ট্রাইব্যুনাল ও তথ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিস্ফোরণ-জামায়াতের বেপরোয়া ভাঙচুর
জামায়াতে ইসলামীর তিন নেতাকে আদালত
অবমাননার দায়ে দণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গতকাল
রবিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল এই দণ্ড ঘোষণা
করে রায় দেন।
এ রায়ের পর জামায়াতে ইসলামী আজ সোমবার সারা
দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। তবে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের
প্রচার-প্রচারণা নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল
সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকাকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
হরতাল ডাকার পরপরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুর করে। রাজধানীর মিরপুরে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বাড়ির সামনেও পরপর কয়েকটি হাতবোমা ফাটানো হয়। তবে মন্ত্রী এ সময় বাসায় ছিলেন না। পরিবারের সদস্যরা বাসায় থাকলেও কেউ হতাহত হননি। এ ছাড়া রাত পৌনে ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন লক্ষ্য করে তিনটি ককটেল ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এর একটি বিস্ফোরিত হয় এবং অন্য দুটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ককটেল দুটি উদ্ধার করে।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যে নেতাদের দণ্ডিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মো. সেলিম উদ্দিন। রফিকুল ইসলাম ও হামিদুর রহমানকে তিন মাস করে কারাদণ্ড এবং তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে প্রত্যেককে আরো দুই সপ্তাহের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এ দুজন পলাতক।
ট্রাইব্যুনাল মো. সেলিম উদ্দিনকে এক দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলাকালে সেখানে তাঁর অবস্থানের মধ্য দিয়ে এ কারাদণ্ড কার্যকর হবে। একই সঙ্গে তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তাঁকে এক সপ্তাহের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে ট্রাইব্যুনাল দণ্ডাদেশে উল্লেখ করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, পুলিশের প্রতিবেদনে রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদকে পলাতক দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা জনসমক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ সংসদেও গেছেন। তাঁরা ট্রাইব্যুনালে হাজির না হয়েও আদালত অবমাননা করেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করার পর অথবা আত্মসমর্পণের পর থেকে এ সাজা কার্যকর হবে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, জামায়াতের তিন নেতা ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করায় আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ায় গত ২১ এপ্রিল এই তিন জামায়াত নেতাকে আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, তা জানাতে বলেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জবাব দিতে বলা হলেও তাঁরা তিনটি ধার্য তারিখে জবাব দেননি। পরে গত ৬ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর সেলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ১০ মার্চ তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ওই দিনই তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত জবাব দেন। অন্য দুজনকে আর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাঁরা আত্মসমর্পণও করেননি।
ট্রাইব্যুনালের কাছে সেলিম উদ্দিনের লিখিত জবাব সন্তোষজনক মনে হয়নি। এ কারণে তাঁকেও শাস্তি দেওয়া হয়। তবে তাঁকে শাস্তি কম দেওয়া হয়েছে।
জামায়াত নেতা সেলিম উদ্দিন গত ৪ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলে দলের এক সমাবেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, 'একটা রায়-ই শেষ নয়। রায়ের পর বহু প্রতিক্রিয়া আছে। বিষয়টি হালকাভাবে দেখলে চলবে না। দেশকে গৃহযুদ্ধের থেকে বাঁচাতে হলে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।' একই সমাবেশে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আর এক মুহূর্তও চলতে পারে না। একই দিনে রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সরকারের নির্দেশিত।
আজ সারা দেশে হরতাল : রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামী আজ সোমবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে এই হরতালের ডাক দেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী গণগ্রেপ্তার, গণনির্যাতন বন্ধ, জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার সরকারি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের প্রতিবাদে এবং গ্রেপ্তারকৃত জামায়াত নেতাদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহালের দাবিতে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের আদালত অবমাননার রায়ে জামায়াত নেতারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
চার সিটি আওতামুক্ত : গতকাল জামায়াতের স্থানীয় শাখার নেতাদের স্বাক্ষরিত পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী ১৫ জুন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা নির্বিঘ্ন রাখতে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনকে আজকের হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিস্ফোরণ : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে তথ্যমন্ত্রীর দারুসসালাম রোডের ইস্টার্ন হাউজিং-১-এর হাসনাহেনা নামক বাসার সামনে দুটি মোটরসাইকেল এসে থামে। এর পর মোটরসাইকেলের আরোহীরা তথ্যমন্ত্রীর বাসা লক্ষ্য করে চারটি ককটেল ছুড়ে মারে। দুটি হাতবোমা বাসার দেওয়ালে ও অন্যগুলো বাসার সামনে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। এতে বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
বোমা হামলার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক তথ্যমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি পুলিশের আইজিকে জানান। পরে সচিবালয় থেকে ছুটে যান নিজ বাসভবনে। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠি এই ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আমার কোনো শত্রু নেই। আর রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করা উচিত।'
এদিকে বোমা বিস্ফোরণের পর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আলামত সংগ্রহ করে। একই সঙ্গে এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বোমাগুলো মন্ত্রীর বাড়ি লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে বিস্ফোরণে কেউ হতাহত হয়নি। ঘটনার সময় স্ত্রী-সন্তান বাসায় থাকলেও মন্ত্রী তাঁর দপ্তরে ছিলেন। কারা কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের ধরতে পুলিশের তিনটি টিম কাজ করছে।
মন্ত্রী ইনুর স্ত্রী আফরোজা হক রীনা পুলিশকে জানান, দুপুরে তিনি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসায় ছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে বিকট শব্দে পরপর চারটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়।
দারুসসালাম থানার ওসি খলিলুর রহমান জানান, মন্ত্রীর বাসায় কে বা কারা বোমা হামলা চালিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে ঘটনায় জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতালের আগের দিন রমনা এলাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও আওয়ামী লীগ নেতা হানিফের বাসার ভেতরে হাতবোমা বিস্ফোরিত হয়। ওই সব হামলার ঘটনায় পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
রাজধানীতে মিছিল ককটেল, ভাঙচুর : হরতালের আগের দিন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ও ঝটিকা মিছিল করেছে জামায়াত-শিবির ও ছাত্রদল। খিলগাঁও, রামপুরা ও মতিঝিলে ঝটিকা মিছিল এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
পুলিশ জানায়, মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের উদ্যোগে সকাল ১১টার দিকে খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের সামনে থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে চার-পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ভাঙচুরের শিকার হয় বেশ কয়েকটি গাড়ি। রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে ছাত্রদল ও শিবির পৃথকভাবে ঝটিকা মিছিল বের করে। তিতাস রোডের মোড়ে কমপক্ষে পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় মিছিলকারীরা। বিকেল ৪টায় উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত। পরে পুলিশি ধাওয়ার মুখে মিছিলকারীরা পালিয়ে যায়।
না.গঞ্জে বাসে আগুন, ভাঙচুর : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আজকের হরতালকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় গতকাল রাতে দুটি বাসে আগুন ও দুটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেছে ছাত্রশিবির। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাত ৮টায় চাষাঢ়ায় খাজা সুপার মার্কেটের সামনে থেকে ঝটিকা মিছিল বের করে শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা একটি বাস ও একটি হিউম্যান হলারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাঙচুরের শিকার হয় দুটি প্রাইভেট কার।
খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে শিবিরকর্মীরা সটকে পড়ে। পরে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। ওসি মঞ্জুর কাদের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, পুলিশ আসার আগেই শিবিরের লোকজন কেটে পড়ায় কাউকে পাকড়াও করা যায়নি।
বগুড়ায় সংঘর্ষ, ককটেল, গুলি : বগুড়া অফিস জানায়, হরতালের সমর্থনে গতকাল বগুড়া শহরে মিছিলে বাধা দিতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। পুলিশও রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময় উভয় পক্ষে সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ আটজন আহত হন। পুলিশ শহর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ আটজনকে আটক করেছে।
সদর থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম জানান, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহরের গোহাইল রোডে জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে থেকে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে আকস্মিক মিছিল বের করে। খবর পেয়ে বাধা দিতে গেলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। আটক করা হয় সেখান থেকে শহর জামায়াত নেতা আবদুল হাকিমসহ আটজনকে।
হরতাল ডাকার পরপরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুর করে। রাজধানীর মিরপুরে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বাড়ির সামনেও পরপর কয়েকটি হাতবোমা ফাটানো হয়। তবে মন্ত্রী এ সময় বাসায় ছিলেন না। পরিবারের সদস্যরা বাসায় থাকলেও কেউ হতাহত হননি। এ ছাড়া রাত পৌনে ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন লক্ষ্য করে তিনটি ককটেল ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এর একটি বিস্ফোরিত হয় এবং অন্য দুটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ককটেল দুটি উদ্ধার করে।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যে নেতাদের দণ্ডিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মো. সেলিম উদ্দিন। রফিকুল ইসলাম ও হামিদুর রহমানকে তিন মাস করে কারাদণ্ড এবং তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে প্রত্যেককে আরো দুই সপ্তাহের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এ দুজন পলাতক।
ট্রাইব্যুনাল মো. সেলিম উদ্দিনকে এক দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলাকালে সেখানে তাঁর অবস্থানের মধ্য দিয়ে এ কারাদণ্ড কার্যকর হবে। একই সঙ্গে তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তাঁকে এক সপ্তাহের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে ট্রাইব্যুনাল দণ্ডাদেশে উল্লেখ করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, পুলিশের প্রতিবেদনে রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদকে পলাতক দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা জনসমক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ সংসদেও গেছেন। তাঁরা ট্রাইব্যুনালে হাজির না হয়েও আদালত অবমাননা করেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করার পর অথবা আত্মসমর্পণের পর থেকে এ সাজা কার্যকর হবে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, জামায়াতের তিন নেতা ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করায় আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ায় গত ২১ এপ্রিল এই তিন জামায়াত নেতাকে আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, তা জানাতে বলেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জবাব দিতে বলা হলেও তাঁরা তিনটি ধার্য তারিখে জবাব দেননি। পরে গত ৬ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর সেলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ১০ মার্চ তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ওই দিনই তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত জবাব দেন। অন্য দুজনকে আর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাঁরা আত্মসমর্পণও করেননি।
ট্রাইব্যুনালের কাছে সেলিম উদ্দিনের লিখিত জবাব সন্তোষজনক মনে হয়নি। এ কারণে তাঁকেও শাস্তি দেওয়া হয়। তবে তাঁকে শাস্তি কম দেওয়া হয়েছে।
জামায়াত নেতা সেলিম উদ্দিন গত ৪ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলে দলের এক সমাবেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, 'একটা রায়-ই শেষ নয়। রায়ের পর বহু প্রতিক্রিয়া আছে। বিষয়টি হালকাভাবে দেখলে চলবে না। দেশকে গৃহযুদ্ধের থেকে বাঁচাতে হলে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।' একই সমাবেশে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আর এক মুহূর্তও চলতে পারে না। একই দিনে রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সরকারের নির্দেশিত।
আজ সারা দেশে হরতাল : রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামী আজ সোমবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে এই হরতালের ডাক দেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী গণগ্রেপ্তার, গণনির্যাতন বন্ধ, জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার সরকারি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের প্রতিবাদে এবং গ্রেপ্তারকৃত জামায়াত নেতাদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহালের দাবিতে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের আদালত অবমাননার রায়ে জামায়াত নেতারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
চার সিটি আওতামুক্ত : গতকাল জামায়াতের স্থানীয় শাখার নেতাদের স্বাক্ষরিত পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী ১৫ জুন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা নির্বিঘ্ন রাখতে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনকে আজকের হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিস্ফোরণ : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে তথ্যমন্ত্রীর দারুসসালাম রোডের ইস্টার্ন হাউজিং-১-এর হাসনাহেনা নামক বাসার সামনে দুটি মোটরসাইকেল এসে থামে। এর পর মোটরসাইকেলের আরোহীরা তথ্যমন্ত্রীর বাসা লক্ষ্য করে চারটি ককটেল ছুড়ে মারে। দুটি হাতবোমা বাসার দেওয়ালে ও অন্যগুলো বাসার সামনে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। এতে বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
বোমা হামলার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক তথ্যমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি পুলিশের আইজিকে জানান। পরে সচিবালয় থেকে ছুটে যান নিজ বাসভবনে। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠি এই ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আমার কোনো শত্রু নেই। আর রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করা উচিত।'
এদিকে বোমা বিস্ফোরণের পর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আলামত সংগ্রহ করে। একই সঙ্গে এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বোমাগুলো মন্ত্রীর বাড়ি লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে বিস্ফোরণে কেউ হতাহত হয়নি। ঘটনার সময় স্ত্রী-সন্তান বাসায় থাকলেও মন্ত্রী তাঁর দপ্তরে ছিলেন। কারা কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের ধরতে পুলিশের তিনটি টিম কাজ করছে।
মন্ত্রী ইনুর স্ত্রী আফরোজা হক রীনা পুলিশকে জানান, দুপুরে তিনি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসায় ছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে বিকট শব্দে পরপর চারটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়।
দারুসসালাম থানার ওসি খলিলুর রহমান জানান, মন্ত্রীর বাসায় কে বা কারা বোমা হামলা চালিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে ঘটনায় জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতালের আগের দিন রমনা এলাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও আওয়ামী লীগ নেতা হানিফের বাসার ভেতরে হাতবোমা বিস্ফোরিত হয়। ওই সব হামলার ঘটনায় পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
রাজধানীতে মিছিল ককটেল, ভাঙচুর : হরতালের আগের দিন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ও ঝটিকা মিছিল করেছে জামায়াত-শিবির ও ছাত্রদল। খিলগাঁও, রামপুরা ও মতিঝিলে ঝটিকা মিছিল এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
পুলিশ জানায়, মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের উদ্যোগে সকাল ১১টার দিকে খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের সামনে থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে চার-পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ভাঙচুরের শিকার হয় বেশ কয়েকটি গাড়ি। রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে ছাত্রদল ও শিবির পৃথকভাবে ঝটিকা মিছিল বের করে। তিতাস রোডের মোড়ে কমপক্ষে পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় মিছিলকারীরা। বিকেল ৪টায় উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত। পরে পুলিশি ধাওয়ার মুখে মিছিলকারীরা পালিয়ে যায়।
না.গঞ্জে বাসে আগুন, ভাঙচুর : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আজকের হরতালকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় গতকাল রাতে দুটি বাসে আগুন ও দুটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেছে ছাত্রশিবির। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাত ৮টায় চাষাঢ়ায় খাজা সুপার মার্কেটের সামনে থেকে ঝটিকা মিছিল বের করে শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা একটি বাস ও একটি হিউম্যান হলারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাঙচুরের শিকার হয় দুটি প্রাইভেট কার।
খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে শিবিরকর্মীরা সটকে পড়ে। পরে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। ওসি মঞ্জুর কাদের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, পুলিশ আসার আগেই শিবিরের লোকজন কেটে পড়ায় কাউকে পাকড়াও করা যায়নি।
বগুড়ায় সংঘর্ষ, ককটেল, গুলি : বগুড়া অফিস জানায়, হরতালের সমর্থনে গতকাল বগুড়া শহরে মিছিলে বাধা দিতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। পুলিশও রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময় উভয় পক্ষে সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ আটজন আহত হন। পুলিশ শহর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ আটজনকে আটক করেছে।
সদর থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম জানান, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহরের গোহাইল রোডে জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে থেকে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে আকস্মিক মিছিল বের করে। খবর পেয়ে বাধা দিতে গেলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। আটক করা হয় সেখান থেকে শহর জামায়াত নেতা আবদুল হাকিমসহ আটজনকে।
No comments