ভারত- দুর্নীতিবাজদের বিচার করতে হবে by কুলদীপ নায়ার
একসময় আমি লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার ছিলাম। সে সময়ের কথা মনে পড়ছে। কারণ, তখন টাকার সমস্যা এত প্রকট হয়েছিল যে নয়াদিল্লি থেকে জানানো হয়, লন্ডনে বসবাসরত ভারতীয়দের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু সেখানে জার্মান রাষ্ট্রদূত আমাকে যে কথা শোনান, তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়। তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের এত পরিমাণ টাকা গচ্ছিত আছে যে তাঁরা অনায়াসে কয়েকটা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্থ সরবরাহ করতে পারেন। এই অবৈধ বিদেশি ব্যাংক হিসাব নিয়ে শোরগোল তৈরি হওয়ায় যাঁরা এই বিতর্কের আগে সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়েছিলেন, তাঁদের নাম সবাই ভুলে যায়। স্বাভাবিকভাবে, এসব মানুষ প্রধান দুই দলভুক্ত: কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, এই হিসাবধারীরা এত টাকা কোথায় পেলেন, তার অনুসন্ধানও কেউ একটিবার করেননি। আর ব্যাপারটি বন্ধ করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও কোনো কথা নেই।
বিদেশে টাকা জমানো একটি অপরাধ। সে কারণে যাঁরা বিদেশে টাকা লুকিয়েছেন, তাঁরা সবাই দোষী। সরকার কেন তাঁদের নাম লুকাতে চায়, সেটা সত্যিই আমাদের বোধগম্য নয়। নিশ্চিতভাবেই কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ই এর জন্য দায়ী। ফলে তাঁদের নাম প্রকাশ পেলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সে কারণেই দল দুটি চায় না যে নাম প্রকাশিত হোক।
সত্য হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে থাকে। সে টাকার বারো আনাই অবৈধ, আর সেই অবৈধ টাকা লুকানোর স্বর্গ হচ্ছে এই দেশগুলো। ফলে মানুষও এ টাকা সম্বন্ধে জানতে পারে না, আবার তাঁরা বিপুল অঙ্কের করও ফাঁকি দিতে পারেন।
ভারতের জনগণের উচিত জার্মানিকে ধন্যবাদ দেওয়া, কারণ তারাই এসব নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। একটি জার্মান ব্যাংক কেমনভাবে যেন এই তালিকা পেয়ে যায়। তারপর তারা সেটি ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। ভারতের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কৃতিত্ব এখানে নেই। আবার জার্মানি কেন এই নামগুলো ভারতের কাছে হস্তান্তর করল, সেটাও তেমন একটা বোধগম্য নয়। ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে এটা ছিল নয়াদিল্লির ওপর একরকম চাপ প্রয়োগ, তাহলে সেটা কার্যকর হয়েছে।
জনগণ যখন জানতে পারল যে ৮০০ জন ভারতীয়র বিদেশে টাকা আছে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে আরও অনেক নামই প্রকাশিত হয়নি। এটা শুধু বরফখণ্ডের ওপরের অংশ, যার বেশির ভাগটাই পানির নিচে। বিদেশে যে পরিমাণ টাকা জমা আছে, তার পরিমাণ ছয় লাখ কোটি রুপি।
যা-ই হোক, সরকারের হাতে এখন এই হিসাবধারীদের তালিকা আছে। খবর বেরিয়েছে, তাঁরা এ টাকা পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে। রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার ১০০ দিনের মধ্যেই দোষী ব্যক্তিদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ সাত মাস পর তিনি কেবল ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন।
মনমোহন সিংয়ের সরকার কেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিল না, তার ব্যাখ্যা কংগ্রেসের মুখপাত্র দেননি। এরূপ অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর আসলে কেউই দেন না। নাম প্রকাশের ব্যাপারটাও এর মধ্যে পড়ে।
মোদি সরকারেরও পবিত্র কিছু ব্যাপার আছে। তারা করপোরেট খাতের কিছু কোম্পানির নাম প্রকাশ করেছে, আবার কিছু বাদ দিয়েছে। সম্ভবত যে কোম্পানিগুলোর নাম এসেছে, তারা মোদি-জাদুতে বিমোহিত হয়নি। আর এই করপোরেট খাতে গুরুত্ব দেওয়া আসলে রাজনৈতিক খাত থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে জনগণকে এটাও বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যে এই অবৈধ টাকা আসলে করপোরেট জগতের সৃষ্ট, রাজনীতিকদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এটা কালোটাকা, এটা অর্জিতও হয়েছে অবৈধ উপায়ে। ফলে রাজনীতিকদেরই এর দায় নিতে হবে, সরকার বা বিরোধী দল যেখানেই তঁারা থাকুক না কেন। তাঁরা দুর্নীতির প্রতি চোখ বুজে ছিলেন।
আমরা আশা করেছিলাম, মোদি রাজনীতির এই কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন। কারণ, তিনি সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কথা বলেছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তাঁর কথা রাখতে পারেননি। তিনি রাজনীতিক ও আমলাদের দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই যা। কিন্তু দুর্নীতি মোটেও কমেনি।
এখন মোদি যদি সব নাম প্রকাশ করে দেন, তাহলে কিছুটা হলেও তাঁর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা যায়। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বিচারের ব্যাপারটি নির্ভর করছে তথ্য-প্রমাণের ওপর। এতে অন্তত তিনি দুর্নীতিবাজদের নাম গোপন করার কলঙ্ক থেকে রেহাই পাবেন।
হ্যাঁ, এখন যা বলব তা দুর্নীতির কোনো নজির না হলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই দেওয়ালিতে নাকি তিন হাজার কোটি টাকার বাজি পোড়ানো হয়েছে—শুনে তো আমার অক্কা পাওয়ার দশা। আর দসরায় যে টাকা খরচ হয়েছে, সেটা এর বাইরে, তার অঙ্কও কয়েক কোটির কম নয়।
যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, সেখানে এরূপ দুর্নীতির খবর চেপে যাওয়া বা অযাচিত ব্যয় করা আসলে সেই অভুক্ত মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্বহীনতার শামিল; একই সঙ্গে এটা মানবতার চরম অবমাননাও বটে। এর প্রতিবাদে মানুষকে রাস্তায় নেমে গলা ফাটাতে দেখছি না। সমাজে একরকম নিস্পৃহতা দেখা যাচ্ছে, কারণ যাঁরা এই প্রতিবাদ করেন বা জনমত গঠন করেন, তাঁরাও এ সমস্যার অংশে পরিণত হয়েছেন। ফলে তাঁদের তরফ থেকে কোনো সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
বিদেশে টাকা জমানো একটি অপরাধ। সে কারণে যাঁরা বিদেশে টাকা লুকিয়েছেন, তাঁরা সবাই দোষী। সরকার কেন তাঁদের নাম লুকাতে চায়, সেটা সত্যিই আমাদের বোধগম্য নয়। নিশ্চিতভাবেই কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ই এর জন্য দায়ী। ফলে তাঁদের নাম প্রকাশ পেলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সে কারণেই দল দুটি চায় না যে নাম প্রকাশিত হোক।
সত্য হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে থাকে। সে টাকার বারো আনাই অবৈধ, আর সেই অবৈধ টাকা লুকানোর স্বর্গ হচ্ছে এই দেশগুলো। ফলে মানুষও এ টাকা সম্বন্ধে জানতে পারে না, আবার তাঁরা বিপুল অঙ্কের করও ফাঁকি দিতে পারেন।
ভারতের জনগণের উচিত জার্মানিকে ধন্যবাদ দেওয়া, কারণ তারাই এসব নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। একটি জার্মান ব্যাংক কেমনভাবে যেন এই তালিকা পেয়ে যায়। তারপর তারা সেটি ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। ভারতের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কৃতিত্ব এখানে নেই। আবার জার্মানি কেন এই নামগুলো ভারতের কাছে হস্তান্তর করল, সেটাও তেমন একটা বোধগম্য নয়। ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে এটা ছিল নয়াদিল্লির ওপর একরকম চাপ প্রয়োগ, তাহলে সেটা কার্যকর হয়েছে।
