গণতন্ত্র মানে দায়িত্বশীলতা by শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
বাংলাদেশ
একটি গভীর ও ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকারি ক্ষমতা দখলকে
কেন্দ্র করেই সংকটের শুরু, বিকাশ ও বিস্তার; কিন্তু সরকারি ক্ষমতা দখলের
লড়াইকে অতিক্রম করে এটি এখন নানা দিকে ডালপালা মেলে দিয়েছে। এ সংকটের
ফয়সালার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের 'রোডম্যাপ' নির্ধারিত হবে বলে মনে
করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। গণতন্ত্রের 'বাংলাদেশি মডেল' কোন দিকে বাঁক
নেবে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের কী হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি ধর্মভিত্তিক
চরমপন্থার হাতে চলে যাবে কিনা, তাতে করে নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন,
উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়বে কিনা ইত্যাদি প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিকভাবে উঠতেই
পারে এবং উঠছেও।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের কাছে চলমান আন্দোলন হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার, ১৪ দলীয় জোট ও তাদের সমর্থনকারী নাগরিক সমাজ বলছে, বর্তমানে আন্দোলনের নামে যা হচ্ছে তা হচ্ছে নির্জলা সন্ত্রাস। তাদের প্রশ্ন, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরে কোন গণতন্ত্র রক্ষা হবে? তাদের ভাষায়, চলমান অবরোধ ও হরতাল বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান আন্দোলন কি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন? নাকি প্রথম দিকে এটি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন হলেও বর্তমানে এটি বিশুদ্ধ সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের হাতে? এভাবে চলতে থাকলে জামায়াত কি নিঃশেষ হয়ে যাবে, নাকি বাংলাদেশের রাজনীতি জামায়াত ও অন্য চরমপন্থিদের হাতে চলে যাবে? সরকারের ভুলে এবং বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে পেট্রোল বোমা যে বাংলাদেশের রাজনীতির অংশ হয়ে গেল, সেই ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি বেরিয়ে আসতে পারবে কি?
৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট একটি সমাবেশ করলে কী এমন হতো? এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারই শুধু নয়, তাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলবে, কিন্তু বিরোধী দলকে তাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার পালন করা থেকে বিরত রাখবে, ভিন্নমতের দল ও গোষ্ঠীকে সমাবেশ করতে দেবে না, তাহলে সেটি কি গণতন্ত্র হলো? গণতন্ত্রকে তো গণতন্ত্র হতে হবে। গণতন্ত্র তো 'ডিফাইনড, মেড অ্যান্ড মেইনটেইনড বাই আওয়ামী লীগ' হলে হবে না! চলমান গণতন্ত্রের মধ্যে বিএনপিকে 'স্পেস' না দিয়ে আওয়ামী লীগ যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা বোঝার মতো বর্ষীয়ান ও বুঝমান নেতা কি আওয়ামী লীগে নেই? শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দলের প্রয়োজন ও উপযোগিতা সারা পৃথিবীর তাবৎ গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় স্বীকৃত। বিরোধী দলকে নিঃশেষ করে, ভিন্ন মতের দল ও গোষ্ঠীর কণ্ঠ রোধ করে, তাদের সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কী বিপদ তৈরি করছে, আওয়ামী লীগ কি তা বুঝতে পারছে?
নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আমরা যদি মনে করি, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছাব, তাহলে ওই ব্যবস্থার মধ্যে সবার অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এ ব্যবস্থাকে জুতসই মনে না করি, যদি মনে করি যে, বহুদলীয় সরকার এবং 'কমান্ড ইকোনমি'ই আমাদের লক্ষ্য অর্জনকে মসৃণ করবে, তাহলে ওই ব্যবস্থার মধ্যে প্রধান সব দল ও গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিঃশেষ, নির্মূল ও বাদ দেওয়ার রাজনীতি যে ফলপ্রসূ হবে না ইতিমধ্যে সে ব্যাপারে আমরা ধারণা পেয়েছি। ১৯৭৬ সাল থেকে দুই দশক ধরে চলেছে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিঃশেষ করার উদ্যোগ, আয়োজন। সেটা কি সফল হয়েছে? এখন মনে হয় বিএনপিকে নিঃশেষ ও নির্মূল করার চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভারসাম্যের জন্য সেটি কি ভালো হবে?
নরওয়ে, সুইডেন বা সুইজারল্যান্ডের মতো বিশুদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলছি না বা বলশেভিক বিপ্লবের পরে দুই দশকের সাম্যবাদী রাশিয়ার কথাও বলছি না অথবা বলছি না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা কানাডার মতো আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথাও। আমরা যদি কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ এবং মোটামুটি কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও গড়ে তুলতে চাই, তাহলেও আমাদের নির্মূলের রাজনীতি ও নিঃশেষ করে দেওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, নির্মূল করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে, আর নিঃশেষ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা কলুষিত করছে তাদেরকে। কথাগুলো বলা যত সহজ, বাস্তবতাটা ততটা সহজ নয়, সেটা জেনেও বলছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের উন্নয়নকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল ও শক্তির সহাবস্থানে নির্মিত মোটামুটি কার্যকর গণতন্ত্র (খুব কার্যকর বা সন্তোষজনক মাত্রার কার্যকর গণতন্ত্রের কথা বলছি না) বাংলাদেশকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য একটি 'ফাংশনাল' গণতন্ত্র নির্মাণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। এ দুটি বড় দলের উচিত ছিল স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলা এবং নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়া। কিন্তু তারা কেউই তা করেননি। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও সর্বজন-আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন থাকলে গত দুই দশকের রাজনৈতিক হানাহানি, বিপুল প্রাণহানি ও সহিংসতা যেমন বহুলাংশে এড়ানো যেত, তেমনি বাংলাদেশকে পেট্রোল বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে হতো না। ওই প্রতিষ্ঠানের অবর্তমানে যদি 'বাংলাদেশি গণতন্ত্র'কে (যা অতি অবশ্যই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের যৌথ প্রযোজনা) এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বিএনপিকে অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা ও বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করার সব অপতৎপরতা থেকে সরে আসতে হবে। আর আওয়ামী লীগকে বিএনপি নির্মূল ও নিঃশেষ করার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হতে হবে। বিএনপিকে সংসদের বাইরে রেখে, জাতীয় পার্টিকে 'গৃহপালিত বিরোধী দল' বানিয়ে আখেরে খুব সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় 'স্পেস' না দিলে গণতন্ত্র কি 'ফাংশনাল' হবে?
মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর আজ এটি বলতে কোনো বাধা নেই যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মুখবন্ধে যে সাম্যবাদী কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে, বিবৃত রয়েছে যে আইনের শাসন ও ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা, তা কেবলই তাত্তি্বক কথা। অলঙ্কারপূর্ণ ওই বাক্যমালা শুধু সংবিধানের সৌন্দর্যই বর্ধিত করেছে, ওতে জনগণের না হয়েছে কোনো উপকার, না নীতিনির্ধারকরাও সেখান থেকে নিয়েছেন কোনো অনুপ্রেরণা! বাংলাদেশ আজ পেট্রোল বোমায় দগ্ধ, বিস্টেম্ফারণে বিস্টেম্ফারণে ক্ষতবিক্ষত! বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শ্বাস-প্রশ্বাস অব্যাহত রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একটুখানি সহনশীলতা ও ঐকমত্য দরকার, সুশীল সমাজসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অবশ্যই সেই ঐকমত্যের ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের উন্নয়ন আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে ওই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে হবে।
