প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশটি যেন বাস্তবায়িত হয় by একে এম শাহনাওয়াজ
ছাত্রলীগের উন্মত্ত সন্ত্রাসের সর্বশেষ ঘটনায় (প্রার্থনা করি লেখা প্রকাশের আগ পর্যন্ত সর্বশেষ শব্দটি বজায় থাকুক) খুনোখুনির মধ্য দিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার ও দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অপরাধ আড়াল করার নানা চেষ্টা থাকে। ছাত্রলীগের সুবোধ নেতাকর্মীদের ভেতর ছদ্মবেশী অন্য দলের সন্ত্রাসীরা ঢুকে গেছে ধরনের থিওরিও কোনো কোনো পর্যায় থেকে উচ্চারিত হয়েছে। তারপরও এবার একটু স্বস্তির কারণ ঘটেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনারকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সূত্রে নির্দেশ দিয়েছেন, এসব ঘটনা যারা ঘটাবে, দল-পরিচয় না দেখে যেন তাদের ব্যাপারে অ্যাকশন নেয়া হয়। এ নির্দেশে আমরা একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের নীতিনির্ধারক যারা প্রায় পালাক্রমে দেশের ভাগ্যবিধাতা হন, তারা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েন। অপূর্ণ গণতান্ত্রিক আচরণের কারণে প্রকৃত জনসম্পৃক্ত নয় এই দলগুলো। তাই জনগণের ওপর আস্থা রেখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দলীয় নেতৃত্বের নেই। ফলে গণশক্তি নয়, পেশিশক্তি হয়ে যায় তাদের প্রধান অবলম্বন। সরকারে যারা থাকেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় দায় তাদের। জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানের প্রধান আধিকারিক তারাই হন। নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যদি ঘা হয়ে যায়, তবে কোমল পেলব মলম লাগিয়ে নিজেদের আত্ম রক্ষা করা যাবে? গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ার পর সরষে ফুল দেখে লাভ কী! পুরনো কথা বাদ দিলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের আগের পর্ব ও বর্তমান পর্বে ছাত্রলীগের দুর্দমনীয় সন্ত্রাসী আচরণে শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে জনজীবন বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুনোখুনি তো কম হয়নি, হচ্ছে না! বিপন্ন হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। কী অ্যাকশন হয়েছে?
অপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে শাসকশ্রেণী তাদের কাণ্ড-অপকাণ্ডের সমালোচনা শুনতে পছন্দ করে না অথবা ভয় পায়। তাই তাদের যত রাগ গণমাধ্যমের ওপর। সাংবাদিক, কলামিস্ট ও টকশোর বিশ্লেষকদের ওপর। এখন তো সংবাদমাধ্যমের ওপর দোষ চাপানো একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এসব অসুস্থ বয়ান এখন নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদেরও প্রভাবিত করছে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানলাম সেদিন সজীব ওয়াজেদ জয় বলছিলেন, ছাত্রলীগ সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক কথা সংবাদপত্রে লেখা হয়, তাদের ভালো কাজগুলোর কথা প্রচার পায় না। আমি ক্যাম্পাসের দীর্ঘ অবস্থান অভিজ্ঞতা দিয়ে খুঁজে ফিরলাম, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সহকর্মীদের কাছ থেকে তথ্য পেতে চাইলাম। ফলাফল একই ঘটল। কোনো সরকারের আমলেই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের আচরণে উল্লেখ করার মতো কল্যাণধর্মী কাজে যুক্ত হওয়ার উদাহরণ খুঁজে পেলাম না। ছাত্রকল্যাণধর্মী কর্মসূচি গ্রহণের যেকোনো দায় আছে, তা হয়তো এসব সংগঠনের নেতাকর্মীর জানা থাকে না। স্খলনটি তো হঠাৎ হয়নি। অতীতেও একই অস্বস্তি আমরা দেখেছি।
১৪ বছর আগের একটি স্মৃতিচারণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নষ্ট সময়ে নির্মোহ থেকে দলীয় বা ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেম আর বিবেকের তাড়নায় সামান্য শব্দ চয়ন যখন দুর্লভ হয়ে পড়েছিল, তখন সে সময়ের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ন্যায় আর সত্যের শব্দাবলী। প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রপতি তার বিচারপতির প্রজ্ঞা নিয়ে ছাত্র রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন দেখে মুখ খুলেছিলেন। সচেতন অথচ ক্ষমতাহীন এ দেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের কথা জাতির বিবেক হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। বাস্তব অবস্থা মূল্যায়ন করেই তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির রাহুগ্রাসমুক্ত করার জন্য জাতীয় রাজনীতির কাণ্ডারিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বেঁচে গিয়েছিলেন সে সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি। কারণ এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের শ্রদ্ধা আর আস্থা ছিল তার ওপর। তাই রাজনীতির বণিকরা রে রে করে তেড়ে আসতে পারেননি। তবে সমালোচনা করতেও ছাড়েননি অনেকে। ভাবখানা এমন, জীবনভর আইন-আদালত নিয়ে ছিলেন তিনি- রাজনীতির বোঝেন কী! তাই রাজনীতিকদের কেউ কেউ এ বিজ্ঞ বিচারপতিকে তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, কত বড় ভুল তিনি করছেন! ছাত্ররা রাজনীতি না করলে রাজনীতির চর্চা হবে কী করে! সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি করবে কারা? ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতির হাল ধরবে কে? এসব বড় তত্ত্বকথা দিয়ে ডান বামের প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা রাষ্ট্রপতির চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে দেখাতে চেয়েছেন। তারা বুঝতে চাননি (বুঝে গেলে সুবিধার বল নিয়ে খেলা যাবে না ভেবে) যে, রাষ্ট্রপতির দুশ্চিন্তা চিরায়ত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নয়, ছাত্র রাজনীতির নামে আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্যাডারতন্ত্রের যে আধিপত্য তা নিয়ে। আমাদের তথাকথিত রাজনীতির তাত্ত্বিক ও রাজনীতি সচেতন বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রপতির আহ্বানের সারবত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন; কিন্তু একবারও বলেননি ক্যাডারতন্ত্রের আধিপত্যের ভেতর থেকে সুস্থ রাজনীতি বেড়ে উঠতে পারে না। তাই স্বপ্নের ছাত্র রাজনীতি তথা তাত্ত্বিকদের ছাত্র রাজনীতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত ও লালন করতে হলে ক্যাডারতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ক্যাডারতন্ত্র আর সুস্থ রাজনীতির চর্চা পাশাপাশি চলতে পারে না। বইপড়া জ্ঞান আর চোখে দেখা জ্ঞানে তো পার্থক্য থাকতেই পারে। ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট আমরা তো প্রতিদিনই দেখছি, মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই দূরে সরে যাচ্ছে রাজনীতি থেকে।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রত্যাশিত ভালো কাজের সুযোগ কোথায় ছাত্রলীগের তরুণদের? অর্থ আর পেশিশক্তি লোভী ক্যাডারদের নেতৃত্বে এখন যারা ছাত্র রাজনীতির ধ্বজা ধরে আছে ক্যাম্পাসে, তাদের একটা সূত্রের মধ্য ফেলে চেনা যায়। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক তাদের চেনেন এভাবে যে, এ শ্রেণীর তরুণ কদাচিৎ ক্লাস বা টিউটোরিয়ালে উপস্থিত থাকে। নিজের বা বন্ধুদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না থাকলে পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের জন্য চাপ দেয়। চাপ গ্রাহ্য না করলে পরীক্ষার হলে তালা দেয়। পরীক্ষা দিতে আসা বন্ধুদের ধমকে তাড়িয়ে দেয়। হলের কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরীক্ষার ক্ষতি করে দলীয় মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করে।
ক্যাম্পাসের চা-সিগারেটের দোকানদার আর ক্যান্টিন মালিক চেনেন এভাবে যে, এসব তরুণের নামের পাশে হিসাবের খাতায় হাজার হাজার টাকা বাকি পড়ে। বাকি শোধ দিতে বললে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়।
ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা জানে, সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ক্যাডারদের কখনও পাওয়া যায় না। বরঞ্চ মতের মিল না হলে বা যথা সম্মানপূর্বক আমন্ত্রণ না জানালে তারা অনুষ্ঠানমঞ্চ তছনছ করে দিতে দ্বিধা করে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশে ব্যবসায়ী, পুকুর লিজ নেয়া মাছ চাষী আর নির্মাণকাজের ঠিকাদাররা চেনেন এভাবে যে, এসব তরুণের জন্য চাঁদা বরাদ্দ রাখতে তারা বাধ্য। আর ক্যাম্পাস তথা দেশবাসী চেনে এভাবে যে, এ ধারার তরুণরা হয়ে থাকে সন্ত্রাসী এবং তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। পুলিশ ও প্রশাসন তাদের টিকি ছুঁতে পারে না। সবাই দেখে ছাত্রলীগের ক্যাডার (বিএনপি আমলে ছাত্রদলের ক্যাডার) প্রকাশ্যে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ছোটাছুটি করে।
সুতরাং ছাত্র রাজনীতির নামে প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাডারতন্ত্র নিষিদ্ধ করতে যদি সে যুগে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আহ্বান জানিয়ে থাকেন, তবে তার বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি আমাদের অতি মেধাবী রাজনীতিকরা কীভাবে করবেন! ঘা খেয়েও কোন মোহে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা ক্যাডারতন্ত্র উচ্ছেদ করতে চাইছেন না, তা আমাদের বোধের অগম্য। তারা কেন জানি বুঝতে পারছেন না দুধ-কলা দিয়ে কেমন করে কাল সাপ পুষছেন; ওরা যে গোকুলে বাড়ছে তাদেরই বধিতে।
সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি, তার জীবনচর্চার সঙ্গে রাজনীতি আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে। তাই ছাত্র সমাজ- যারা আগামীতে রাষ্ট্র, প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি সবকিছুর নেতৃত্বে আসবে- তাদের রাজনীতি অচেতন থাকা আত্মঘাতী কাজেরই নামান্তর। এ কারণে মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের শুধু রাজনীতি সচেতন নয়, সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির চর্চা করাও জরুরি। এ চিন্তার সঙ্গে সচেতন যে কেউ একমত পোষণ করবেন, সন্দেহ নেই। আজ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। এরা বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছে ছাত্র রাজনীতির প্রতি। এ বাস্তবতা ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ছাত্র রাজনীতির প্রতি একটি সর্বজনীন আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা সৃষ্টি করতে না পারলে ইতিবাচক প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব নয়।
ঘরপোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যত কম চেষ্টা করেননি। ছাত্রলীগের তাণ্ডবে একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সাংগঠনিক নেতৃত্বের সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাতে কি সুবোধ হয়ে গিয়েছিল ছাত্রলীগ? চারপাশ থেকে কি প্রশ্রয় পাওয়া বন্ধ হয়েছিল ছাত্রলীগের? অধুনা এইচটি ইমাম সাহেবরা তো প্রকাশ্যে প্রশ্রয়ের কথা জানিয়েই দিলেন। বোতল তো একই, শুধু মদের তারতম্য। মনে পড়ে বিএনপি আমলে হাওয়া ভবনের যুগে আমার এক ছাত্রের জবানী। সে একটি হল শাখার ছাত্রদলের সভাপতি। স্বস্তির সঙ্গে জানাল, হাওয়া ভবন থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছে, লিখিত পরীক্ষায় পাস করে এলে তার পুলিশের চাকরি নিশ্চিত। একই সঙ্গে জানাল, লিখিত পরীক্ষায় পাস করার সহজ রাস্তাও তাদের আছে।
তারপরও আমরা এ বিপন্ন দশায় এসে আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই। তবে অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষ এত সহজে আশ্বস্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না। এ জন্য প্রয়োজন দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাস্তবায়ন। আশা করব, কোনো পর্যায় থেকেই যেন পিছুটান না থাকে। এ সুযোগে আমরা অন্যায়কারীকে দলীয় পরিচয়ে দেখার অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আর তা না পারলে সাধারণ মানুষ মনে করবে, হয় আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে গলদ রয়েছে, না হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের নীতিনির্ধারক যারা প্রায় পালাক্রমে দেশের ভাগ্যবিধাতা হন, তারা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েন। অপূর্ণ গণতান্ত্রিক আচরণের কারণে প্রকৃত জনসম্পৃক্ত নয় এই দলগুলো। তাই জনগণের ওপর আস্থা রেখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দলীয় নেতৃত্বের নেই। ফলে গণশক্তি নয়, পেশিশক্তি হয়ে যায় তাদের প্রধান অবলম্বন। সরকারে যারা থাকেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় দায় তাদের। জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানের প্রধান আধিকারিক তারাই হন। নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যদি ঘা হয়ে যায়, তবে কোমল পেলব মলম লাগিয়ে নিজেদের আত্ম রক্ষা করা যাবে? গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ার পর সরষে ফুল দেখে লাভ কী! পুরনো কথা বাদ দিলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের আগের পর্ব ও বর্তমান পর্বে ছাত্রলীগের দুর্দমনীয় সন্ত্রাসী আচরণে শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে জনজীবন বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুনোখুনি তো কম হয়নি, হচ্ছে না! বিপন্ন হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। কী অ্যাকশন হয়েছে?
অপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে শাসকশ্রেণী তাদের কাণ্ড-অপকাণ্ডের সমালোচনা শুনতে পছন্দ করে না অথবা ভয় পায়। তাই তাদের যত রাগ গণমাধ্যমের ওপর। সাংবাদিক, কলামিস্ট ও টকশোর বিশ্লেষকদের ওপর। এখন তো সংবাদমাধ্যমের ওপর দোষ চাপানো একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এসব অসুস্থ বয়ান এখন নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদেরও প্রভাবিত করছে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানলাম সেদিন সজীব ওয়াজেদ জয় বলছিলেন, ছাত্রলীগ সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক কথা সংবাদপত্রে লেখা হয়, তাদের ভালো কাজগুলোর কথা প্রচার পায় না। আমি ক্যাম্পাসের দীর্ঘ অবস্থান অভিজ্ঞতা দিয়ে খুঁজে ফিরলাম, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সহকর্মীদের কাছ থেকে তথ্য পেতে চাইলাম। ফলাফল একই ঘটল। কোনো সরকারের আমলেই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের আচরণে উল্লেখ করার মতো কল্যাণধর্মী কাজে যুক্ত হওয়ার উদাহরণ খুঁজে পেলাম না। ছাত্রকল্যাণধর্মী কর্মসূচি গ্রহণের যেকোনো দায় আছে, তা হয়তো এসব সংগঠনের নেতাকর্মীর জানা থাকে না। স্খলনটি তো হঠাৎ হয়নি। অতীতেও একই অস্বস্তি আমরা দেখেছি।
১৪ বছর আগের একটি স্মৃতিচারণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নষ্ট সময়ে নির্মোহ থেকে দলীয় বা ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেম আর বিবেকের তাড়নায় সামান্য শব্দ চয়ন যখন দুর্লভ হয়ে পড়েছিল, তখন সে সময়ের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ন্যায় আর সত্যের শব্দাবলী। প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রপতি তার বিচারপতির প্রজ্ঞা নিয়ে ছাত্র রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন দেখে মুখ খুলেছিলেন। সচেতন অথচ ক্ষমতাহীন এ দেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের কথা জাতির বিবেক হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। বাস্তব অবস্থা মূল্যায়ন করেই তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির রাহুগ্রাসমুক্ত করার জন্য জাতীয় রাজনীতির কাণ্ডারিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বেঁচে গিয়েছিলেন সে সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি। কারণ এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের শ্রদ্ধা আর আস্থা ছিল তার ওপর। তাই রাজনীতির বণিকরা রে রে করে তেড়ে আসতে পারেননি। তবে সমালোচনা করতেও ছাড়েননি অনেকে। ভাবখানা এমন, জীবনভর আইন-আদালত নিয়ে ছিলেন তিনি- রাজনীতির বোঝেন কী! তাই রাজনীতিকদের কেউ কেউ এ বিজ্ঞ বিচারপতিকে তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, কত বড় ভুল তিনি করছেন! ছাত্ররা রাজনীতি না করলে রাজনীতির চর্চা হবে কী করে! সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি করবে কারা? ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতির হাল ধরবে কে? এসব বড় তত্ত্বকথা দিয়ে ডান বামের প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা রাষ্ট্রপতির চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে দেখাতে চেয়েছেন। তারা বুঝতে চাননি (বুঝে গেলে সুবিধার বল নিয়ে খেলা যাবে না ভেবে) যে, রাষ্ট্রপতির দুশ্চিন্তা চিরায়ত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নয়, ছাত্র রাজনীতির নামে আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্যাডারতন্ত্রের যে আধিপত্য তা নিয়ে। আমাদের তথাকথিত রাজনীতির তাত্ত্বিক ও রাজনীতি সচেতন বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রপতির আহ্বানের সারবত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন; কিন্তু একবারও বলেননি ক্যাডারতন্ত্রের আধিপত্যের ভেতর থেকে সুস্থ রাজনীতি বেড়ে উঠতে পারে না। তাই স্বপ্নের ছাত্র রাজনীতি তথা তাত্ত্বিকদের ছাত্র রাজনীতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত ও লালন করতে হলে ক্যাডারতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ক্যাডারতন্ত্র আর সুস্থ রাজনীতির চর্চা পাশাপাশি চলতে পারে না। বইপড়া জ্ঞান আর চোখে দেখা জ্ঞানে তো পার্থক্য থাকতেই পারে। ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট আমরা তো প্রতিদিনই দেখছি, মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই দূরে সরে যাচ্ছে রাজনীতি থেকে।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রত্যাশিত ভালো কাজের সুযোগ কোথায় ছাত্রলীগের তরুণদের? অর্থ আর পেশিশক্তি লোভী ক্যাডারদের নেতৃত্বে এখন যারা ছাত্র রাজনীতির ধ্বজা ধরে আছে ক্যাম্পাসে, তাদের একটা সূত্রের মধ্য ফেলে চেনা যায়। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক তাদের চেনেন এভাবে যে, এ শ্রেণীর তরুণ কদাচিৎ ক্লাস বা টিউটোরিয়ালে উপস্থিত থাকে। নিজের বা বন্ধুদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না থাকলে পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের জন্য চাপ দেয়। চাপ গ্রাহ্য না করলে পরীক্ষার হলে তালা দেয়। পরীক্ষা দিতে আসা বন্ধুদের ধমকে তাড়িয়ে দেয়। হলের কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরীক্ষার ক্ষতি করে দলীয় মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করে।
ক্যাম্পাসের চা-সিগারেটের দোকানদার আর ক্যান্টিন মালিক চেনেন এভাবে যে, এসব তরুণের নামের পাশে হিসাবের খাতায় হাজার হাজার টাকা বাকি পড়ে। বাকি শোধ দিতে বললে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়।
ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা জানে, সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ক্যাডারদের কখনও পাওয়া যায় না। বরঞ্চ মতের মিল না হলে বা যথা সম্মানপূর্বক আমন্ত্রণ না জানালে তারা অনুষ্ঠানমঞ্চ তছনছ করে দিতে দ্বিধা করে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশে ব্যবসায়ী, পুকুর লিজ নেয়া মাছ চাষী আর নির্মাণকাজের ঠিকাদাররা চেনেন এভাবে যে, এসব তরুণের জন্য চাঁদা বরাদ্দ রাখতে তারা বাধ্য। আর ক্যাম্পাস তথা দেশবাসী চেনে এভাবে যে, এ ধারার তরুণরা হয়ে থাকে সন্ত্রাসী এবং তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। পুলিশ ও প্রশাসন তাদের টিকি ছুঁতে পারে না। সবাই দেখে ছাত্রলীগের ক্যাডার (বিএনপি আমলে ছাত্রদলের ক্যাডার) প্রকাশ্যে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ছোটাছুটি করে।
সুতরাং ছাত্র রাজনীতির নামে প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাডারতন্ত্র নিষিদ্ধ করতে যদি সে যুগে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আহ্বান জানিয়ে থাকেন, তবে তার বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি আমাদের অতি মেধাবী রাজনীতিকরা কীভাবে করবেন! ঘা খেয়েও কোন মোহে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা ক্যাডারতন্ত্র উচ্ছেদ করতে চাইছেন না, তা আমাদের বোধের অগম্য। তারা কেন জানি বুঝতে পারছেন না দুধ-কলা দিয়ে কেমন করে কাল সাপ পুষছেন; ওরা যে গোকুলে বাড়ছে তাদেরই বধিতে।
সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি, তার জীবনচর্চার সঙ্গে রাজনীতি আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে। তাই ছাত্র সমাজ- যারা আগামীতে রাষ্ট্র, প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি সবকিছুর নেতৃত্বে আসবে- তাদের রাজনীতি অচেতন থাকা আত্মঘাতী কাজেরই নামান্তর। এ কারণে মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের শুধু রাজনীতি সচেতন নয়, সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির চর্চা করাও জরুরি। এ চিন্তার সঙ্গে সচেতন যে কেউ একমত পোষণ করবেন, সন্দেহ নেই। আজ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। এরা বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছে ছাত্র রাজনীতির প্রতি। এ বাস্তবতা ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ছাত্র রাজনীতির প্রতি একটি সর্বজনীন আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা সৃষ্টি করতে না পারলে ইতিবাচক প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব নয়।
ঘরপোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যত কম চেষ্টা করেননি। ছাত্রলীগের তাণ্ডবে একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সাংগঠনিক নেতৃত্বের সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাতে কি সুবোধ হয়ে গিয়েছিল ছাত্রলীগ? চারপাশ থেকে কি প্রশ্রয় পাওয়া বন্ধ হয়েছিল ছাত্রলীগের? অধুনা এইচটি ইমাম সাহেবরা তো প্রকাশ্যে প্রশ্রয়ের কথা জানিয়েই দিলেন। বোতল তো একই, শুধু মদের তারতম্য। মনে পড়ে বিএনপি আমলে হাওয়া ভবনের যুগে আমার এক ছাত্রের জবানী। সে একটি হল শাখার ছাত্রদলের সভাপতি। স্বস্তির সঙ্গে জানাল, হাওয়া ভবন থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছে, লিখিত পরীক্ষায় পাস করে এলে তার পুলিশের চাকরি নিশ্চিত। একই সঙ্গে জানাল, লিখিত পরীক্ষায় পাস করার সহজ রাস্তাও তাদের আছে।
তারপরও আমরা এ বিপন্ন দশায় এসে আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই। তবে অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষ এত সহজে আশ্বস্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না। এ জন্য প্রয়োজন দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাস্তবায়ন। আশা করব, কোনো পর্যায় থেকেই যেন পিছুটান না থাকে। এ সুযোগে আমরা অন্যায়কারীকে দলীয় পরিচয়ে দেখার অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আর তা না পারলে সাধারণ মানুষ মনে করবে, হয় আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে গলদ রয়েছে, না হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments