বাংলাদেশ, চলেছ কোথায়? by মীযানুল করীম
বৃহস্পতিবার
যাচ্ছিলাম অফিসে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর পাশের রাস্তায় দেখি, ক্ষমতাসীন
দলের মিছিল আসছে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে। শ্রমিক-কর্মচারী,
পেশাজীবীদের নামে আয়োজিত মিছিলটি বড়। আমরা তখন দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছে।
হঠাৎ কী যেন ফুটল। সবাই পশ্চিমে তাকিয়ে দেখি, অল্প দূরে বেশ ধোঁয়া। অর্থাৎ
কেউ ককটেল ফাটিয়েছে। এত পুলিশ পাহারার মধ্যে, এমন জনাকীর্ণ স্থানে
বোমাবাজির ঘটনা রহস্যজনক মনে হলো। মিনিবাসে যাত্রীরা ভয়ে জানালা বন্ধ করে
দিলেন। কেউ কেউ নেমে নিরাপদ জায়গায় যেতে চাচ্ছিলেন। পরে জানা যায়, ওই
মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। এর আগে গত সোমবার
এই মন্ত্রীর নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল গুলশানে বেগম জিয়ার অফিস ঘেরাও করতে।
সেখানে গুলশান এভিনিউতে ককটেল বিস্ফোরণে একজনের পা উড়ে যায়। পরদিন দৈনিক
Dhaka Tribune পত্রিকায় লিড নিউজের বিরাট শিরোনামÑ Mystery blast at
ministerÕs march)। অর্থাৎ, রাজনীতির অঙ্কের হিসাব অত সহজ নয়। সেখানে কে
কিভাবে কাকে ঘায়েল করার জন্য কোন খেলা খেলছেন, বোঝা কঠিন। আমরা দু’চোখে যা
দেখি, তা প্রকাশ্য। আড়ালে কী ঘটছে, আমাদের জানা নেই।
যা হোক, বৃহস্পতিবারের মতিঝিলে ফিরে যাই। মিনিবাসে শাপলা চত্বরে নেমে উত্তরে পা বাড়ালাম। ফিলিং স্টেশনটার সামনে পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামতেই দু’জন নেমে রাস্তা থেকে ুদ্রাকৃতির কী যেন তুলে নিচ্ছিলেন। বুঝলাম, একটু আগে এখানেও কিছু ‘ফেটেছে’। এর ‘আলামত’ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারপর আরেকটু যেতেই নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায়, সদর রাস্তার ওপর দু’টি ককটেল ফুটল। লোকজন ছোটাছুটি করে এ দিক সে দিক আশ্রয় নিলেন।
গত কয়েক বছরে সরকারের দমননীতি, অনেকের ককটেল-প্রীতি আর জনগণের যৌক্তিক ভীতিÑ তিনটিই বেড়েছে। প্রসঙ্গক্রমে একাধিক ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর। বাংলামোটর থেকে মিনিবাস যাচ্ছে শাহবাগ। শেরাটনের উত্তরে পরীবাগ ওভারব্রিজ পার হতেই ব্রিজের ওপর থেকে কী যেন ছোড়া হলো। সাথে সাথে আওয়াজ। মিনিবাসে আসনের শেষ সারির জানালার পাশে বসে দেখলাম, অল্পের জন্য ককটেল থেকে বেঁচে গেছে আমাদের গাড়িটি।
২০১৩ সালের ২ নভেম্বর। যাচ্ছিলাম সংসদ ভবনের পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে। বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। ফুটপাথে পথচারীও কম নয়। হঠাৎ মনিপুরী পাড়ার একটা গলি থেকে কয়েকটি যুবক ছুটে এসে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। মনে হলো, তাদের টার্গেট আমাদের বহনকারী মিনিবাসটি। চালক গাড়িটা দ্রুত চালিয়ে নিতে পারেননি। এ দিকে, হামলাকারীরা দ্রুত এসেই পেছনের জানালা দিয়ে পেট্রলভেজা জ্বলন্ত ন্যাকড়া ছুড়ে মারে। আমার মতো কয়েক যাত্রী অল্পের জন্য সে দিন বেঁচে যাই আল্লাহর রহমতে। তবে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে অনেকেই আহত হন। বিশেষ করে মহিলাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ততক্ষণে গাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। আক্রান্ত গাড়ি থেকে নেমে দেখি, কারো পায়ের চাপে আমার একটি জুতা হারিয়ে গেছে। কী আর করা, আরেক পাটি জুতা বাংলাদেশের অপরাজনীতির উদ্দেশে ছুড়ে দিলাম। এ দিকে, ভাঙা কাচের আঘাতে কপালে খানিকটা রক্ত। কাছের এক ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম।
এ অভিজ্ঞতা তো অনেকের তুলনায় সামান্য। গাড়িতে বোমা; বাড়িতে ধরপাকড়। কোথাও বিস্ফোরণ বা অগ্নিসংযোগ হলে দাঁড়িয়ে থাকলে ¯িপ্লন্টারে বা আগুনে আহত হওয়ার ভয়। আবার জান বাঁচাতে ছুটে পালাতে গেলে যে, গুলি খাবেন না কিংবা আটকে থানায় চালান হবেন না, তার গ্যারান্টি দেবে কে?
নিরীহ-নির্দোষ সাধারণ মানুষের এখন মহামুসিবত। যানের যাত্রী হলে হামলায় জান নিয়ে টানাটানি। অন্য দিকে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে জেরা ও তল্লাশিতে মান নিয়ে টান পড়ছে অনেকের। প্রতিপক্ষ না হয়েও বোমায়, আগুনে হতাহত হচ্ছে পাবলিক। অপর দিকে, শুধু সন্দেহের দরুন পিটুনি খাচ্ছে এবং পাকড়াও হচ্ছে প্রধানত তারাই। এভাবে আমজনতার যারা বারোটা বাজাচ্ছেন, তারা কিন্তু দেশটার অন্তত সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন।
এমন ঘটনা এখন নিত্যকার। কে যে কখন ফুটিয়ে আর ফাটিয়ে দেবে, বলা যায় না। সাধারণ মানুষ অষ্টপ্রহর আশঙ্কায়। যানে থাকুন আর হাঁটায় থাকুন, দোয়া ইউনুস পড়ে সারাক্ষণ পরম করুণাময় আল্লাহর স্মরণ নেয়া ছাড়া উপায় নেই। সরকারের প্রচারণা যা-ই হোক, পত্রপত্রিকা পড়ে মানুষ মনে করছেÑ বোমাবাজি ও সন্ত্রাস কোনো পক্ষের একচেটিয়া নয়। কেউ ক্রোধে, কেউ বা কৌশলে এসব ইস্তেমাল করে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল করে তুলছে।
বীর এখন ফুটপাথে
‘বঙ্গবীর’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দু’জন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। একজন ছিলেন সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী। অন্য জন হলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। এক সময়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের চোখের মণি। হয়েছিলেন সে দল থেকে এমপিও। যখন নীতিগত প্রশ্নে এমপি-পদ এবং প্রাণপ্রিয় দলটি ছাড়লেন, তখন থেকে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের চোখের বালি। তাই এখন তিনি যত ভালো কথাই বলুন, সেটা সরকারের ভালো লাগবে না।
২৮ জানুয়ারি থেকে পড়ে আছেন মতিঝিলের ফুটপাথে। তার এই অনির্দিষ্টকাল অবস্থান কর্মসূচির লক্ষ্য, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা। এ জন্য তিনি দেশ বাঁচাতে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন ‘জননেত্রী’ শেখ হাসিনার কাছে। আর মানুষ বাঁচাতে হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ‘দেশনেত্রী’ বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি। কেউ তার কথা কানে তোলেননি। তিনিও হাল ছাড়েননি। এ পর্যন্ত ২৮ দিন একটানা রাস্তার পাশে দিবারাত্র কাটিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন। এর মধ্যে বৃষ্টি-বাতাস এবং পুলিশের একাধিক হানার ঝামেলা গেছে। দেশে একটানা ৫০ দিন অবরোধ এবং এতেও সাড়া না দেয়ার রেকর্ড যেমন সৃষ্টি হয়েছে, এর পাশাপাশি আরেক রেকর্ড গড়েছেন ছোট দলের বড় নেতা কাদের সিদ্দিকী।
প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার পথে মতিঝিলের ফুটপাথে কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান কর্মসূচির অবস্থা দেখি। কোনো কোনো দিন বেশ লোকসমাগম দেখা যায়। বুধবার বিকেলে দেখলাম, ‘গণস্বাস্থ্য’ খ্যাত ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফুটপাথে বসে আছেন সিদ্দিকীর সাথে। কেউ কেউ অর্থসাহায্য দিচ্ছেন এই আন্দোলনে। পাশেই একজন মাঝবয়েসী শিল্পীকে প্রায় সময়ে দেখা যায় হেলে দুলে মাথা ঝাঁকিয়ে গান গাইতে। সাথে যন্ত্রশিল্পী ও দোহার আছেন। আর কাদের সিদ্দিকী কখনো বসে আলাপ করছেন, কখনো সেখানেই সটান শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্যরকম একটা দৃশ্য দেখা গেলো। মাথায় টুপি, গলায় গামছা, কাদের সিদ্দিকী বসে আছেন। এমন সময় দু’টি কিশোরী একটি শিশুকে নিয়ে এলো। ওদের পোশাকপরিচ্ছদে মনে হলো, নেহাত গরিব; হয়তো বস্তিবাসী। কাদের সিদ্দিকী নিঃসঙ্কোচে শিশুটিকে স্নেহ করে কোলে বসালেন। লোকজন ভিড় করে দেখছিল এসব কিছু।
রাজনৈতিক সহিংসতা : একটি গবেষণা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাস-সহিংসতা যে আন্তর্জাতিকভাবে সবিশেষ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে, তা স্বাভাবিক। এখন এটা অ্যাকাডেমিক গবেষণার ‘আকর্ষণীয়’ ইস্যু। যেমন, বেলজিয়ামের ঘেন্ট ইউনিভার্সিটির সঙ্ঘাত ও উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ড. বের্ট সুইকেন্স বর্তমানে গবেষণারত যে বিষয় নিয়ে, তা হলোÑ ‘বাংলাদেশে শাসন ও জনশৃঙ্খলার স্বরূপ নির্ধারণে রাজনৈতিক সহিংসতা।’
পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ড. সুইকেন্স জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ২০০২ থেকে ২০১৩, এই এক যুগে এ দেশে সংঘটিত রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার ওপর তারা গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের দৃষ্টিতেÑ অপরিপক্ব ও নৈতিকতাবিহীন রাজনৈতিক শ্রেণী এই সহিংসতা ঘটিয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশি সহিংসতা ঘটেছে ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে।’ এখানে উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে লাঠি-লগি-বৈঠার ঘটনা এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ মঞ্চকেন্দ্রিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সংসদ নির্বাচন-পূর্ব নানা অঘটন ঘটেছে। বেলজিয়ান গবেষক ড. সুইকেন্স এ দেশের সংবাদপত্র থেকে ১৮ হাজার ৩০৯টি ঘটনার তথ্য পেয়েছেন রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে। ২০০২ থেকে ’১৩ সাল পর্যন্ত ঘটেছে এই ঘটনাগুলো। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটনা ২০১৩ সালের, যাতে আহতের সংখ্যা ১২ হাজার। আর নিহত হয়েছেন ৩০০ জন। এই ইউরোপিয়ান শিক্ষাবিদ ও গবেষক বলেছেন, এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রধানত রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং বড় বড় দল জড়িত। তার ভাষায়, With regard to lethal casualties, state actors dominate, being active in over half of all violence in which fatalities occur. (হতাহতের মারাত্মক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। প্রাণহানির ঘটনার মতো সহিংসতার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তি ছিল তৎপর)
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার কারণ হিসেবে নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ছাড়াও দলীয় কোন্দল, দলে অবস্থান লাভের প্রয়াস, সম্পত্তি দখল, টেন্ডারবাজির উল্লেখ করা হয়েছে। হরতাল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সহিংসতার এক-চতুর্থাংশের মতো ঘটনা হরতালের সাথে জড়িত। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা প্রসঙ্গে জানানো হয়, ছাত্রলীগের ৪০ শতাংশ এবং ছাত্রদলের ৩০ শতাংশ সহিংসতার কারণ, নিজেদের মধ্যকার গ্রুপিং।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. বের্ট সুইকেন্স তার বক্তব্য শেষ করেছেন এই ভাষায় - This year started as a violent year. We have to see whether it continues in the same pace. At the moment, it is really difficult to make any prediction.
মুরগি আগে জন্মেছে, না ডিম?
বাংলাদেশ সর্বাধিক জনঘনত্বের একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে অনেক আগে থেকে পরিচিত ছিল। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান ৪০ বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। অথচ সুবিধাভোগী ধনাঢ্য কিছু মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বহু আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। বহু দেশে বাংলাদেশের মানুষ ‘মিসকিন’। এ দিকে দেশটির দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দুর্ভাগ্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে দুর্নীতির উপর্যুপরি চ্যাম্পিয়নশিপ। এতসব নেতিবাচক পরিচয়কেও ম্লান করে দিচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা। ঘৃণা-বিভাজনের রাজনীতি, লুণ্ঠনের অর্থনীতি এবং ঐতিহ্যবিস্মৃতির সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে গোটা জাতির বুকের ওপর উন্মাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবিধাবাদ ও সঙ্কীর্ণতা এবং হিংসা হানাহানিই প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিজাতীয় শক্তির চক্রান্তে জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন। রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা বন্ধু ও শত্রু নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে ক্রমাগত অপরিণামদর্শিতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সর্বগ্রাসী প্লাবন দেশের ভবিষ্যৎকে ডুবিয়ে দেয়ার আশঙ্কা জেগেছে। এর মূল কারণ দূর করার বদলে সরকার শুধু লক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে মেতে থাকায় পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতিই যেন আমাদের নিয়তি।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এক দিকে হরতাল-অবরোধের নামে অর্থনীতি ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ অপর দিকে প্রভাবশালী মন্ত্রী মিনিস্টাররা বলছেন, জনজীবনে হরতাল-অবরোধ প্রভাব ফেলতে পারছে না। এক মুখে দু’রকম কথা ক্ষমতাসীন মহলের মনের অস্থিরতা ও কাজের সমন্বয়হীনতা নির্দেশ করে।
যে কারো মনে প্রশ্ন না জেগে পারে না সরকারের দ্বৈত মনোভাব ও বক্তব্য নিয়ে। একই সরকার ও দলের এক নেতার কথায় মনে হয়, হরতাল-অবরোধই অর্থনীতিকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। তা না হলে আকাশে উঠে যেত। অন্য নেতার কথা শুনলে ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’ ভাবে উল্লসিত হয়ে উঠতে ইচ্ছা করবে।
গত বুধবার রাতে একটি টিভি চ্যানেলের খবর, জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো শিগগিরই বাংলাদেশে আসছেন না। পরদিন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবর, তারানকো বাংলাদেশে আসছেন। এখন কোনটা বিশ্বাসযোগ্য? আসবেন, নাকি আসবেন না? তবে পত্রিকার খবর পড়ে মনে হয়, টিভি চ্যানেলটি সরকার সমর্থক বলে তারানকো না আসার কথা জানিয়েছে। সরকার তারানকো এলে তার সাথে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। আর প্রকাশ্যে এমনভাব দেখাচ্ছে যেন, তার আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এত রাখঢাকের কী দরকার? জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সাথে সরকার আগেও অনেক কথা বলেছে। এবারো তার সাথে কথা বলা লজ্জা বা পরাজয়ের কোনো বিষয় নয়। বরং এটাই এ মুহূর্তে সরকারের একটা বড় দায়িত্ব।
মুরগি আগে জন্মেছে, না ডিম? এ বিতর্ক যে অর্থহীন, তা সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও ঠাহর করা যায়। তেমনি, আগে সন্ত্রাস বন্ধ, নাকি সংলাপ শুরু করতে হবেÑ তা নিয়ে বিতণ্ডা সৃষ্টিও নিষ্প্রয়োজন। এখন মূলত কী চলছে? বিরোধী দলের অবরোধ ও হরতাল। এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হওয়ার কথা নয়। কারণ, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, মশাল মিছিল ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে আমাদের দেশে দীর্ঘ দিন ধরেই স্বীকৃত। এগুলো কোনো দণ্ডণীয় অপরাধ হতে পারে না। এ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও অনেকবার বাস্তবায়ন করেছে। এমনকি, লাঠি-মিছিল (লগি-বৈঠারও) এবং সশস্ত্র ‘শান্তি’ মিছিল করার ক্ষেত্রে দলটি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যা হোক, কোথাও কোথাও হরতাল-অবরোধের অপপ্রয়োগ যে অতীতে হয়নি, তা নয়। এখনো হচ্ছে। আবার অনেকে এ ধরনের কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নানা অঘটন ঘটিয়ে দেয়া অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন : আজকে দেশের যে চরম উদ্বেগজনক ও আতঙ্কপূর্ণ পরিস্থিতি, এর উৎস কী? গত বছরের একতরফা ও প্রহসনের সংসদ নির্বাচন। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে যারা নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে তুলে ধরছেন, তারা নিজেরাও বুঝেন যে, এটা প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা ও কোণঠাসা করার কৌশল। রাজনৈতিক সমস্যার সুরাহা প্রশাসনিক পন্থায় হয় না। তাই যত বাহিনী নামুক, রাজনীতির বিয়োগান্ত কাহিনী কেবলি বাড়বে। সঙ্কট নিরসন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নির্ভর করছে প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। বিশেষ করে সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ববহ। তিনি শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরাট একটি সংগঠনের সভানেত্রীই নন, সাংবিধানিকভাবেও অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমানে সরকারের সমর্থক ও সমালোচক নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করেন, আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই (অতীতের প্রেসিডেন্টদের মতো অথবা এর চেয়েও বেশি) দল ও সরকার, উভয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব। তিনি যদি এখন শুধু এ ঘোষণা দেন যে, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিদ্যমান সঙ্কট মোচনের উপায় নিয়ে সংলাপের প্রশ্নে আমাদের দ্বিমত নেই’, আমরা আশা করি, সাথে সাথে পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটবে। তখন জনগণ দেখবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে কোন পক্ষের আন্তরিকতা কতটুকু। দেশবাসীর কাছে সবার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হবেই।
কারো সাথে সংলাপ অর্থ একতরফা ছাড় দিয়ে, প্রতিপক্ষের সব দাবি মেনে আত্মসমর্পণ করা নয়। অনেক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সঙ্কট অবসানের পন্থা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ জন্য পারস্পরিক আস্থা এবং উদ্দেশ্যের সততা প্রয়োজন। গলাগলি জরুরি নয়; শুধু গালাগালি বন্ধ হলেও মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। সংলাপকে পাগলের প্রলাপ বলা সত্যের অপলাপ মাত্র। মুখ দেখাদেখি তো বটেই, একে অন্যের সাথে কথা বলাও যদি বন্ধ থাকে, আমরা নিজেদের কি সভ্য জাতি হিসেবে মনে করতে পারি? আলোচনার মধ্য দিয়ে একে অন্যকে বোঝা সম্ভব। তখন ছাড় দেয়া ও সমঝোতার পথে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে বলে আমরা আশাবাদী।
পাদটীকা : ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন হাইস্কুলে নিচের দিকে পড়ি। ফেনীতে আধপাগলা এক লোক একটা অদ্ভুত গান গাইতেন। এর প্রথম কলিÑ ‘চলেছে চৈতন্যের গাড়ি সোনার মদিনায়’। হিন্দুদের বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শ্রীচৈতন্য দেবের গাড়ি কেন মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর মদিনা শরিফের উদ্দেশে যাত্রা করবে, এর জবাব পাইনি। এখনকার রাজনীতির বেহাল দশা দেখে ভাবি, আমরাও কি ভুল গাড়িতে চড়ে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছব ভেবে যাত্রা করেছি?