তবে জামায়াত নিষিদ্ধ করার কথা বলাটা যত সহজ, বাস্তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তার ধাক্কাটা সামাল দেওয়া অতটা সহজ নয়। কেননা বর্তমানে সারা বাংলাদেশেই জামায়াতের একটি 'সাপোর্ট বেইজ' রয়েছে, জামায়াতের রয়েছে ব্যাংক, বীমা, কোচিং, পরিবহন ও কয়েকশ' এনজিও। সে জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে নিষিদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ব্যাপারে বিবেচনাপ্রসূত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া জামায়াত নিষিদ্ধ করলে এবং বিএনপিকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় 'স্পেস' না দিলে বাংলাদেশে চরমপন্থার উত্থান হতে পারে বলে আশঙ্কা করাটা কি খুব অমূলক হবে? তবে বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়ে, যদি তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য জনগণকে সংশ্লিষ্ট করতে না পেরে পেট্রোল বোমাভিত্তিক সন্ত্রাসে স্থাণু হয়ে বসে, তাহলে সেটি তাদের জন্য নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। পরিশেষে শুধু বলতে চাই, গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি নয়, গণতন্ত্র মানে সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংখ্যালঘুর সুরক্ষা। গণতন্ত্র মানে নির্মূল ও নিঃশেষ নয়, গণতন্ত্র মানে অন্তর্ভুক্তি।
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের কাছে চলমান আন্দোলন হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার, ১৪ দলীয় জোট ও তাদের সমর্থনকারী নাগরিক সমাজ বলছে, বর্তমানে আন্দোলনের নামে যা হচ্ছে তা হচ্ছে নির্জলা সন্ত্রাস। তাদের প্রশ্ন, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরে কোন গণতন্ত্র রক্ষা হবে? তাদের ভাষায়, চলমান অবরোধ ও হরতাল বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান আন্দোলন কি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন? নাকি প্রথম দিকে এটি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন হলেও বর্তমানে এটি বিশুদ্ধ সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের হাতে? এভাবে চলতে থাকলে জামায়াত কি নিঃশেষ হয়ে যাবে, নাকি বাংলাদেশের রাজনীতি জামায়াত ও অন্য চরমপন্থিদের হাতে চলে যাবে? সরকারের ভুলে এবং বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে পেট্রোল বোমা যে বাংলাদেশের রাজনীতির অংশ হয়ে গেল, সেই ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি বেরিয়ে আসতে পারবে কি?
৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট একটি সমাবেশ করলে কী এমন হতো? এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারই শুধু নয়, তাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলবে, কিন্তু বিরোধী দলকে তাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার পালন করা থেকে বিরত রাখবে, ভিন্নমতের দল ও গোষ্ঠীকে সমাবেশ করতে দেবে না, তাহলে সেটি কি গণতন্ত্র হলো? গণতন্ত্রকে তো গণতন্ত্র হতে হবে। গণতন্ত্র তো 'ডিফাইনড, মেড অ্যান্ড মেইনটেইনড বাই আওয়ামী লীগ' হলে হবে না! চলমান গণতন্ত্রের মধ্যে বিএনপিকে 'স্পেস' না দিয়ে আওয়ামী লীগ যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা বোঝার মতো বর্ষীয়ান ও বুঝমান নেতা কি আওয়ামী লীগে নেই? শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দলের প্রয়োজন ও উপযোগিতা সারা পৃথিবীর তাবৎ গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় স্বীকৃত। বিরোধী দলকে নিঃশেষ করে, ভিন্ন মতের দল ও গোষ্ঠীর কণ্ঠ রোধ করে, তাদের সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কী বিপদ তৈরি করছে, আওয়ামী লীগ কি তা বুঝতে পারছে?
নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আমরা যদি মনে করি, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছাব, তাহলে ওই ব্যবস্থার মধ্যে সবার অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এ ব্যবস্থাকে জুতসই মনে না করি, যদি মনে করি যে, বহুদলীয় সরকার এবং 'কমান্ড ইকোনমি'ই আমাদের লক্ষ্য অর্জনকে মসৃণ করবে, তাহলে ওই ব্যবস্থার মধ্যে প্রধান সব দল ও গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিঃশেষ, নির্মূল ও বাদ দেওয়ার রাজনীতি যে ফলপ্রসূ হবে না ইতিমধ্যে সে ব্যাপারে আমরা ধারণা পেয়েছি। ১৯৭৬ সাল থেকে দুই দশক ধরে চলেছে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিঃশেষ করার উদ্যোগ, আয়োজন। সেটা কি সফল হয়েছে? এখন মনে হয় বিএনপিকে নিঃশেষ ও নির্মূল করার চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভারসাম্যের জন্য সেটি কি ভালো হবে?
নরওয়ে, সুইডেন বা সুইজারল্যান্ডের মতো বিশুদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলছি না বা বলশেভিক বিপ্লবের পরে দুই দশকের সাম্যবাদী রাশিয়ার কথাও বলছি না অথবা বলছি না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা কানাডার মতো আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথাও। আমরা যদি কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ এবং মোটামুটি কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও গড়ে তুলতে চাই, তাহলেও আমাদের নির্মূলের রাজনীতি ও নিঃশেষ করে দেওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, নির্মূল করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে, আর নিঃশেষ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা কলুষিত করছে তাদেরকে। কথাগুলো বলা যত সহজ, বাস্তবতাটা ততটা সহজ নয়, সেটা জেনেও বলছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের উন্নয়নকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল ও শক্তির সহাবস্থানে নির্মিত মোটামুটি কার্যকর গণতন্ত্র (খুব কার্যকর বা সন্তোষজনক মাত্রার কার্যকর গণতন্ত্রের কথা বলছি না) বাংলাদেশকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য একটি 'ফাংশনাল' গণতন্ত্র নির্মাণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। এ দুটি বড় দলের উচিত ছিল স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলা এবং নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়া। কিন্তু তারা কেউই তা করেননি। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও সর্বজন-আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন থাকলে গত দুই দশকের রাজনৈতিক হানাহানি, বিপুল প্রাণহানি ও সহিংসতা যেমন বহুলাংশে এড়ানো যেত, তেমনি বাংলাদেশকে পেট্রোল বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে হতো না। ওই প্রতিষ্ঠানের অবর্তমানে যদি 'বাংলাদেশি গণতন্ত্র'কে (যা অতি অবশ্যই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের যৌথ প্রযোজনা) এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বিএনপিকে অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা ও বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করার সব অপতৎপরতা থেকে সরে আসতে হবে। আর আওয়ামী লীগকে বিএনপি নির্মূল ও নিঃশেষ করার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হতে হবে। বিএনপিকে সংসদের বাইরে রেখে, জাতীয় পার্টিকে 'গৃহপালিত বিরোধী দল' বানিয়ে আখেরে খুব সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় 'স্পেস' না দিলে গণতন্ত্র কি 'ফাংশনাল' হবে?
মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর আজ এটি বলতে কোনো বাধা নেই যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মুখবন্ধে যে সাম্যবাদী কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে, বিবৃত রয়েছে যে আইনের শাসন ও ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা, তা কেবলই তাত্তি্বক কথা। অলঙ্কারপূর্ণ ওই বাক্যমালা শুধু সংবিধানের সৌন্দর্যই বর্ধিত করেছে, ওতে জনগণের না হয়েছে কোনো উপকার, না নীতিনির্ধারকরাও সেখান থেকে নিয়েছেন কোনো অনুপ্রেরণা! বাংলাদেশ আজ পেট্রোল বোমায় দগ্ধ, বিস্টেম্ফারণে বিস্টেম্ফারণে ক্ষতবিক্ষত! বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শ্বাস-প্রশ্বাস অব্যাহত রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একটুখানি সহনশীলতা ও ঐকমত্য দরকার, সুশীল সমাজসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অবশ্যই সেই ঐকমত্যের ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের উন্নয়ন আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে ওই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে হবে।
তবে জামায়াত নিষিদ্ধ করার কথা বলাটা যত সহজ, বাস্তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তার ধাক্কাটা সামাল দেওয়া অতটা সহজ নয়। কেননা বর্তমানে সারা বাংলাদেশেই জামায়াতের একটি 'সাপোর্ট বেইজ' রয়েছে, জামায়াতের রয়েছে ব্যাংক, বীমা, কোচিং, পরিবহন ও কয়েকশ' এনজিও। সে জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে নিষিদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ব্যাপারে বিবেচনাপ্রসূত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া জামায়াত নিষিদ্ধ করলে এবং বিএনপিকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় 'স্পেস' না দিলে বাংলাদেশে চরমপন্থার উত্থান হতে পারে বলে আশঙ্কা করাটা কি খুব অমূলক হবে? তবে বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়ে, যদি তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য জনগণকে সংশ্লিষ্ট করতে না পেরে পেট্রোল বোমাভিত্তিক সন্ত্রাসে স্থাণু হয়ে বসে, তাহলে সেটি তাদের জন্য নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। পরিশেষে শুধু বলতে চাই, গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি নয়, গণতন্ত্র মানে সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংখ্যালঘুর সুরক্ষা। গণতন্ত্র মানে নির্মূল ও নিঃশেষ নয়, গণতন্ত্র মানে অন্তর্ভুক্তি।
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments