মুসলিম ইতিহাসে রাষ্ট্র ও ইসলাম by শাহ আব্দুল হান্নান
ইসলামের কি রাষ্ট্র বা রাজনীতির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই? ইসলাম রাষ্ট্রকে কী নজরে দেখে, এ বিষয়টিই আলোচনা করব। কেউ কেউ মক্কায় অবতীর্ণ সূরা কাফিরুনের উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসলামে রাষ্ট্র করার কোনো বিষয় নেই, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
সূরা কাফিরুন নাজিলের পটভূমিকা সম্পর্কে ইবনে হাতিম, তাবারানি, তাফসির ইবনে জারির ও ইবনে হিশামের সিরাতে উল্লেখ রয়েছে, মক্কার অমুসলিম নেতারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে তারা বলেছিলেন, তারা মুসলিমদের সাথে এক বছর আল্লাহর ইবাদত করবেন; পরের বছর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের লাত ও উজ্জার পূজা করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফিরুন নাজিল করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, এ ধরনের ইবাদতের মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ এবং লাত-উজ্জার ইবাদত এক সাথে করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘হে রাসূল! আপনি বলুন, হে কাফের সম্প্রদায়, তোমরা যাদের ইবাদত করো, আমি তাদের ইবাদত করি না। আমি যার ইবাদত করি, তোমরা তার ইবাদত করো না।... তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য।’
এ সূরায় মূলত ইবাদত পদ্ধতির মিশ্রণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রত্যেকে তার ইবাদতের ক্ষেত্রে স্বাধীন তা-ও বলা হয়েছে। এ সূরার অন্য কোনো তাৎপর্য নেই। যদি এর অর্থ সেকুলারিজম (রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্ম বর্জনবাদ) হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা গিয়েই একটি রাষ্ট্র গঠন করতেন না। আমরা সবাই ‘মদিনা সনদ’-এর কথা জানি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জারি করেছিলেন। এ সনদের মূল কথা ছিল নিম্নরূপ :
১. সব মুসলিম এক উম্মাহ (একটি আদর্শভিত্তিক জাতি); ২. ইহুদিদের অধিকার সমান, তাদের ওপর অত্যাচার করা যাবে না এবং তাদের শত্রুদের সাহায্য করা যাবে না; ৩. ইহুদি ও মুসলিমরা মিলে একটি মিল্লাত (তারা একই রাজনৈতিক ও জাতীয়তা অর্থাৎ মদিনা রাষ্ট্রের নাগরিক); ৪. তারা মিলিতভাবে মদিনাকে রক্ষা করবে; ৫. সনদের আওতাধীন সবার জন্য এ শহর হবে নিরাপত্তার স্থান; ৬. সব মতবিরোধপূর্ণ বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করা হবে।
মদিনা রাষ্ট্রটির আইন ছিল ইসলামি আইন। তবে ইহুদিদের ব্যক্তিগত আইন তাদের শরিয়াহ মোতাবেক নির্ধারিত হতো। এ অবস্থা খেলাফতে রাশিদিনের সময় পরিবর্তন করা হয়নি। তারা সবাই শাসক হিসেবে ইসলামকেই অনুসরণ করতেন। রাষ্ট্রের আইন ছিল কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। এর বাইরে আইনের প্রয়োজন হলে তা ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো। অসংখ্য নতুন বিধান তারা করেছিলেন। এসবের বেশির ভাগই ছিল প্রশাসন সংক্রান্ত (ইসলামি আইনের পরিভাষায় এসব আইনকে ‘সিয়াসা আশশারিয়াহ’ বলে)। বিচারব্যবস্থা কাজীদের হাতে ছিল। তারাই ইসলামি আইনের ভিত্তিতে বিচার করতেন।
একই অবস্থা উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানীয়, ফাতিমীয়, মোগল আমলে অব্যাহত ছিল; এমনকি বাংলাদেশের সুলতানি আমলেও। ইসলামি আইনই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল। কাজীরাই বিচার করতেন। ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এসব রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য ইসলাম ও ইসলামি আইনই ছিল।
মুসলিম ইতিহাসে রাষ্ট্র ও ইসলাম কখনোই বিচ্ছিন্ন ছিল নাÑ সে রাষ্ট্রের শাসক সুন্নি, শিয়া, খারিজি যা-ই হোন না কেন, এর পরিবর্তন ঘটেছে উপনিবেশবাদের সময়। যা হোক, ইসলামে বিষয়টি বিতর্কমূলক নয়। বিষয়টিকে বিতর্কিত না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
