কিশোর অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
এমন অনেক সমাজ আছে যেখানে ব্যক্তির চেয়ে
চারপাশের মানুষ দেশের আইনবিধি সম্পর্কে এমন বক্তব্য ও ব্যাখ্যা দেয় যে
তাদের সবার উচিত দেশের প্রচলিত আইনবিধি মেনে চলা।
পক্ষান্তরে এমন সমাজেরও অভাব নেই, যেখানে ব্যক্তির চারপাশের লোকজন দেশের
প্রচলিত আইনবিধির এমন ব্যাখ্যা দেয় যে তাদের সবার মনে হতে পারে আইন ভঙ্গ
করা শ্রেয়। ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামাজিক গোষ্ঠী বা দল ব্যক্তির
কাছে দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি যে ধরনের মনোভাব পোষণ করতে শেখায় ব্যক্তি
তাই শেখে। আবার কোনো বিশেষ ব্যক্তি এমন দুই ধরনের দল বা গোষ্ঠীর সংস্পর্শে
আসে যাদের এক পক্ষ আইন অমান্য করে অপরাধমূলক আচরণে ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করে
এবং অন্যপক্ষ আইন মান্য করার শিক্ষা দিয়ে অপরাধপ্রবণতা থেকে নিজেকে দূরে
রাখতে চেষ্টা করে। যখন মানুষ অপরাধী হয় তখন তা এ জন্য হয়ে থাকে যে, একদিকে
যেমন সমাজের অপরাধমূলক আচরণধর্মী মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং অন্যদিকে ভালো
মানুষের সংস্পর্শ থেকে নিজেদের দূরে রাখে। এতে একদিকে যেমন ব্যক্তি সৎ
প্রকৃতির লোকদের কাছ থেকে সুশিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে অসৎ
ব্যক্তিদের কাছ থেকে অসৎ আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়। অপরাধের কারণ বিশ্লেষণে এ
ধরনের বক্তব্য গবেষণার ফল এবং তা প্রতিদানযোগ্য।
সমাজবিজ্ঞানীরা অপরাধমূলক আচরণ বিশ্লেষণে সামাজিক মেলামেশাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে বোঝাতে চেয়েছেন যে বিশেষ বিশেষ সঙ্গ, দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসার মাধ্যমে এ কাজটি সম্পন্ন হয়। সেই বিশেষ বিশেষ উপাদান পারিবারিক সঙ্গ থেকে শুরু করে পরিবারের বাইরের বিভিন্ন সঙ্গের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে উৎসাহিত করে। মোটা দাগে এটি একটি প্রক্রিয়া, যা প্রচলিত আইনকানুন ভঙ্গকারী মানুষদের সঙ্গ ও ভঙ্গকারী ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে আইন ভঙ্গ করার কাজে এক ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়। কাজটিকে আরো উৎসাহিত এবং অধিক কিংবা আজীবন এ কাজে নিজেকে যুক্ত করার মানসিকতা তৈরি হয় যখন অপরাধ করার পর শাস্তির আওতা থেকে অপরাধী নিজেকে দূরে রাখতে পারে। অপরাধ সৃষ্টি বা প্রেক্ষাপট এবং এ কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ বিধায় সমাজে অপরাধের পরিসংখ্যান দীর্ঘায়িত হয়। শিখে শিখে ভদ্র ও সাদামাটা গোছের মানুষগুলোও অপরাধজগতে প্রবেশ করে।
অর্থ রোজগারের জন্য অপরাধ এখন নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যেও এ ধরনের অপরাধের স্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। ধারণা এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে কিশোরদের মনে করা হতো তারা রাস্তাঘাটে হৈচৈ করবে কিংবা কারো বাগানে গিয়ে ফল চুরি করে খাবে। একটু বেশি হলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখন আমরা এর চেয়েও বেশি লক্ষ করি। কেননা এদের ও বড়দের প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রয়োজন যেখানে মুখ্য এমনকি অপ্রয়োজনেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বড়দের যেখানে দৈনন্দিন প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দরকার, ছোটরা সেখানে পিছিয়ে নেই। বড়দের যখন সুন্দর ও দামি মোবাইল প্রয়োজন সেখানে ছোটরাও পিছিয়ে কেন? বরং ওদের প্রয়োজনটি বেশি এ জন্য যে আধুনিক জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন বড়দের তুলনায় তাদের একটু বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৌলিক প্রয়োজন এবং অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত আর্থিক লাভবান হওয়ার মানসে কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে অপরাধস্পৃহা দানা বাঁধে। এদের মধ্যে অনেকে লেখাপড়ায় পারদর্শী হওয়ায় অপরাধের কৌশলগুলো ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে। আর কাছের মানুষটির বিরুদ্ধে যখন অপরাধ কাজটি সম্পন্ন হয় তখন যিনি কাজটি করছেন তার 'সাহস' বিষয়টি বেশি কাজ করে। কেননা এখানে ভয় ও শঙ্কা দুটোই কাজ করে কম। প্রায়ই কিশোরটি হয় তার পূর্বপরিচিত, চেনাজানা এবং থাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সাবলীল ও খোলামেলা থাকা হয় সহজ। কাজে ঝুঁকিও থাকে কম। অন্যপক্ষে যিনি ভিকটিম তার পরিবারের কাছের লোকটিকে সন্দেহ করার ইচ্ছা না থাকাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। কৌশল হিসেবে এমন সব আচরণ করে যেন মনে হয় তার মতো ভালো লোক আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও বড়দের অপরাধের ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধতা কাজ নাও করতে পারে তবে কিশোরদের ক্ষেত্রে এটি শতভাগ সত্য। কেননা তাদের মধ্যে অনেকেই পেশাদার অপরাধী নয়। অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দুষ্টমন কিংবা কাউকে অনুকরণ করার প্রত্যয়ে পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা আগপাছ না ভেবে অপরাধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সফলও হয়; কিন্তু প্রবাদ আছে অপরাধী কিংবা ভিকটিম কোনো না কোনো আলামত রেখে যায়। ফলে গ্রেপ্তার কিংবা শাস্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা জটিল হয়ে পড়ে।
বন্ধু ভয়ংকর শিরোনামে কালের কণ্ঠে সম্প্রতি প্রকাশিত কিশোর অপরাধ চিত্র আমাদের অনেককে হতবাক করে তোলে। ভয়ংকর এ বন্ধুর কাছ থেকে ভিকটিম পরিবার বাঁচতে পারল না। এমনকি বাসা বদল করেও তাদের রেহাই হলো না। ভয়ংকর বন্ধুটির অপরাধ আমরা বয়স্কদের মধ্যেও যে বেশিমাত্রায় লক্ষ করি তা নয়। একটি ছেলের সরলতার সুযোগ নিয়ে যে ভয়ংকর কাজটি বন্ধুটি করেছেন তা বয়স্ক অপরাধকেও হার মানায়। আমাদের উদ্বেগের বিষয় তখন যখন আমরা দেখি যে ধরনের অপরাধ বয়স্কদের করার কথা সেই ধরনের অপরাধ কিশোরদের দ্বারা ঘটছে। আমাদের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনে এবং আমরা শঙ্কিত এই জন্য যে আমরা এখন কী করব? আমার ছেলে কিংবা মেয়েটিকে ঘরে বন্দি করে রাখব না কি বাইরের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেব। আকারে ছোট হলেও পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানটি একটি শক্তিশালী ও যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠান। ছোট এ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বহিস্থ ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গ ও মেলামেশার প্রতি মা-বাবার কঠোর ও মায়াময়ী পর্যবেক্ষণ এবং ছেলে ও মেয়েদের বস্তুগত ও অবস্তুগত প্রয়োজনের প্রতি সমান ও চাহিদামাফিক গুরুত্বারোপ হয়তো কিশোরদের হত্যার মতো অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করতে পারবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
সমাজবিজ্ঞানীরা অপরাধমূলক আচরণ বিশ্লেষণে সামাজিক মেলামেশাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে বোঝাতে চেয়েছেন যে বিশেষ বিশেষ সঙ্গ, দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসার মাধ্যমে এ কাজটি সম্পন্ন হয়। সেই বিশেষ বিশেষ উপাদান পারিবারিক সঙ্গ থেকে শুরু করে পরিবারের বাইরের বিভিন্ন সঙ্গের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে উৎসাহিত করে। মোটা দাগে এটি একটি প্রক্রিয়া, যা প্রচলিত আইনকানুন ভঙ্গকারী মানুষদের সঙ্গ ও ভঙ্গকারী ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে আইন ভঙ্গ করার কাজে এক ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়। কাজটিকে আরো উৎসাহিত এবং অধিক কিংবা আজীবন এ কাজে নিজেকে যুক্ত করার মানসিকতা তৈরি হয় যখন অপরাধ করার পর শাস্তির আওতা থেকে অপরাধী নিজেকে দূরে রাখতে পারে। অপরাধ সৃষ্টি বা প্রেক্ষাপট এবং এ কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ বিধায় সমাজে অপরাধের পরিসংখ্যান দীর্ঘায়িত হয়। শিখে শিখে ভদ্র ও সাদামাটা গোছের মানুষগুলোও অপরাধজগতে প্রবেশ করে।
অর্থ রোজগারের জন্য অপরাধ এখন নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যেও এ ধরনের অপরাধের স্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। ধারণা এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে কিশোরদের মনে করা হতো তারা রাস্তাঘাটে হৈচৈ করবে কিংবা কারো বাগানে গিয়ে ফল চুরি করে খাবে। একটু বেশি হলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখন আমরা এর চেয়েও বেশি লক্ষ করি। কেননা এদের ও বড়দের প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রয়োজন যেখানে মুখ্য এমনকি অপ্রয়োজনেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বড়দের যেখানে দৈনন্দিন প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দরকার, ছোটরা সেখানে পিছিয়ে নেই। বড়দের যখন সুন্দর ও দামি মোবাইল প্রয়োজন সেখানে ছোটরাও পিছিয়ে কেন? বরং ওদের প্রয়োজনটি বেশি এ জন্য যে আধুনিক জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন বড়দের তুলনায় তাদের একটু বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৌলিক প্রয়োজন এবং অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত আর্থিক লাভবান হওয়ার মানসে কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে অপরাধস্পৃহা দানা বাঁধে। এদের মধ্যে অনেকে লেখাপড়ায় পারদর্শী হওয়ায় অপরাধের কৌশলগুলো ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে। আর কাছের মানুষটির বিরুদ্ধে যখন অপরাধ কাজটি সম্পন্ন হয় তখন যিনি কাজটি করছেন তার 'সাহস' বিষয়টি বেশি কাজ করে। কেননা এখানে ভয় ও শঙ্কা দুটোই কাজ করে কম। প্রায়ই কিশোরটি হয় তার পূর্বপরিচিত, চেনাজানা এবং থাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সাবলীল ও খোলামেলা থাকা হয় সহজ। কাজে ঝুঁকিও থাকে কম। অন্যপক্ষে যিনি ভিকটিম তার পরিবারের কাছের লোকটিকে সন্দেহ করার ইচ্ছা না থাকাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। কৌশল হিসেবে এমন সব আচরণ করে যেন মনে হয় তার মতো ভালো লোক আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও বড়দের অপরাধের ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধতা কাজ নাও করতে পারে তবে কিশোরদের ক্ষেত্রে এটি শতভাগ সত্য। কেননা তাদের মধ্যে অনেকেই পেশাদার অপরাধী নয়। অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দুষ্টমন কিংবা কাউকে অনুকরণ করার প্রত্যয়ে পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা আগপাছ না ভেবে অপরাধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সফলও হয়; কিন্তু প্রবাদ আছে অপরাধী কিংবা ভিকটিম কোনো না কোনো আলামত রেখে যায়। ফলে গ্রেপ্তার কিংবা শাস্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা জটিল হয়ে পড়ে।
বন্ধু ভয়ংকর শিরোনামে কালের কণ্ঠে সম্প্রতি প্রকাশিত কিশোর অপরাধ চিত্র আমাদের অনেককে হতবাক করে তোলে। ভয়ংকর এ বন্ধুর কাছ থেকে ভিকটিম পরিবার বাঁচতে পারল না। এমনকি বাসা বদল করেও তাদের রেহাই হলো না। ভয়ংকর বন্ধুটির অপরাধ আমরা বয়স্কদের মধ্যেও যে বেশিমাত্রায় লক্ষ করি তা নয়। একটি ছেলের সরলতার সুযোগ নিয়ে যে ভয়ংকর কাজটি বন্ধুটি করেছেন তা বয়স্ক অপরাধকেও হার মানায়। আমাদের উদ্বেগের বিষয় তখন যখন আমরা দেখি যে ধরনের অপরাধ বয়স্কদের করার কথা সেই ধরনের অপরাধ কিশোরদের দ্বারা ঘটছে। আমাদের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনে এবং আমরা শঙ্কিত এই জন্য যে আমরা এখন কী করব? আমার ছেলে কিংবা মেয়েটিকে ঘরে বন্দি করে রাখব না কি বাইরের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেব। আকারে ছোট হলেও পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানটি একটি শক্তিশালী ও যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠান। ছোট এ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বহিস্থ ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গ ও মেলামেশার প্রতি মা-বাবার কঠোর ও মায়াময়ী পর্যবেক্ষণ এবং ছেলে ও মেয়েদের বস্তুগত ও অবস্তুগত প্রয়োজনের প্রতি সমান ও চাহিদামাফিক গুরুত্বারোপ হয়তো কিশোরদের হত্যার মতো অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করতে পারবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments