বাজেট বিশ্লেষণ অর্ধেক গ্লাস পূর্ণ অর্ধেক খালি by মাহফুজ কবীর
শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রত্যাশার
চেয়ে কম বিনিয়োগ, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা, অস্থিতিশীল রপ্তানি বাজার ও
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায়ে অনিশ্চয়তার পরিস্থিতিতে এবারের বাজেট
(২০১৩-১৪) জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলো।
ব্যাকরণগত ও
সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে বাজেটে ভুল ধরা যাবে অতি সামান্যই। বাজেটের আকার
দুই লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা অতিকায় দেখালেও এর ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি
মোটামুটিভাবে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে। সংগত কারণেই এবার
‘জাদুর চেরাগ’ থেকে কিছু এনে দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশাও
তেমন নেই। তবে আপাতদৃষ্টিতে বাজেটটিকে উল্লম্ফন দেখালেও আগামী অর্থবছরের
প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য এ রকম একটি সরকারি ব্যয়ের পরিকল্পনা
দরকার। এ বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বললেও ভুল হবে। কেননা, গত কয়েক মাসে
রাজনীতিবিদদের অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার কারণে পুরো অর্থনীতি
এখন বিক্ষত ও রুগ্ণ অবয়বে। একে সারিয়ে তোলার জন্য তাই একটি বড় বাজেটের
বিকল্প আমাদের হাতে কি আর আছে? এ অর্থবছরে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের
অঙ্ক স্পর্শ করেছে, যার প্রশংসা করেছে সবাই। গত কয়েক বছরে গড়ে ৬ শতাংশ
প্রবৃদ্ধিকে আমাদের শক্তিমান বিদেশি বন্ধুরা সমীহ করেছেন। এখন বাজেটের ৭২
হাজার কোটি টাকার ওপরে সরকারি বিনিয়োগ পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়ে
সংশয়ের অবকাশ থাকলেও আগামী অর্থবছরে অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে
এবং আরও বেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের একটি
ইতিবাচক হাতিয়ার হিসেবে দেখা যেতে পারে।
গত কয়েক বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সফল হলেও আগামী অর্থবছরে এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে একটুখানি কম বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। কারণ, এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনীতির চাকা অনেকটা কম সচল ছিল বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে রাজস্ব আহরণে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধ হবে মূলত নির্বাচনী সময় এবং বাকি অর্ধেক হবে নতুন সরকারের ঘর গোছানোর সময়। সব মিলিয়ে ২১ শতাংশের মতো এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা এবং এর বাইরে এনবিআর-বহির্ভূত কর, করবহির্ভূত রাজস্ব এবং বিদেশি অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নসহ এ সরকারের শেষ আর্থিক বছরে ব্যয় বাড়ানোর জন্য অর্থমন্ত্রী অনেকখানি চাপ ও প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছেন। তাই এই অতিরিক্ত অর্থ আসতে হবে দেশের জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকেই। এর পরও সার্বিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে, যা প্রত্যাশিত জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল, কিন্তু আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ না হয়ে অর্থনীতির চলতি গতি-প্রকৃতি অনুসারে সাড়ে ৬ শতাংশ হলেই কিন্তু এ ঘাটতি হবে জিডিপির ৫ শতাংশ। তাতে কী? সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন সরকারকে বাজেটঘাটতি ‘সহনীয়’ সীমার মধ্যে রাখতে বলেছে, যদিও এ সীমার সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে, এই সামগ্রিক ঘাটতি উন্নয়ন বাজেটের তিন-চতুর্থাংশ। এখন অর্থমন্ত্রী দুই দিকে ধারালো একটি ছুরির মুখোমুখি হতে পারেন, যা হলো সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। সরকার এ ঘাটতি অর্থসংস্থান ঠিকমতো করতে না পারলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়বে। আর ব্যাংকিং খাত থেকে আগ্রাসী হয়ে সরকার এ ঘাটতি মেটাতে চাইলে কিছুটা ‘ক্রাউডিং আউট’ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়তে হতে পারে, যাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অবশ্য আমাদের দেশে এ রকম প্রভাব নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এখন খাতওয়ারি বরাদ্দ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। জনপ্রশাসন খাত এবার ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পেয়েছে (মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ), যা কিনা বিদায়ী অর্থবছরের প্রস্তাবিত ও সংশোধিত উভয় বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি। বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুদ পরিশোধ, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সামাজিক খাতের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরা হয়, যা মানবিক পুঁজি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা বাজেট গত কয়েক বছরে ক্রমহ্রাসমান ধারা দেখালেও এবারের বাজেটে এ খাতের অবস্থান ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ নিয়ে তৃতীয়। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও মোট বাজেটের অংশ ২০১২-১৩-এর সংশোধিত বাজেটের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়েছে।
কৃষি খাত বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় অনেক কমলেও প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় বেড়েছে। এর মূল কারণ, কৃষি মন্ত্রণালয় সংশোধিত বাজেটের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পেয়েছে। সংশোধিত বাজেটে কৃষি ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও আগামী বাজেটে এটা ধরা হয়েছে নয় হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের অংশ হিসেবে কৃষি খাত চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে পেয়েছে ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যেখানে আগামী অর্থবছরে এ বরাদ্দ মাত্র ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
শিল্প-অর্থনৈতিক সেবা খাত মোট বাজেটে পেয়েছে অতি সামান্যই! মাত্র ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এটাও আবার সংশোধিত বাজেটের তুলনায় সামান্য কম। অন্যদিকে, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বরাদ্দ বেড়েছে অনেক, সংশোধিত বাজেটের ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ থেকে হয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাজেটের এ রকম বৃদ্ধির মূল কারণ পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ। জ্বালানি খাতের বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও মোট বাজেটের অংশ হিসেবে কমেছে (সংশোধিত বাজেটের ৫ দশমিক ২৮ শতাংশের তুলনায় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ)। এ ছাড়া বাজেট বক্তৃতায় কুইক রেন্টালের মতো অস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে স্থায়ী পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দও দেখা যায়নি।
ব্যক্তিগত করবিহীন আয়ের সীমা দুই লাখ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কেননা, গত দুই অর্থবছরে অসহনীয় মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় যেভাবে কমিয়ে দিচ্ছিল, তা খানিকটা পোষানো যাবে। আমাদের ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামো অনেক দিন ধরেই অধোগতিশীল (রিগ্রেসিভ), যার একটি কাঠামোগত সংস্কার দরকার, যাতে করে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা সম্পদের ন্যায্য মালিকানা পেতে পারেন।
সামাজিক নিরাপত্তা খাত এবারের বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে রয়েছে। তালিকায় ৯৩টি কর্মসূচি ও প্রকল্পের উল্লেখ থাকলেও ৮২টি কর্মসূচি ও প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে গত কয়েক বছরে বরাদ্দের ধারা ক্রমহ্রাসমান। বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতের অংশ ১২ দশমিক ২ শতাংশ হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এটি ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ উভয়ই বেড়েছে, যেমন: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা, অসচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি। গৃহায়ণ সহায়তা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও পোলট্রি খামারি সহায়তা, থোক বরাদ্দ, অতিদরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি, বিবিধ প্রান্তজনের (যেমন: হরিজন, বেদে, দলিত ইত্যাদি) জীবনমান উন্নয়ন, স্কুলফিডিং, আশ্রয়ণ-২, চর উন্নয়ন-৪, ইত্যাদি কর্মসূচিতেও বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু ১১টি কর্মসূচি বা প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, যার মধ্যে রয়েছে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম, পল্লি কর্মসংস্থান ও রাস্তা মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ, সাক্ষরতা-পরবর্তী অবিরত শিক্ষা, জাতীয় স্যানিটেশন প্রকল্প ইত্যাদি। এ ছাড়া সমগ্র সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে ঢেলে সাজানো দরকার ছিল, যাতে করে এটি দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আর বাংলাদেশের জন্য একটি সামাজিক নিরাপত্তানীতি প্রণয়নেরও দিকনির্দেশনা আমরা পাইনি।
সব মিলিয়ে আমরা কি এ বাজেটকে পরিপূর্ণ বলে এর পাশে দাঁড়াতে পারি? উত্তর পাওয়া যাবে ওপরের আলোচনাতেই। বরাবরের মতো অর্ধেক গ্লাস পূর্ণ বলেই বাকি অর্ধেক খালি।
ড. মাহফুজ কবীর: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।
mahfuzkabir@yahoo.com
গত কয়েক বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সফল হলেও আগামী অর্থবছরে এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে একটুখানি কম বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। কারণ, এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনীতির চাকা অনেকটা কম সচল ছিল বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে রাজস্ব আহরণে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধ হবে মূলত নির্বাচনী সময় এবং বাকি অর্ধেক হবে নতুন সরকারের ঘর গোছানোর সময়। সব মিলিয়ে ২১ শতাংশের মতো এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা এবং এর বাইরে এনবিআর-বহির্ভূত কর, করবহির্ভূত রাজস্ব এবং বিদেশি অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নসহ এ সরকারের শেষ আর্থিক বছরে ব্যয় বাড়ানোর জন্য অর্থমন্ত্রী অনেকখানি চাপ ও প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছেন। তাই এই অতিরিক্ত অর্থ আসতে হবে দেশের জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকেই। এর পরও সার্বিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে, যা প্রত্যাশিত জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল, কিন্তু আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ না হয়ে অর্থনীতির চলতি গতি-প্রকৃতি অনুসারে সাড়ে ৬ শতাংশ হলেই কিন্তু এ ঘাটতি হবে জিডিপির ৫ শতাংশ। তাতে কী? সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন সরকারকে বাজেটঘাটতি ‘সহনীয়’ সীমার মধ্যে রাখতে বলেছে, যদিও এ সীমার সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে, এই সামগ্রিক ঘাটতি উন্নয়ন বাজেটের তিন-চতুর্থাংশ। এখন অর্থমন্ত্রী দুই দিকে ধারালো একটি ছুরির মুখোমুখি হতে পারেন, যা হলো সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। সরকার এ ঘাটতি অর্থসংস্থান ঠিকমতো করতে না পারলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়বে। আর ব্যাংকিং খাত থেকে আগ্রাসী হয়ে সরকার এ ঘাটতি মেটাতে চাইলে কিছুটা ‘ক্রাউডিং আউট’ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়তে হতে পারে, যাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অবশ্য আমাদের দেশে এ রকম প্রভাব নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এখন খাতওয়ারি বরাদ্দ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। জনপ্রশাসন খাত এবার ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পেয়েছে (মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ), যা কিনা বিদায়ী অর্থবছরের প্রস্তাবিত ও সংশোধিত উভয় বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি। বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুদ পরিশোধ, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সামাজিক খাতের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরা হয়, যা মানবিক পুঁজি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা বাজেট গত কয়েক বছরে ক্রমহ্রাসমান ধারা দেখালেও এবারের বাজেটে এ খাতের অবস্থান ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ নিয়ে তৃতীয়। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও মোট বাজেটের অংশ ২০১২-১৩-এর সংশোধিত বাজেটের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়েছে।
কৃষি খাত বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় অনেক কমলেও প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় বেড়েছে। এর মূল কারণ, কৃষি মন্ত্রণালয় সংশোধিত বাজেটের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পেয়েছে। সংশোধিত বাজেটে কৃষি ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও আগামী বাজেটে এটা ধরা হয়েছে নয় হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের অংশ হিসেবে কৃষি খাত চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে পেয়েছে ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যেখানে আগামী অর্থবছরে এ বরাদ্দ মাত্র ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
শিল্প-অর্থনৈতিক সেবা খাত মোট বাজেটে পেয়েছে অতি সামান্যই! মাত্র ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এটাও আবার সংশোধিত বাজেটের তুলনায় সামান্য কম। অন্যদিকে, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বরাদ্দ বেড়েছে অনেক, সংশোধিত বাজেটের ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ থেকে হয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাজেটের এ রকম বৃদ্ধির মূল কারণ পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ। জ্বালানি খাতের বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও মোট বাজেটের অংশ হিসেবে কমেছে (সংশোধিত বাজেটের ৫ দশমিক ২৮ শতাংশের তুলনায় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ)। এ ছাড়া বাজেট বক্তৃতায় কুইক রেন্টালের মতো অস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে স্থায়ী পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দও দেখা যায়নি।
ব্যক্তিগত করবিহীন আয়ের সীমা দুই লাখ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কেননা, গত দুই অর্থবছরে অসহনীয় মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় যেভাবে কমিয়ে দিচ্ছিল, তা খানিকটা পোষানো যাবে। আমাদের ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামো অনেক দিন ধরেই অধোগতিশীল (রিগ্রেসিভ), যার একটি কাঠামোগত সংস্কার দরকার, যাতে করে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা সম্পদের ন্যায্য মালিকানা পেতে পারেন।
সামাজিক নিরাপত্তা খাত এবারের বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে রয়েছে। তালিকায় ৯৩টি কর্মসূচি ও প্রকল্পের উল্লেখ থাকলেও ৮২টি কর্মসূচি ও প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে গত কয়েক বছরে বরাদ্দের ধারা ক্রমহ্রাসমান। বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতের অংশ ১২ দশমিক ২ শতাংশ হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এটি ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ উভয়ই বেড়েছে, যেমন: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা, অসচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি। গৃহায়ণ সহায়তা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও পোলট্রি খামারি সহায়তা, থোক বরাদ্দ, অতিদরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি, বিবিধ প্রান্তজনের (যেমন: হরিজন, বেদে, দলিত ইত্যাদি) জীবনমান উন্নয়ন, স্কুলফিডিং, আশ্রয়ণ-২, চর উন্নয়ন-৪, ইত্যাদি কর্মসূচিতেও বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু ১১টি কর্মসূচি বা প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, যার মধ্যে রয়েছে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম, পল্লি কর্মসংস্থান ও রাস্তা মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ, সাক্ষরতা-পরবর্তী অবিরত শিক্ষা, জাতীয় স্যানিটেশন প্রকল্প ইত্যাদি। এ ছাড়া সমগ্র সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে ঢেলে সাজানো দরকার ছিল, যাতে করে এটি দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আর বাংলাদেশের জন্য একটি সামাজিক নিরাপত্তানীতি প্রণয়নেরও দিকনির্দেশনা আমরা পাইনি।
সব মিলিয়ে আমরা কি এ বাজেটকে পরিপূর্ণ বলে এর পাশে দাঁড়াতে পারি? উত্তর পাওয়া যাবে ওপরের আলোচনাতেই। বরাবরের মতো অর্ধেক গ্লাস পূর্ণ বলেই বাকি অর্ধেক খালি।
ড. মাহফুজ কবীর: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।
mahfuzkabir@yahoo.com
No comments