হুমকির মুখে টক শো আলোচকরা
মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার সমর্থন করে
জাতিসংঘ। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি
স্টারের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে এ কথা
বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক। তিনি
বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার
যেকোন দেশের গণতন্ত্রের একটি বিরাট অংশ। ওদিকে, লন্ডন ভিত্তিক মানবাধিকার
সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
বাংলাদেশে অব্যাহত হামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার
কর্মীরা।
গত কয়েক দিনের মতো জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ২৪শে ফেব্রুয়ারিও উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। নিচে প্রশ্নোত্তর-পর্বের বাংলাদেশ অংশটি উপস্থাপন করা হলো :
প্রশ্ন: বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি জানতে চাই। একই সঙ্গে আমার প্রশ্ন জেফ্রে ফেল্টম্যানের শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমার কথা হলো, সেখানে দৃশ্যত সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন, আমার প্রশ্ন তা নিয়ে। তিনি বলেছেন, একটি প্রচারণামূলক পোস্টারের ছবি ছাপানোর কারণে দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আমি জানতে চাই, এ বিষয়ে আপনার কোন প্রতিক্রিয়া আছে কিনা অথবা আপনার কাছে অন্যকিছু আছে কিনা। আমি জানি যে, অনুরোধ জানানো হয়েছে। লোকজন গুম হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি- এ বিষয়ে অবস্থান কি?
উত্তর: আমার কাছে আপনার জন্য নতুন কোন খবর নেই। তবে অবশ্যই আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রসমূহের টিকে থাকার অধিকারকে সমর্থন করি, যা যে কোন দেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় একটি অংশ।
হুমকির মুখে টক শো আলোচকরা: বাংলাদেশে ডজনেরও বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, হুমকির কারণে তারা কথা বলার সময় সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা করেন। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশ অধ্যায়ে এসব কথা বলেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে ওই রিপোর্ট। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করছেন কারখানা শ্রমিকরা। এছাড়া, আপিলের কোন সুযোগ না দিয়ে অন্তত একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বিশ্বের ১৬০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে গতকাল প্রকাশিত হয় ওই প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, গত বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর থেকে তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিএনপি) ও এর মিত্ররা। নির্বাচনের প্রতিবাদে বিরোধীদের বিক্ষোভের সময় শতাধিক মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে বেশকিছু মানুষ মারা যায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে। তারাও এ সময় সহিংস হয়ে উঠেছিল। এসব মৃত্যুর কোনটিরই তদন্ত করা হয় নি। বিরোধী দলের সমর্থকরা বাস ও অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে পেট্রলবোমা ছুড়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এতে কমপক্ষে ৯ জন নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। দেশে প্রচণ্ড রকম মেরুকরণ করা আবহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রায় দিয়েছে। এসব মামলার সমর্থকরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ হাজির করেছে তা যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা তা বিবেচনা না করেই তারা তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জোর করে গুম করে দেয়া অংশে বলা হয়, জোর করে কতজন মানুষকে গুম করে দেয়া হয়েছে তার সঠিক কোন সংখ্যা নেই। তবে কারো কারো মতে এ সংখ্যা ৮০’রও বেশি। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে নথিভুক্ত গুমের ঘটনা ২০টি। এর মধ্যে ৯ জনকে পরে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। দীর্ঘ সময় আটক থাকার পর স্বজনদের কাছে ফিরেছেন ৬ জন। এ সময়ে তারা কোথায় ছিলেন সে বিষয়ে কেউ জানতো না। বাকি ৫ জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই। গত বছর এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে গুম করা হয়। এরপর দেখা যায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এতে বছর শেষ নাগাদ এমন সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ১৭। ২০০৪ সালে র্যাব গঠন করার পর এটাই ছিল এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ। র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ওই তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মাধ্যমে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। তবে এ বিষয়ে জনগণের চাপ কমে এলে সরকার মামলাগুলো বাদও দিতে পারে বলে উদ্বেগ অব্যাহত আছে। এ মামলা বাদ দিলে একই রকম অন্য কোন ঘটনায় তদন্তের পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলেনি। ফেব্রুয়ারিতে অপহরণ করা হয় আব্রাহাম লিঙ্কনকে। তাকে পরে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই প্রতিবেদনে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বলা হয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই ধারার অধীনে, কেউ যদি এ আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হন ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়ে থাকে ২০১৩ সালের ৬ই অক্টোবরের আগে তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল দেয়া হতে পারে। ওই সময়ে, একটি সংশোধনীতে শুধু শাস্তি বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরই করা হয় নি, একই সঙ্গে সর্বনিম্ন শাস্তি করা হয়েছে ৭ বছর। শান্তিপূর্ণ কিছু কর্মকাণ্ডকে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা করা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট করা। ২০১৩-১৪ সময়কালের মধ্যে আইসিটির ৫৭ ধারার অধীনে কমপক্ষে চারজন ব্লগার, ফেসবুকের দু’জন ব্যবহারকারী ও মানবাধিকারবিষয়ক একটি সংগঠনের দু’কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, সুব্রত অধিকারী শুভ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ। মানবাধিকার কর্মীরা হলেন- অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলেন। সাংবাদিক সহ মিডিয়ার এক ডজনেরও বেশি কর্মী বলেছেন, কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করায় নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো তাদেরকে হুমকি দিয়েছে। তারা সাধারণত সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ফোনে সরাসরি এই হুমকি দেয় অথবা তার সম্পাদকের মাধ্যমে ওই বার্তা পৌঁছে দেয়। অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, এর ফলে তাদেরকে সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা করতে হচ্ছে। ধর্মীয় গ্রুপগুলোরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হুমকি। কমপক্ষে ১০টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এসব গ্রুপ গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে, নির্দিষ্ট কেউ একজন সামাজিক মিডিয়াতে ইসলামের অবমাননা করেছে অথবা কর্মক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। এতে কমপক্ষে ৫ জনের ওপর হামলা হয়েছে। তার মধ্যে দু’জন নিহত হয়েছেন। মারাত্মক আহত হয়েছেন অন্যরা। নিহত দু’জন হলেন আহমেদ রাজিব ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একেএম শফিকুল ইসলাম। এর মধ্যে শফিকুল ইসলামকে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তিনি ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরাকে ইসলাম পরিপন্থি বলে আখ্যায়িত করেন। এক্ষেত্রে তার নিন্দা জানিয়েছিল যারা, তাকে তারাই হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে। অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মানবাধিকারের জন্য বিরাট উদ্বেগ। নারী অধিকারবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলেছে, মিডিয়া রিপোর্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে- ২০১৪ সালের শুধু অক্টোবরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪২৩ জন নারী ও যুবতী নানা রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তারা আরও বলেছে, ধর্ষিত হয়েছেন শতাধিক নারী। এর মধ্যে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৪০ জনের বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর কারণ, তার পিতার পরিবার স্বামীকে বা শ্বশুরপক্ষকে যৌতুক দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে আঘাতে মারা গেছেন ১৬ জন। অভ্যন্তরীণ সহিংসতা, এসিড হামলা ও পাচারের শিকার নারীরা। নির্যাতন সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়, নির্যাতন ও অন্যান্য অশোভন আচরণ ব্যাপক আকারে ছিল বাংলাদেশে। তবে এসব ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিয়মিত নির্যাতন করে পুলিশ। এক্ষেত্রে তারা যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তার মধ্যে রয়েছে প্রহার, সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেয়া, প্রজননতন্ত্রে বৈদ্যুতিক শক, কোন কোন ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তির পায়ে গুলি করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি ও জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৯ জনের। অভিযোগ আছে নির্যাতনের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে, কারখানা ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান ভয়াবহ রকম নিম্নমানের। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারে ধসে পড়ে ৯ তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা। এতে কমপক্ষে ১১৩০ গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০০ শ্রমিক। পরে দেখা যায়, সেখানকার গার্মেন্ট কারখানার ম্যানেজাররা শ্রমিকদের ওই ভবনে ঘটনার দিন কাজে যেতে বাধ্য করেছিলেন। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। তখন তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ১১২ শ্রমিক নিহত হন। কারণ, কারখানার ম্যানেজার শ্রমিকদের বাইরে বেরুতে দেয় নি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার সঙ্গে জড়িত সরকার, বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড। আইএলও দেখেছে এ উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। জীবিতরা এখনও লড়াই করছে অবলম্বনের জন্য। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বলা হয়, আদালত শাস্তি নিয়ে মৃত্যুদণ্ড অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। সরকারপক্ষ এই আদালতের রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করায় একজনকে সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। যেসব বন্দির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছে তাদেরকে যেকোন সময় ফাঁসি দেয়া হতে পারে।
গত কয়েক দিনের মতো জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ২৪শে ফেব্রুয়ারিও উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। নিচে প্রশ্নোত্তর-পর্বের বাংলাদেশ অংশটি উপস্থাপন করা হলো :
প্রশ্ন: বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি জানতে চাই। একই সঙ্গে আমার প্রশ্ন জেফ্রে ফেল্টম্যানের শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমার কথা হলো, সেখানে দৃশ্যত সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন, আমার প্রশ্ন তা নিয়ে। তিনি বলেছেন, একটি প্রচারণামূলক পোস্টারের ছবি ছাপানোর কারণে দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আমি জানতে চাই, এ বিষয়ে আপনার কোন প্রতিক্রিয়া আছে কিনা অথবা আপনার কাছে অন্যকিছু আছে কিনা। আমি জানি যে, অনুরোধ জানানো হয়েছে। লোকজন গুম হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি- এ বিষয়ে অবস্থান কি?
