ভুল পথে বিএনপি! by সোহরাব হাসান
সংসদ
বাংলা অভিধান অনুযায়ী আন্দোলন শব্দের অর্থ দোলন, আলোড়ন। লক্ষ্য সিদ্ধির
জন্য প্রচার, উত্তেজনা, সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ প্রদর্শন। যে নামেই ডাকি না কেন
দল হিসেবে বিএনপি কিংবা ২০-দলীয় জোট এখন আন্দোলনে আছে। কিন্তু সেই
আন্দোলনের স্বরূপটি কেমন, কারা সেই আন্দোলনের নির্দেশ দিচ্ছেন, কীভাবে
নির্দেশ দিচ্ছেন, কারা সেই নির্দেশ পালন করছেন, সেসব মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
আন্দোলন আর বিপ্লব এক নয়। বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব দুটোই আকস্মিক ঘটে।
বাংলাদেশেও এর একাধিক নজির আছে। কিন্তু গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে হয় জনগণকে
সঙ্গে নিয়ে, ধাপে ধাপে। একটি স্তর পার হয়ে আরেকটি স্তরে তাকে নিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের
বিগত আন্দোলনগুলোর দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা
করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সেই
আন্দোলন পূর্ণতা পায় ১৯৫২ সালে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৬২
সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে। এরপর
চৌষট্টির দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ছেষট্টির ছয় দফা, আটষট্টির
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পার হয়ে উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটি
পূর্ণতা পায় এবং আইয়ুব শাহির পতন ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ছাত্র বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে জীবন দেন জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহাসহ অনেক শিক্ষার্থী। এরপর ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮ হয়ে নব্বইয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। সেই আন্দোলনের অগ্রসারিতে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল এবং বামপন্থার অনুসারী পাঁচ দল। সে সময় তিন জোট মিলে দেশ শাসনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটি ছুড়ে ফেলেছে। বর্তমানে গণতন্ত্রের যে সংকট, তার মূলেও রয়েছে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন না করা এবং পরিত্যক্ত স্বৈরাচার ও রাজাকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ শাসন।
এরশাদের পতনের পরও এ দেশে গণ-আন্দোলন হয়েছে। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী মিলে আন্দোলন করেছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী জোট বেঁধে আন্দোলন করেছে। আবার সব দল যুগপৎ আন্দোলন করেছে সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে। সেসব আন্দোলন যতই ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও আদর্শবর্জিতই হোক না কেন, জনগণের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা ছিল। সরকারের জেল-জুলুম, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে আন্দোলনরত দলগুলোর নেতা-কর্মীরা মাঠে তৎপর ছিলেন।
কিন্তু এবারের আন্দোলনের চেহারাটি ভিন্ন। আন্দোলনের নামে প্রায় পৌনে দুই মাস ধরে চলছে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পেট্রলবোমার আগুনে, ককটেলের আঘাতে মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ। মারা যাচ্ছে কথিত বন্দুকযুদ্ধেও। আন্দোলন আহ্বানকারীরা জনগণ দূরে থাক, দলীয় নেতা-কর্মীদেরও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ভেবেছেন ২০১৩ সালের কায়দায় বোমা মেরে, বাস-ট্রেন জ্বালিয়ে আন্দোলন সফল করা যাবে। একটি যৌক্তিক দাবির আন্দোলন কীভাবে সন্ত্রাসের চোরাগলিতে নিক্ষিপ্ত হয়, তার প্রমাণ বিএনপি-জামায়াত জোটের লাগাতার কর্মসূচি। তাদের আন্দোলনে মানুষ উদ্বুদ্ধ ও আশ্বস্ত হওয়ার বদলে নিয়ত শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।
বিএনপির তরফে যুক্তি দেখানো হয় যে সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামতে পারছেন না। দলীয় নেত্রীকে তাঁর অফিসে প্রায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে নেতারা আত্মগোপন অবস্থা থেকে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তাঁদের এই অভিযোগ হয়তো অসত্য নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখি মাঠে নামতে না দেওয়া বিএনপির কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবর্ধনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসেন, খোশ আলাপ করেন, তখন ভাবি তাহলে কি ধরপাকড়ের বিষয়টিও বাছাই করা?
বিএনপি তার কর্মসূচিতে কেন জনগণকে সম্পৃক্ত করাতে পারেনি, সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে দলের দাবিগুলোর প্রতি আলোকপাত করা যাক। ২০০৭ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ডান-বাম সবাইকে এক করতে পারলেও খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগবিরোধী সবাইকে পক্ষে টানতে পারেননি। জামায়াতকে জোটে নেওয়া এবং বিএনপি আমলের বাড়াবাড়িই এর কারণ। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ২০০৭ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ পার করে নির্বাচনের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া শুরু থেকেই জামায়াতকে (যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোই ওই দলটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল) নিয়ে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিরোধের ডাক দেন। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার সংলাপ প্রস্তাবও তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এক বছর বিএনপি জোট প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকে হঠাৎ লাগাতার কর্মসূচি দেশবাসীর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের অনেক নেতা-কর্মীও অবাক হয়েছেন। কেননা, এ ধরনের একটি কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে যে প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন, তা বিএনপির ছিল না।
গত ৩১ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া নতুন নির্বাচনের দাবিতে যখন সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেন, তখনো কর্মসূচি সম্পর্কে দেশবাসীকে ন্যূনতম ধারণা দেওয়া হয়নি। খালেদার প্রস্তাবগুলো ছিল যথাক্রমে এক. জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। দুই. নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের সম্মতিতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও বর্তমান আরপিও সংশোধন। তিন. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিতে গঠিত’ নির্দলীয় সরকারের হাতে দায়িত্ব দেওয়া। চার. ভোটের তারিখ ঘোষণার পর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা। পাঁচ. নির্বাচনের প্রচার শুরুর আগেই সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানোর পাশাপাশি ‘চিহ্নিত ও বিতর্কিত’ ব্যক্তিদের প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা। ছয়. সব রাজবন্দীকে মুক্তি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নামে থাকা ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহার। সাত. এ সরকারের সময়ে ‘বন্ধ করে দেওয়া’ সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খুলে দিতে হবে।
এসব অযৌক্তিক নয়। কিন্তু এই যৌক্তিক দাবি আদায়ে যে পথ তিনি বেছে নিলেন, তা অযৌক্তিক ও জবরদস্তিমূলক। সরকার ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে জনসভা করতে দেয়নি। তাঁকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমরা তার নিন্দা করি। তাই বলে তিনি দেশবাসীকে মাসের পর মাস অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেন না। বিএনপির নেত্রী পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিক কর্মসূচি আসবে বলে ঘোষণা দিলেও দেশবাসীর ওপর বিরামহীন অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছেন।
১ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়: খালেদা জিয়া যে এ ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরবেন, তা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি বড় অংশ জানতেন না। হঠাৎ এ উদ্যোগে তাঁরা কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া এ প্রস্তাব দেওয়ার আগে তা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়।... বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যাডামের বক্তব্যে আমরা নিজেরাও কনফিউজড (বিভ্রান্ত)। উনি যেভাবে কথা বলছিলেন, এগুলো তো নির্বাচনের প্রাক্কালের কথা। নির্বাচন কি খুব কাছাকাছি সময়ে হচ্ছে? কেউই মনে করছে না যে মার্চ-এপ্রিল বা ভেরি নিয়ার ফিউচার (নিকট ভবিষ্যৎ) নির্বাচন হচ্ছে। জাতিসংঘের মতো বড় কোনো শক্তি কি নির্বাচনের ব্যবস্থা করছে? আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিস্থিতি তো সে কথা বলছে না।’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০১৫)
বিএনপির সাত দফা প্রস্তাব ও পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে খোদ দলেই বিভ্রান্তি আছে। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা ছাড়া কেউই কর্মসূচি সম্পর্কে জানতেন না। সে কারণেই শীর্ষ নেতৃত্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিদেশি সুহৃদদের ওপর বেশি ভরসা করেছেন। এমনকি তারা ভারতের মন জয় করারও চেষ্টা করেছেন। বিজেপি নেতা অমিত শাহর সঙ্গে কথিত টেলিফোন সংলাপ সেই চেষ্টারই ফল।
কয়েক দিন আগে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়। দেখলাম তাঁরা আন্দোলনের গতি–প্রকৃতি নিয়ে বেশ হতাশ। একজন বললেন, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই, তাই রাজনীতি নিয়ে তাঁর কথা বলারও আগ্রহ নেই। আরেকজন বললেন, দেশের পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। জিজ্ঞেস করলাম, এর জন্য কি সরকার একাই দায়ী? তিনি উত্তরে বললেন, সরকারেরও ভুল আছে, আমাদেরও ভুল আছে। আন্দোলনের নামে যেভাবে পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তা মেনে নিতে পারেননি এই নেতা।
লাগাতার অবরোধের শুরুতে অজ্ঞাত স্থান থেকে এলান পাঠাতেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর পাঠান সালাহ উদ্দিন আহমদ। দুজনই দলের যুগ্ম মহাসচিব। সালাহ উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আজ আমরা ঘোষণা করছি, চলমান গণ-আন্দোলনে যাদের প্রাণ বিসর্জিত হচ্ছে, সরকারি বাহিনীর হাতে, তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করা হবে, তাদের পরিবারদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা হবে। তাদের সবাই এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।’
১৯৭১ সালে এই দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরাই মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় বীর। কিন্তু সালাহ উদ্দিন সাহেবরা নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় বীর বানাতে চাইছেন। এটি কিসের আলামত? তবে যেসব নিরীহ মানুষ বিএনপি ও জামায়াত–শিবিরের কর্মীদের ছোড়া পেট্রলবোমায় মারা গেছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছুই বলেননি বিএনপির এই নেতা। পেট্রলবোমার দায়ও নিতে চাইছেন না তাঁরা। কিন্তু দায় অস্বীকার করলেই কি দায়িত্ব এড়ানো যায়?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ছাত্র বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে জীবন দেন জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহাসহ অনেক শিক্ষার্থী। এরপর ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮ হয়ে নব্বইয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। সেই আন্দোলনের অগ্রসারিতে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল এবং বামপন্থার অনুসারী পাঁচ দল। সে সময় তিন জোট মিলে দেশ শাসনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটি ছুড়ে ফেলেছে। বর্তমানে গণতন্ত্রের যে সংকট, তার মূলেও রয়েছে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন না করা এবং পরিত্যক্ত স্বৈরাচার ও রাজাকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ শাসন।
এরশাদের পতনের পরও এ দেশে গণ-আন্দোলন হয়েছে। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী মিলে আন্দোলন করেছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী জোট বেঁধে আন্দোলন করেছে। আবার সব দল যুগপৎ আন্দোলন করেছে সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে। সেসব আন্দোলন যতই ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও আদর্শবর্জিতই হোক না কেন, জনগণের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা ছিল। সরকারের জেল-জুলুম, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে আন্দোলনরত দলগুলোর নেতা-কর্মীরা মাঠে তৎপর ছিলেন।
কিন্তু এবারের আন্দোলনের চেহারাটি ভিন্ন। আন্দোলনের নামে প্রায় পৌনে দুই মাস ধরে চলছে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পেট্রলবোমার আগুনে, ককটেলের আঘাতে মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ। মারা যাচ্ছে কথিত বন্দুকযুদ্ধেও। আন্দোলন আহ্বানকারীরা জনগণ দূরে থাক, দলীয় নেতা-কর্মীদেরও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ভেবেছেন ২০১৩ সালের কায়দায় বোমা মেরে, বাস-ট্রেন জ্বালিয়ে আন্দোলন সফল করা যাবে। একটি যৌক্তিক দাবির আন্দোলন কীভাবে সন্ত্রাসের চোরাগলিতে নিক্ষিপ্ত হয়, তার প্রমাণ বিএনপি-জামায়াত জোটের লাগাতার কর্মসূচি। তাদের আন্দোলনে মানুষ উদ্বুদ্ধ ও আশ্বস্ত হওয়ার বদলে নিয়ত শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।
বিএনপির তরফে যুক্তি দেখানো হয় যে সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামতে পারছেন না। দলীয় নেত্রীকে তাঁর অফিসে প্রায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে নেতারা আত্মগোপন অবস্থা থেকে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তাঁদের এই অভিযোগ হয়তো অসত্য নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখি মাঠে নামতে না দেওয়া বিএনপির কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবর্ধনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসেন, খোশ আলাপ করেন, তখন ভাবি তাহলে কি ধরপাকড়ের বিষয়টিও বাছাই করা?
বিএনপি তার কর্মসূচিতে কেন জনগণকে সম্পৃক্ত করাতে পারেনি, সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে দলের দাবিগুলোর প্রতি আলোকপাত করা যাক। ২০০৭ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ডান-বাম সবাইকে এক করতে পারলেও খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগবিরোধী সবাইকে পক্ষে টানতে পারেননি। জামায়াতকে জোটে নেওয়া এবং বিএনপি আমলের বাড়াবাড়িই এর কারণ। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ২০০৭ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ পার করে নির্বাচনের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া শুরু থেকেই জামায়াতকে (যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোই ওই দলটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল) নিয়ে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিরোধের ডাক দেন। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার সংলাপ প্রস্তাবও তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এক বছর বিএনপি জোট প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকে হঠাৎ লাগাতার কর্মসূচি দেশবাসীর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের অনেক নেতা-কর্মীও অবাক হয়েছেন। কেননা, এ ধরনের একটি কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে যে প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন, তা বিএনপির ছিল না।
গত ৩১ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া নতুন নির্বাচনের দাবিতে যখন সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেন, তখনো কর্মসূচি সম্পর্কে দেশবাসীকে ন্যূনতম ধারণা দেওয়া হয়নি। খালেদার প্রস্তাবগুলো ছিল যথাক্রমে এক. জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। দুই. নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের সম্মতিতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও বর্তমান আরপিও সংশোধন। তিন. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিতে গঠিত’ নির্দলীয় সরকারের হাতে দায়িত্ব দেওয়া। চার. ভোটের তারিখ ঘোষণার পর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা। পাঁচ. নির্বাচনের প্রচার শুরুর আগেই সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানোর পাশাপাশি ‘চিহ্নিত ও বিতর্কিত’ ব্যক্তিদের প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা। ছয়. সব রাজবন্দীকে মুক্তি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নামে থাকা ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহার। সাত. এ সরকারের সময়ে ‘বন্ধ করে দেওয়া’ সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খুলে দিতে হবে।
এসব অযৌক্তিক নয়। কিন্তু এই যৌক্তিক দাবি আদায়ে যে পথ তিনি বেছে নিলেন, তা অযৌক্তিক ও জবরদস্তিমূলক। সরকার ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে জনসভা করতে দেয়নি। তাঁকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমরা তার নিন্দা করি। তাই বলে তিনি দেশবাসীকে মাসের পর মাস অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেন না। বিএনপির নেত্রী পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিক কর্মসূচি আসবে বলে ঘোষণা দিলেও দেশবাসীর ওপর বিরামহীন অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছেন।
১ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়: খালেদা জিয়া যে এ ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরবেন, তা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি বড় অংশ জানতেন না। হঠাৎ এ উদ্যোগে তাঁরা কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া এ প্রস্তাব দেওয়ার আগে তা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়।... বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যাডামের বক্তব্যে আমরা নিজেরাও কনফিউজড (বিভ্রান্ত)। উনি যেভাবে কথা বলছিলেন, এগুলো তো নির্বাচনের প্রাক্কালের কথা। নির্বাচন কি খুব কাছাকাছি সময়ে হচ্ছে? কেউই মনে করছে না যে মার্চ-এপ্রিল বা ভেরি নিয়ার ফিউচার (নিকট ভবিষ্যৎ) নির্বাচন হচ্ছে। জাতিসংঘের মতো বড় কোনো শক্তি কি নির্বাচনের ব্যবস্থা করছে? আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিস্থিতি তো সে কথা বলছে না।’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০১৫)
বিএনপির সাত দফা প্রস্তাব ও পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে খোদ দলেই বিভ্রান্তি আছে। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা ছাড়া কেউই কর্মসূচি সম্পর্কে জানতেন না। সে কারণেই শীর্ষ নেতৃত্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিদেশি সুহৃদদের ওপর বেশি ভরসা করেছেন। এমনকি তারা ভারতের মন জয় করারও চেষ্টা করেছেন। বিজেপি নেতা অমিত শাহর সঙ্গে কথিত টেলিফোন সংলাপ সেই চেষ্টারই ফল।
কয়েক দিন আগে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়। দেখলাম তাঁরা আন্দোলনের গতি–প্রকৃতি নিয়ে বেশ হতাশ। একজন বললেন, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই, তাই রাজনীতি নিয়ে তাঁর কথা বলারও আগ্রহ নেই। আরেকজন বললেন, দেশের পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। জিজ্ঞেস করলাম, এর জন্য কি সরকার একাই দায়ী? তিনি উত্তরে বললেন, সরকারেরও ভুল আছে, আমাদেরও ভুল আছে। আন্দোলনের নামে যেভাবে পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তা মেনে নিতে পারেননি এই নেতা।
লাগাতার অবরোধের শুরুতে অজ্ঞাত স্থান থেকে এলান পাঠাতেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর পাঠান সালাহ উদ্দিন আহমদ। দুজনই দলের যুগ্ম মহাসচিব। সালাহ উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আজ আমরা ঘোষণা করছি, চলমান গণ-আন্দোলনে যাদের প্রাণ বিসর্জিত হচ্ছে, সরকারি বাহিনীর হাতে, তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করা হবে, তাদের পরিবারদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা হবে। তাদের সবাই এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।’
১৯৭১ সালে এই দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরাই মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় বীর। কিন্তু সালাহ উদ্দিন সাহেবরা নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় বীর বানাতে চাইছেন। এটি কিসের আলামত? তবে যেসব নিরীহ মানুষ বিএনপি ও জামায়াত–শিবিরের কর্মীদের ছোড়া পেট্রলবোমায় মারা গেছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছুই বলেননি বিএনপির এই নেতা। পেট্রলবোমার দায়ও নিতে চাইছেন না তাঁরা। কিন্তু দায় অস্বীকার করলেই কি দায়িত্ব এড়ানো যায়?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments