‘কারাগারে পাঠানো খাবার ফিরিয়ে দেয়ার পরই আশঙ্কা জাগে পরিবারে’ by আশরাফুল ইসলাম
গোপীবাগের ভাড়া বাসা থেকে প্রতিদিন রান্না করে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য খাবার পাঠাতেন স্ত্রী সৈয়দা নাফিসা ইসলাম। ৩রা নভেম্বরও কারাগারে রান্না করা খাবার পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বারবার তার পাঠানো খাবার ফেরত পাঠাচ্ছিল কারা কর্তৃপক্ষ। তখনই তারা আঁচ করতে পারেন, হয়তো ভয়াবহ কোন দুঃসংবাদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বন্দি থাকা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একই সঙ্গে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানও। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার এক সপ্তাহ পর ২৩শে আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। নির্মম সে হত্যাযজ্ঞের পর সেই সময়ের দুঃসহ নানা স্মৃতির কথা মানবজমিনকে বলেছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহোদর ও বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া। বয়সের ভারে শয্যাশায়ী হলেও একমাত্র ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু ও শূন্যতা স্মৃতিকাতর ছোটভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়াকে আজও কাঁদায়। তার কাছে সেদিনের স্মৃতি কখনওই পুরনো হওয়ার নয়। আজও তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে তার ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশের তাজা ছবি।
বাকরুদ্ধ কণ্ঠে পট্টু মিয়া জানান, ওই সময় তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাসহ সৈয়দ নজরুলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সৈয়দা নাফিসা ইসলাম সরকারি বাসভবন ছেড়ে গোপীবাগে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠেন। সেই বাসা থেকেই প্রতিদিন রান্না করে সৈয়দ নজরুলের জন্য তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে খাবার পাঠাতেন। কিন্তু ৩রা নভেম্বর তিনি বারবার খাবার পাঠালেও প্রতিবারই কারা কর্তৃপক্ষ সেই খাবার ফেরত পাঠায়। তখনই অজানা আশঙ্কা জাগে পরিবারের সদস্যদের মাঝে। হয়তো ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে, এমনটি আঁচ করেন তারা। শেষ পর্যন্ত তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর সৈয়দ নজরুলের তখনকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম করিম ঢাকার জেলা প্রশাসককে ঘটনা অবহিত করেন। জেলা প্রশাসক চরম এই দুঃসংবাদটি জানান ঢাকার আরমানিটোলায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্বন্ধী আসাদুজ্জামানের বাসায়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ তার আরেক সম্বন্ধী মসুদুজ্জামানের পুত্র ক্যাপ্টেন আনু কারাগার থেকে আসাদুজ্জামানের বাসভবনে নিয়ে আসেন। পরে আরমানিটোলা মাঠে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে জেলহত্যার এ ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। নৃশংস এই ঘটনার আগে তারা বুঝতেই পারেন নি, এভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হতে পারে। তখনকার ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে জানাজায় খুব বেশি মানুষ যেতে সাহস করেনি। সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া জানান, ৩রা নভেম্বরের জেলহত্যা ঘটনার সময় সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ছোট ছেলে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দেশের বাইরে ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহধর্মিণী সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, অন্য দুই ছেলে সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম ও সৈয়দ শরীফুল ইসলাম এবং দুই মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া আক্তার নূর লিপি ও সৈয়দা রূপা পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে শোক সামলেছেন। সে সময় তাদের সমবেদনা জানানোর মতোও কেউ ছিল না। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে তাদের নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে হয়েছে।
পট্টু মিয়া বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ৩রা নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনায় আমাদের পরিবারের উপর নির্যাতন ও দুর্যোগ নেমে আসে। সে সময় ভয়ে আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে নিকটাত্মীয়রাও যোগাযোগ রাখতেন না। এমনকি তীব্র আর্থিক কষ্টের মধ্যেও কেউ কোন ধরনের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। তিনি বলেন, আমাদের পরিবার থেকে আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় ’৭৬ সালে আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়। প্রায় তিন বছর কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটাতে হয়েছে। এমনকি কিশোরগঞ্জের যশোদল বীরদামপাড়ার আমাদের পৈতৃক বাড়িটিও সে সময় সরকার বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে এটি আমরা ফেরত আনতে সক্ষম হই।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জ শহরের ৩ কিলোমিটার পুবে যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালে। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুর রইস এবং মা সৈয়দা নূরুন্নাহার খাতুন। সরকারি চাকুরে পিতা এলাকায় রইস মিয়া সাহেব নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। ‘সাহেব বাড়ি’ নামে ওই বাড়িটির খ্যাতি আজও বর্তমান। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় বোন সৈয়দা আনোয়ারা ইসলাম, মধ্যম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ছোট সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাল্যকালের ডাকনাম ছিল ‘গোলাপ’। কিশোরগঞ্জে তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে যথাক্রমে প্রবেশিকা ও আইএ পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদে যোগদান করেন। কিন্তু আরও বৃহৎ কর্মযজ্ঞ যার জন্য অপেক্ষা করছে, তিনি সাধারণ একটি সরকারি চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকবেন কেন? দুই বছরের মধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। কিছুদিন পর এ পেশা ছেড়ে আইন ব্যবসায় এবং রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছাত্রজীবনেই রাজনীতি ও দেশ সেবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সুসাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৪ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে সমাসীন ছিলেন। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণীত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দিনে দিনে স্বাধিকার আন্দোলন প্রবলভাবে বেগবান হতে থাকে। ওই সঙ্কটময় সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতির (১৯৬৬-১৯৬৯) গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত করা হয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম তা রক্ষা করে গেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা জাতি এক ভয়াবহ সঙ্কটে নিপতিত হয়। শুরু হয় গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগরে গঠন করা হয় অস্থায়ী সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট আর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় ওই সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট। মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুলের কাঁধেই বর্তায় মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রবাসী সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার। কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হলে নতুন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হন সৈয়দ নজরুল। ১৯৭৩ সালে নতুন সরকার গঠিত হলে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করা হলে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। খোন্দকার মোশ্তাক আহমাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে পুরনো সহকর্মীদের কয়েকজনকে তার মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুলসহ জাতীয় ৪ নেতা উক্ত মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে ২৩শে আগস্ট তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় ৪ নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বন্দি থাকা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একই সঙ্গে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানও। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার এক সপ্তাহ পর ২৩শে আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। নির্মম সে হত্যাযজ্ঞের পর সেই সময়ের দুঃসহ নানা স্মৃতির কথা মানবজমিনকে বলেছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহোদর ও বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া। বয়সের ভারে শয্যাশায়ী হলেও একমাত্র ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু ও শূন্যতা স্মৃতিকাতর ছোটভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়াকে আজও কাঁদায়। তার কাছে সেদিনের স্মৃতি কখনওই পুরনো হওয়ার নয়। আজও তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে তার ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশের তাজা ছবি।
বাকরুদ্ধ কণ্ঠে পট্টু মিয়া জানান, ওই সময় তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাসহ সৈয়দ নজরুলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সৈয়দা নাফিসা ইসলাম সরকারি বাসভবন ছেড়ে গোপীবাগে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠেন। সেই বাসা থেকেই প্রতিদিন রান্না করে সৈয়দ নজরুলের জন্য তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে খাবার পাঠাতেন। কিন্তু ৩রা নভেম্বর তিনি বারবার খাবার পাঠালেও প্রতিবারই কারা কর্তৃপক্ষ সেই খাবার ফেরত পাঠায়। তখনই অজানা আশঙ্কা জাগে পরিবারের সদস্যদের মাঝে। হয়তো ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে, এমনটি আঁচ করেন তারা। শেষ পর্যন্ত তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর সৈয়দ নজরুলের তখনকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম করিম ঢাকার জেলা প্রশাসককে ঘটনা অবহিত করেন। জেলা প্রশাসক চরম এই দুঃসংবাদটি জানান ঢাকার আরমানিটোলায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্বন্ধী আসাদুজ্জামানের বাসায়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ তার আরেক সম্বন্ধী মসুদুজ্জামানের পুত্র ক্যাপ্টেন আনু কারাগার থেকে আসাদুজ্জামানের বাসভবনে নিয়ে আসেন। পরে আরমানিটোলা মাঠে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে জেলহত্যার এ ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। নৃশংস এই ঘটনার আগে তারা বুঝতেই পারেন নি, এভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হতে পারে। তখনকার ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে জানাজায় খুব বেশি মানুষ যেতে সাহস করেনি। সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া জানান, ৩রা নভেম্বরের জেলহত্যা ঘটনার সময় সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ছোট ছেলে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দেশের বাইরে ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহধর্মিণী সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, অন্য দুই ছেলে সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম ও সৈয়দ শরীফুল ইসলাম এবং দুই মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া আক্তার নূর লিপি ও সৈয়দা রূপা পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে শোক সামলেছেন। সে সময় তাদের সমবেদনা জানানোর মতোও কেউ ছিল না। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে তাদের নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে হয়েছে।
পট্টু মিয়া বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ৩রা নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনায় আমাদের পরিবারের উপর নির্যাতন ও দুর্যোগ নেমে আসে। সে সময় ভয়ে আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে নিকটাত্মীয়রাও যোগাযোগ রাখতেন না। এমনকি তীব্র আর্থিক কষ্টের মধ্যেও কেউ কোন ধরনের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। তিনি বলেন, আমাদের পরিবার থেকে আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় ’৭৬ সালে আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়। প্রায় তিন বছর কারাগারে দুঃসহ জীবন কাটাতে হয়েছে। এমনকি কিশোরগঞ্জের যশোদল বীরদামপাড়ার আমাদের পৈতৃক বাড়িটিও সে সময় সরকার বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে এটি আমরা ফেরত আনতে সক্ষম হই।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জ শহরের ৩ কিলোমিটার পুবে যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালে। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুর রইস এবং মা সৈয়দা নূরুন্নাহার খাতুন। সরকারি চাকুরে পিতা এলাকায় রইস মিয়া সাহেব নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। ‘সাহেব বাড়ি’ নামে ওই বাড়িটির খ্যাতি আজও বর্তমান। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় বোন সৈয়দা আনোয়ারা ইসলাম, মধ্যম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ছোট সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাল্যকালের ডাকনাম ছিল ‘গোলাপ’। কিশোরগঞ্জে তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে যথাক্রমে প্রবেশিকা ও আইএ পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদে যোগদান করেন। কিন্তু আরও বৃহৎ কর্মযজ্ঞ যার জন্য অপেক্ষা করছে, তিনি সাধারণ একটি সরকারি চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকবেন কেন? দুই বছরের মধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। কিছুদিন পর এ পেশা ছেড়ে আইন ব্যবসায় এবং রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছাত্রজীবনেই রাজনীতি ও দেশ সেবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সুসাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৪ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে সমাসীন ছিলেন। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণীত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দিনে দিনে স্বাধিকার আন্দোলন প্রবলভাবে বেগবান হতে থাকে। ওই সঙ্কটময় সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতির (১৯৬৬-১৯৬৯) গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত করা হয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম তা রক্ষা করে গেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা জাতি এক ভয়াবহ সঙ্কটে নিপতিত হয়। শুরু হয় গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগরে গঠন করা হয় অস্থায়ী সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট আর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় ওই সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট। মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুলের কাঁধেই বর্তায় মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রবাসী সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার। কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হলে নতুন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হন সৈয়দ নজরুল। ১৯৭৩ সালে নতুন সরকার গঠিত হলে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করা হলে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। খোন্দকার মোশ্তাক আহমাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে পুরনো সহকর্মীদের কয়েকজনকে তার মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুলসহ জাতীয় ৪ নেতা উক্ত মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে ২৩শে আগস্ট তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় ৪ নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
No comments