‘রাসুল (সা.)-এর পদপ্রান্তে’ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

রাজার অতিথি আমি, দর্শনপ্রার্থী তাঁর, যিনি সব রাজার রাজা। সৌদি দূতাবাস থেকে জরুরি টেলিফোন, ‘পাসপোর্ট পাঠান, হজ ডেলিগেশনে রাজকীয় মেহমান আপনি।’ শেষ ফ্লাইটে সৌদিয়া বিমানে বিজনেস ক্লাসে বসে আল্লাহকে জানালাম কোটি কোটি শুকরিয়া। হজ করেছি ৩২ বছর আগে, আবার গত বছর ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। মদিনায় খেজুর বাগানে গিয়ে শারমিনীকে জানালাম জীবনের শেষ স্বপ্নের কথা। এখানেই থাকতে মন চায় জীবনের শেষ কয়টি দিন। তবে কি সেই আহ্বানই শুনতে পেয়েছেন বিধাতা? হজের প্রচণ্ড ভিড়ে কাবাঘর স্পর্শ পঁচাত্তর-উত্তীর্ণ যুবকদের পক্ষে অসম্ভব কল্পনা, আল্লাহ অল্প আয়েসেই অধমকে পৌঁছে দিলেন সেই স্থানে। দেয়ালের স্পর্শ ছাড়ব না কিছুতেই, চাইব যতক্ষণ দেহে আছে শক্তি, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মুসলমানদের জন্য এবং দেশের সবার জন্য চাইব শান্তির ফয়সালা। জীবনব্যাপী ভুলের নজরানা কুলাল না নজরুল-আব্বাসউদ্দীনের ফেলে যাওয়া গজলসম্ভারে, দুকূল ভাঙা অশ্রুধারা শুকাল শেষে ক্লান্তিহীন করুণা ভিক্ষায়। কাবা প্রদক্ষিণের এ অনন্ত স্রোতধারা, শেষ হবে না কোনো দিন। পতঙ্গের মতো, সুযোগ পেয়েছি আলোর আবর্তে নিজকে বিলীন করার, সুযোগ পেয়েছি প্রাণ ভরে মজলুম মুসলমানদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার। কাঙালের মতো এই ক্ষণে ফরিয়াদরত নারী– পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ-যুবা একাকার। জীবন স্রোতের সঙ্গে তুলনীয় এই স্রোত কেউ কখনো খুঁজে পাবে না পৃথিবীর অন্য কোথাও।
অনেক দিন আগে মক্কা শহরে গেছেন যাঁরা, পুরোনো কোনো কিছুই আর তাঁরা খুঁজে পাবেন না। ইতিহাসের কোনো কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কাবাগৃহ ছাড়া। অচিরেই এটি পরিণত হতে চলেছে পৃথিবীর আধুনিকতম নগরের একটিতে। শোভা পাবে যেখানে নতুন নতুন গগনচুম্বী হোটেল, নতুন পথঘাট, বাজারহাট। তীর্থযাত্রীরা থাকবেন শহর থেকে দূরত্বে, নতুন নতুন স্যাটেলাইট টাউনে—কম খরচে, আরাম-আয়েশে। বিদ্যুৎবেগে বিদ্যুৎ ট্রেনে পৌঁছে দেওয়া হবে কাবাগৃহের সামনে। ধরা যাক, সেদিন বাংলাদেশ থেকে যাঁরা হজে যাবেন, তাঁদের জন্য প্রস্তুত হবে ‘বাংলাদেশ মরু-পল্লি’, ভারতের জন্য ‘ভারত মরু-পল্লি’ ইত্যাদি। তীর্থযাত্রীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা, যেমন– সুআহার, চিকিৎসা ও নামাজের বন্দোবস্ত ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় সুনিদ্রার ব্যবস্থা থাকবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে স্থানসংকুলান না হওয়ায় ২৫ লাখ তীর্থযাত্রীর মক্কা ও মদিনায় একসঙ্গে থাকা-খাওয়া, ঘুমানো বেশ কষ্টসাধ্য। মিনা ও মুজদালিফায় তীর্থযাত্রীরা যে কষ্টের মধ্যে পতিত হন, তা থেকে এখন ব্যবস্থা উন্নততর। মরুভূমিতে প্রয়োজন পানি। তুলনায় পর্যাপ্ত পানি ও তাঁবু মজুত আছে এখন। কাবা শরিফ, মক্কা-মদিনা সব সময় পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। পরিষ্কারে নিয়োজিত আমরা, বাংলাদেশের তরুণ শক্তি।
কাবাগৃহের চতুর্দিকে উঠছে, উঠবে, পাঁচতারা হোটেল, যেখানে বিত্তশালীরা কামরায় বসেই এবাদতে মশগুল থাকবেন। গয়া, কাশি, বেনারসেও আকাশচুম্বী হোটেলগুলোতে হতে চলেছে ভারতের লাখো মানুষের জন্য সুবিধা, গঙ্গার জলের নির্মলতা। সুব্যবস্থা গ্রহণ করছে নতুন সরকার। জাপানের কিয়োটো শহর, বৌদ্ধদের বড় মন্দির দেখে এসেছি, যেন নির্মলতা ও পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। নবীর পদপ্রান্তে কয়টি দিন। নবীর কাছে কীভাবে যাব, ভাবছি প্রতিক্ষণ। হয়তো জায়গাই পাব না। অবাক আমি। তাঁর পদপ্রান্তে সবচেয়ে গরিব কয়জন আরববাসীর পাশেই আমার জায়গা করে দিলেন তিনি। সোম ও বৃহস্পতিবার তাঁরা রোজা রাখেন নবীর পদাঙ্ক অনুসরণে। আমার জন্যও আঁজলা ভরে জমজমের পানি, আজওয়া খেজুর ও খুবজা এগিয়ে দিলেন। রোজা ছিলাম না, অথচ ওদের সঙ্গে ইফতার করায় সওয়াব পেলাম। রাসুল (সা.)-এর কথা মনে হতেই বাংলার মানুষের চোখে অশ্রুর ঢল নামে। রাসুল (সা.)-এর জন্য আমার এবারের সওগাত:‘রসুলের পদপ্রান্তে’—আমারই লেখা মুহাম্মদের নাম গ্রন্থের ২০ বছর পর।
গ্রন্থটি মনেই ছিল, পরিণত বয়সে যা দল মেলতে চলেছে। আমার সঙ্গে এবার বাংলাদেশের শতসহস্র বঞ্চিত শিশু, যারা কোনো দিন হজে যায়নি, যেতে পারবে না। অথচ আমার সঙ্গে গেলে কত সহজেই নবীর পায়ের কাছে বসে শুনতে পারবে নজরুলের অসংখ্য গজল, যা গীত হয়েছে পিতা আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ১০০ বছর ধরে। ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই তাঁর সামনে খেলা করছে, তারা গান গাইছে, সহজ নৃত্য করছে, আর রাসুল (সা.)-এর স্নেহ, চুম্বনে হচ্ছে অভিসিক্ত। এ আমার মায়ার খেলা। কল্পনার চোখে এ খেলা প্রত্যক্ষ করেছি। চোখের পানিতে সয়লাব হয়ে গানগুলো আবার গেয়েছি। কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তফা ও পিতা আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ ছিলেন আমার সঙ্গে। কল্পনার মাহফিলে বঞ্চিত শিশুরা গান গেয়েছে, সেই সঙ্গে অবগাহন করে এসেছি নবী (সা.)-এর সেই সময়ের দেশ, যেটি ছিল মরুময়, মাঝেমধ্যে ছোট ছোট গাছ, সেখানে উট চরিয়ে ফিরছে ছোট শিশুরা। সে দৃশ্য এখনো আছে বৈকি। শুধু বদলে গেছে মক্কা-মদিনা।
সৌদি আরবের আমন্ত্রণে বারো শ মেহমান। চীন, জাপান, রাশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, আফ্রিকার দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশ। একসঙ্গে খাওয়া, তাঁবুতে ঘুমানো, জায়নামাজে সিজদা। রাজার সঙ্গে দেখা হয়নি, পাঠিয়েছেন: জায়নামাজ, তাসবিহ, আতর, মোবাইল ও জমজমের পানি। ডিরেক্টর জেনারেল বললেন, ‘আব্বাসী সাহেব, সালাম পৌঁছে দেবেন সবার কাছে। আপনাদের খাদেম আমরা। তাঁর সুন্দর হাসিটি অনেক দিন মনে থাকবে।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.