ব্যক্তি-হত্যা নয়, একটি জাতিসত্তা-হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা থেকে লন্ডনে ফিরে আসার সময় নতুন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি দেশে বাকশাল-শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ আয়োজনে ব্যস্ত। তিনি জানতেন, আমি বাকশাল-পদ্ধতির সমর্থক; কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বাকশাল-পদ্ধতির প্রবর্তন সমীচীন মনে করছি না। কথায় কথায় তিনি বললেন, আমি একটি ইতিহাস তৈরি করেছি। এই ইতিহাস ধ্বংস হয়ে যাক তা আমি চাই না। সেজন্যই দেশে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছি। যদি এই ইতিহাস রক্ষায় ব্যর্থ হই, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাব। শেষের কথাটা তিনি ইংরেজিতে বলেছিলেন, If I fail to continue this historical process then I will go to oblivion for a long time. বঙ্গবন্ধুর এই কথাগুলো আমার ডায়েরিতে টুকে নিয়েছিলাম।
এই সাক্ষাৎকারের এক মাস না যেতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। তারপর তিন মাস না ফুরোতেই জেলের ভেতর চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক মৃত্যু। তারপর থেকে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এবং জেলহত্যার ৩ নভেম্বর তারিখটি ঘুরে এলেই বঙ্গবন্ধুর ওই কথা কটি আমার মনে পড়ে। এখন আর বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না যে, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডেরই পরিণতি। দুটি হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এবং এই কারবালা-কাণ্ড কোনো ব্যক্তি হত্যাও নয়। এটা ছিল একটি নতুন স্বাধীন হওয়া জাতির সত্তা ও ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর যদি ঘাতকরা ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড না ঘটাতো, তাহলে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম বাংলাদেশের জন্য যে ইতিহাস তৈরি করেছে, সেই ইতিহাসকে দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির আড়ালে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী প্রমুখের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চালিত হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে।
১৯৭৫ সালেও কেবল বঙ্গবন্ধু এবং শেখ ফজলুল হক মনিসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে পাকিস্তানের অনুচর মুষ্টিমেয় বাঙালি সামরিক অফিসার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারতো না। জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে যে গণঅভ্যুত্থান হতো তাতে সেনা অভ্যুত্থান হতো প্রতিহত এবং ঘাতক ফারুক, রশীদ, ডালিম গংসহ তাদের সামরিক পৃষ্ঠপোষক জেনারেল জিয়াউর রহমান, রাজনৈতিক সহচর খন্দকার মোশতাকসহ অনেককেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। এই
সম্ভাবনা রোধ করার জন্যই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে
চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এবং বঙ্গবন্ধু যে বলেছিলেন দীর্ঘকালের জন্য ইতিহাস থেকে তাদের
মুছে ফেলা হবে, ঘাতকরা ক্ষমতা দখল করে সেই চেষ্টাই শুরু করেছিল।
পরেশ সাহা ছিলেন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। দীর্ঘকাল কলকাতায় দৈনিক যুগান্তর (অধুনালুপ্ত) পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু-হত্যার ওপর একটি বইও লিখেছেন। তিনি ঢাকায় জেলহত্যার পর যুগান্তরে তার কলামে লিখেছিলেন, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড যদি প্রতিহত করা যেত এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতাকে কারামুক্ত করা যেত, তাহলে পাকিস্তানের গোয়েন্দাচক্র এবং মার্কিন সিআইএর মদদ সত্ত্বেও বাংলাদেশে ঘাতকচক্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারত না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিসিঞ্জার-পরিকল্পনা আরেকটি পরাজয়বরণ করত।
পরেশ সাহা ছিলেন কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বাংলাদেশ সম্পর্কে ছিল তার গভীর দরদ। কাদের সিদ্দিকীরও তিনি বন্ধু ছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং তেসরা নভেম্বর নিয়ে তিনি লিখেছেন, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তার একটি উপমহাদেশীয় প্রতিক্রিয়াও ঘটেছে। বাংলাদেশে ৩ নভেম্বরের বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব হওয়াতেই সিআইএর সাহস ও শক্তি বাড়ে। শুরু হয় ভারতেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার চেষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতের শিখ সেনাপতিকে দিয়েই বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বর্ণমন্দির বিদ্রোহ ঘটানো হয়। পরিণতিতে ইন্দিরা একবার নির্বাচনে পরাজিত এবং পরে শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন। গোটা উপমহাদেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর তার সূচক। পরেশ সাহার এই বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি বলেই দীর্ঘকাল পর তার দুটি লেখার উদ্ধৃতি দিলাম। কেউ কেউ বলেন, ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনার সময় মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল ওসমানী এবং জিয়াউর রহমানসহ অন্য সেক্টর কমান্ডারদের ভূমিকাও ঘাতকদের ক্ষমতা দখলে বাধা সৃষ্টি করেনি। সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ কার্যত ঘাতকদের হাতে আটক ছিলেন। উপ-সেনাপ্রধান জেনালের জিয়াউর রহমান ছিলেন ঘাতকদের কোলাবরেটর। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার, বিশেষ করে ব্রিগেডিয়ার জেনালেল খালেদ মোশাররফের ভূমিকা তখন কী ছিল এই প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক বীরত্ব প্রদর্শনকারী খালেদ মোশাররফ ছিলেন রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিও। তিনি জিয়াউর রহমানদের চক্রান্তে এবং তখনকার জাসদ-নেতাদের অবিমৃষ্যকারিতায় ভেঙে পড়া সামরিক বাহিনীর কমান্ড পুনর্গঠনে তার কে ফোর্স নিয়ে আগে কেন সক্রিয় হননি এ প্রশ্নও কেউ কেউ তোলেন। অনেক পরে স্বল্পকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি নিজেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করার জন্য অযথা সময় নষ্ট করেছেন। ধূর্ত জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি অবস্থায় না রেখে দ্রুত কোনো সুরক্ষিত বন্দি নিবাসে পাঠাননি। জেলে বন্দি চার নেতাকে সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি দেয়ার সময় হয়তো তিনি পাননি। তার ওপর সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় বিদ্রোহী সেনাদের প্রস্তাবিত গোপন স্থানে আলোচনার জন্য গিয়ে তিনি সঙ্গীদেরসহ নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতা পুনর্দখল নিয়েও ঘাতকরা উৎসবে মেতে ওঠে। তাকে নাম দেয়া হয় সিপাহি-জনতার বিপ্লব।
সন্দেহ নেই ৩ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার দিন। এই দিন যদি জেলহত্যা নিবারণ করা যেত, দেশপ্রেমিক জেনালের খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর বিধ্বস্ত কমান্ড পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণ দ্রুত করতে পারতেন, জিয়া ও মোশতাকসহ ঘাতকদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে জাতীয় নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারতেন, তাহলে শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা উপমহাদেশের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। এমনও হতে পারত, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও হত্যা করা সম্ভব হতো না; বরং উপমহাদেশের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ডেমোক্রেটিক কমনওয়েলথ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা শক্তিশালী হতো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ব্যর্থ হতো। গোটা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্নের জোন অব পিস গড়ে উঠত। হতে পারে এটা আমার একটু বেশি আশাবাদ ছিল।
আজ আবার তেসরা নভেম্বর। বাংলাদেশে অনাড়ম্বরভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। আজ জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইমলাম, কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীকে প্রথাগতভাবে স্মরণ করা হবে। তাতে তেসরা নভেম্বরের আসল তাৎপর্যটি নতুন প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না। আর তা বোঝানো না গেলে তা শুধু দিবস পালনেই পর্যবসিত হয়ে থাকবে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে বাঙালির স্বাধীন জাতীয় সত্তা ধ্বংস করার যে অপচেষ্টা হয়েছিল, সেই চক্রান্ত ও চক্রান্তকারীদের সম্পর্কে জাতিকে সজাগ ও সতর্ক রাখা এখনও প্রয়োজন। কারণ, সেই চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি এবং চক্রান্তকারীরাও জাতীয় রাজনীতি থেকে নির্মূল হয়নি।
বার্নার্ডশ বলেছেন, ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ কখনও শিক্ষা নেয় না। কিন্তু ৩ নভেম্বরের ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। জাতীয় নেতাদের জীবনকথা স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং কেন তাদের জেলের ভেতরে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হল তার ইতিহাসও দেশের তরুণ প্রজন্মকে জানতে দিতে হবে। তাহলেই তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হবে না এবং পঁচাত্তরের ঘাতকদের অনুসারী ও সন্তানদের ইতহাস-বিকৃতির অপচেষ্টা সফল হবে না।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেশদ্রোহী ঘাতক চক্র চেয়েছিল, বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের নতুন ইতিহাস মুছে ফেলতে। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বরং এ দুটি দিবসই জাতির জন্য ইতিহাসের এক নতুন দীপশিখা জ্বেলেছে। যে দীপশিখা জাতিকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে।
লন্ডন ২ নভেম্বর, রোববার, ২০১৪
এই সাক্ষাৎকারের এক মাস না যেতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। তারপর তিন মাস না ফুরোতেই জেলের ভেতর চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক মৃত্যু। তারপর থেকে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এবং জেলহত্যার ৩ নভেম্বর তারিখটি ঘুরে এলেই বঙ্গবন্ধুর ওই কথা কটি আমার মনে পড়ে। এখন আর বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না যে, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডেরই পরিণতি। দুটি হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এবং এই কারবালা-কাণ্ড কোনো ব্যক্তি হত্যাও নয়। এটা ছিল একটি নতুন স্বাধীন হওয়া জাতির সত্তা ও ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর যদি ঘাতকরা ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড না ঘটাতো, তাহলে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম বাংলাদেশের জন্য যে ইতিহাস তৈরি করেছে, সেই ইতিহাসকে দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির আড়ালে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী প্রমুখের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চালিত হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে।
১৯৭৫ সালেও কেবল বঙ্গবন্ধু এবং শেখ ফজলুল হক মনিসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে পাকিস্তানের অনুচর মুষ্টিমেয় বাঙালি সামরিক অফিসার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারতো না। জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে যে গণঅভ্যুত্থান হতো তাতে সেনা অভ্যুত্থান হতো প্রতিহত এবং ঘাতক ফারুক, রশীদ, ডালিম গংসহ তাদের সামরিক পৃষ্ঠপোষক জেনারেল জিয়াউর রহমান, রাজনৈতিক সহচর খন্দকার মোশতাকসহ অনেককেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। এই
সম্ভাবনা রোধ করার জন্যই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে
চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এবং বঙ্গবন্ধু যে বলেছিলেন দীর্ঘকালের জন্য ইতিহাস থেকে তাদের
মুছে ফেলা হবে, ঘাতকরা ক্ষমতা দখল করে সেই চেষ্টাই শুরু করেছিল।
পরেশ সাহা ছিলেন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। দীর্ঘকাল কলকাতায় দৈনিক যুগান্তর (অধুনালুপ্ত) পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু-হত্যার ওপর একটি বইও লিখেছেন। তিনি ঢাকায় জেলহত্যার পর যুগান্তরে তার কলামে লিখেছিলেন, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড যদি প্রতিহত করা যেত এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতাকে কারামুক্ত করা যেত, তাহলে পাকিস্তানের গোয়েন্দাচক্র এবং মার্কিন সিআইএর মদদ সত্ত্বেও বাংলাদেশে ঘাতকচক্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারত না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিসিঞ্জার-পরিকল্পনা আরেকটি পরাজয়বরণ করত।
পরেশ সাহা ছিলেন কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বাংলাদেশ সম্পর্কে ছিল তার গভীর দরদ। কাদের সিদ্দিকীরও তিনি বন্ধু ছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং তেসরা নভেম্বর নিয়ে তিনি লিখেছেন, ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তার একটি উপমহাদেশীয় প্রতিক্রিয়াও ঘটেছে। বাংলাদেশে ৩ নভেম্বরের বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব হওয়াতেই সিআইএর সাহস ও শক্তি বাড়ে। শুরু হয় ভারতেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার চেষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতের শিখ সেনাপতিকে দিয়েই বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বর্ণমন্দির বিদ্রোহ ঘটানো হয়। পরিণতিতে ইন্দিরা একবার নির্বাচনে পরাজিত এবং পরে শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন। গোটা উপমহাদেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর তার সূচক। পরেশ সাহার এই বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি বলেই দীর্ঘকাল পর তার দুটি লেখার উদ্ধৃতি দিলাম। কেউ কেউ বলেন, ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনার সময় মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল ওসমানী এবং জিয়াউর রহমানসহ অন্য সেক্টর কমান্ডারদের ভূমিকাও ঘাতকদের ক্ষমতা দখলে বাধা সৃষ্টি করেনি। সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ কার্যত ঘাতকদের হাতে আটক ছিলেন। উপ-সেনাপ্রধান জেনালের জিয়াউর রহমান ছিলেন ঘাতকদের কোলাবরেটর। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার, বিশেষ করে ব্রিগেডিয়ার জেনালেল খালেদ মোশাররফের ভূমিকা তখন কী ছিল এই প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক বীরত্ব প্রদর্শনকারী খালেদ মোশাররফ ছিলেন রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিও। তিনি জিয়াউর রহমানদের চক্রান্তে এবং তখনকার জাসদ-নেতাদের অবিমৃষ্যকারিতায় ভেঙে পড়া সামরিক বাহিনীর কমান্ড পুনর্গঠনে তার কে ফোর্স নিয়ে আগে কেন সক্রিয় হননি এ প্রশ্নও কেউ কেউ তোলেন। অনেক পরে স্বল্পকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি নিজেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করার জন্য অযথা সময় নষ্ট করেছেন। ধূর্ত জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি অবস্থায় না রেখে দ্রুত কোনো সুরক্ষিত বন্দি নিবাসে পাঠাননি। জেলে বন্দি চার নেতাকে সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি দেয়ার সময় হয়তো তিনি পাননি। তার ওপর সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় বিদ্রোহী সেনাদের প্রস্তাবিত গোপন স্থানে আলোচনার জন্য গিয়ে তিনি সঙ্গীদেরসহ নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতা পুনর্দখল নিয়েও ঘাতকরা উৎসবে মেতে ওঠে। তাকে নাম দেয়া হয় সিপাহি-জনতার বিপ্লব।
সন্দেহ নেই ৩ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার দিন। এই দিন যদি জেলহত্যা নিবারণ করা যেত, দেশপ্রেমিক জেনালের খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর বিধ্বস্ত কমান্ড পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণ দ্রুত করতে পারতেন, জিয়া ও মোশতাকসহ ঘাতকদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে জাতীয় নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারতেন, তাহলে শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা উপমহাদেশের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। এমনও হতে পারত, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও হত্যা করা সম্ভব হতো না; বরং উপমহাদেশের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ডেমোক্রেটিক কমনওয়েলথ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা শক্তিশালী হতো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ব্যর্থ হতো। গোটা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্নের জোন অব পিস গড়ে উঠত। হতে পারে এটা আমার একটু বেশি আশাবাদ ছিল।
আজ আবার তেসরা নভেম্বর। বাংলাদেশে অনাড়ম্বরভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। আজ জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইমলাম, কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীকে প্রথাগতভাবে স্মরণ করা হবে। তাতে তেসরা নভেম্বরের আসল তাৎপর্যটি নতুন প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না। আর তা বোঝানো না গেলে তা শুধু দিবস পালনেই পর্যবসিত হয়ে থাকবে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে বাঙালির স্বাধীন জাতীয় সত্তা ধ্বংস করার যে অপচেষ্টা হয়েছিল, সেই চক্রান্ত ও চক্রান্তকারীদের সম্পর্কে জাতিকে সজাগ ও সতর্ক রাখা এখনও প্রয়োজন। কারণ, সেই চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি এবং চক্রান্তকারীরাও জাতীয় রাজনীতি থেকে নির্মূল হয়নি।
বার্নার্ডশ বলেছেন, ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ কখনও শিক্ষা নেয় না। কিন্তু ৩ নভেম্বরের ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। জাতীয় নেতাদের জীবনকথা স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং কেন তাদের জেলের ভেতরে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিতে হল তার ইতিহাসও দেশের তরুণ প্রজন্মকে জানতে দিতে হবে। তাহলেই তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হবে না এবং পঁচাত্তরের ঘাতকদের অনুসারী ও সন্তানদের ইতহাস-বিকৃতির অপচেষ্টা সফল হবে না।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেশদ্রোহী ঘাতক চক্র চেয়েছিল, বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের নতুন ইতিহাস মুছে ফেলতে। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বরং এ দুটি দিবসই জাতির জন্য ইতিহাসের এক নতুন দীপশিখা জ্বেলেছে। যে দীপশিখা জাতিকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে।
লন্ডন ২ নভেম্বর, রোববার, ২০১৪
No comments