লেখক : সাবেক সচিব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সূরা কাফিরুন নাজিলের পটভূমিকা সম্পর্কে ইবনে হাতিম, তাবারানি, তাফসির ইবনে জারির ও ইবনে হিশামের সিরাতে উল্লেখ রয়েছে, মক্কার অমুসলিম নেতারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে তারা বলেছিলেন, তারা মুসলিমদের সাথে এক বছর আল্লাহর ইবাদত করবেন; পরের বছর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের লাত ও উজ্জার পূজা করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফিরুন নাজিল করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, এ ধরনের ইবাদতের মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ এবং লাত-উজ্জার ইবাদত এক সাথে করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘হে রাসূল! আপনি বলুন, হে কাফের সম্প্রদায়, তোমরা যাদের ইবাদত করো, আমি তাদের ইবাদত করি না। আমি যার ইবাদত করি, তোমরা তার ইবাদত করো না।... তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য।’
এ সূরায় মূলত ইবাদত পদ্ধতির মিশ্রণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রত্যেকে তার ইবাদতের ক্ষেত্রে স্বাধীন তা-ও বলা হয়েছে। এ সূরার অন্য কোনো তাৎপর্য নেই। যদি এর অর্থ সেকুলারিজম (রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্ম বর্জনবাদ) হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা গিয়েই একটি রাষ্ট্র গঠন করতেন না। আমরা সবাই ‘মদিনা সনদ’-এর কথা জানি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জারি করেছিলেন। এ সনদের মূল কথা ছিল নিম্নরূপ :
১. সব মুসলিম এক উম্মাহ (একটি আদর্শভিত্তিক জাতি); ২. ইহুদিদের অধিকার সমান, তাদের ওপর অত্যাচার করা যাবে না এবং তাদের শত্রুদের সাহায্য করা যাবে না; ৩. ইহুদি ও মুসলিমরা মিলে একটি মিল্লাত (তারা একই রাজনৈতিক ও জাতীয়তা অর্থাৎ মদিনা রাষ্ট্রের নাগরিক); ৪. তারা মিলিতভাবে মদিনাকে রক্ষা করবে; ৫. সনদের আওতাধীন সবার জন্য এ শহর হবে নিরাপত্তার স্থান; ৬. সব মতবিরোধপূর্ণ বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করা হবে।
মদিনা রাষ্ট্রটির আইন ছিল ইসলামি আইন। তবে ইহুদিদের ব্যক্তিগত আইন তাদের শরিয়াহ মোতাবেক নির্ধারিত হতো। এ অবস্থা খেলাফতে রাশিদিনের সময় পরিবর্তন করা হয়নি। তারা সবাই শাসক হিসেবে ইসলামকেই অনুসরণ করতেন। রাষ্ট্রের আইন ছিল কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। এর বাইরে আইনের প্রয়োজন হলে তা ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো। অসংখ্য নতুন বিধান তারা করেছিলেন। এসবের বেশির ভাগই ছিল প্রশাসন সংক্রান্ত (ইসলামি আইনের পরিভাষায় এসব আইনকে ‘সিয়াসা আশশারিয়াহ’ বলে)। বিচারব্যবস্থা কাজীদের হাতে ছিল। তারাই ইসলামি আইনের ভিত্তিতে বিচার করতেন।
একই অবস্থা উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানীয়, ফাতিমীয়, মোগল আমলে অব্যাহত ছিল; এমনকি বাংলাদেশের সুলতানি আমলেও। ইসলামি আইনই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল। কাজীরাই বিচার করতেন। ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এসব রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য ইসলাম ও ইসলামি আইনই ছিল।
মুসলিম ইতিহাসে রাষ্ট্র ও ইসলাম কখনোই বিচ্ছিন্ন ছিল নাÑ সে রাষ্ট্রের শাসক সুন্নি, শিয়া, খারিজি যা-ই হোন না কেন, এর পরিবর্তন ঘটেছে উপনিবেশবাদের সময়। যা হোক, ইসলামে বিষয়টি বিতর্কমূলক নয়। বিষয়টিকে বিতর্কিত না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
লেখক : সাবেক সচিব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
No comments