রিপোর্টারের ডায়েরি- জাতিসংঘ জেনেভা দফতরে
২ ডিসেম্বর, বুধবার। আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সপ্তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। কালই আমরা জেনেভা থেকে চলে যাব। ইতোমধ্যে চার দিন হয়ে যাচ্ছে। ব্যয়বহুল এ শহরে ১৬০ মার্কিন ডলার হোটেল ভাড়া দিয়ে আমাদের মতো মানুষের বেশি দিন থাকার উপায় নেই।
তাছাড়া আমাকে কোপেনহেগেন যেতে হবে। ৭ ডিসেম্বর থেকে ওখানে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শুরম্ন হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন শেষ করে ওই সম্মেলন কভার করতে যাব। ইনকিলাবের সালাহউদ্দিন বাবলু, নিউএজ-এর তানিম আহমেদ এবং ডয়েচভেলের ঝুমুর বারি ও আমি যাব কোপেনহেগেন। অন্যরা যার যার মতো আশপাশের দেশ ঘুরে দেশে ফিরে যাবেন। আমরা কোপেনহেগেন যাব জুরিখ হয়ে। কারণ জেনেভা থেকে সরাসরি ট্রেন সার্ভিস নেই। জুরিখ ও কোলন (জার্মানি) হয়ে তবেই কোপেনহেগেন যেতে হবে। ফলে গত রাতেই আমরা যার যার মতো গোছগাছ করে নিয়েছি।
আমাদের রম্নমমেট দিলাল ঢাকা থেকে সুগন্ধী চাল ও মিষ্টি নিয়ে এসেছেন জেনেভায় জাতিসংঘ দফতরের এক বাঙালী কর্মকর্তার জন্য। ওই কর্মকর্তার নাম মিয়া আবুল কালাম। তাঁর ওখানেই দিলালের থাকার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যনত্ম সে আর তার ওখানে না উঠে আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। সেই চাল ও মিষ্টি আজ তাঁকে দিতে যাবে দিলাল। জেনেভায় কাজের মাঝে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়নি। অবস্থা এমন যে লেকের পার পর্যনত্ম যেতে পারিনি। যদিও আসা-যাওয়ার পথে যতটা দেখেছি। তাই এখানকার জাতিসংঘ দফতর দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি তাঁকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি তাঁকে বলুন আমাদের একটু জাতিসংঘ দফতর ঘুরিয়ে দেখাক। দিলালের এ প্রসত্মাবে ভ্রদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। মনে হলো বাংলাদেশ থেকে আসা তিন বাঙালীর সানি্নধ্য তিনি কিছুণের জন্য গ্রহণ করতে চান।
সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্রামে উঠলাম। সরাসরি গিয়ে নামলাম ইউএন স্টপেজে একেবারে জাতিসংঘ জেনেভা দফতরের সামনে। দফতরের সামনে বেশ বড় একটি খোলা উন্মুক্ত স্থান। ওই স্থানের দফতরের সামনের দিকে সেই এক পা ভাঙ্গা চেয়ারটি বসানো। ওখানে গিয়ে দিলাল কালাম সাহেবকে ফোন করল। তিনি প্রধান গেটে যেতে বললেন। গেটে গিয়ে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বললাম, আমরা আবুল কালাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারা আমাদের বুকে ঝুলানো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেখে বলেন, এই পাস দিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না। তাঁরা কালাম সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল এবং আমাদের পাশে দাঁড়াতে বলল। কিছুণের মধ্যেই কালাম সাহেব তাঁর গাড়ি নিয়ে আসলেন। গাড়ি গেটের ওপাশে রেখে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তাকর্মীদের অনুরোধ করলেন, আমাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিতে। তাঁরা তাঁকে পরামর্শ দিলেন এই গেট শুধু জাতিসংঘ স্টাফদের প্রবেশপথ। এই অফিসে ১৬শ' স্টাফ কাজ করেন। পাশে আরেকটি গেট আছে ওখান দিয়ে তাঁরা আমাদের নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কি আর করা কালাম সাহেব আমাদের অপোয় রেখে ভেতরে চলে গেলেন। কিছুণ পর অপর গেট দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসলেন আমাদের নিতে। আমরা গাড়িতে উঠে বসতেই তিনি আবার সেই গেটের দিকে ছুটলেন।
জাতিসংঘ জেনেভা দফতর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি প্রথম ছিল লিগ অব নেশনসের সদর দফতর। শানত্মি নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ল্য নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা করা হয়। শহরটির আনত্মর্জাতিক কূটনীতি ও আলোচনার প্রচলিত ধারাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য লিগ অব নেশনসের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের স্থান হিসাবে বেছে নেয়া হয় জেনেভাকে। লিগ অব নেশনসের অফিস ছিল প্যালেস উইলসনে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জাতিসংঘ। জেনেভা শহর কর্তর্র্ৃপ ১৯২৬ সালে বর্তমান হেডকোয়ার্টারের স্থান অনুদান হিসাবে লিগ অব নেশনসকে প্রদান করে। ১৯২৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নতুন জাতিসংঘ ভবনের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করা হয়।
প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী এই জেনেভা দফতর পরিদর্শন করে। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য গাইডেড পরিদর্শনের ব্যবস্থাও আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নানা পেশার দর্শনার্থীরা প্রতিদিন এটি পরিদর্শন করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা আসে এ ভবন দেখতে। গাইডেড দর্শনার্থীদের ১০ ফ্রা দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। সবমিলিয়ে দৈনিক ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ পরিদর্শন করে এ ভবন। আর প্রতিবছর এখানে ৪০ হাজার ছোটবড় মিটিং হয়। শীতের কারণে ডিসেম্বর মাসে কম মিটিং হয়। মূলত জাসিংঘের বিভিন্ন সংস্থার মিটিংগুলো শুরম্ন হয় ফেব্রম্নয়ারি মাস থেকে। চলে নবেম্বর মাস পর্যনত্ম।
আমাদের আর টিকেটের প্রয়োজন হলো না। কালাম সাহেবকে সবাই এখানে চেনেন। তিনি দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জে। সপরিবারে এখানে আছেন। তবে দেশের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ আছে। তিনি গেটের নিরাপত্তাকর্মীদের বলে সহজেই আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে আমরা গেলাম তাঁর কর্মস্থানে। ওখানে ব্যাগ-ল্যাপটপ রেখে তাঁকে নিয়ে পরিদর্শনে বের হলাম। এই ভবনের নয় তলায় আংটাডের অফিস। ওখানেই জেনেভার বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বসেন। তিনি আংটাড মহাপরিচালকের এলডিসি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন।