উত্তর: আমার কাছে আপনার জন্য নতুন কোন খবর নেই। তবে অবশ্যই আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রসমূহের টিকে থাকার অধিকারকে সমর্থন করি, যা যে কোন দেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় একটি অংশ।
হুমকির মুখে টক শো আলোচকরা: বাংলাদেশে ডজনেরও বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, হুমকির কারণে তারা কথা বলার সময় সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা করেন। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশ অধ্যায়ে এসব কথা বলেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে ওই রিপোর্ট। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করছেন কারখানা শ্রমিকরা। এছাড়া, আপিলের কোন সুযোগ না দিয়ে অন্তত একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বিশ্বের ১৬০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে গতকাল প্রকাশিত হয় ওই প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, গত বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর থেকে তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিএনপি) ও এর মিত্ররা। নির্বাচনের প্রতিবাদে বিরোধীদের বিক্ষোভের সময় শতাধিক মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে বেশকিছু মানুষ মারা যায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে। তারাও এ সময় সহিংস হয়ে উঠেছিল। এসব মৃত্যুর কোনটিরই তদন্ত করা হয় নি। বিরোধী দলের সমর্থকরা বাস ও অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে পেট্রলবোমা ছুড়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এতে কমপক্ষে ৯ জন নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। দেশে প্রচণ্ড রকম মেরুকরণ করা আবহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রায় দিয়েছে। এসব মামলার সমর্থকরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ হাজির করেছে তা যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা তা বিবেচনা না করেই তারা তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জোর করে গুম করে দেয়া অংশে বলা হয়, জোর করে কতজন মানুষকে গুম করে দেয়া হয়েছে তার সঠিক কোন সংখ্যা নেই। তবে কারো কারো মতে এ সংখ্যা ৮০’রও বেশি। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে নথিভুক্ত গুমের ঘটনা ২০টি। এর মধ্যে ৯ জনকে পরে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। দীর্ঘ সময় আটক থাকার পর স্বজনদের কাছে ফিরেছেন ৬ জন। এ সময়ে তারা কোথায় ছিলেন সে বিষয়ে কেউ জানতো না। বাকি ৫ জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই। গত বছর এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে গুম করা হয়। এরপর দেখা যায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এতে বছর শেষ নাগাদ এমন সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ১৭। ২০০৪ সালে র্যাব গঠন করার পর এটাই ছিল এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ। র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ওই তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মাধ্যমে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। তবে এ বিষয়ে জনগণের চাপ কমে এলে সরকার মামলাগুলো বাদও দিতে পারে বলে উদ্বেগ অব্যাহত আছে। এ মামলা বাদ দিলে একই রকম অন্য কোন ঘটনায় তদন্তের পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলেনি। ফেব্রুয়ারিতে অপহরণ করা হয় আব্রাহাম লিঙ্কনকে। তাকে পরে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই প্রতিবেদনে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বলা হয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই ধারার অধীনে, কেউ যদি এ আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হন ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়ে থাকে ২০১৩ সালের ৬ই অক্টোবরের আগে তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল দেয়া হতে পারে। ওই সময়ে, একটি সংশোধনীতে শুধু শাস্তি বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরই করা হয় নি, একই সঙ্গে সর্বনিম্ন শাস্তি করা হয়েছে ৭ বছর। শান্তিপূর্ণ কিছু কর্মকাণ্ডকে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা করা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট করা। ২০১৩-১৪ সময়কালের মধ্যে আইসিটির ৫৭ ধারার অধীনে কমপক্ষে চারজন ব্লগার, ফেসবুকের দু’জন ব্যবহারকারী ও মানবাধিকারবিষয়ক একটি সংগঠনের দু’কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, সুব্রত অধিকারী শুভ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ। মানবাধিকার কর্মীরা হলেন- অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলেন। সাংবাদিক সহ মিডিয়ার এক ডজনেরও বেশি কর্মী বলেছেন, কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করায় নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো তাদেরকে হুমকি দিয়েছে। তারা সাধারণত সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ফোনে সরাসরি এই হুমকি দেয় অথবা তার সম্পাদকের মাধ্যমে ওই বার্তা পৌঁছে দেয়। অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, এর ফলে তাদেরকে সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা করতে হচ্ছে। ধর্মীয় গ্রুপগুলোরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হুমকি। কমপক্ষে ১০টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এসব গ্রুপ গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে, নির্দিষ্ট কেউ একজন সামাজিক মিডিয়াতে ইসলামের অবমাননা করেছে অথবা কর্মক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। এতে কমপক্ষে ৫ জনের ওপর হামলা হয়েছে। তার মধ্যে দু’জন নিহত হয়েছেন। মারাত্মক আহত হয়েছেন অন্যরা। নিহত দু’জন হলেন আহমেদ রাজিব ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একেএম শফিকুল ইসলাম। এর মধ্যে শফিকুল ইসলামকে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তিনি ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরাকে ইসলাম পরিপন্থি বলে আখ্যায়িত করেন। এক্ষেত্রে তার নিন্দা জানিয়েছিল যারা, তাকে তারাই হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে। অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মানবাধিকারের জন্য বিরাট উদ্বেগ। নারী অধিকারবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলেছে, মিডিয়া রিপোর্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে- ২০১৪ সালের শুধু অক্টোবরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪২৩ জন নারী ও যুবতী নানা রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তারা আরও বলেছে, ধর্ষিত হয়েছেন শতাধিক নারী। এর মধ্যে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৪০ জনের বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর কারণ, তার পিতার পরিবার স্বামীকে বা শ্বশুরপক্ষকে যৌতুক দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে আঘাতে মারা গেছেন ১৬ জন। অভ্যন্তরীণ সহিংসতা, এসিড হামলা ও পাচারের শিকার নারীরা। নির্যাতন সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়, নির্যাতন ও অন্যান্য অশোভন আচরণ ব্যাপক আকারে ছিল বাংলাদেশে। তবে এসব ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিয়মিত নির্যাতন করে পুলিশ। এক্ষেত্রে তারা যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তার মধ্যে রয়েছে প্রহার, সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেয়া, প্রজননতন্ত্রে বৈদ্যুতিক শক, কোন কোন ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তির পায়ে গুলি করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি ও জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৯ জনের। অভিযোগ আছে নির্যাতনের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে, কারখানা ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান ভয়াবহ রকম নিম্নমানের। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারে ধসে পড়ে ৯ তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা। এতে কমপক্ষে ১১৩০ গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০০ শ্রমিক। পরে দেখা যায়, সেখানকার গার্মেন্ট কারখানার ম্যানেজাররা শ্রমিকদের ওই ভবনে ঘটনার দিন কাজে যেতে বাধ্য করেছিলেন। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। তখন তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ১১২ শ্রমিক নিহত হন। কারণ, কারখানার ম্যানেজার শ্রমিকদের বাইরে বেরুতে দেয় নি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার সঙ্গে জড়িত সরকার, বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড। আইএলও দেখেছে এ উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। জীবিতরা এখনও লড়াই করছে অবলম্বনের জন্য। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বলা হয়, আদালত শাস্তি নিয়ে মৃত্যুদণ্ড অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। সরকারপক্ষ এই আদালতের রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করায় একজনকে সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। যেসব বন্দির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছে তাদেরকে যেকোন সময় ফাঁসি দেয়া হতে পারে।
No comments