জনতার যন্ত্রণা ক্ষমতার আনন্দ by আলমগীর মহিউদ্দিন
সাধারণ মানুষ ক্ষমতার লড়াই এর গিনিপিগ নয় |
প্রতিদিন
খবরের কাগজে চলমান ঘটনার ছিটেফোঁটা বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে। এই আংশিক চিত্র
অনাকাক্সিত, অসম্ভব, অবিশ্বাস্য মনে হয়। এর চেয়ে কঠিনতম ও কঠোরতম ঘটনা ঘটছে
বলে দাবি মানুষের মুখে মুখে। এসব দাবি যাচাই করা কঠিন। তবে অনুভব করা যায়।
একটি প্রশ্ন তাই মুখে মুখে- ‘এরপর কী?’ স্বগতোক্তিতে অনেকেই এর জবাব
উচ্চারণ করছেন। বেশির ভাগই হতাশাব্যঞ্জক, কিছু কিছু উচ্চারণযোগ্য নয়। এক
কথায় মানুষ যন্ত্রণাকিষ্ট, হতাশ। চিত্রটি সাধারণ। অপর চিত্রটি অসাধারণ।
সে চিত্রের ধারক-বাহক ও পরিচালকেরা ক্ষমতাবান। এরা দাবি করছেন, সব ঠিক আছে।
যৎসামান্য বিশৃঙ্খলা যা আছে, এক সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে। অবশ্য এর মাঝে কয়েক
সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আর চিত্রটি ক্রমান্বয়ে অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য হয়ে
উঠছে। তাই ক্ষমতাবানেরা সুরও পাল্টাতে শুরু করেছেন। এ দু’টি চিত্র
বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। এ দেশের ঊষালগ্ন থেকেই ঘটে চলেছে এমন রবাহূত
ঘটনাবলি। আর একইভাবে এর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। একটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য দিয়ে
এমন ঘটনাবলির বর্ণনা দেয়া হয়- ‘দেশ এখন ক্রান্তিকালের মাঝ দিয়ে চলছে।’ এ
ক্রান্তিকালের শেষ নেই। গত সাড়ে চার দশক ধরে চলছে। দেশের জন্মের প্রথম তিন
বছরে এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। হত্যা-খুন-গুম নিত্যদিনের বিষয় হয়ে পড়লে
মানুষ নীরবে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চাইত। মজলুমের আর্তি আকাশ-বাতাস যেন ছেয়ে
যাচ্ছিল। কেউ ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করত না। উল্লেখ্য,
আজকের ক্ষমতাবানদের একাংশ তখন সেই বিরোধিতার নেতৃত্ব দিয়েছিল। বর্তমানের
অবস্থা বর্ণনা করে ইন্টারনেটে হাজার মন্তব্যের মাঝে রোকেয়ার মন্তব্যটি
উদ্ধৃত করা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের অভিধান থেকে গণতন্ত্র, সততা,
বিশ্বাস, মতবিনিময়, অনুভব, সহানুভূতি, আস্থা, সম্মানবোধ, স্বাধীনতা,
সহনীয়তা, ক্ষমা, দয়া, নৈতিকতা, ধৈর্য, বোধশক্তিসহ মানবিক ও সামাজিক
শব্দগুলো হারিয়ে গেছে।’ লেখিকা এই এক বাক্যে চমৎকারভাবে শ্বাসরুদ্ধকর
অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন হয়? এক কথায় এর জবাব, ক্ষমতার লড়াই। ঠিক একই ঘটনা ফ্রান্সের ইতিহাসে বিধৃত। রাজার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে এমন হত্যা-গুম-খুন ফরাসি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত শতবর্ষব্যাপী চলে। রাজা সৃষ্টি করেন গোপন বিচারকক্ষ, যার নাম ছিল ‘চেম্বার আরদঁত’। প্যারিসের বাস্তিলের (যেখানে বিপ্লবের শেষ যুদ্ধ হয়) কাছে অবস্থিত ছিল এই বিচারকক্ষ। একে ‘জ্বলন্ত কক্ষ’ বলা হতো। কারণ, মশাল দিয়ে একে আলোকিত করা হতো; কেননা আলো প্রবেশের কোনো পথ ছিল না। এখানে রাজা লুই-১ নির্বাচিত বিচারকগণ বসে নির্ধারিত রায় পড়ে শোনাতেন। রায় হতো মৃত্যু ও পোড়ানো। লুইয়ের ছেলে হেনরি ছিলেন আরো হিংসাত্মক ও নিষ্ঠুর। তখন ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টের মধ্যে চলছিল বিরোধ। হেনরি প্রটেস্টান্টদের, বিশেষ করে ক্যালভিনিস্টদের সহ্যই করতে পারতেন না। ক্যালভিনিস্টদের নানা বদনাম দিয়ে শত শত লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো বা পুড়িয়ে মারা হতো এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো।
ক্যালভিনিস্টদের যে অপবাদ দেয়া হতো তা আজকের যুগের বহুল প্রচলিত শব্দগুলোর সাথে মিলে যায়। যেমন- মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি।
হেনরি প্রতিপক্ষদের নির্মূল করার জন্য কয়েকটি সরকারি সংস্থার সৃষ্টি করেন। তাদের কাজ ছিল খুঁজে খুঁজে ক্যালভিনিস্টদের বের করা অথবা প্রতিপক্ষদের তেমন আখ্যা দিয়ে আটক করা এবং গুম করে ফেলা। এমনই একটি সংস্থার প্রধান ছিল গ্যাবরিয়েল মন্টগোমারি। রাজার স্কটগার্ডের প্রধান মন্টগোমারির অন্যতম প্রধান কাজ ছিল ধৃত প্রতিপক্ষের ওপর নির্ধারিত বিভিন্ন অত্যাচার করে হত্যা করা এবং তা রাজা হেনরিকে নিজে জানানো। হেনরি ‘প্লেস দ্য ভোসাজে’ ঘোড়সওয়ারি বর্শা খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। তবে কোনো না কোনো ঘোড়সওয়ারকে মরতে হতো। হেনরি আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন। তার সাথে দর্শকেরা যোগ না দিলে তারা সরকারি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতো। এসব ঘটনা হয়তো মন্টগোমারিকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। ১৫৫৯ সালের সেই দিনের প্লেস দ্য ভোসাজের বর্শা খেলার এক ফাঁকে মন্টগোমারি তার বর্শা দিয়ে রাজা হেনরিকে বিদ্ধ করলে ফ্রান্সের নিষ্ঠুর একটি সময়ের অবসান ঘটে। এরপর ‘আরদঁত কক্ষটি’ বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ১১৫ বছর পর সেই কক্ষটি আবার খুলে দেয়া হয় রাজা লুইস-৪ এর রাজত্বকালে। রাজা এখানে সেই একই গোপন বিচার চালাতেন- সেই একই গুম-খুন-হত্যা করে। বিচারকেরা এজলাসে বসলে রাজার তরফ থেকে নির্দেশ আসত এবং সেই মোতাবেক রায় হতো। সবক্ষেত্রে মৃত্যু। এসব মৃতদেহ একত্র করে জনসমক্ষে পুড়িয়ে ফেলা হতো- যেন কেউ রাজার বিরুদ্ধে মুখটি না খোলে। এক মার্কিন সাংবাদিক জেফরি সেন্ট কেয়ার লিখেছেন, “এই আরদঁত কক্ষে অত্যাচারের পদ্ধতিগুলো আজ সারা বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। বিচারের রায় আগেই লেখা হচ্ছে এবং ক্ষমতাবানেরা সে রায়গুলো কার্যকর হতে দেখে আনন্দিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৬৭৫ ও ১৬৮২ সালের মধ্যে রাজা লুই ২১০টি গোপন বিচারে কয়েক হাজার প্রতিপক্ষকে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় নিরুদ্দেশ এবং পানি খাওয়ানো। এখন যাকে বলা হয় ‘ওয়াটার বর্ডিং’।”
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশবাহিনীর সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক স্যাম মিত্রিয়ানি (কলেজ দুপাজের ইতিহাসের অধ্যাপক) লিখেছেন, ‘পুলিশের সৃষ্টি হয়েছিল, প্রভুসমাজকে রক্ষা এবং সেবা করার জন্য। পুলিশের জন্ম অপরাধ দমনের জন্য নয়- বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যেমনটি বোঝে। তাদের সৃষ্টি সমাজের প্রভুদের শান্তি যারা ভঙ্গ করে তাদের দমনের জন্য।’ তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে এর অনেক পরিবর্তন হয় এবং এক সময়ে নির্বাচিত পুলিশব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত নির্বাচিত ক্ষমতাবানেরা এ ব্যবস্থা ভেঙে বর্তমান পুলিশব্যবস্থা চালু করেন। এতে ‘নির্বাচিত’ ক্ষমতাবান সংখ্যালঘিষ্ঠরা পুলিশকে ব্যাপক ব্যবহারের সুযোগ পান। এখানেই পুলিশি রাষ্ট্রের ধারণাটি জন্ম নেয় এবং বর্তমান বিশ্বে এর উপস্থিতি ব্যাপক। এই ব্যাপকতার কারণ ক্ষমতালিপ্সুু একশ্রেণীর মানুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পুলিশ ও তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সহজে ব্যবহার করতে পারে। গত ১০০ বছরে পুলিশবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাশালী করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা মানুষের স্বস্তি-শান্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সব রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে সীমাবদ্ধ করেছেন। এক দিকে জনগণ যন্ত্রণায় থাকে, অপর দিকে শাসকেরা শান্তিতে জীবন উপভোগ করেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামিরিটাস অধ্যাপক এডওয়ার্ড এস হারমান তার ‘টেরোরিজম ইন ফ্যাক্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’ বইতে লিখেছেন- ‘তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানেরা নিরাপত্তা রক্ষার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সব অনাচার ও অপরাধ রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহারের মাঝ দিয়ে করে যাচ্ছে। এবং তারা বাইরের সাহায্যে টিকে থাকে।’
আবার ক্ষমতাসীনেরা সব সময় মুনাফা খোঁজেন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে সেভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন। বিভিন্ন দেশে এমনকি কারাগার বেসরকারি সংস্থার কাছে সঁপে দিয়ে এই মুনাফার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগারকে বেসরকারি খাতে দেয়া হয়েছে। কারেকশন করপোরেশন অব আমেরিকা (সিসিএ) অনেক কারাগার পরিচালনা করে। এর বার্ষিক মুনাফা ১৭০ কোটি ডলার। এসব বেসরকারি সংস্থা কারাগার বা বন্দীদের ব্যাপারে কোনো সংস্কারে নারাজ। কারণ, মুনাফা কমে যেতে পারে। তৃতীয় বিশ্বে পুলিশকে এ ব্যাপারে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রতিবাদ ও সমালোচনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ। তাই পুলিশ ও ক্ষমতাবানেরা যেকোনো প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে একত্রে মুনাফার কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনৈতিক আইন তৈরি হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে বিচারক নির্বাচিত করা হয়- যেন এই মুনাফার কর্মকাণ্ডে ব্যত্যয় না ঘটে। এক কথায়, ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। তবে রাষ্ট্রটি ফ্যাসিবাদীতে নিমজ্জিত হয়েছে কি না তার অন্তত ১৪টি চিহ্ন থাকবে। অধ্যাপক লরেন্স ব্রিট হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো ইত্যাদির শাসন অনুসন্ধান করে এই চিহ্নগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার- ০১. সব সময় দেশপ্রেম এবং এ সম্পর্কে গান, প্রচারণা, স্লোগানে মত্ত থাকে এবং জনগণকে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য করে; ০২. মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। বৈদেশিক ও ভেতরের শত্রুর দোহাই দিয়ে জনগণের অধিকার হরণ করে; ০৩. দুর্বল গোষ্ঠীকে অন্যের দোষের বোঝা বইতে বাধ্য করে; ০৪. সামরিক বাহিনীসহ সব রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীকে সবার ওপরে স্থান দেয়া হয়; ০৫. সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়; ০৬. জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়াবাড়ির মাঝ দিয়ে জনগণকে এক ভীতির মধ্যে রাখা হয়; ০৭. ধর্মকে ব্যবহার করা হয় নানাভাবে; ০৮. করপোরেট শক্তি ও রাষ্ট্রীয় শক্তি এক হয়ে পড়ে; ০৯. চিন্তাবিদ ও তাদের কর্মকাণ্ডকে নিন্দা করা হয়; ১০. পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয় এবং অপরাধ দমনের নামে প্রচণ্ড অনাচারের রাজত্ব কায়েম করে; ১১. নির্বাচন নামমাত্র হয় এবং এমন ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হয় যেন সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসে; ১২. নিজের দল ও আত্মীয়রা সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়; ১৩. কোনো গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করা হয় এবং হত্যা ও গুম সাধারণ দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই অনুভব করা যায় জনগণ ফ্যাসিস্ট আবহাওয়ায় অবস্থান করছে কি না।
হিংসাত্মক ঘটনার আবির্ভাব কেন ঘটে, এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন হানাহ্ আরেন্ডট। তার এই মৌলিক গবেষণা বিশ্বে প্রধান সূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতা ও সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’ তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আকার ও অবস্থান নির্ধারণ করে ক্ষমতাসীনেরা কত দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে।’ ইতিহাস আলোচনা করে আরেন্ডট লিখেছেন, ‘এই ক্ষমতাসীনেরা সন্ত্রাস ব্যবহারের মাঝ দিয়ে তাদের ক্ষমতার স্থিতি রক্ষা করতে চায়। কিন্তু দেখা গেছে, যে সরকার সন্ত্রাসের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল হয় তাদের আসলে কোনো শক্তিই থাকে না। কেননা স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারীকে সন্ত্রাসের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।’ তার বক্তব্য অনুসারে স্বৈরাচারের পতন হয়, যখন জনগণ অনুভব করতে শুরু করে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। সঙ্ঘাত তখন সৃষ্টি হয়। জনগণের ঐক্যের ওপর নির্ভর করে স্বৈরাচার কত সময় স্থায়ী হবে। স্বৈরাচারীরা নিজেদের সন্ত্রাসকে আইনসম্মত করার চেষ্টা করে। আর জনগণের প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অপবাদে নির্মূল করার চেষ্টা করে। কেলি কার্টার জ্যাকসন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস সব পরিবর্তনের মূল। জনগণকে সন্ত্রাসে যোগ দিতে হয় অত্যাচারী সরকারকে উৎখাত করতে। আর সরকার সন্ত্রাস করে জনগণকে স্তব্ধ করতে।’ তিনি ফরাসি বিপ্লবকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
তবে গবেষকগণ দেখিয়েছেন ‘সন্ত্রাস, অসস্তি ও সামাজিক টানাপড়েন বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে, যদি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক মানুষেরা নিজেদের মাঝে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে সম্মান করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার চর্চা করে। বাংলাদেশের বর্তমানের অবস্থা এভাবে সহজেই সমাধান হতে পারে। কারণ, বর্তমান অশান্তির মূলে একদল নতুন নির্বাচন চায়। আর ক্ষমতাসীনেরা তা মানতে রাজি নন। অথচ তারা দাবি করছেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে তাদের বিজয় অবধারিত। এরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৫২৭টি হরতালও করেছিলেন। তার ফলে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনও হয়েছিল। তাহলে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে জনগণকে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে তাদের এত অনীহা কেন? তারা জনগণের সেবাই তো করতে চান।
এক কথায় বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে শান্তি সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব, যদি ক্ষমতাবানেরা সবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করেন এবং নিজেরা সহনশীলতার পরিচয় দেন। দুঃখের কথা হলেও এটা সত্য, মার্কিন সংস্থা ‘এথিক্যাল কনজিউমার্স’ তাদের সবচেয়ে নিপীড়নমূলক সরকারের তালিকায় ৪১টি দেশকে গত পাঁচ বছর হলো বারবার উল্লেখ করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। তাই ক্ষমতাবানদের বক্তব্যের অশ্লীলতা পরিহার করতে হবে এবং স্বাধীনতার ঊষালগ্নের নেতৃবৃন্দ যেমন সবাইকে নিয়ে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তেমন চেষ্টা এখনই করতে হবে। অশান্তি, অনাচার, অত্যচার দিয়ে হয়তো সাময়িক ফল পাওয়া যায়, পরিশেষে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতি থেকে জাতিকে বাঁচানো রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশে একটি ধারণা জনগণের মাঝে দৃঢ় হয়ে পড়েছে, তা হলো- রাজনীতিবিদেরা নিজেদের ও তাদের গোষ্ঠীগুলোর সেবা করতেই ক্ষমতায় যেতে চান। ধারণাটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে তাদের।
প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন হয়? এক কথায় এর জবাব, ক্ষমতার লড়াই। ঠিক একই ঘটনা ফ্রান্সের ইতিহাসে বিধৃত। রাজার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে এমন হত্যা-গুম-খুন ফরাসি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত শতবর্ষব্যাপী চলে। রাজা সৃষ্টি করেন গোপন বিচারকক্ষ, যার নাম ছিল ‘চেম্বার আরদঁত’। প্যারিসের বাস্তিলের (যেখানে বিপ্লবের শেষ যুদ্ধ হয়) কাছে অবস্থিত ছিল এই বিচারকক্ষ। একে ‘জ্বলন্ত কক্ষ’ বলা হতো। কারণ, মশাল দিয়ে একে আলোকিত করা হতো; কেননা আলো প্রবেশের কোনো পথ ছিল না। এখানে রাজা লুই-১ নির্বাচিত বিচারকগণ বসে নির্ধারিত রায় পড়ে শোনাতেন। রায় হতো মৃত্যু ও পোড়ানো। লুইয়ের ছেলে হেনরি ছিলেন আরো হিংসাত্মক ও নিষ্ঠুর। তখন ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টের মধ্যে চলছিল বিরোধ। হেনরি প্রটেস্টান্টদের, বিশেষ করে ক্যালভিনিস্টদের সহ্যই করতে পারতেন না। ক্যালভিনিস্টদের নানা বদনাম দিয়ে শত শত লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো বা পুড়িয়ে মারা হতো এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো।
ক্যালভিনিস্টদের যে অপবাদ দেয়া হতো তা আজকের যুগের বহুল প্রচলিত শব্দগুলোর সাথে মিলে যায়। যেমন- মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি।
হেনরি প্রতিপক্ষদের নির্মূল করার জন্য কয়েকটি সরকারি সংস্থার সৃষ্টি করেন। তাদের কাজ ছিল খুঁজে খুঁজে ক্যালভিনিস্টদের বের করা অথবা প্রতিপক্ষদের তেমন আখ্যা দিয়ে আটক করা এবং গুম করে ফেলা। এমনই একটি সংস্থার প্রধান ছিল গ্যাবরিয়েল মন্টগোমারি। রাজার স্কটগার্ডের প্রধান মন্টগোমারির অন্যতম প্রধান কাজ ছিল ধৃত প্রতিপক্ষের ওপর নির্ধারিত বিভিন্ন অত্যাচার করে হত্যা করা এবং তা রাজা হেনরিকে নিজে জানানো। হেনরি ‘প্লেস দ্য ভোসাজে’ ঘোড়সওয়ারি বর্শা খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। তবে কোনো না কোনো ঘোড়সওয়ারকে মরতে হতো। হেনরি আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন। তার সাথে দর্শকেরা যোগ না দিলে তারা সরকারি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতো। এসব ঘটনা হয়তো মন্টগোমারিকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। ১৫৫৯ সালের সেই দিনের প্লেস দ্য ভোসাজের বর্শা খেলার এক ফাঁকে মন্টগোমারি তার বর্শা দিয়ে রাজা হেনরিকে বিদ্ধ করলে ফ্রান্সের নিষ্ঠুর একটি সময়ের অবসান ঘটে। এরপর ‘আরদঁত কক্ষটি’ বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ১১৫ বছর পর সেই কক্ষটি আবার খুলে দেয়া হয় রাজা লুইস-৪ এর রাজত্বকালে। রাজা এখানে সেই একই গোপন বিচার চালাতেন- সেই একই গুম-খুন-হত্যা করে। বিচারকেরা এজলাসে বসলে রাজার তরফ থেকে নির্দেশ আসত এবং সেই মোতাবেক রায় হতো। সবক্ষেত্রে মৃত্যু। এসব মৃতদেহ একত্র করে জনসমক্ষে পুড়িয়ে ফেলা হতো- যেন কেউ রাজার বিরুদ্ধে মুখটি না খোলে। এক মার্কিন সাংবাদিক জেফরি সেন্ট কেয়ার লিখেছেন, “এই আরদঁত কক্ষে অত্যাচারের পদ্ধতিগুলো আজ সারা বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। বিচারের রায় আগেই লেখা হচ্ছে এবং ক্ষমতাবানেরা সে রায়গুলো কার্যকর হতে দেখে আনন্দিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৬৭৫ ও ১৬৮২ সালের মধ্যে রাজা লুই ২১০টি গোপন বিচারে কয়েক হাজার প্রতিপক্ষকে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় নিরুদ্দেশ এবং পানি খাওয়ানো। এখন যাকে বলা হয় ‘ওয়াটার বর্ডিং’।”
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশবাহিনীর সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক স্যাম মিত্রিয়ানি (কলেজ দুপাজের ইতিহাসের অধ্যাপক) লিখেছেন, ‘পুলিশের সৃষ্টি হয়েছিল, প্রভুসমাজকে রক্ষা এবং সেবা করার জন্য। পুলিশের জন্ম অপরাধ দমনের জন্য নয়- বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যেমনটি বোঝে। তাদের সৃষ্টি সমাজের প্রভুদের শান্তি যারা ভঙ্গ করে তাদের দমনের জন্য।’ তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে এর অনেক পরিবর্তন হয় এবং এক সময়ে নির্বাচিত পুলিশব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত নির্বাচিত ক্ষমতাবানেরা এ ব্যবস্থা ভেঙে বর্তমান পুলিশব্যবস্থা চালু করেন। এতে ‘নির্বাচিত’ ক্ষমতাবান সংখ্যালঘিষ্ঠরা পুলিশকে ব্যাপক ব্যবহারের সুযোগ পান। এখানেই পুলিশি রাষ্ট্রের ধারণাটি জন্ম নেয় এবং বর্তমান বিশ্বে এর উপস্থিতি ব্যাপক। এই ব্যাপকতার কারণ ক্ষমতালিপ্সুু একশ্রেণীর মানুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পুলিশ ও তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সহজে ব্যবহার করতে পারে। গত ১০০ বছরে পুলিশবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাশালী করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা মানুষের স্বস্তি-শান্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সব রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে সীমাবদ্ধ করেছেন। এক দিকে জনগণ যন্ত্রণায় থাকে, অপর দিকে শাসকেরা শান্তিতে জীবন উপভোগ করেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামিরিটাস অধ্যাপক এডওয়ার্ড এস হারমান তার ‘টেরোরিজম ইন ফ্যাক্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’ বইতে লিখেছেন- ‘তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানেরা নিরাপত্তা রক্ষার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সব অনাচার ও অপরাধ রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহারের মাঝ দিয়ে করে যাচ্ছে। এবং তারা বাইরের সাহায্যে টিকে থাকে।’
আবার ক্ষমতাসীনেরা সব সময় মুনাফা খোঁজেন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে সেভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন। বিভিন্ন দেশে এমনকি কারাগার বেসরকারি সংস্থার কাছে সঁপে দিয়ে এই মুনাফার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগারকে বেসরকারি খাতে দেয়া হয়েছে। কারেকশন করপোরেশন অব আমেরিকা (সিসিএ) অনেক কারাগার পরিচালনা করে। এর বার্ষিক মুনাফা ১৭০ কোটি ডলার। এসব বেসরকারি সংস্থা কারাগার বা বন্দীদের ব্যাপারে কোনো সংস্কারে নারাজ। কারণ, মুনাফা কমে যেতে পারে। তৃতীয় বিশ্বে পুলিশকে এ ব্যাপারে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রতিবাদ ও সমালোচনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ। তাই পুলিশ ও ক্ষমতাবানেরা যেকোনো প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে একত্রে মুনাফার কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনৈতিক আইন তৈরি হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে বিচারক নির্বাচিত করা হয়- যেন এই মুনাফার কর্মকাণ্ডে ব্যত্যয় না ঘটে। এক কথায়, ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। তবে রাষ্ট্রটি ফ্যাসিবাদীতে নিমজ্জিত হয়েছে কি না তার অন্তত ১৪টি চিহ্ন থাকবে। অধ্যাপক লরেন্স ব্রিট হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো ইত্যাদির শাসন অনুসন্ধান করে এই চিহ্নগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার- ০১. সব সময় দেশপ্রেম এবং এ সম্পর্কে গান, প্রচারণা, স্লোগানে মত্ত থাকে এবং জনগণকে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য করে; ০২. মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। বৈদেশিক ও ভেতরের শত্রুর দোহাই দিয়ে জনগণের অধিকার হরণ করে; ০৩. দুর্বল গোষ্ঠীকে অন্যের দোষের বোঝা বইতে বাধ্য করে; ০৪. সামরিক বাহিনীসহ সব রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীকে সবার ওপরে স্থান দেয়া হয়; ০৫. সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়; ০৬. জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়াবাড়ির মাঝ দিয়ে জনগণকে এক ভীতির মধ্যে রাখা হয়; ০৭. ধর্মকে ব্যবহার করা হয় নানাভাবে; ০৮. করপোরেট শক্তি ও রাষ্ট্রীয় শক্তি এক হয়ে পড়ে; ০৯. চিন্তাবিদ ও তাদের কর্মকাণ্ডকে নিন্দা করা হয়; ১০. পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয় এবং অপরাধ দমনের নামে প্রচণ্ড অনাচারের রাজত্ব কায়েম করে; ১১. নির্বাচন নামমাত্র হয় এবং এমন ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হয় যেন সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসে; ১২. নিজের দল ও আত্মীয়রা সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়; ১৩. কোনো গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করা হয় এবং হত্যা ও গুম সাধারণ দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই অনুভব করা যায় জনগণ ফ্যাসিস্ট আবহাওয়ায় অবস্থান করছে কি না।
হিংসাত্মক ঘটনার আবির্ভাব কেন ঘটে, এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন হানাহ্ আরেন্ডট। তার এই মৌলিক গবেষণা বিশ্বে প্রধান সূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতা ও সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’ তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আকার ও অবস্থান নির্ধারণ করে ক্ষমতাসীনেরা কত দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে।’ ইতিহাস আলোচনা করে আরেন্ডট লিখেছেন, ‘এই ক্ষমতাসীনেরা সন্ত্রাস ব্যবহারের মাঝ দিয়ে তাদের ক্ষমতার স্থিতি রক্ষা করতে চায়। কিন্তু দেখা গেছে, যে সরকার সন্ত্রাসের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল হয় তাদের আসলে কোনো শক্তিই থাকে না। কেননা স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারীকে সন্ত্রাসের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।’ তার বক্তব্য অনুসারে স্বৈরাচারের পতন হয়, যখন জনগণ অনুভব করতে শুরু করে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। সঙ্ঘাত তখন সৃষ্টি হয়। জনগণের ঐক্যের ওপর নির্ভর করে স্বৈরাচার কত সময় স্থায়ী হবে। স্বৈরাচারীরা নিজেদের সন্ত্রাসকে আইনসম্মত করার চেষ্টা করে। আর জনগণের প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অপবাদে নির্মূল করার চেষ্টা করে। কেলি কার্টার জ্যাকসন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস সব পরিবর্তনের মূল। জনগণকে সন্ত্রাসে যোগ দিতে হয় অত্যাচারী সরকারকে উৎখাত করতে। আর সরকার সন্ত্রাস করে জনগণকে স্তব্ধ করতে।’ তিনি ফরাসি বিপ্লবকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
তবে গবেষকগণ দেখিয়েছেন ‘সন্ত্রাস, অসস্তি ও সামাজিক টানাপড়েন বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে, যদি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক মানুষেরা নিজেদের মাঝে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে সম্মান করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার চর্চা করে। বাংলাদেশের বর্তমানের অবস্থা এভাবে সহজেই সমাধান হতে পারে। কারণ, বর্তমান অশান্তির মূলে একদল নতুন নির্বাচন চায়। আর ক্ষমতাসীনেরা তা মানতে রাজি নন। অথচ তারা দাবি করছেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে তাদের বিজয় অবধারিত। এরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৫২৭টি হরতালও করেছিলেন। তার ফলে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনও হয়েছিল। তাহলে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে জনগণকে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে তাদের এত অনীহা কেন? তারা জনগণের সেবাই তো করতে চান।
এক কথায় বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে শান্তি সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব, যদি ক্ষমতাবানেরা সবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করেন এবং নিজেরা সহনশীলতার পরিচয় দেন। দুঃখের কথা হলেও এটা সত্য, মার্কিন সংস্থা ‘এথিক্যাল কনজিউমার্স’ তাদের সবচেয়ে নিপীড়নমূলক সরকারের তালিকায় ৪১টি দেশকে গত পাঁচ বছর হলো বারবার উল্লেখ করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। তাই ক্ষমতাবানদের বক্তব্যের অশ্লীলতা পরিহার করতে হবে এবং স্বাধীনতার ঊষালগ্নের নেতৃবৃন্দ যেমন সবাইকে নিয়ে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তেমন চেষ্টা এখনই করতে হবে। অশান্তি, অনাচার, অত্যচার দিয়ে হয়তো সাময়িক ফল পাওয়া যায়, পরিশেষে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতি থেকে জাতিকে বাঁচানো রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশে একটি ধারণা জনগণের মাঝে দৃঢ় হয়ে পড়েছে, তা হলো- রাজনীতিবিদেরা নিজেদের ও তাদের গোষ্ঠীগুলোর সেবা করতেই ক্ষমতায় যেতে চান। ধারণাটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে তাদের।
No comments