নিত্যজাতম্-পে কমিশন, পরিষেবা ও মৌচাক by মহসীন হাবিব

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী পে কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য আগে থেকেই পে কমিশনের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহের কথা জানা গিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, '২০১০ সালে একটি বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ২০০৯ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কয়েক বছর পরপর এ রকম বেতন কমিশন গঠনের পরিবর্তে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন সব সময় বেতন-ভাতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে। বেতন-ভাতা নির্ধারণে যেসব অসংগতি হয়, কমিশন সেগুলোর সমাধান দিতে পারবে।'
যুক্তি আছে বটে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিপাতে। ওদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যাপারে একই রকম সহানুভূতির দৃষ্টি লক্ষ করা গেছে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের একটি ডিও লেটারে। গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিজের প্যাডে অর্থমন্ত্রীকে পাঠানো সেই লেটারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, 'আপনি হয়তো অবগত থাকবেন, জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কয়েকটি আর্থিক দাবি আমার নিকট সময়ে-অসময়ে উপস্থাপিত হয়ে আসছে।' তিনি বেশ কয়েকটি দাবির কথা উল্লেখ করে তাঁর ডিও লেটারে বলেন, 'এ দাবিগুলোর অধিকাংশেরই যৌক্তিকতা আছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষিত হলে তাদের যে কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে তাতে পরিষেবার উন্নয়ন স্মারকে জনগণ সরাসরি উপকৃত হবে বলে মনে করি।'
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি তাঁর এই দরদও ভালো লাগার মতো। ভালো কথা কার না ভালো লাগে! কিছুদিন আগে এ কথাও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। সে তো আরো ভালো কথা। আমরা নিশ্চয়ই চাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এমন পর্যায়ে বেতন-ভাতা প্রদান করা হোক, যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে, সন্তানের স্কুলের খরচ মিটিয়ে তাঁরা সানন্দে অফিস করতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হোক, যাতে অবসরজীবনে সন্তান বা অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়। তবে এই 'তবে'র আগে একটি গল্প বলা জোর আবশ্যক। এক ব্যক্তি বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁর ব্যক্তিগত ড্রাইভারের বেতন বৃদ্ধি করেন না। ভদ্রলোকের বন্ধুর কানে গেল কথাটি। বন্ধু একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নাকি ড্রাইভারের বেতন বাড়াও না? ভদ্রলোক বললেন, 'কথা সত্য, বাড়াই না।' বন্ধু বললেন, 'মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, অন্য সবার বেতন বাড়ছে কিন্তু ওর বেতন তুমি কেন বাড়াও না, এটা অমানবিক না?' ভদ্রলোক সোজা কথায় উত্তরে বললেন, 'বেতন বাড়ালেও তেল চুরি করবে, না বাড়ালেও করবে। তার চেয়ে ও তেলের ওপরই থাকুক! যদি তুমি নিশ্চয়তা দিতে পার যে ও আর তেল চুরি করবেই না, তাহলে বেতন বাড়াব তিন গুণ। তাতে আমারই লাভ হবে।' বন্ধু বললেন, 'ড্রাইভার পাল্টাও!' ভদ্রলোক এবার বললেন, 'যে ড্রাইভার তেল চুরি করবে না, তার পেশা পাল্টাতে হবে। ড্রাইভার সমাজই তাকে হাবাগোবা হিসেবে সমাজচ্যুত করবে।'
দয়া করে সরকারি কর্মকর্তারা এই গল্পে মাইন্ড করবেন না। দেশে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারী যে তা কিন্তু বলছি না। তবে হাতে গোনা যে কয়জন আছেন, তাঁদের পেছন থেকে অন্য সহকর্মীরা 'অ্যাবনরমাল' বলে মনে করেন। এই হাতে গোনা কয়েকজনকে মহামানব মনে করি। খুঁজে বের করে তাঁদের সোনার মেডেল পরিয়ে দিলেও ঋণ শোধ হবে না। ধরুন, পাশাপাশি দুজন পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তা বসবাস করেন। একজনের সন্তানরা ভূতের জোগাড় করা অর্থে প্লাজমা টেলিভিশন দেখে, লাখ লাখ টাকায় ইংরেজি মাধ্যমের বিদেশি নামের স্কুলে পড়ে, অন্যজনকে অন্ন-বস্ত্র জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। তার পরও দ্বিতীয়জন যদি নষ্ট হতে না চান, তাহলে তিনি মহামানব ছাড়া আর কী? সমস্যা হলো, এই মহামানুষের সংখ্যা দিন দিন বিলুপ্তির পথে চলেছে। এমন সরকারি কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে গলদঘর্ম হতে হবে। জনপ্রশাসন কতটা বেহাল, তা দেশের অনেকে যেমন জানেন, তেমনি আবার অনেকেরই অজানা। আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ সরকারি চাকুরে দিয়ে পরিপূর্ণ। দেখতে পাই, কিভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সোনার বাংলাকে ডাকাতের গ্রামে পরিণত করেছেন! আর সে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। আমরা এমনো দেখি, একটি বিভাগের চার-পাঁচ হাজার প্রকল্পের কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডেকে এনে রমনা পার্কে বসিয়ে মাথাপিছু ১০-২০ হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। আমরা দেখতে পাই, জেলা প্রশাসনে পিয়নের চাকরির জন্য (সাম্প্রতিক ঘটনা) পাঁচ লাখ টাকা নগদ গ্রহণ করে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়! যে আপনারই খাবার এগিয়ে দেবে, চা এনে দেবে, চেয়ার মুছে তোয়ালে ঠিক করে দেবে, তার কাছ থেকে আপনি ঘুষ নিয়ে নিয়োগ দিচ্ছেন! এইচ টি ইমামসহ সরকারের কাছে বিনীত জিজ্ঞাসা, এ অধঃপতন থেকে টেনে তোলার উপায় কী?
তাই বলে কী প্রণোদনা দেওয়া হবে না, পে কমিশন হবে না? অবশ্যই হবে। কিন্তু শুধু প্রণোদনা দিলেই বা পে কমিশন করলেই কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে বা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে- এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। একদিকে সরকারের চাকরিবিধিতে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের নীতিমালার দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে, অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওএসডি করা, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, সুপারসিড করা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। সরকারি চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের নীতিমালায় বেশ কয়েকটি 'তবে' লাগানো আছে। জ্যেষ্ঠতা হলো জ্যেষ্ঠতা। কেউ পাগল হলে, সুনির্দিষ্ট কারণে চাকরির অনুপযুক্ত হলে তাকে অবসরে পাঠানো বা যেকোনো যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্য কোনো বিবেচনায় কাউকে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। অথচ প্রতিটি সরকারের আমলেই এই 'তবে'র শক্তিবলে সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে দেখা যায়। আমরা হামেশাই দেখতে পাচ্ছি, একজন জুনিয়র কর্মকর্তা সচিব হয়ে গেছেন, অথচ তাঁর দুই ব্যাচ আগের একজন যুগ্ম সচিব হয়ে আছেন। এই অসুস্থ চর্চা যতকাল থাকবে, ততকাল যথাযথ সেবা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন আশা করা যাবে না। অন্যদিকে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করে যদি সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণ ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে সরকারের কোটি কোটি টাকাই বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে ব্যয় হবে, সরকার সেবা নিশ্চিত করতে পারবে না। আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে এসব কথা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে অনুরোধ করছি। পুলিশ প্রশাসনে বিশেষ স্কেল প্রদান করে ঘুষ গ্রহণের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করুন, দেখবেন, তিন মাসের মধ্যে এই দেশ স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ঠোঁটকাটা লোকরা বলেন, তা নাকি কোনো সরকারই করবে না। কারণ 'বনে কত মাছি ওড়ে/ওরা সব মৌমাছি/ঐখানে মৌ-চাক/তাতে আছে মধু ভরা।
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.