যা হোক, বৃহস্পতিবারের মতিঝিলে ফিরে যাই। মিনিবাসে শাপলা চত্বরে নেমে উত্তরে পা বাড়ালাম। ফিলিং স্টেশনটার সামনে পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামতেই দু’জন নেমে রাস্তা থেকে ুদ্রাকৃতির কী যেন তুলে নিচ্ছিলেন। বুঝলাম, একটু আগে এখানেও কিছু ‘ফেটেছে’। এর ‘আলামত’ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারপর আরেকটু যেতেই নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায়, সদর রাস্তার ওপর দু’টি ককটেল ফুটল। লোকজন ছোটাছুটি করে এ দিক সে দিক আশ্রয় নিলেন।
গত কয়েক বছরে সরকারের দমননীতি, অনেকের ককটেল-প্রীতি আর জনগণের যৌক্তিক ভীতিÑ তিনটিই বেড়েছে। প্রসঙ্গক্রমে একাধিক ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর। বাংলামোটর থেকে মিনিবাস যাচ্ছে শাহবাগ। শেরাটনের উত্তরে পরীবাগ ওভারব্রিজ পার হতেই ব্রিজের ওপর থেকে কী যেন ছোড়া হলো। সাথে সাথে আওয়াজ। মিনিবাসে আসনের শেষ সারির জানালার পাশে বসে দেখলাম, অল্পের জন্য ককটেল থেকে বেঁচে গেছে আমাদের গাড়িটি।
২০১৩ সালের ২ নভেম্বর। যাচ্ছিলাম সংসদ ভবনের পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে। বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। ফুটপাথে পথচারীও কম নয়। হঠাৎ মনিপুরী পাড়ার একটা গলি থেকে কয়েকটি যুবক ছুটে এসে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। মনে হলো, তাদের টার্গেট আমাদের বহনকারী মিনিবাসটি। চালক গাড়িটা দ্রুত চালিয়ে নিতে পারেননি। এ দিকে, হামলাকারীরা দ্রুত এসেই পেছনের জানালা দিয়ে পেট্রলভেজা জ্বলন্ত ন্যাকড়া ছুড়ে মারে। আমার মতো কয়েক যাত্রী অল্পের জন্য সে দিন বেঁচে যাই আল্লাহর রহমতে। তবে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে অনেকেই আহত হন। বিশেষ করে মহিলাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ততক্ষণে গাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। আক্রান্ত গাড়ি থেকে নেমে দেখি, কারো পায়ের চাপে আমার একটি জুতা হারিয়ে গেছে। কী আর করা, আরেক পাটি জুতা বাংলাদেশের অপরাজনীতির উদ্দেশে ছুড়ে দিলাম। এ দিকে, ভাঙা কাচের আঘাতে কপালে খানিকটা রক্ত। কাছের এক ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম।
এ অভিজ্ঞতা তো অনেকের তুলনায় সামান্য। গাড়িতে বোমা; বাড়িতে ধরপাকড়। কোথাও বিস্ফোরণ বা অগ্নিসংযোগ হলে দাঁড়িয়ে থাকলে ¯িপ্লন্টারে বা আগুনে আহত হওয়ার ভয়। আবার জান বাঁচাতে ছুটে পালাতে গেলে যে, গুলি খাবেন না কিংবা আটকে থানায় চালান হবেন না, তার গ্যারান্টি দেবে কে?
নিরীহ-নির্দোষ সাধারণ মানুষের এখন মহামুসিবত। যানের যাত্রী হলে হামলায় জান নিয়ে টানাটানি। অন্য দিকে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে জেরা ও তল্লাশিতে মান নিয়ে টান পড়ছে অনেকের। প্রতিপক্ষ না হয়েও বোমায়, আগুনে হতাহত হচ্ছে পাবলিক। অপর দিকে, শুধু সন্দেহের দরুন পিটুনি খাচ্ছে এবং পাকড়াও হচ্ছে প্রধানত তারাই। এভাবে আমজনতার যারা বারোটা বাজাচ্ছেন, তারা কিন্তু দেশটার অন্তত সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন।
এমন ঘটনা এখন নিত্যকার। কে যে কখন ফুটিয়ে আর ফাটিয়ে দেবে, বলা যায় না। সাধারণ মানুষ অষ্টপ্রহর আশঙ্কায়। যানে থাকুন আর হাঁটায় থাকুন, দোয়া ইউনুস পড়ে সারাক্ষণ পরম করুণাময় আল্লাহর স্মরণ নেয়া ছাড়া উপায় নেই। সরকারের প্রচারণা যা-ই হোক, পত্রপত্রিকা পড়ে মানুষ মনে করছেÑ বোমাবাজি ও সন্ত্রাস কোনো পক্ষের একচেটিয়া নয়। কেউ ক্রোধে, কেউ বা কৌশলে এসব ইস্তেমাল করে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল করে তুলছে।
বীর এখন ফুটপাথে
‘বঙ্গবীর’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দু’জন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। একজন ছিলেন সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী। অন্য জন হলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। এক সময়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের চোখের মণি। হয়েছিলেন সে দল থেকে এমপিও। যখন নীতিগত প্রশ্নে এমপি-পদ এবং প্রাণপ্রিয় দলটি ছাড়লেন, তখন থেকে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের চোখের বালি। তাই এখন তিনি যত ভালো কথাই বলুন, সেটা সরকারের ভালো লাগবে না।
২৮ জানুয়ারি থেকে পড়ে আছেন মতিঝিলের ফুটপাথে। তার এই অনির্দিষ্টকাল অবস্থান কর্মসূচির লক্ষ্য, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা। এ জন্য তিনি দেশ বাঁচাতে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন ‘জননেত্রী’ শেখ হাসিনার কাছে। আর মানুষ বাঁচাতে হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ‘দেশনেত্রী’ বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি। কেউ তার কথা কানে তোলেননি। তিনিও হাল ছাড়েননি। এ পর্যন্ত ২৮ দিন একটানা রাস্তার পাশে দিবারাত্র কাটিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন। এর মধ্যে বৃষ্টি-বাতাস এবং পুলিশের একাধিক হানার ঝামেলা গেছে। দেশে একটানা ৫০ দিন অবরোধ এবং এতেও সাড়া না দেয়ার রেকর্ড যেমন সৃষ্টি হয়েছে, এর পাশাপাশি আরেক রেকর্ড গড়েছেন ছোট দলের বড় নেতা কাদের সিদ্দিকী।
প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার পথে মতিঝিলের ফুটপাথে কাদের সিদ্দিকীর অবস্থান কর্মসূচির অবস্থা দেখি। কোনো কোনো দিন বেশ লোকসমাগম দেখা যায়। বুধবার বিকেলে দেখলাম, ‘গণস্বাস্থ্য’ খ্যাত ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফুটপাথে বসে আছেন সিদ্দিকীর সাথে। কেউ কেউ অর্থসাহায্য দিচ্ছেন এই আন্দোলনে। পাশেই একজন মাঝবয়েসী শিল্পীকে প্রায় সময়ে দেখা যায় হেলে দুলে মাথা ঝাঁকিয়ে গান গাইতে। সাথে যন্ত্রশিল্পী ও দোহার আছেন। আর কাদের সিদ্দিকী কখনো বসে আলাপ করছেন, কখনো সেখানেই সটান শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্যরকম একটা দৃশ্য দেখা গেলো। মাথায় টুপি, গলায় গামছা, কাদের সিদ্দিকী বসে আছেন। এমন সময় দু’টি কিশোরী একটি শিশুকে নিয়ে এলো। ওদের পোশাকপরিচ্ছদে মনে হলো, নেহাত গরিব; হয়তো বস্তিবাসী। কাদের সিদ্দিকী নিঃসঙ্কোচে শিশুটিকে স্নেহ করে কোলে বসালেন। লোকজন ভিড় করে দেখছিল এসব কিছু।
রাজনৈতিক সহিংসতা : একটি গবেষণা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাস-সহিংসতা যে আন্তর্জাতিকভাবে সবিশেষ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে, তা স্বাভাবিক। এখন এটা অ্যাকাডেমিক গবেষণার ‘আকর্ষণীয়’ ইস্যু। যেমন, বেলজিয়ামের ঘেন্ট ইউনিভার্সিটির সঙ্ঘাত ও উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ড. বের্ট সুইকেন্স বর্তমানে গবেষণারত যে বিষয় নিয়ে, তা হলোÑ ‘বাংলাদেশে শাসন ও জনশৃঙ্খলার স্বরূপ নির্ধারণে রাজনৈতিক সহিংসতা।’
পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ড. সুইকেন্স জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ২০০২ থেকে ২০১৩, এই এক যুগে এ দেশে সংঘটিত রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার ওপর তারা গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের দৃষ্টিতেÑ অপরিপক্ব ও নৈতিকতাবিহীন রাজনৈতিক শ্রেণী এই সহিংসতা ঘটিয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশি সহিংসতা ঘটেছে ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে।’ এখানে উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে লাঠি-লগি-বৈঠার ঘটনা এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ মঞ্চকেন্দ্রিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সংসদ নির্বাচন-পূর্ব নানা অঘটন ঘটেছে। বেলজিয়ান গবেষক ড. সুইকেন্স এ দেশের সংবাদপত্র থেকে ১৮ হাজার ৩০৯টি ঘটনার তথ্য পেয়েছেন রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে। ২০০২ থেকে ’১৩ সাল পর্যন্ত ঘটেছে এই ঘটনাগুলো। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটনা ২০১৩ সালের, যাতে আহতের সংখ্যা ১২ হাজার। আর নিহত হয়েছেন ৩০০ জন। এই ইউরোপিয়ান শিক্ষাবিদ ও গবেষক বলেছেন, এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রধানত রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং বড় বড় দল জড়িত। তার ভাষায়, With regard to lethal casualties, state actors dominate, being active in over half of all violence in which fatalities occur. (হতাহতের মারাত্মক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। প্রাণহানির ঘটনার মতো সহিংসতার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তি ছিল তৎপর)
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার কারণ হিসেবে নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ছাড়াও দলীয় কোন্দল, দলে অবস্থান লাভের প্রয়াস, সম্পত্তি দখল, টেন্ডারবাজির উল্লেখ করা হয়েছে। হরতাল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সহিংসতার এক-চতুর্থাংশের মতো ঘটনা হরতালের সাথে জড়িত। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা প্রসঙ্গে জানানো হয়, ছাত্রলীগের ৪০ শতাংশ এবং ছাত্রদলের ৩০ শতাংশ সহিংসতার কারণ, নিজেদের মধ্যকার গ্রুপিং।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. বের্ট সুইকেন্স তার বক্তব্য শেষ করেছেন এই ভাষায় - This year started as a violent year. We have to see whether it continues in the same pace. At the moment, it is really difficult to make any prediction.
মুরগি আগে জন্মেছে, না ডিম?
বাংলাদেশ সর্বাধিক জনঘনত্বের একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে অনেক আগে থেকে পরিচিত ছিল। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান ৪০ বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। অথচ সুবিধাভোগী ধনাঢ্য কিছু মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বহু আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। বহু দেশে বাংলাদেশের মানুষ ‘মিসকিন’। এ দিকে দেশটির দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দুর্ভাগ্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে দুর্নীতির উপর্যুপরি চ্যাম্পিয়নশিপ। এতসব নেতিবাচক পরিচয়কেও ম্লান করে দিচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা। ঘৃণা-বিভাজনের রাজনীতি, লুণ্ঠনের অর্থনীতি এবং ঐতিহ্যবিস্মৃতির সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে গোটা জাতির বুকের ওপর উন্মাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবিধাবাদ ও সঙ্কীর্ণতা এবং হিংসা হানাহানিই প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিজাতীয় শক্তির চক্রান্তে জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন। রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা বন্ধু ও শত্রু নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে ক্রমাগত অপরিণামদর্শিতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সর্বগ্রাসী প্লাবন দেশের ভবিষ্যৎকে ডুবিয়ে দেয়ার আশঙ্কা জেগেছে। এর মূল কারণ দূর করার বদলে সরকার শুধু লক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে মেতে থাকায় পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতিই যেন আমাদের নিয়তি।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এক দিকে হরতাল-অবরোধের নামে অর্থনীতি ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ অপর দিকে প্রভাবশালী মন্ত্রী মিনিস্টাররা বলছেন, জনজীবনে হরতাল-অবরোধ প্রভাব ফেলতে পারছে না। এক মুখে দু’রকম কথা ক্ষমতাসীন মহলের মনের অস্থিরতা ও কাজের সমন্বয়হীনতা নির্দেশ করে।
যে কারো মনে প্রশ্ন না জেগে পারে না সরকারের দ্বৈত মনোভাব ও বক্তব্য নিয়ে। একই সরকার ও দলের এক নেতার কথায় মনে হয়, হরতাল-অবরোধই অর্থনীতিকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। তা না হলে আকাশে উঠে যেত। অন্য নেতার কথা শুনলে ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’ ভাবে উল্লসিত হয়ে উঠতে ইচ্ছা করবে।
গত বুধবার রাতে একটি টিভি চ্যানেলের খবর, জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো শিগগিরই বাংলাদেশে আসছেন না। পরদিন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবর, তারানকো বাংলাদেশে আসছেন। এখন কোনটা বিশ্বাসযোগ্য? আসবেন, নাকি আসবেন না? তবে পত্রিকার খবর পড়ে মনে হয়, টিভি চ্যানেলটি সরকার সমর্থক বলে তারানকো না আসার কথা জানিয়েছে। সরকার তারানকো এলে তার সাথে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। আর প্রকাশ্যে এমনভাব দেখাচ্ছে যেন, তার আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এত রাখঢাকের কী দরকার? জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সাথে সরকার আগেও অনেক কথা বলেছে। এবারো তার সাথে কথা বলা লজ্জা বা পরাজয়ের কোনো বিষয় নয়। বরং এটাই এ মুহূর্তে সরকারের একটা বড় দায়িত্ব।
মুরগি আগে জন্মেছে, না ডিম? এ বিতর্ক যে অর্থহীন, তা সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও ঠাহর করা যায়। তেমনি, আগে সন্ত্রাস বন্ধ, নাকি সংলাপ শুরু করতে হবেÑ তা নিয়ে বিতণ্ডা সৃষ্টিও নিষ্প্রয়োজন। এখন মূলত কী চলছে? বিরোধী দলের অবরোধ ও হরতাল। এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হওয়ার কথা নয়। কারণ, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, মশাল মিছিল ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে আমাদের দেশে দীর্ঘ দিন ধরেই স্বীকৃত। এগুলো কোনো দণ্ডণীয় অপরাধ হতে পারে না। এ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও অনেকবার বাস্তবায়ন করেছে। এমনকি, লাঠি-মিছিল (লগি-বৈঠারও) এবং সশস্ত্র ‘শান্তি’ মিছিল করার ক্ষেত্রে দলটি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যা হোক, কোথাও কোথাও হরতাল-অবরোধের অপপ্রয়োগ যে অতীতে হয়নি, তা নয়। এখনো হচ্ছে। আবার অনেকে এ ধরনের কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নানা অঘটন ঘটিয়ে দেয়া অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন : আজকে দেশের যে চরম উদ্বেগজনক ও আতঙ্কপূর্ণ পরিস্থিতি, এর উৎস কী? গত বছরের একতরফা ও প্রহসনের সংসদ নির্বাচন। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে যারা নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে তুলে ধরছেন, তারা নিজেরাও বুঝেন যে, এটা প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা ও কোণঠাসা করার কৌশল। রাজনৈতিক সমস্যার সুরাহা প্রশাসনিক পন্থায় হয় না। তাই যত বাহিনী নামুক, রাজনীতির বিয়োগান্ত কাহিনী কেবলি বাড়বে। সঙ্কট নিরসন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নির্ভর করছে প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। বিশেষ করে সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ববহ। তিনি শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরাট একটি সংগঠনের সভানেত্রীই নন, সাংবিধানিকভাবেও অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমানে সরকারের সমর্থক ও সমালোচক নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করেন, আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই (অতীতের প্রেসিডেন্টদের মতো অথবা এর চেয়েও বেশি) দল ও সরকার, উভয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব। তিনি যদি এখন শুধু এ ঘোষণা দেন যে, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিদ্যমান সঙ্কট মোচনের উপায় নিয়ে সংলাপের প্রশ্নে আমাদের দ্বিমত নেই’, আমরা আশা করি, সাথে সাথে পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটবে। তখন জনগণ দেখবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে কোন পক্ষের আন্তরিকতা কতটুকু। দেশবাসীর কাছে সবার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হবেই।
কারো সাথে সংলাপ অর্থ একতরফা ছাড় দিয়ে, প্রতিপক্ষের সব দাবি মেনে আত্মসমর্পণ করা নয়। অনেক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সঙ্কট অবসানের পন্থা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ জন্য পারস্পরিক আস্থা এবং উদ্দেশ্যের সততা প্রয়োজন। গলাগলি জরুরি নয়; শুধু গালাগালি বন্ধ হলেও মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। সংলাপকে পাগলের প্রলাপ বলা সত্যের অপলাপ মাত্র। মুখ দেখাদেখি তো বটেই, একে অন্যের সাথে কথা বলাও যদি বন্ধ থাকে, আমরা নিজেদের কি সভ্য জাতি হিসেবে মনে করতে পারি? আলোচনার মধ্য দিয়ে একে অন্যকে বোঝা সম্ভব। তখন ছাড় দেয়া ও সমঝোতার পথে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে বলে আমরা আশাবাদী।
পাদটীকা : ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন হাইস্কুলে নিচের দিকে পড়ি। ফেনীতে আধপাগলা এক লোক একটা অদ্ভুত গান গাইতেন। এর প্রথম কলিÑ ‘চলেছে চৈতন্যের গাড়ি সোনার মদিনায়’। হিন্দুদের বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শ্রীচৈতন্য দেবের গাড়ি কেন মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর মদিনা শরিফের উদ্দেশে যাত্রা করবে, এর জবাব পাইনি। এখনকার রাজনীতির বেহাল দশা দেখে ভাবি, আমরাও কি ভুল গাড়িতে চড়ে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছব ভেবে যাত্রা করেছি?
No comments