বিপর্যস্ত চিকিৎসাসেবা by মো. শফিকুল ইসলাম
কিশোরগঞ্জ
থেকে হন্তদন্ত হয়ে এক রোগী এসেছে। চোখ লাল, তীব্র ব্যথা, সঙ্গে
মাথাব্যথা। দৃষ্টি কমে গেছে। চোখের এ অসুখ তার দীর্ঘদিনের। তবে এবার
ব্যথাটা যেন কিছুটা বেশি। দৃষ্টিহ্রাসের বিষয়টিও। চোখের জন্য ভারতের
চেন্নাই পর্যন্ত গিয়েছে। চিকিৎসা হয়েছে ওখানে। চোখের যক্ষ্মারোগের
চিকিৎসা চলেছে। ওখানকার চিকিৎসকেরা বলেছেন, ব্যথা বা চোখ লাল হলে শিগগির
চোখের ডাক্তারকে দেখাতে হবে। দেশে ফেরার পর মোটামুটি ভালোই ছিল সে।
কিন্তু গত ১০ বা ১১ জানুয়ারি তার ব্যথা শুরু হয়। বিষয়টা চোখ বলে
সুচিকিৎসার প্রত্যাশায় ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত তার। কিন্তু কেমন করে আসবে?
প্রতিদিন রাস্তায় মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে পেট্রলবোমায়। পত্রিকা-টেলিভিশনে
খবর আসছে। দগ্ধ মানুষের ছবি দেখে আতঙ্কিত সে।
পরামর্শ সময়মতো মানা সম্ভব হয়নি। ‘আজ অথবা কাল অবরোধ উঠে যাবে’—এ মিথ্যা সমীকরণে কাটিয়েছে কয়েক দিন। শেষে অনন্যোপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছে ঢাকায়। রেলস্টেশনে নেমে দেরি না করে আমার চেম্বারে চলে এসেছে। জরুরি বিবেচনায় তার চোখ দেখি। তাতে মন খারাপই হয়। উপসর্গের শুরুর দিন আসতে পারলে হয়তো এই জটিলতায় পড়তে হতো না। চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা দেখা দিয়েছে। তার রেশ থেকে যাবে দীর্ঘদিন।
২.
বগুড়া থেকে আমার একসময়ের ছাত্র (এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) এক রোগী পাঠিয়েছে। তার চোখে উচ্চচাপের (গ্লকোমা) সমস্যা। গ্লকোমার মতো দৃষ্টিনাশী রোগের চিকিৎসার জন্য প্রেরিত হয়েও যথাসময়ে আসতে পারেনি সেই রোগী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েক দিন প্রতীক্ষার পর ঢাকার পথ ধরেছে। তারও চোখের চিকিৎসা হওয়া উচিত ছিল যথাসময়ে। চোখের উচ্চচাপ বেশিক্ষণ থাকলে তাতে ক্ষতি হয়ে যায় চোখের। দৃষ্টিপরিধি কমে যায়। এই ক্ষতি কোনোমতেই পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু অদ্যাবধি এই রোগী আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে পারেনি। রাস্তার অনিশ্চয়তায় হয়তো পথ পরিবর্তন করেছে। নাকি সেও শিকার হয়েছে পেট্রলবোমার?
৩.
এ রকম প্রতিদিন রাজধানীর বাইরের অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য সময়মতো ঢাকা আসতে পারছে না। হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, খাদ্যনালির জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের পক্ষে হয়তো আর চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের হয়তো মৃত্যুর হিমশীতল কোলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। আমার নিজেরই এক আত্মীয়াকে দেখেছি হরতালজনিত কারণে সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে। জরায়ু ফেটে যাওয়ায় অধিক রক্তক্ষরণজনিত কারণে অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। জরুরি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে বাঁচানো যেত তাকে। আন্দোলন-ধর্মঘটের জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।
এ রকম একা আমি নই, আমার মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষের স্বজনেরা চিকিৎসার জন্য চলমান অনির্ধারিত অবরোধ-হরতালের নির্মম শিকার হচ্ছে। আমি চিকিৎসক হয়ে আমার কর্মক্ষেত্রে যেতে ভয় পাই। চেম্বারে পৌঁছে ফেরার চিন্তায় আতঙ্কিত থাকি সারাক্ষণ। অবরোধ-ধর্মঘটে বিপন্ন আমার অবস্থান! চিকিৎসকদের বাহন অবরোধকারীদের আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীরা চিকিৎসক-হাসপাতাল বোঝে না। তাদের লক্ষ্য মানুষ বা পণ্যবাহী যেকোনো ধরনের যানবাহন! আগুন জ্বালানো আর জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানানোর মোচ্ছবের মধে্য তারা যেন দেখতে পাচ্ছে নিজেদের কৃতিত্ব!
