রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি by গোলাপ মুনীর
গত ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে সুইডেন। এর মাধ্যমে ইরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম দেশ হিসেবে সুইডেন ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিলো। এর মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৩৫টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলো। জাতিসঙ্ঘের ৬৯.৯ শতাংশ সদস্য দেশই ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে মেনে নিলো। অনেক দেশ এখনো ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও পিএলওকে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করে। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত এক প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের ‘এনটিটি’ স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে ‘নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট’ করা হয়। এ প্রস্তাবের পক্ষে পড়ে ১৩৮ ভোট, বিপক্ষে ৯ ভোট। ভোটদানে বিরত থাকে ৪১টি দেশ। ইসরাইলসহ আরো কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দেয়ার পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে, ফিলিস্তিন নামের রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি শুধু দেয়া যেতে পারে ইসরাইল ও প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই সমঝোতা চুক্তি না হওয়ার প্রশ্নে এখন বড় বাধা হচ্ছেÑ সীমান্ত ও নিরাপত্তা, পানির অধিকার, জেরুসালেমের মর্যাদা, ধর্মীয় স্থানগুলোতে প্রবেশাধিকার, অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলের অব্যাহত বসতি নির্মাণ সম্প্রসারণ, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বৈধতা ও তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসার বিষয়।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত প্রবাসী প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিলের বিশেষ অতিরিক্ত অধিবেশনে ‘রাষ্ট্র ফিলিস্তিন’ গঠনের লক্ষ্যে দেয়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এর প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় ছিল পিএলও’র অন্যতম লক্ষ্য। ফিলিস্তিনের এই স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বিপুলসংখ্যক দেশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। সে বছর এসব স্বীকৃতিদাতা দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০টি। পরের বছর ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি পিএলও প্রতিনিধি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৯৪টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে দাবি করেন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসার লক্ষ্যে ইসরাইল ও পিএলও’র মধ্যে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত হয় অসলো চুক্তি। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ), যা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কাজ শুরু করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্বশাসিত প্রশাসন হিসেবে; কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ডি-ফেক্টো নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এমনকি পিএনএ প্রশাসনের তথা সরকারের আওতাধীন এলাকায়ও ইসরাইল এ ডি-ফেক্টো নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখে চলেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ৩০ অক্টোবর সুইডেনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১৩৫টি দেশের স্বীকৃতি আদায় পূরণ হলো। আশা করা যাচ্ছে, সুইডেনের উদাহরণ অনুসরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ দ্রুত ফিলিস্তিনের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করে যেমন ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইসরাইলের অমানবিক নির্যাতনের পথ চিরতরে বন্ধ করার জন্য এগিয়ে আসবে, তেমনি ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করবে।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৩২৩৬ নম্বর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, জাতীয় স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া হয়। এ প্রস্তাবে পিএলওকে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করা হয়। সেই সাথে পিএলও জাতিসঙ্ঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদাও দেয়া হয়। ফিলিস্তিন স্বাধীনতার সে ঘোষণাটি স্বীকার পিএলও’র প্যালেস্টাইন ডিজাইনেশনিটিও জাতিসঙ্ঘ মেনে নেয় ১৯৮৮ সালে; কিন্তু ঘোষিত রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক স্ট্যাটাস নেই জাতিসঙ্ঘ ব্যবস্থায়।
১৯৮৮ সালের স্বাধীনতা ঘোষণার সামান্য পর অনেক আফ্রিকা ও এশীয় উন্নয়নশীল দেশ এবং একই সাথে কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্ট দেশও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র এর বিদেশী সহায়তা আইন ও অন্যান্য পদক্ষেপ প্রয়োগ করে অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নিরুৎসাহিত করছে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশল অনেক ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। তবে আরব লিগ ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি তাৎক্ষণিকভাবে বিবৃতি দিয়ে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি ও সহায়তার কথা ঘোষণা করে। সেই সাথে এ দুই ফোরামই ফিলিস্তিনকে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি ফিলিস্তিনকে ৯৪টি দেশের স্বীকৃতির কথা জানায়। পরবর্তী সময় ফিলিস্তিন পদক্ষেপ নেয় জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ পাওয়ার জন্য; কিন্তু সেখানেও আসে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিÑ জাতিসঙ্ঘের কোনো সংস্থা ফিলিস্তিনকে সদস্যপদ দিলে সে সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তহবিল জোগানো বন্ধ করে দেবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে পিএলও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে, যুক্তরাষ্ট্র ওই সংস্থাকে সে কথা জানিয়ে দেয়। সেই মাসে ফিলিস্তিনের হয়ে ওআইসি সদস্য দেশের একটি গ্রুপ ইউনেস্কোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে, এবং তাতে উল্লেখ করা হয় মোট ৯১টি দেশ তখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই বছরের জন্য সুইজারল্যান্ড সরকারের কাছে জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯-এর জন্য লেটারস অব অ্যাক্সেসন পেশ করে; কিন্তু ডিপোজিটরি স্টেট হিসেবে সুইজারল্যান্ড জানিয়ে দেয়, যেহেতু আন্তর্জাতিক সমাজে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্বের প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত, তাই এই লেটারস অব অ্যাক্সেসন বৈধ কি না, তা নির্ধারণ করা যায়নি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না থাকার অজুহাতে এখানে ইউনেস্কোর সদস্যপদ লাভের ব্যাপারটি আটকে দেয়া হয়। এর ফলে আরব লিগ ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে পিএলওকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এই খসড়া প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র আবারো হুমকি দেয়Ñ এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘে ভোটাভুটি হলে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে তহবিল দেয়া বন্ধ করে দেবে। আরব দেশ এ প্রস্তাব প্রত্যাহারে সম্মত হয়, তবে দাবি জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে জাতিসঙ্ঘকে আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়া হবে না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিসংক্রান্ত অনেক বিবৃতিকে বিবেচনা করা হয় অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থক ও অভিপ্রায়প্রবণ হিসেবে। তা ছাড়া অনেক রাষ্ট্র এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। এর অর্থ এই নয়, এসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের অবস্থান কী? ১৯৬৭ সালের ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ এবং ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির মধ্যবর্তী সময়ে কোনো ইসরাইলি সরকারই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়নি। এমনকি ১৯৯৪ সালে প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটি (পিএনএ) প্রতিষ্ঠার পর ইসরাইলের বেশির ভাগ মূলধারার রাজনীতিবিদ এ ধারণার বিরোধিতা করেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের আমলে তার আগের দুই সরকারকে অর্থাৎ রবিন ও পেরেজের সরকার অভিযুক্ত করে বলা হয়, এরাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নামের ‘বিপদ’ বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বায়ত্তশাসনের গণ্ডির বাইরে যেতে না দেয়া।
তবে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অ্যারিয়েল শ্যারন ঘোষণা করেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হচ্ছে এ দ্বন্দ্বের সমাধান এবং তার প্রশাসনের লক্ষ্যও তাই। এহুদ ওলমার্টের নেতৃত্বাধীন সরকার একই উদ্দেশ্যের কথা পুনরুল্লেখ করে। ২০০৯ সালে নেতানিয়াহু আবার ক্ষমতায় আসার পর তার সরকার আবার দাবি করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্য ‘বিপদ’। তা সত্ত্বেও সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে ওবামা প্রশাসন থেকে বাধা আসার পর। ২০০৯ সালের ১৪ জুন নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো একটি বক্তব্য দিয়ে সামরিক বাহিনীবিহীন ও আরো ুদ্রায়তনের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানান। এই অবস্থান সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, তার বক্তব্যে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
সে যাই হোক, ইসরাইল এ সাধারণ ধারণা মেনে নিয়েছেÑ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব সময়ের সীমানা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। এ ক্ষেত্রে অজুহাত খাড়া করছে নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে এনে। ইসরাইলি সামরিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ১৯৬৭ সালের বর্ডার কৌশলগতভাবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষার উপযোগী নয়। ইসরাইল আপত্তি করছে জাতিসঙ্ঘের কাছে দেয়া ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রত্ব সম্পর্কিত ফিলিস্তিনি পরিকল্পনার ব্যাপারেও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি। ফিলিস্তিন প্রশ্নে এ ইউনিয়নের অবস্থান একটি উল্লেখযোগ্য বিবেচ্য। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ হিসেবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সুইডেন। এর অর্থ এ ইউনিয়নের বাকি দেশগুলো এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ইইউ বিদেশনীতি-প্রধান জেভিয়ার সোলানা জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানান একটি সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। যদিও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় পৌঁছা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হলে সমাধান দেবে আন্তর্জাতিক সমাজ। নির্ধারিত তারিখের পর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করে জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য করা হবে ফিলিস্তিনকে এবং তা বাস্তবায়নের তারিখ নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিল ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত প্রশ্নে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ইইউ’র এ সম্পর্কিত নীতির প্রতিফলন রয়েছে। এতে জোর দেয়া হয়, ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর ওপর এবং বলা হয়, ১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তে ও জেরুসালেমের সীমান্তে কোনো পরিবর্তন ইইউ মেনে নেবে না, যদি বিবদমান পক্ষ দু’টি ভিন্ন কিছু মেনে না নেয়। ইইউ আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ইইউ কখনোই পূর্ব জেরুসালেমের একীভূতকরণকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী অবশ্যই থাকতে হবে জেরুসালেমে। ২০১০ সালের জিসেম্বরে ইইউ কাউন্সিল আবার জোর দিয়ে এসব সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে এবং ঘোষণা করে যথাসময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ইইউ প্রস্তুত। তবে ইইউ উভয়পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। ২০১০ সালের পর আরো চারটি বছর কেটে গেছে। এবার প্রথম ইইউ দেশ হিসেবে সুইডেনের স্বীকৃত পেল ফিলিস্তিন। আমরা আশা করব, ইইউ এবার সুইডেনকে অনুসরণ করে আর দেরি না করেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃত দিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের অবসানপ্রক্রিয়াকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা জানি, ইইউ হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সহায়তা দানে এককভাবে সবচেয়ে বড় দাতাগোষ্ঠী। একইভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ১৯৬৭-পূর্ব সীমানায় ফিরে যাওয়া, দখল করা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বসতি স্থাপন ও ইতোমধ্যে স্থাপিত বসতির অপসারণ এবং জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে ইইউ বড় মাপের ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সাথে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ চায়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎশক্তিগুলো ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ালে ইসরাইলি বর্বরবতার অবসান ঘটবে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে নাগরিক সাধারণের শক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
বিশ্ববাসী জানে, পাঁচ শ’ বছর ধরে ইউরোপ মহাদেশে সংখ্যালঘু হিসেবে নিগৃহীত হয়েছে গোটা ইহুদি জাতি গোষ্ঠী। দুই বিশ্বযুদ্ধে এরা শিকার হয়েছে সীমাহীন নিগ্রহ, নির্যাতন ও গণহত্যার। ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তি এখন এই ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে এনে ফিলিস্তিনিদের একই ধরনের নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতে দিলে ইউরোপীয় দেশগুলোর পাপের বোঝা দ্বিগুণে পৌঁছবে। শোধরানোর পথ হবে বন্ধ। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে বিশ্বমোড়ল বলে পরিচিত দেশগুলো মিলে থামাতে হবে মানবতার শত্রু ইসরাইলকে। গড়তে হবে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত প্রবাসী প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিলের বিশেষ অতিরিক্ত অধিবেশনে ‘রাষ্ট্র ফিলিস্তিন’ গঠনের লক্ষ্যে দেয়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এর প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় ছিল পিএলও’র অন্যতম লক্ষ্য। ফিলিস্তিনের এই স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বিপুলসংখ্যক দেশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। সে বছর এসব স্বীকৃতিদাতা দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০টি। পরের বছর ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি পিএলও প্রতিনিধি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৯৪টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে দাবি করেন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসার লক্ষ্যে ইসরাইল ও পিএলও’র মধ্যে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত হয় অসলো চুক্তি। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ), যা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কাজ শুরু করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্বশাসিত প্রশাসন হিসেবে; কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ডি-ফেক্টো নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এমনকি পিএনএ প্রশাসনের তথা সরকারের আওতাধীন এলাকায়ও ইসরাইল এ ডি-ফেক্টো নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখে চলেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ৩০ অক্টোবর সুইডেনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১৩৫টি দেশের স্বীকৃতি আদায় পূরণ হলো। আশা করা যাচ্ছে, সুইডেনের উদাহরণ অনুসরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ দ্রুত ফিলিস্তিনের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করে যেমন ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইসরাইলের অমানবিক নির্যাতনের পথ চিরতরে বন্ধ করার জন্য এগিয়ে আসবে, তেমনি ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করবে।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৩২৩৬ নম্বর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, জাতীয় স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া হয়। এ প্রস্তাবে পিএলওকে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করা হয়। সেই সাথে পিএলও জাতিসঙ্ঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদাও দেয়া হয়। ফিলিস্তিন স্বাধীনতার সে ঘোষণাটি স্বীকার পিএলও’র প্যালেস্টাইন ডিজাইনেশনিটিও জাতিসঙ্ঘ মেনে নেয় ১৯৮৮ সালে; কিন্তু ঘোষিত রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক স্ট্যাটাস নেই জাতিসঙ্ঘ ব্যবস্থায়।
১৯৮৮ সালের স্বাধীনতা ঘোষণার সামান্য পর অনেক আফ্রিকা ও এশীয় উন্নয়নশীল দেশ এবং একই সাথে কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্ট দেশও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র এর বিদেশী সহায়তা আইন ও অন্যান্য পদক্ষেপ প্রয়োগ করে অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নিরুৎসাহিত করছে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশল অনেক ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। তবে আরব লিগ ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি তাৎক্ষণিকভাবে বিবৃতি দিয়ে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি ও সহায়তার কথা ঘোষণা করে। সেই সাথে এ দুই ফোরামই ফিলিস্তিনকে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি ফিলিস্তিনকে ৯৪টি দেশের স্বীকৃতির কথা জানায়। পরবর্তী সময় ফিলিস্তিন পদক্ষেপ নেয় জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ পাওয়ার জন্য; কিন্তু সেখানেও আসে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিÑ জাতিসঙ্ঘের কোনো সংস্থা ফিলিস্তিনকে সদস্যপদ দিলে সে সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তহবিল জোগানো বন্ধ করে দেবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে পিএলও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে, যুক্তরাষ্ট্র ওই সংস্থাকে সে কথা জানিয়ে দেয়। সেই মাসে ফিলিস্তিনের হয়ে ওআইসি সদস্য দেশের একটি গ্রুপ ইউনেস্কোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে, এবং তাতে উল্লেখ করা হয় মোট ৯১টি দেশ তখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই বছরের জন্য সুইজারল্যান্ড সরকারের কাছে জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯-এর জন্য লেটারস অব অ্যাক্সেসন পেশ করে; কিন্তু ডিপোজিটরি স্টেট হিসেবে সুইজারল্যান্ড জানিয়ে দেয়, যেহেতু আন্তর্জাতিক সমাজে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্বের প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত, তাই এই লেটারস অব অ্যাক্সেসন বৈধ কি না, তা নির্ধারণ করা যায়নি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না থাকার অজুহাতে এখানে ইউনেস্কোর সদস্যপদ লাভের ব্যাপারটি আটকে দেয়া হয়। এর ফলে আরব লিগ ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে পিএলওকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এই খসড়া প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র আবারো হুমকি দেয়Ñ এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘে ভোটাভুটি হলে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে তহবিল দেয়া বন্ধ করে দেবে। আরব দেশ এ প্রস্তাব প্রত্যাহারে সম্মত হয়, তবে দাবি জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে জাতিসঙ্ঘকে আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়া হবে না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিসংক্রান্ত অনেক বিবৃতিকে বিবেচনা করা হয় অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থক ও অভিপ্রায়প্রবণ হিসেবে। তা ছাড়া অনেক রাষ্ট্র এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। এর অর্থ এই নয়, এসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের অবস্থান কী? ১৯৬৭ সালের ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ এবং ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির মধ্যবর্তী সময়ে কোনো ইসরাইলি সরকারই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়নি। এমনকি ১৯৯৪ সালে প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটি (পিএনএ) প্রতিষ্ঠার পর ইসরাইলের বেশির ভাগ মূলধারার রাজনীতিবিদ এ ধারণার বিরোধিতা করেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের আমলে তার আগের দুই সরকারকে অর্থাৎ রবিন ও পেরেজের সরকার অভিযুক্ত করে বলা হয়, এরাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নামের ‘বিপদ’ বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বায়ত্তশাসনের গণ্ডির বাইরে যেতে না দেয়া।
তবে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অ্যারিয়েল শ্যারন ঘোষণা করেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হচ্ছে এ দ্বন্দ্বের সমাধান এবং তার প্রশাসনের লক্ষ্যও তাই। এহুদ ওলমার্টের নেতৃত্বাধীন সরকার একই উদ্দেশ্যের কথা পুনরুল্লেখ করে। ২০০৯ সালে নেতানিয়াহু আবার ক্ষমতায় আসার পর তার সরকার আবার দাবি করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্য ‘বিপদ’। তা সত্ত্বেও সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে ওবামা প্রশাসন থেকে বাধা আসার পর। ২০০৯ সালের ১৪ জুন নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো একটি বক্তব্য দিয়ে সামরিক বাহিনীবিহীন ও আরো ুদ্রায়তনের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানান। এই অবস্থান সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, তার বক্তব্যে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
সে যাই হোক, ইসরাইল এ সাধারণ ধারণা মেনে নিয়েছেÑ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব সময়ের সীমানা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। এ ক্ষেত্রে অজুহাত খাড়া করছে নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে এনে। ইসরাইলি সামরিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ১৯৬৭ সালের বর্ডার কৌশলগতভাবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষার উপযোগী নয়। ইসরাইল আপত্তি করছে জাতিসঙ্ঘের কাছে দেয়া ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রত্ব সম্পর্কিত ফিলিস্তিনি পরিকল্পনার ব্যাপারেও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি। ফিলিস্তিন প্রশ্নে এ ইউনিয়নের অবস্থান একটি উল্লেখযোগ্য বিবেচ্য। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ হিসেবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সুইডেন। এর অর্থ এ ইউনিয়নের বাকি দেশগুলো এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ইইউ বিদেশনীতি-প্রধান জেভিয়ার সোলানা জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানান একটি সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। যদিও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় পৌঁছা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হলে সমাধান দেবে আন্তর্জাতিক সমাজ। নির্ধারিত তারিখের পর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করে জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য করা হবে ফিলিস্তিনকে এবং তা বাস্তবায়নের তারিখ নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিল ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত প্রশ্নে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ইইউ’র এ সম্পর্কিত নীতির প্রতিফলন রয়েছে। এতে জোর দেয়া হয়, ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর ওপর এবং বলা হয়, ১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তে ও জেরুসালেমের সীমান্তে কোনো পরিবর্তন ইইউ মেনে নেবে না, যদি বিবদমান পক্ষ দু’টি ভিন্ন কিছু মেনে না নেয়। ইইউ আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ইইউ কখনোই পূর্ব জেরুসালেমের একীভূতকরণকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী অবশ্যই থাকতে হবে জেরুসালেমে। ২০১০ সালের জিসেম্বরে ইইউ কাউন্সিল আবার জোর দিয়ে এসব সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে এবং ঘোষণা করে যথাসময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ইইউ প্রস্তুত। তবে ইইউ উভয়পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। ২০১০ সালের পর আরো চারটি বছর কেটে গেছে। এবার প্রথম ইইউ দেশ হিসেবে সুইডেনের স্বীকৃত পেল ফিলিস্তিন। আমরা আশা করব, ইইউ এবার সুইডেনকে অনুসরণ করে আর দেরি না করেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃত দিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের অবসানপ্রক্রিয়াকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা জানি, ইইউ হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সহায়তা দানে এককভাবে সবচেয়ে বড় দাতাগোষ্ঠী। একইভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ১৯৬৭-পূর্ব সীমানায় ফিরে যাওয়া, দখল করা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বসতি স্থাপন ও ইতোমধ্যে স্থাপিত বসতির অপসারণ এবং জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে ইইউ বড় মাপের ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সাথে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ চায়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎশক্তিগুলো ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ালে ইসরাইলি বর্বরবতার অবসান ঘটবে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে নাগরিক সাধারণের শক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
বিশ্ববাসী জানে, পাঁচ শ’ বছর ধরে ইউরোপ মহাদেশে সংখ্যালঘু হিসেবে নিগৃহীত হয়েছে গোটা ইহুদি জাতি গোষ্ঠী। দুই বিশ্বযুদ্ধে এরা শিকার হয়েছে সীমাহীন নিগ্রহ, নির্যাতন ও গণহত্যার। ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তি এখন এই ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে এনে ফিলিস্তিনিদের একই ধরনের নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতে দিলে ইউরোপীয় দেশগুলোর পাপের বোঝা দ্বিগুণে পৌঁছবে। শোধরানোর পথ হবে বন্ধ। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে বিশ্বমোড়ল বলে পরিচিত দেশগুলো মিলে থামাতে হবে মানবতার শত্রু ইসরাইলকে। গড়তে হবে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন।
No comments