জনগণ যখন জানতে পারল যে ৮০০ জন ভারতীয়র বিদেশে টাকা আছে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে আরও অনেক নামই প্রকাশিত হয়নি। এটা শুধু বরফখণ্ডের ওপরের অংশ, যার বেশির ভাগটাই পানির নিচে। বিদেশে যে পরিমাণ টাকা জমা আছে, তার পরিমাণ ছয় লাখ কোটি রুপি।
যা-ই হোক, সরকারের হাতে এখন এই হিসাবধারীদের তালিকা আছে। খবর বেরিয়েছে, তাঁরা এ টাকা পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে। রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার ১০০ দিনের মধ্যেই দোষী ব্যক্তিদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ সাত মাস পর তিনি কেবল ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন।
মনমোহন সিংয়ের সরকার কেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিল না, তার ব্যাখ্যা কংগ্রেসের মুখপাত্র দেননি। এরূপ অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর আসলে কেউই দেন না। নাম প্রকাশের ব্যাপারটাও এর মধ্যে পড়ে।
মোদি সরকারেরও পবিত্র কিছু ব্যাপার আছে। তারা করপোরেট খাতের কিছু কোম্পানির নাম প্রকাশ করেছে, আবার কিছু বাদ দিয়েছে। সম্ভবত যে কোম্পানিগুলোর নাম এসেছে, তারা মোদি-জাদুতে বিমোহিত হয়নি। আর এই করপোরেট খাতে গুরুত্ব দেওয়া আসলে রাজনৈতিক খাত থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে জনগণকে এটাও বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যে এই অবৈধ টাকা আসলে করপোরেট জগতের সৃষ্ট, রাজনীতিকদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এটা কালোটাকা, এটা অর্জিতও হয়েছে অবৈধ উপায়ে। ফলে রাজনীতিকদেরই এর দায় নিতে হবে, সরকার বা বিরোধী দল যেখানেই তঁারা থাকুক না কেন। তাঁরা দুর্নীতির প্রতি চোখ বুজে ছিলেন।
আমরা আশা করেছিলাম, মোদি রাজনীতির এই কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন। কারণ, তিনি সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কথা বলেছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তাঁর কথা রাখতে পারেননি। তিনি রাজনীতিক ও আমলাদের দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই যা। কিন্তু দুর্নীতি মোটেও কমেনি।
এখন মোদি যদি সব নাম প্রকাশ করে দেন, তাহলে কিছুটা হলেও তাঁর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা যায়। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বিচারের ব্যাপারটি নির্ভর করছে তথ্য-প্রমাণের ওপর। এতে অন্তত তিনি দুর্নীতিবাজদের নাম গোপন করার কলঙ্ক থেকে রেহাই পাবেন।
হ্যাঁ, এখন যা বলব তা দুর্নীতির কোনো নজির না হলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই দেওয়ালিতে নাকি তিন হাজার কোটি টাকার বাজি পোড়ানো হয়েছে—শুনে তো আমার অক্কা পাওয়ার দশা। আর দসরায় যে টাকা খরচ হয়েছে, সেটা এর বাইরে, তার অঙ্কও কয়েক কোটির কম নয়।
যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, সেখানে এরূপ দুর্নীতির খবর চেপে যাওয়া বা অযাচিত ব্যয় করা আসলে সেই অভুক্ত মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্বহীনতার শামিল; একই সঙ্গে এটা মানবতার চরম অবমাননাও বটে। এর প্রতিবাদে মানুষকে রাস্তায় নেমে গলা ফাটাতে দেখছি না। সমাজে একরকম নিস্পৃহতা দেখা যাচ্ছে, কারণ যাঁরা এই প্রতিবাদ করেন বা জনমত গঠন করেন, তাঁরাও এ সমস্যার অংশে পরিণত হয়েছেন। ফলে তাঁদের তরফ থেকে কোনো সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
No comments