নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু by মোহাম্মদ আবদুর রহমান খান
আর কত অপেক্ষা। অপেক্ষা করতে করতে তো
সরকারের শেষ সময় এসে গেল। কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অজুহাতে বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতুতে ঋণ স্থগিত করল। অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাও বিশ্বব্যাংকের
পথ অনুসরণ করল।
সংস্থাটির একরোখা সিদ্ধান্তের
পরিপ্রেক্ষিতে উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হলো বিশ্বব্যাংকের
সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে। তার পরও বিশ্বব্যাংকের কাছে নানাভাবে ধরনা দিয়েছে
সরকার। তবে কোনো ফল হয়নি। অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা সর্বদা
পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে এনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত
করতে। অর্থনীতিবিদদের যুক্তি, বিশ্বব্যাংকের মতো এমন সরল সুদে কোনো উন্নয়ন
সংস্থাই ঋণ দেবে না; আর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে গেলে
বিদেশি পরামর্শকদের বেতন-ভাতা, বিদেশি ঠিকাদারদের বিল প্রদান ও সেতুর জন্য
বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় পেমেন্ট করা
যাবে না। সবাইকে বিদেশি মুদ্রায় পেমেন্ট করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রিজার্ভের
ওপর চাপ পড়বে এবং রিজার্ভ হয়তো শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
এমন সব যুক্তি এত দিন আমরা সব সময় শুনে আসছি বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের মুখ থেকে। তা ছাড়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে অন্য দেশ বা সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার কথা বহু শুনেছি। আর দেশের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরাও তো হরহামেশাই নানা যুক্তি দেখিয়ে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে নসিয়ত করতেই আছেন। কিন্তু এ সব যুক্তি আর কত দিন শুনব? আমরা কি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি না, একটি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারি না। এ কথা তো ভুললে চলবে না, সারা বিশ্বই জানে, বাঙালি একটি সাহসী জাতি। প্রতিবছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই এ জাতিকে পথ চলতে হয়। তা ছাড়া বাঙালি জাতির রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে। অতএব, যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস ও শক্তি তো বাঙালি জাতির রয়েছে। সেখানে জাতীয় স্বার্থে নিজস্ব অর্থায়নে একটি বৃহৎ সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এ জাতির কোনো দ্বিধা বা পিছুটান থাকবে কেন?
বেশ কয়েক দিন আগে দুদকের তদন্তদল কানাডায় গিয়েছিল। পদ্মা সেতুতে ঘুষ দেওয়াকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল এবং এ-সংক্রান্ত এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশের ডায়েরিতে যা লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তদন্তদল সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হয়। দুদকের তদন্ত চলছে, হয়তো আরো কিছুদিন চলবে। শেষমেশ কী হবে, সেটি বিধাতাই জানেন। আবার কানাডার বিচারালয়ে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও বিচারাধীন। সেটি ফয়সালা হতে কত দিন লাগবে, কখনই বা শেষ হবে, সেটি ভবিতব্যই বলতে পারে।
পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে আর কত অপেক্ষা এবং ধৈর্য ধরে থাকতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে? দেশের মানুষ যেমন এ সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশায় ভুগছে, তেমনি সরকারের পিঠও এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকারের পক্ষে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ একটি যথাযথ পদক্ষেপ বলা যায়। সেই লক্ষ্যে এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পদ্মা সেতুর জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ৮৮২ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণ শেষে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হবে দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয়ের প্রয়োজন হবে ১৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ২০৩ কোটি ডলার; যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৮০ কোটি ডলার হলেই চলবে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা সরকার অব্যাহত রেখেছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণে আগামী ৩০ জুন দরপত্র আহ্বান করা হবে বলা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতে আহ্বান করা হবে ৯ হাজার ১৭২ কোটি টাকার দরপত্র। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা যায়। এ সেতু প্রকল্পের জাজিরা সংযোগ সড়ক ও সংযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে গত ৫ জুন এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তা ছাড়া মূল সেতু নির্মাণের অন্যান্য উপাত্তের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানা গেছে।
২০০৭ সালের আগস্টে একনেক অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা, তখন সেতুর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা হয় ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। কিন্তু ভাঙনে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সেতুর দৈর্ঘ্য এখন দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া সময়ের অপচয়, পরামর্শ সেবা, পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণেই সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে নতুনভাবে সেতুর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা; অর্থাৎ ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ২০১১ সালের শেষদিকে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে ২০১২ সালের ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। তবে দুর্নীতিতে জড়িতদের সরকারি কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ কয়েকটি শর্তে এ প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতি তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে একটি প্রতিনিধিদলও পাঠায় সংস্থাটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিশ্বব্যাংক এবং অসন্তোষ প্রকাশ করে দুদকের কার্যক্রমে; বিশেষ করে তাদের দৃষ্টিতে মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িত করা হয়নি বলে। বিশ্বব্যাংকের এ একরোখা মনোভাবের জন্য একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে সংস্থাটিকে না করে দেওয়া হয়। এর পর থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে আসছে সরকার।
এদিকে চীন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পদ্মা সেতু প্রকল্প অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। সময় সময় সরকার বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে ওই সব দেশ বা সংস্থার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখার আগ্রহ দেখায়।
পদ্মা সেতু নির্মিত হলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষই সুফল ভোগ করবে না, এ সেতুর দ্বারা বাংলাদেশের সব অঞ্চল তথা দেশের ১৬ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ছাড়াও থাকবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঞ্চালন লাইন। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহু ছোট-বড় কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর মংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল থাকায় ওসব বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার ফলে যেমন ব্যয় ও সময় কমবে, তেমনি এ সেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং আর কালক্ষেপণ নয়, নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতুর বাস্তবায়ন হোক- সেটাই এখন দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সেতু বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
এমন সব যুক্তি এত দিন আমরা সব সময় শুনে আসছি বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের মুখ থেকে। তা ছাড়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে অন্য দেশ বা সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার কথা বহু শুনেছি। আর দেশের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরাও তো হরহামেশাই নানা যুক্তি দেখিয়ে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে নসিয়ত করতেই আছেন। কিন্তু এ সব যুক্তি আর কত দিন শুনব? আমরা কি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি না, একটি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারি না। এ কথা তো ভুললে চলবে না, সারা বিশ্বই জানে, বাঙালি একটি সাহসী জাতি। প্রতিবছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই এ জাতিকে পথ চলতে হয়। তা ছাড়া বাঙালি জাতির রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে। অতএব, যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস ও শক্তি তো বাঙালি জাতির রয়েছে। সেখানে জাতীয় স্বার্থে নিজস্ব অর্থায়নে একটি বৃহৎ সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এ জাতির কোনো দ্বিধা বা পিছুটান থাকবে কেন?
বেশ কয়েক দিন আগে দুদকের তদন্তদল কানাডায় গিয়েছিল। পদ্মা সেতুতে ঘুষ দেওয়াকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল এবং এ-সংক্রান্ত এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশের ডায়েরিতে যা লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তদন্তদল সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হয়। দুদকের তদন্ত চলছে, হয়তো আরো কিছুদিন চলবে। শেষমেশ কী হবে, সেটি বিধাতাই জানেন। আবার কানাডার বিচারালয়ে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিও বিচারাধীন। সেটি ফয়সালা হতে কত দিন লাগবে, কখনই বা শেষ হবে, সেটি ভবিতব্যই বলতে পারে।
পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে আর কত অপেক্ষা এবং ধৈর্য ধরে থাকতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে? দেশের মানুষ যেমন এ সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশায় ভুগছে, তেমনি সরকারের পিঠও এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকারের পক্ষে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ একটি যথাযথ পদক্ষেপ বলা যায়। সেই লক্ষ্যে এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পদ্মা সেতুর জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ৮৮২ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণ শেষে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হবে দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয়ের প্রয়োজন হবে ১৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ২০৩ কোটি ডলার; যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৮০ কোটি ডলার হলেই চলবে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা সরকার অব্যাহত রেখেছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণে আগামী ৩০ জুন দরপত্র আহ্বান করা হবে বলা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতে আহ্বান করা হবে ৯ হাজার ১৭২ কোটি টাকার দরপত্র। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা যায়। এ সেতু প্রকল্পের জাজিরা সংযোগ সড়ক ও সংযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে গত ৫ জুন এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তা ছাড়া মূল সেতু নির্মাণের অন্যান্য উপাত্তের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানা গেছে।
২০০৭ সালের আগস্টে একনেক অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা, তখন সেতুর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা হয় ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। কিন্তু ভাঙনে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সেতুর দৈর্ঘ্য এখন দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া সময়ের অপচয়, পরামর্শ সেবা, পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণেই সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে নতুনভাবে সেতুর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা; অর্থাৎ ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ২০১১ সালের শেষদিকে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে ২০১২ সালের ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। তবে দুর্নীতিতে জড়িতদের সরকারি কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ কয়েকটি শর্তে এ প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতি তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে একটি প্রতিনিধিদলও পাঠায় সংস্থাটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিশ্বব্যাংক এবং অসন্তোষ প্রকাশ করে দুদকের কার্যক্রমে; বিশেষ করে তাদের দৃষ্টিতে মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িত করা হয়নি বলে। বিশ্বব্যাংকের এ একরোখা মনোভাবের জন্য একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে সংস্থাটিকে না করে দেওয়া হয়। এর পর থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে আসছে সরকার।
এদিকে চীন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পদ্মা সেতু প্রকল্প অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। সময় সময় সরকার বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে ওই সব দেশ বা সংস্থার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখার আগ্রহ দেখায়।
পদ্মা সেতু নির্মিত হলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষই সুফল ভোগ করবে না, এ সেতুর দ্বারা বাংলাদেশের সব অঞ্চল তথা দেশের ১৬ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ছাড়াও থাকবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঞ্চালন লাইন। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহু ছোট-বড় কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর মংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল থাকায় ওসব বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার ফলে যেমন ব্যয় ও সময় কমবে, তেমনি এ সেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং আর কালক্ষেপণ নয়, নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতুর বাস্তবায়ন হোক- সেটাই এখন দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সেতু বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
No comments