প্রতিটি চিকিৎসালয়ে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। যারা আসছে, তারা নিরুপায় হয়ে আসছে। যেসব রোগী আসতে পারছে না তাদের চিকিৎসার দায় কে নেবে? সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল কম। যানবাহনের অপ্রতুলতায় রোগীও কম। রোগী বাড়ছে বার্ন ইউনিটে। বিশ্বের কোনো দেশে এভাবে দিনের পর দিন বার্ন ইউনিটে এত রোগী ভর্তির ঘটনা ঘটে কি না, আমার জানা নেই। বার্ন ইউনিটের মৃতপ্রায় রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে কোনো বিছানা খালি নেই। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও। অন্য কোনো অসুখে আক্রান্ত, যাদের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন, সেসব রোগীকে স্থান দেওয়া যাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে ভালুকার মাস্টারবাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার আমার এক আত্মীয়কে হাসপাতালে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হয়নি। তরুণ এই পোশাককর্মীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকায়। রাতে কোনো যানবাহন রাস্তায় নামতে চায় না। অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে তাঁকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত ১১টায়। আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হলেও কোনো বিছানা পাওয়া যায়নি। স্বল্প আয়ের এই পোশাককর্মীকে সে রাতেই লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। বাবার একমাত্র সন্তান যথাসময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন। তাঁর ছোট সন্তানটিও এতিম হয়ে গেল। ওই শিশুর বুকফাটা আর্তনাদের দায় কার?
৪.
সারা দেশ যেন বার্ন ইউনিটে পরিণত হয়েছে। সারা দেশ যেন আর্তচিৎকারের বিষণ্ন পরিবেশের জরুরি বিভাগে রূপান্তরিত! আমরা চিকিৎসকেরা এখানে অসহায়। আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলছি, সীমাবদ্ধতায় চিকিৎসা দিচ্ছি। আমাদের অনুভূতির মানবিক জগৎ অস্থির যন্ত্রে রূপান্তরিত। আমরা এ অবস্থার অবসান চাই।
মো. শফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
পরামর্শ সময়মতো মানা সম্ভব হয়নি। ‘আজ অথবা কাল অবরোধ উঠে যাবে’—এ মিথ্যা সমীকরণে কাটিয়েছে কয়েক দিন। শেষে অনন্যোপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছে ঢাকায়। রেলস্টেশনে নেমে দেরি না করে আমার চেম্বারে চলে এসেছে। জরুরি বিবেচনায় তার চোখ দেখি। তাতে মন খারাপই হয়। উপসর্গের শুরুর দিন আসতে পারলে হয়তো এই জটিলতায় পড়তে হতো না। চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা দেখা দিয়েছে। তার রেশ থেকে যাবে দীর্ঘদিন।
২.
বগুড়া থেকে আমার একসময়ের ছাত্র (এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) এক রোগী পাঠিয়েছে। তার চোখে উচ্চচাপের (গ্লকোমা) সমস্যা। গ্লকোমার মতো দৃষ্টিনাশী রোগের চিকিৎসার জন্য প্রেরিত হয়েও যথাসময়ে আসতে পারেনি সেই রোগী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েক দিন প্রতীক্ষার পর ঢাকার পথ ধরেছে। তারও চোখের চিকিৎসা হওয়া উচিত ছিল যথাসময়ে। চোখের উচ্চচাপ বেশিক্ষণ থাকলে তাতে ক্ষতি হয়ে যায় চোখের। দৃষ্টিপরিধি কমে যায়। এই ক্ষতি কোনোমতেই পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু অদ্যাবধি এই রোগী আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে পারেনি। রাস্তার অনিশ্চয়তায় হয়তো পথ পরিবর্তন করেছে। নাকি সেও শিকার হয়েছে পেট্রলবোমার?
৩.
এ রকম প্রতিদিন রাজধানীর বাইরের অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য সময়মতো ঢাকা আসতে পারছে না। হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, খাদ্যনালির জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের পক্ষে হয়তো আর চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের হয়তো মৃত্যুর হিমশীতল কোলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। আমার নিজেরই এক আত্মীয়াকে দেখেছি হরতালজনিত কারণে সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে। জরায়ু ফেটে যাওয়ায় অধিক রক্তক্ষরণজনিত কারণে অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। জরুরি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে বাঁচানো যেত তাকে। আন্দোলন-ধর্মঘটের জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।
এ রকম একা আমি নই, আমার মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষের স্বজনেরা চিকিৎসার জন্য চলমান অনির্ধারিত অবরোধ-হরতালের নির্মম শিকার হচ্ছে। আমি চিকিৎসক হয়ে আমার কর্মক্ষেত্রে যেতে ভয় পাই। চেম্বারে পৌঁছে ফেরার চিন্তায় আতঙ্কিত থাকি সারাক্ষণ। অবরোধ-ধর্মঘটে বিপন্ন আমার অবস্থান! চিকিৎসকদের বাহন অবরোধকারীদের আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীরা চিকিৎসক-হাসপাতাল বোঝে না। তাদের লক্ষ্য মানুষ বা পণ্যবাহী যেকোনো ধরনের যানবাহন! আগুন জ্বালানো আর জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানানোর মোচ্ছবের মধে্য তারা যেন দেখতে পাচ্ছে নিজেদের কৃতিত্ব!
প্রতিটি চিকিৎসালয়ে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। যারা আসছে, তারা নিরুপায় হয়ে আসছে। যেসব রোগী আসতে পারছে না তাদের চিকিৎসার দায় কে নেবে? সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল কম। যানবাহনের অপ্রতুলতায় রোগীও কম। রোগী বাড়ছে বার্ন ইউনিটে। বিশ্বের কোনো দেশে এভাবে দিনের পর দিন বার্ন ইউনিটে এত রোগী ভর্তির ঘটনা ঘটে কি না, আমার জানা নেই। বার্ন ইউনিটের মৃতপ্রায় রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে কোনো বিছানা খালি নেই। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও। অন্য কোনো অসুখে আক্রান্ত, যাদের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন, সেসব রোগীকে স্থান দেওয়া যাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে ভালুকার মাস্টারবাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার আমার এক আত্মীয়কে হাসপাতালে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হয়নি। তরুণ এই পোশাককর্মীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকায়। রাতে কোনো যানবাহন রাস্তায় নামতে চায় না। অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে তাঁকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত ১১টায়। আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হলেও কোনো বিছানা পাওয়া যায়নি। স্বল্প আয়ের এই পোশাককর্মীকে সে রাতেই লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। বাবার একমাত্র সন্তান যথাসময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন। তাঁর ছোট সন্তানটিও এতিম হয়ে গেল। ওই শিশুর বুকফাটা আর্তনাদের দায় কার?
৪.
সারা দেশ যেন বার্ন ইউনিটে পরিণত হয়েছে। সারা দেশ যেন আর্তচিৎকারের বিষণ্ন পরিবেশের জরুরি বিভাগে রূপান্তরিত! আমরা চিকিৎসকেরা এখানে অসহায়। আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলছি, সীমাবদ্ধতায় চিকিৎসা দিচ্ছি। আমাদের অনুভূতির মানবিক জগৎ অস্থির যন্ত্রে রূপান্তরিত। আমরা এ অবস্থার অবসান চাই।
মো. শফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments