নিজ নিজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য দর্শকদের মধ্যে অনুধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
নিদর্শনগুলো অতীতের কথা বলে। জাতির গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস-স্মারক, সমাজের মূলযোগ ঐতিহ্য। জাতিতাত্ত্বিক উপাত্তের শিকড়, যা দেখলে নিজেদের জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি পায়, এমন নিদর্শনের উপযুক্ত প্রকাশনা ও গবেষণা করে সুলভ মূল্যে বিপণন, বিতরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
No comments