এ বিশাল ভবনে ২৬টি কনফারেন্স হল আছে। প্রত্যেকটি হলের শৈল্পিক কারম্নকাজ অপূর্ব। প্রথমে কালাম সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন ২০নং ক।ে ওখানে মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক চলছে। নরওয়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমরা গ্যালারিতে গেলাম ভেতরের অবস্থা দেখার জন্য। স্পেনের অর্থায়নে তিন কোটি ডলার দিয়ে এই হলটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদের ইনডোর ডেকোরেশন এতটাই কালারফুল ও চমৎকার যে তা দেখে আমরা অভিভূত হয়ে পড়লাম। তিন মাস পর পর এখানে মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক হয়। আর চার বছর পর পর এক একটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। আর একটি হলে দেখা গেল ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশনের বৈঠক হচ্ছে। কালাম সাহেব জানালেন, কিছুদিন আগে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনের বৈঠক হয়েছে। তাতে বাংলাদেশ অংশ নেয়।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকলাম কাফেটারিয়ায়। জেনেভা লেকের পারে অত্যনত্ম মনোরম পরিবেশে এই জাতিসংঘ দফতরের অবস্থান। লেকের ওপারে সারি সারি পাহাড়। কাফেটারিয়াটির লেকের দিকের অংশ গস্নাস দেয়া। যাতে কাফেটারিয়ায় বসে লেক ও পাহাড়ের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
দূরে কুচকুচে কাল পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি পাহাড়ের চূড়াই সাদা বরফে ঢাকা। এখান থেকে পাহাড়গুলোর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। পর্বতমালার মধ্যে একটি পাহাড়ের চূড়া বেশ উঁচু। সেটিকে মবলা পাহাড় বলা হয়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু পাড়াহ। সব সময়ই এই পাহাড়ে বরফ থাকে। আমরা কাফেটারিয়ায় দাঁড়িয়ে লেক ও পাহাড়গুলোকে পেছনে রেখে ছবি তুললাম। এরপর গেলাম পাশেই ইউনাইটেড নেশন কমপেনসেশন কমিশন দেখতে। এটি মূল ভবনের বাইরে জাতিংঘ কমপেস্নক্সের মধ্যেই অবস্থিত। কাফেটারিয়া থেকে দেখা যায়। ইরাক যুদ্ধের পর এই কমিশন গঠন করা হয়। যুদ্ধের কারণে তিগ্রসত্মদের তিপূরণ দিতে এই কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। কমিশন সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে তিপূরণ আদায় করে তিগ্রসত্মদের প্রদান করে। ইরাক-কুয়েত ফেরত অনেক বাংলাদেশী এই তিপূরণের অর্থ পেয়েছে। বর্তমানে ছোট আকারে এই অফিসের উপস্থিতি রয়েছে।
কড়িডরের দেয়ালে কিংবা স্থানে স্থানে উপহার হিসাবে দেয়া বিভিন্ন দেশের ঐহিহ্যভিত্তিক চিত্রকর্ম ও প্রতিকৃতি বসানো রয়েছে। লিগ অব নেশনের প্রথম বৈঠকের ছবিটিও বেশ গুরম্নত্বসহকারে দেয়ালে সংরণ করা আছে। বিভিন্ন দেশ তাদের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে চিত্রকর্ম তৈরি করে জাতিসংঘকে উপহার দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন চিত্রকর্ম কোথাও দেখা গেল না। কালাম সাহেব জানালেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। ১৯৮৬ সালে এখানে তাঁর একটি বৈঠকে আসার কথা ছিল। ওই বৈঠকের আগেই তিনি মারা যান।
এরপর আমরা গেলাম জাতিসংঘ লাইব্রেরি ভবনে। এখানে দুনিয়ার যত বই ও তথ্য আছে সব সংরণ করা আছে। সময়ের কারণে আমরা আর ভেতরে না গিয়ে এগিয়ে গেলাম। অপর একটি হলে ইউএনএইচসিআর-এর মিটিং চলছে। বিশ্বের উদ্বাস্তুদের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন উপস্থিতি নেই এই মিটিংয়ে।
বিশাল এ্যাসেম্বলি হলে গিয়ে চোখে ধাঁধা লেগে গেল। এটি এই দফতরের প্রধান হল। এখানে সব বড় বড় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কোন মিটিং না থাকায় তখন এটি ফাঁকা ছিল। আমরা ভেতরে গিয়ে মূল ডায়াসে উঠে নানাভাবে ছবি তুললাম। এ হলের পাশেই নিরস্ত্রীকরণ হল। জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ সংক্রানত্ম মিটিংগুলো ওই হলে অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ জানুয়ারি থেকে এখানে মিটিং শুরম্ন হয়। এক একটি মিটিং চলে তিন মাস ধরে। এই হলটি বিশেষভাবে তৈরি। কারণ যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শানত্মি প্রতিষ্ঠা করাই জাতিসংগের মূল উদ্দেশ্য। এই হলের বাইরে বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। এখানে ইরানের প্রেসিডেন্ট শাহের দেয়া একটি ইরানী কার্পেট আছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ওই কার্পেট উপহার দিয়েছিলেন।
সর্বশেষ কাউন্সিল চেম্বার পরিদর্শনের মধ্যদিয়ে আমাদের জেনেভা দফতর পরিদর্শন শেষ হলো। এই চেম্বারে জাতিসংঘের একজন আন্ডার সেক্রেটারি বসেন। যিনি এই দফতরের কার্যক্রম তদারকি করেন। এছাড়া বড় বড় কর্মকর্তারাও আছে এখানে। জাতিসংঘ মহাসচিবের একটি দফতর এখানেও আছে। তিনি কিছুদিন পর পর নিউইয়র্ক থেকে এখানে এসে অবস্থান করেন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
জাতিসংঘ জেনেভা দফতর পরিদর্শন করতে দুপুর হয়ে যায়। ততণে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শুরম্ন হয়ে গেছে। কালাম সাহেব আমাদের নিয়ে তাঁর বাসায় মধ্যাহ্নভোজে যেতে চাইলে। সময় কম। মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে নিউজ পাঠাতে হবে। তাই তার বাসায় খেতে রাজি হলাম না। অগত্যা তিনি তাঁর বাসাটা আমাদের দেখিয়ে আনত্মর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে নামিয়ে দিলেন। এর ফাঁকে তিনি জেনেভায় অবস্থিত অন্যান্য জাতিসংঘ অঙ্গ সংস্থাগুলোর কার্যালয়গুলোও দেখালেন।
_কাওসার রহমান
ঘুম এক দূর আকাশের পাখি...
২২ জানুয়ারি, শুক্রবার। বিশ্ব এজতেমার কভার করতে যেতে হবে টঙ্গী। সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে বের হয়ে মগবাজার এলাম। এখান থেকে টিকেটের বাসে টঙ্গী যাব। মগবাজার বাস কাউন্টারগুলোতে এজতেমাগামী মুসলিস্নদের ভিড়। একটা টিকেট গাজীপুর পরিবহনে অনেক ঠেলাঠেলি দিয়ে কাটলাম। বাস কাউন্টারে দাঁড়াতেই এজতেমাগামী মুসলিস্নরা হুড়মুড়িয়ে উঠতে শুরম্ন করলেন। আমি ভিড় ঠেলতে চাইলাম না। পরে উঠলাম। বাসে উঠে দেখি তিনজন বসার সিটে দু'জন এজতেমাগামী হুজুর বসে আছেন কাঁথা কাপড়ের গাঁট্টি নিয়ে। একজনকে অনুরোধ করলাম কাপড়ের গাঁট্টিটা সরালে আমি বসতে পারি। তিনি আমার অনুরোধে রাজি হয়ে বসতে দিলেন। কষ্ট করেই বসলাম। তাদের দু'জনের গাঁট্টি এত বড় যে সিটে বসতে কষ্টই হচ্ছিল। আমি তাদের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে আলাপ জমিয়ে নিলাম। তারা দু'জন মামা ভাগ্নে। মামা একটি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর ভাগ্নে জসিম সদ্য বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। মুসলিম দেশ জর্দানে নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে তিন বছর চাকরি করেছেন। তাঁর এই মামাই জর্দানে পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁরা দুই ভাই। জর্দানে গিয়ে বাড়িতে তেমন কিছু করতে পারেননি। তবে তাঁর ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠাতে পেরেছেন। মামা তাঁকে বলেছেন, এবার তাঁকে ইরাকে পাঠাবেন। ইরাকে ভাল বেতন পাওয়া যাবে। জর্দানে বেতন ছিল খুবই কম। দিনরাত পরিশ্রম করে অল্পকিছু টাকা যোগাড় করতে পেরেছিলেন তিনি। তাই দিয়েই ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠায়িছেন। জসিমের সঙ্গে আমি যখন কথা বলতে ছিলাম তখন তাঁর মামা ঘুমাচ্ছিলেন। জসিম বলেন, আমি কোনদিন এজতেমায় আসিনি। জর্দানে যখন কাজ করতাম আখেরী মোনাজাতের দিন দুই ঘণ্টার জন্য আমাদের ছুটি দিত। আমরা টেলিভিশনে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতাম। জর্দানীরা বলত, এজতেমা নাকি দ্বিতীয় হজ। জর্দান থেকে বহু মানুষ এজতেমায় যোগ দিতে আসেন। জর্দানীরা এজতেমা খুব গুরম্নত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। প্রথম বছর এমন দৃশ্য দেখে মনে মনে সিদ্ধানত্ম নিয়েছিলাম দেশে ফিরে গিয়ে এজতেমায় অংশ নেব। তাই এবার এজতেমায় যাচ্ছি। পথে কোন কষ্ট হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জসিম বলেন, কষ্ট না করলে তো আলস্নাহকে পাওয়া যাবে না। তাই কষ্ট তো কিছু স্বীকার করতেই হবে। জসিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে উত্তরা র্যাব-১-এর কার্যালয়ের সামনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। তবে পথে বাসে কিছু ঝগড়া দেখেছি। মহিলারা সমান অধিকারের কথা বলে অথচ এক মহিলা পুরম্নষকে সিট থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসার জন্য তুমুল ঝগড়া করছে। ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এই মহিলার মুখে কোন কিছু আটকাচ্ছে না। যার সঙ্গে ঝগড়া তিনি ডিফেন্সে চাকরি করেন। তিনি কিছুতেই সিট ছাড়বেন না। যৌক্তিকভাবেই তিনি বলছিলেন, সমান অধিকারের কথা বলে অসহায়ত্ব দেখিয়ে সিটে বসতে চাচ্ছেন কেন। বাসের যাত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন এজতেমাগামী যাত্রী, তারা ওই ব্যক্তির যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে উল্টো তাকেই ভর্ৎসনা করছিলেন। পরে তিনি সিট ছেড়ে ওই মহিলাকে বসতে দিলেন। এই ঝগড়া থামতে থামতে আরও একটি স্টপেজ থেকে কয়েকজন মহিলা যাত্রী বাসে উঠলেন। এবার কয়েকটি সিট ছেড়ে দেয়ার ব্যাপার। যাঁরা সিটে বসে আছেন তাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ। নবীনরা অনেকে সিট ছেড়ে প্রবীণদের বসতে দিয়েছেন। এবার আর কিছু করার রইল না। এজতেমাগামী মুসলিস্নরাও আর কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। যথারীতি গাদাগাদির মধ্যদিয়েই তাদের গনত্মব্যে যেতে হবে। কিছুৰণ পরে বাসের কন্ট্রাকটর বলছে বাস আর যাবে না। এখান থেকে টঙ্গী পর্যনত্ম হেঁটে যেতে হবে। র্যাব কার্যালয়ের সামনে নেমে পড়লাম। হাঁটা শুরম্ন করলাম এজতেমা ময়দানের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় টঙ্গী জোড়া ব্রিজের ওপরে উঠতেই জুমার নামাজ শুরম্ন হয়ে গেল। যে যেখানে জায়গা পেল সেখানেই জায়নামাজ, পেপার, হোগলার চাটাই অথবা পথে-মাটিতে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি আর আগাতে পারছিলাম না। অনেক ঘুরে ফিরে ব্রিজের উত্তর প্রানত্মে গিয়ে রাসত্মার ধারে কলাগাছের ছায়ায় দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে জনকণ্ঠের গাজীপুরের সাংবাদিক মোসত্মাফিজুর রহমান টিটুকে ফোন করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এজতেমার ১নং গেটে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার দূরে। পথে মানুষের যে ভয়ঙ্কর স্রোত দেখেছি সেই স্রোত মারিয়ে কিভাবে সেখানে যাই এমন চিনত্মা করছিলাম। যেতে যেহেতু হবে তাই কখনও মানুষের স্রোতের অনুকূলে আবার কখনও স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে থাকলাম। বিকেল ৩টার দিকে ১নং গেটের কাছে পেঁৗছে গেলাম। এখানে এসে টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ইরোর দেখাচ্ছে। লাখ লাখ লোক মোবাইল ব্যবহার করার কারণে নেটওয়ার্কের এমন সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক পরে সাংবাদিক টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হলো। টিটুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমরা চলে গেলাম গাজীপুরে। সেখানে এনটিভির সাংবাদিক নাসির ভাইয়ের অফিসে এজতেমার নিউজ লিখলাম। নিউজ লিখতে সময় অফিস থেকে কাওসার ভাই দুই দফা ফোন দিয়েছে দ্রম্নত নিউজ পাঠাতে। রাত সাড়ে ৮টায় নিউজ পাঠিয়ে গাজীপুর থেকে রাত ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
_ফিরোজ মান্না
লন্ডনে থার্টিফার্স্ট নাইট
থার্টিফার্স্ট নাইট! দেখলাম লন্ডনের তারম্নণ্য। বর্ণিল আলোয় ঝলসে ওটা আর পপ সঙ্গীতের প্রাণ কাঁপানো বিটের তালে তালে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল গোটা লন্ডন। এই অনুভূতি ভোলার নয়। দেখতে দেখতে দুটো বছর পেরম্নল। প্রিয় ঢাকা, প্রিয় জনকণ্ঠ অফিস, বন্ধুবান্ধব সবকিছু মিস করি প্রচ-ভাবে। প্রথম বছরটিতে লন্ডনে আমার থার্টিফার্স্ট রাতে বের হওয়া হয়নি। এবার ফ্রান্সের বন্ধু ইগোরের চাপেই মূলত বের হওয়া। আমারও কিছু ইচ্ছা ছিল লন্ডনের এই রাতটি দেখার।
সন্ধ্যা সাতটায় আবারও ইগোরের ফোন। পিকাডিলি সার্কাস স্টেশনে পেঁৗছে দেখি ওর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এমি, হাঙ্গেরির রবার্ট, এডিত, পোলান্ডের জুডিথসহ আমাদের আরও কয়েক বন্ধু। ওরা আমাকে দেখেই চিৎকার করে উঠল। সবার হাতে শ্যামপেনের বোতল। আমি এ্যালকোহল পান করি না। তাই ইগোর একটি আপেল জুসের বোতল এগিয়ে দিল আমাকে। ওখানেই শুরম্ন হলো হৈ চৈ।
আগের দিন রাত থেকে বিবিসিসহ রেডিও স্টেশনগুলো থেকে বার বার বুলেটেন প্রচার করা হচ্ছে এবার থার্টিফার্স্ট পালনে লন্ডন মেয়রের আয়োজন নিয়ে। মেয়রের উদ্যোগে গত দশ বছর ধরে উদ্যাপিত হচ্ছে ফায়ার ওয়ার্কস। লেজার শো কিংবা আতশবাজির ভেল্কিখেলা সে সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূর্ছনা লন্ডনীদের ঘুম কেড়ে নেয় এই রাতে। লন্ডনের অন্যতম নয়নাভিরাম লন্ডন আইকে প্রতিবছর ব্যবহার করা হয় এই ফায়ার ওয়ার্কসের জন্য। এটি ওয়েস্টমিনিস্টার স্টেশন সংলগ্ন থেমস নদীর পারে। এর পাশে রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন এবং দেড় শ' বছরের পুরনো লন্ডনের আরেক আশ্চর্য বিগবেন। বিগবেনে রাত ঘডির কাঁটা বারোটার উপর উঠলেই শুরম্ন হয় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আলোর খেলা।
ফায়ার ওয়ার্কস সফল করার জন্য লন্ডন আই'র আশপাশের সকল রাসত্মায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। স্থগিত করা হয় কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন সার্ভিস। ফায়ার ওয়ার্কস দেখার জন্য এবার লন্ডন আই এলাকায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষের সমাগম হয় বলে বিবিসি প্রচার করেছে।
বাস বন্ধ থাকায় পিকাডিলি সার্কাস থেকে ট্রেনে গাদাগাদি করে আমরা গেলাম ওয়েস্টমিনিস্টার। তখন রাত সাড়ে দশটা। লন্ডনের স্বচ্ছ নীলাকাশে গোলাকার চাঁদ। শীতের তীব্রতা মাইনাস টু। ভাগ্য ভাল আজ বৃষ্টি হচ্ছে না। আগেরদিন রাতে বেশ তুষার পড়েছে। ওয়েস্টমিনিস্টার পেঁৗছে মনে হলো এই জনসমুদ্র থেকে বের হয়ে যাওয়া কোনদিন সম্ভব নয়। থেমসের পারের কানায় কানায় মানুষ আর মানুষ। সরাসরি নদীর পারে আর জায়গা না থাকায় পুলিশ এবং সিকিউরিটি কমর্ীরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। সে সঙ্গে তারা মাইকে জানিয়ে দিচ্ছে আর কোথায় কোথায় অবস্থান নিলে ফায়ার ওয়ার্কস দেখা যাবে। আমাদের কিউ হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ঠিক উল্টো পাশে। বলা হলো এই কিউ অনুসরণ করলে ফায়ার ওয়ার্কস ভালমতো দেখা যাবে। আমরা পিঁপড়ার মতো টিম টিম করে এগিয়ে চলেছি সেদিকে। মদ আর বিয়ারের গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে আশপাশের বাতাস। শ্যাম্পেনের বোতল ছুড়ে কেউ কেউ সৃষ্টি করছে কৃত্রিম বৃষ্টির ধারা। বিগবেন চত্বর থেকে ১০ ডাউনিং স্ট্রিট মাত্র দু মিনিটের হাঁটা পথ। অথচ এই পথটি অতিক্রম করতে আমাদের সময় লাগল প্রায় আধা ঘণ্টা। সঙ্গের বন্ধুরা ততণে মাতাল।
শুরম্ন হলো অপোর পালা। কখন বারোটা বাজে। জীবন থেকে আরও একটি বছর বিদায় নিতে তখনও এক ঘণ্টা বাকি। মাথার ওপর ব্রিটিশ সিকিউরিটি ফোর্সের হেলিকপ্টার বার বার টহল দিচ্ছে। শীতের প্রকোপ বাড়ছে। ঘটির কাঁটা যখন ঠিক বারোটা ধম ধম করে বেজে উঠল বিগবেন। জানান দিল নতুন আরও একটি বছরের। নানা বর্ণের ফায়ারওয়ার্কসে আলোকিত হয়ে উঠল ওয়েস্টমিনিস্টারের গোটা এলাকা। নাচগান আর টগবগে তারম্নণ্য উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হলো ২০১০ সাল। সবার মুখে ধ্বনিত হচ্ছে হ্যাপি নিউ ইয়ার। জনসমুদ্রের কারণে রাত বারোটার পর ওয়েস্টমিনিস্টার, ওয়াটার লু, চ্যারিং ক্রসসহ আশপাশের গুরম্নত্বপূর্ণ আন্ডার গ্রাউন্ড টিউব সার্ভিসগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই এলাকার একমাত্র এম্ব্যাংকমেন্ট স্টেশনটি খোলা ছিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে যখন স্টেশনে ঢুকে ট্রেনে উঠলাম তখন রাত সাড়ে তিনটা। বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বাজল। ততণে বাংলাদেশে ১ জানুয়ারির দুপুর বেলা। তারপর দীর্ঘ ঘুম। উঠে দেখি আড়াইটা বেজে গেছে।
-শফিকুল ইসলাম জীবন
আমাদের রম্নমমেট দিলাল ঢাকা থেকে সুগন্ধী চাল ও মিষ্টি নিয়ে এসেছেন জেনেভায় জাতিসংঘ দফতরের এক বাঙালী কর্মকর্তার জন্য। ওই কর্মকর্তার নাম মিয়া আবুল কালাম। তাঁর ওখানেই দিলালের থাকার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যনত্ম সে আর তার ওখানে না উঠে আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। সেই চাল ও মিষ্টি আজ তাঁকে দিতে যাবে দিলাল। জেনেভায় কাজের মাঝে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়নি। অবস্থা এমন যে লেকের পার পর্যনত্ম যেতে পারিনি। যদিও আসা-যাওয়ার পথে যতটা দেখেছি। তাই এখানকার জাতিসংঘ দফতর দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি তাঁকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি তাঁকে বলুন আমাদের একটু জাতিসংঘ দফতর ঘুরিয়ে দেখাক। দিলালের এ প্রসত্মাবে ভ্রদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। মনে হলো বাংলাদেশ থেকে আসা তিন বাঙালীর সানি্নধ্য তিনি কিছুণের জন্য গ্রহণ করতে চান।
সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্রামে উঠলাম। সরাসরি গিয়ে নামলাম ইউএন স্টপেজে একেবারে জাতিসংঘ জেনেভা দফতরের সামনে। দফতরের সামনে বেশ বড় একটি খোলা উন্মুক্ত স্থান। ওই স্থানের দফতরের সামনের দিকে সেই এক পা ভাঙ্গা চেয়ারটি বসানো। ওখানে গিয়ে দিলাল কালাম সাহেবকে ফোন করল। তিনি প্রধান গেটে যেতে বললেন। গেটে গিয়ে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বললাম, আমরা আবুল কালাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারা আমাদের বুকে ঝুলানো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেখে বলেন, এই পাস দিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না। তাঁরা কালাম সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল এবং আমাদের পাশে দাঁড়াতে বলল। কিছুণের মধ্যেই কালাম সাহেব তাঁর গাড়ি নিয়ে আসলেন। গাড়ি গেটের ওপাশে রেখে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তাকর্মীদের অনুরোধ করলেন, আমাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিতে। তাঁরা তাঁকে পরামর্শ দিলেন এই গেট শুধু জাতিসংঘ স্টাফদের প্রবেশপথ। এই অফিসে ১৬শ' স্টাফ কাজ করেন। পাশে আরেকটি গেট আছে ওখান দিয়ে তাঁরা আমাদের নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কি আর করা কালাম সাহেব আমাদের অপোয় রেখে ভেতরে চলে গেলেন। কিছুণ পর অপর গেট দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসলেন আমাদের নিতে। আমরা গাড়িতে উঠে বসতেই তিনি আবার সেই গেটের দিকে ছুটলেন।
জাতিসংঘ জেনেভা দফতর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি প্রথম ছিল লিগ অব নেশনসের সদর দফতর। শানত্মি নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ল্য নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা করা হয়। শহরটির আনত্মর্জাতিক কূটনীতি ও আলোচনার প্রচলিত ধারাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য লিগ অব নেশনসের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের স্থান হিসাবে বেছে নেয়া হয় জেনেভাকে। লিগ অব নেশনসের অফিস ছিল প্যালেস উইলসনে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জাতিসংঘ। জেনেভা শহর কর্তর্র্ৃপ ১৯২৬ সালে বর্তমান হেডকোয়ার্টারের স্থান অনুদান হিসাবে লিগ অব নেশনসকে প্রদান করে। ১৯২৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নতুন জাতিসংঘ ভবনের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করা হয়।
প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী এই জেনেভা দফতর পরিদর্শন করে। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য গাইডেড পরিদর্শনের ব্যবস্থাও আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নানা পেশার দর্শনার্থীরা প্রতিদিন এটি পরিদর্শন করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা আসে এ ভবন দেখতে। গাইডেড দর্শনার্থীদের ১০ ফ্রা দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। সবমিলিয়ে দৈনিক ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ পরিদর্শন করে এ ভবন। আর প্রতিবছর এখানে ৪০ হাজার ছোটবড় মিটিং হয়। শীতের কারণে ডিসেম্বর মাসে কম মিটিং হয়। মূলত জাসিংঘের বিভিন্ন সংস্থার মিটিংগুলো শুরম্ন হয় ফেব্রম্নয়ারি মাস থেকে। চলে নবেম্বর মাস পর্যনত্ম।
আমাদের আর টিকেটের প্রয়োজন হলো না। কালাম সাহেবকে সবাই এখানে চেনেন। তিনি দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জে। সপরিবারে এখানে আছেন। তবে দেশের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ আছে। তিনি গেটের নিরাপত্তাকর্মীদের বলে সহজেই আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে আমরা গেলাম তাঁর কর্মস্থানে। ওখানে ব্যাগ-ল্যাপটপ রেখে তাঁকে নিয়ে পরিদর্শনে বের হলাম। এই ভবনের নয় তলায় আংটাডের অফিস। ওখানেই জেনেভার বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বসেন। তিনি আংটাড মহাপরিচালকের এলডিসি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন।
এ বিশাল ভবনে ২৬টি কনফারেন্স হল আছে। প্রত্যেকটি হলের শৈল্পিক কারম্নকাজ অপূর্ব। প্রথমে কালাম সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন ২০নং ক।ে ওখানে মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক চলছে। নরওয়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমরা গ্যালারিতে গেলাম ভেতরের অবস্থা দেখার জন্য। স্পেনের অর্থায়নে তিন কোটি ডলার দিয়ে এই হলটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদের ইনডোর ডেকোরেশন এতটাই কালারফুল ও চমৎকার যে তা দেখে আমরা অভিভূত হয়ে পড়লাম। তিন মাস পর পর এখানে মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক হয়। আর চার বছর পর পর এক একটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। আর একটি হলে দেখা গেল ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশনের বৈঠক হচ্ছে। কালাম সাহেব জানালেন, কিছুদিন আগে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনের বৈঠক হয়েছে। তাতে বাংলাদেশ অংশ নেয়।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকলাম কাফেটারিয়ায়। জেনেভা লেকের পারে অত্যনত্ম মনোরম পরিবেশে এই জাতিসংঘ দফতরের অবস্থান। লেকের ওপারে সারি সারি পাহাড়। কাফেটারিয়াটির লেকের দিকের অংশ গস্নাস দেয়া। যাতে কাফেটারিয়ায় বসে লেক ও পাহাড়ের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
দূরে কুচকুচে কাল পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি পাহাড়ের চূড়াই সাদা বরফে ঢাকা। এখান থেকে পাহাড়গুলোর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। পর্বতমালার মধ্যে একটি পাহাড়ের চূড়া বেশ উঁচু। সেটিকে মবলা পাহাড় বলা হয়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু পাড়াহ। সব সময়ই এই পাহাড়ে বরফ থাকে। আমরা কাফেটারিয়ায় দাঁড়িয়ে লেক ও পাহাড়গুলোকে পেছনে রেখে ছবি তুললাম। এরপর গেলাম পাশেই ইউনাইটেড নেশন কমপেনসেশন কমিশন দেখতে। এটি মূল ভবনের বাইরে জাতিংঘ কমপেস্নক্সের মধ্যেই অবস্থিত। কাফেটারিয়া থেকে দেখা যায়। ইরাক যুদ্ধের পর এই কমিশন গঠন করা হয়। যুদ্ধের কারণে তিগ্রসত্মদের তিপূরণ দিতে এই কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। কমিশন সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে তিপূরণ আদায় করে তিগ্রসত্মদের প্রদান করে। ইরাক-কুয়েত ফেরত অনেক বাংলাদেশী এই তিপূরণের অর্থ পেয়েছে। বর্তমানে ছোট আকারে এই অফিসের উপস্থিতি রয়েছে।
কড়িডরের দেয়ালে কিংবা স্থানে স্থানে উপহার হিসাবে দেয়া বিভিন্ন দেশের ঐহিহ্যভিত্তিক চিত্রকর্ম ও প্রতিকৃতি বসানো রয়েছে। লিগ অব নেশনের প্রথম বৈঠকের ছবিটিও বেশ গুরম্নত্বসহকারে দেয়ালে সংরণ করা আছে। বিভিন্ন দেশ তাদের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে চিত্রকর্ম তৈরি করে জাতিসংঘকে উপহার দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন চিত্রকর্ম কোথাও দেখা গেল না। কালাম সাহেব জানালেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। ১৯৮৬ সালে এখানে তাঁর একটি বৈঠকে আসার কথা ছিল। ওই বৈঠকের আগেই তিনি মারা যান।
এরপর আমরা গেলাম জাতিসংঘ লাইব্রেরি ভবনে। এখানে দুনিয়ার যত বই ও তথ্য আছে সব সংরণ করা আছে। সময়ের কারণে আমরা আর ভেতরে না গিয়ে এগিয়ে গেলাম। অপর একটি হলে ইউএনএইচসিআর-এর মিটিং চলছে। বিশ্বের উদ্বাস্তুদের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন উপস্থিতি নেই এই মিটিংয়ে।
বিশাল এ্যাসেম্বলি হলে গিয়ে চোখে ধাঁধা লেগে গেল। এটি এই দফতরের প্রধান হল। এখানে সব বড় বড় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কোন মিটিং না থাকায় তখন এটি ফাঁকা ছিল। আমরা ভেতরে গিয়ে মূল ডায়াসে উঠে নানাভাবে ছবি তুললাম। এ হলের পাশেই নিরস্ত্রীকরণ হল। জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ সংক্রানত্ম মিটিংগুলো ওই হলে অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ জানুয়ারি থেকে এখানে মিটিং শুরম্ন হয়। এক একটি মিটিং চলে তিন মাস ধরে। এই হলটি বিশেষভাবে তৈরি। কারণ যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শানত্মি প্রতিষ্ঠা করাই জাতিসংগের মূল উদ্দেশ্য। এই হলের বাইরে বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। এখানে ইরানের প্রেসিডেন্ট শাহের দেয়া একটি ইরানী কার্পেট আছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ওই কার্পেট উপহার দিয়েছিলেন।
সর্বশেষ কাউন্সিল চেম্বার পরিদর্শনের মধ্যদিয়ে আমাদের জেনেভা দফতর পরিদর্শন শেষ হলো। এই চেম্বারে জাতিসংঘের একজন আন্ডার সেক্রেটারি বসেন। যিনি এই দফতরের কার্যক্রম তদারকি করেন। এছাড়া বড় বড় কর্মকর্তারাও আছে এখানে। জাতিসংঘ মহাসচিবের একটি দফতর এখানেও আছে। তিনি কিছুদিন পর পর নিউইয়র্ক থেকে এখানে এসে অবস্থান করেন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
জাতিসংঘ জেনেভা দফতর পরিদর্শন করতে দুপুর হয়ে যায়। ততণে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শুরম্ন হয়ে গেছে। কালাম সাহেব আমাদের নিয়ে তাঁর বাসায় মধ্যাহ্নভোজে যেতে চাইলে। সময় কম। মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে নিউজ পাঠাতে হবে। তাই তার বাসায় খেতে রাজি হলাম না। অগত্যা তিনি তাঁর বাসাটা আমাদের দেখিয়ে আনত্মর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে নামিয়ে দিলেন। এর ফাঁকে তিনি জেনেভায় অবস্থিত অন্যান্য জাতিসংঘ অঙ্গ সংস্থাগুলোর কার্যালয়গুলোও দেখালেন।
_কাওসার রহমান
ঘুম এক দূর আকাশের পাখি...
২২ জানুয়ারি, শুক্রবার। বিশ্ব এজতেমার কভার করতে যেতে হবে টঙ্গী। সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে বের হয়ে মগবাজার এলাম। এখান থেকে টিকেটের বাসে টঙ্গী যাব। মগবাজার বাস কাউন্টারগুলোতে এজতেমাগামী মুসলিস্নদের ভিড়। একটা টিকেট গাজীপুর পরিবহনে অনেক ঠেলাঠেলি দিয়ে কাটলাম। বাস কাউন্টারে দাঁড়াতেই এজতেমাগামী মুসলিস্নরা হুড়মুড়িয়ে উঠতে শুরম্ন করলেন। আমি ভিড় ঠেলতে চাইলাম না। পরে উঠলাম। বাসে উঠে দেখি তিনজন বসার সিটে দু'জন এজতেমাগামী হুজুর বসে আছেন কাঁথা কাপড়ের গাঁট্টি নিয়ে। একজনকে অনুরোধ করলাম কাপড়ের গাঁট্টিটা সরালে আমি বসতে পারি। তিনি আমার অনুরোধে রাজি হয়ে বসতে দিলেন। কষ্ট করেই বসলাম। তাদের দু'জনের গাঁট্টি এত বড় যে সিটে বসতে কষ্টই হচ্ছিল। আমি তাদের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে আলাপ জমিয়ে নিলাম। তারা দু'জন মামা ভাগ্নে। মামা একটি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর ভাগ্নে জসিম সদ্য বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। মুসলিম দেশ জর্দানে নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে তিন বছর চাকরি করেছেন। তাঁর এই মামাই জর্দানে পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁরা দুই ভাই। জর্দানে গিয়ে বাড়িতে তেমন কিছু করতে পারেননি। তবে তাঁর ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠাতে পেরেছেন। মামা তাঁকে বলেছেন, এবার তাঁকে ইরাকে পাঠাবেন। ইরাকে ভাল বেতন পাওয়া যাবে। জর্দানে বেতন ছিল খুবই কম। দিনরাত পরিশ্রম করে অল্পকিছু টাকা যোগাড় করতে পেরেছিলেন তিনি। তাই দিয়েই ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠায়িছেন। জসিমের সঙ্গে আমি যখন কথা বলতে ছিলাম তখন তাঁর মামা ঘুমাচ্ছিলেন। জসিম বলেন, আমি কোনদিন এজতেমায় আসিনি। জর্দানে যখন কাজ করতাম আখেরী মোনাজাতের দিন দুই ঘণ্টার জন্য আমাদের ছুটি দিত। আমরা টেলিভিশনে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতাম। জর্দানীরা বলত, এজতেমা নাকি দ্বিতীয় হজ। জর্দান থেকে বহু মানুষ এজতেমায় যোগ দিতে আসেন। জর্দানীরা এজতেমা খুব গুরম্নত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। প্রথম বছর এমন দৃশ্য দেখে মনে মনে সিদ্ধানত্ম নিয়েছিলাম দেশে ফিরে গিয়ে এজতেমায় অংশ নেব। তাই এবার এজতেমায় যাচ্ছি। পথে কোন কষ্ট হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জসিম বলেন, কষ্ট না করলে তো আলস্নাহকে পাওয়া যাবে না। তাই কষ্ট তো কিছু স্বীকার করতেই হবে। জসিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে উত্তরা র্যাব-১-এর কার্যালয়ের সামনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। তবে পথে বাসে কিছু ঝগড়া দেখেছি। মহিলারা সমান অধিকারের কথা বলে অথচ এক মহিলা পুরম্নষকে সিট থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসার জন্য তুমুল ঝগড়া করছে। ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এই মহিলার মুখে কোন কিছু আটকাচ্ছে না। যার সঙ্গে ঝগড়া তিনি ডিফেন্সে চাকরি করেন। তিনি কিছুতেই সিট ছাড়বেন না। যৌক্তিকভাবেই তিনি বলছিলেন, সমান অধিকারের কথা বলে অসহায়ত্ব দেখিয়ে সিটে বসতে চাচ্ছেন কেন। বাসের যাত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন এজতেমাগামী যাত্রী, তারা ওই ব্যক্তির যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে উল্টো তাকেই ভর্ৎসনা করছিলেন। পরে তিনি সিট ছেড়ে ওই মহিলাকে বসতে দিলেন। এই ঝগড়া থামতে থামতে আরও একটি স্টপেজ থেকে কয়েকজন মহিলা যাত্রী বাসে উঠলেন। এবার কয়েকটি সিট ছেড়ে দেয়ার ব্যাপার। যাঁরা সিটে বসে আছেন তাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ। নবীনরা অনেকে সিট ছেড়ে প্রবীণদের বসতে দিয়েছেন। এবার আর কিছু করার রইল না। এজতেমাগামী মুসলিস্নরাও আর কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। যথারীতি গাদাগাদির মধ্যদিয়েই তাদের গনত্মব্যে যেতে হবে। কিছুৰণ পরে বাসের কন্ট্রাকটর বলছে বাস আর যাবে না। এখান থেকে টঙ্গী পর্যনত্ম হেঁটে যেতে হবে। র্যাব কার্যালয়ের সামনে নেমে পড়লাম। হাঁটা শুরম্ন করলাম এজতেমা ময়দানের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় টঙ্গী জোড়া ব্রিজের ওপরে উঠতেই জুমার নামাজ শুরম্ন হয়ে গেল। যে যেখানে জায়গা পেল সেখানেই জায়নামাজ, পেপার, হোগলার চাটাই অথবা পথে-মাটিতে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি আর আগাতে পারছিলাম না। অনেক ঘুরে ফিরে ব্রিজের উত্তর প্রানত্মে গিয়ে রাসত্মার ধারে কলাগাছের ছায়ায় দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে জনকণ্ঠের গাজীপুরের সাংবাদিক মোসত্মাফিজুর রহমান টিটুকে ফোন করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এজতেমার ১নং গেটে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার দূরে। পথে মানুষের যে ভয়ঙ্কর স্রোত দেখেছি সেই স্রোত মারিয়ে কিভাবে সেখানে যাই এমন চিনত্মা করছিলাম। যেতে যেহেতু হবে তাই কখনও মানুষের স্রোতের অনুকূলে আবার কখনও স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে থাকলাম। বিকেল ৩টার দিকে ১নং গেটের কাছে পেঁৗছে গেলাম। এখানে এসে টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ইরোর দেখাচ্ছে। লাখ লাখ লোক মোবাইল ব্যবহার করার কারণে নেটওয়ার্কের এমন সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক পরে সাংবাদিক টিটুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হলো। টিটুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমরা চলে গেলাম গাজীপুরে। সেখানে এনটিভির সাংবাদিক নাসির ভাইয়ের অফিসে এজতেমার নিউজ লিখলাম। নিউজ লিখতে সময় অফিস থেকে কাওসার ভাই দুই দফা ফোন দিয়েছে দ্রম্নত নিউজ পাঠাতে। রাত সাড়ে ৮টায় নিউজ পাঠিয়ে গাজীপুর থেকে রাত ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
_ফিরোজ মান্না
লন্ডনে থার্টিফার্স্ট নাইট
থার্টিফার্স্ট নাইট! দেখলাম লন্ডনের তারম্নণ্য। বর্ণিল আলোয় ঝলসে ওটা আর পপ সঙ্গীতের প্রাণ কাঁপানো বিটের তালে তালে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল গোটা লন্ডন। এই অনুভূতি ভোলার নয়। দেখতে দেখতে দুটো বছর পেরম্নল। প্রিয় ঢাকা, প্রিয় জনকণ্ঠ অফিস, বন্ধুবান্ধব সবকিছু মিস করি প্রচ-ভাবে। প্রথম বছরটিতে লন্ডনে আমার থার্টিফার্স্ট রাতে বের হওয়া হয়নি। এবার ফ্রান্সের বন্ধু ইগোরের চাপেই মূলত বের হওয়া। আমারও কিছু ইচ্ছা ছিল লন্ডনের এই রাতটি দেখার।
সন্ধ্যা সাতটায় আবারও ইগোরের ফোন। পিকাডিলি সার্কাস স্টেশনে পেঁৗছে দেখি ওর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার এমি, হাঙ্গেরির রবার্ট, এডিত, পোলান্ডের জুডিথসহ আমাদের আরও কয়েক বন্ধু। ওরা আমাকে দেখেই চিৎকার করে উঠল। সবার হাতে শ্যামপেনের বোতল। আমি এ্যালকোহল পান করি না। তাই ইগোর একটি আপেল জুসের বোতল এগিয়ে দিল আমাকে। ওখানেই শুরম্ন হলো হৈ চৈ।
আগের দিন রাত থেকে বিবিসিসহ রেডিও স্টেশনগুলো থেকে বার বার বুলেটেন প্রচার করা হচ্ছে এবার থার্টিফার্স্ট পালনে লন্ডন মেয়রের আয়োজন নিয়ে। মেয়রের উদ্যোগে গত দশ বছর ধরে উদ্যাপিত হচ্ছে ফায়ার ওয়ার্কস। লেজার শো কিংবা আতশবাজির ভেল্কিখেলা সে সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূর্ছনা লন্ডনীদের ঘুম কেড়ে নেয় এই রাতে। লন্ডনের অন্যতম নয়নাভিরাম লন্ডন আইকে প্রতিবছর ব্যবহার করা হয় এই ফায়ার ওয়ার্কসের জন্য। এটি ওয়েস্টমিনিস্টার স্টেশন সংলগ্ন থেমস নদীর পারে। এর পাশে রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন এবং দেড় শ' বছরের পুরনো লন্ডনের আরেক আশ্চর্য বিগবেন। বিগবেনে রাত ঘডির কাঁটা বারোটার উপর উঠলেই শুরম্ন হয় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আলোর খেলা।
ফায়ার ওয়ার্কস সফল করার জন্য লন্ডন আই'র আশপাশের সকল রাসত্মায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। স্থগিত করা হয় কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন সার্ভিস। ফায়ার ওয়ার্কস দেখার জন্য এবার লন্ডন আই এলাকায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষের সমাগম হয় বলে বিবিসি প্রচার করেছে।
বাস বন্ধ থাকায় পিকাডিলি সার্কাস থেকে ট্রেনে গাদাগাদি করে আমরা গেলাম ওয়েস্টমিনিস্টার। তখন রাত সাড়ে দশটা। লন্ডনের স্বচ্ছ নীলাকাশে গোলাকার চাঁদ। শীতের তীব্রতা মাইনাস টু। ভাগ্য ভাল আজ বৃষ্টি হচ্ছে না। আগেরদিন রাতে বেশ তুষার পড়েছে। ওয়েস্টমিনিস্টার পেঁৗছে মনে হলো এই জনসমুদ্র থেকে বের হয়ে যাওয়া কোনদিন সম্ভব নয়। থেমসের পারের কানায় কানায় মানুষ আর মানুষ। সরাসরি নদীর পারে আর জায়গা না থাকায় পুলিশ এবং সিকিউরিটি কমর্ীরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। সে সঙ্গে তারা মাইকে জানিয়ে দিচ্ছে আর কোথায় কোথায় অবস্থান নিলে ফায়ার ওয়ার্কস দেখা যাবে। আমাদের কিউ হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ঠিক উল্টো পাশে। বলা হলো এই কিউ অনুসরণ করলে ফায়ার ওয়ার্কস ভালমতো দেখা যাবে। আমরা পিঁপড়ার মতো টিম টিম করে এগিয়ে চলেছি সেদিকে। মদ আর বিয়ারের গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে আশপাশের বাতাস। শ্যাম্পেনের বোতল ছুড়ে কেউ কেউ সৃষ্টি করছে কৃত্রিম বৃষ্টির ধারা। বিগবেন চত্বর থেকে ১০ ডাউনিং স্ট্রিট মাত্র দু মিনিটের হাঁটা পথ। অথচ এই পথটি অতিক্রম করতে আমাদের সময় লাগল প্রায় আধা ঘণ্টা। সঙ্গের বন্ধুরা ততণে মাতাল।
শুরম্ন হলো অপোর পালা। কখন বারোটা বাজে। জীবন থেকে আরও একটি বছর বিদায় নিতে তখনও এক ঘণ্টা বাকি। মাথার ওপর ব্রিটিশ সিকিউরিটি ফোর্সের হেলিকপ্টার বার বার টহল দিচ্ছে। শীতের প্রকোপ বাড়ছে। ঘটির কাঁটা যখন ঠিক বারোটা ধম ধম করে বেজে উঠল বিগবেন। জানান দিল নতুন আরও একটি বছরের। নানা বর্ণের ফায়ারওয়ার্কসে আলোকিত হয়ে উঠল ওয়েস্টমিনিস্টারের গোটা এলাকা। নাচগান আর টগবগে তারম্নণ্য উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হলো ২০১০ সাল। সবার মুখে ধ্বনিত হচ্ছে হ্যাপি নিউ ইয়ার। জনসমুদ্রের কারণে রাত বারোটার পর ওয়েস্টমিনিস্টার, ওয়াটার লু, চ্যারিং ক্রসসহ আশপাশের গুরম্নত্বপূর্ণ আন্ডার গ্রাউন্ড টিউব সার্ভিসগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই এলাকার একমাত্র এম্ব্যাংকমেন্ট স্টেশনটি খোলা ছিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে যখন স্টেশনে ঢুকে ট্রেনে উঠলাম তখন রাত সাড়ে তিনটা। বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বাজল। ততণে বাংলাদেশে ১ জানুয়ারির দুপুর বেলা। তারপর দীর্ঘ ঘুম। উঠে দেখি আড়াইটা বেজে গেছে।
-শফিকুল ইসলাম জীবন
No comments