জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুমোদন পাচ্ছে না- * জামায়াতের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিচ্ছে ইসি- * জামায়াত বলছে ইসির কথা শুনলে তাদের সকলকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হবে
নাজনীন আখতার এবারও অনুমোদন মিলছে না জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের।
ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা, মজলিশে শূরায় নারীর প্রতিনিধিত্ব, অমুসলিমদের
অবস্থানসহ গঠনতন্ত্রের বেশ কয়েকটি ধারা জামায়াতকে স্পষ্ট করতে বলবে
নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সে সব ধারায় স্পষ্টতা ও ব্যাখ্যা চেয়ে জামায়াতে
ইসলামীকে আবারও চিঠি দিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আজ অথবা কাল উচ্চ পযর্ায়
থেকে চিঠি অনুমোদনের পর তা পাঠিয়ে দেয়া হবে দলের কেন্দ্রীয় কাযর্ালয়ে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার
ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ প্রকাশ করার পর গত কয়েক দিন ধরেই ফুঁসে উঠেছে
ইসলামী দলগুলো। জামায়াতে ইসলামী মোচর্া গঠন করে সরকার পতনসহ দেশকে
অস্থিতিশীল করারও হুঁমকি দিচ্ছে। এ অবস্থায় জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর
গঠনতন্ত্রের কয়েকটি ধারাকে 'স্পর্শকাতর' মনত্মব্য করে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে
ইসি। চিঠির বিষয়বস্তু নিয়েও কঠোর গোপনীয়তা রৰা করা হচ্ছে। দলগুলোর
গঠনতন্ত্রের কোন কোন ধারায় সংশোধনীর পরিবর্তে প্রথমে স্পষ্টতা ও ব্যাখ্যা
চাওয়ার সিদ্ধানত্ম নিয়েছে কমিশন। সংশিস্নষ্টদের মতে, কমিশনের আপত্তির মুখে
প্রথম দফায় নাম পরিবর্তনসহ কয়েক ধারায় সংশোধন আনলেও দেশের সার্বভৌমত্ব,
বিচার ব্যবস্থা, নারী ও পুরম্নষ, ধর্ম-বর্ণে এখনও জামায়াতের গঠনতন্ত্র
সংবিধানবিরোধী। তবে দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় দাবি করে
জামায়াত জানিয়েছে, দলের যেসব ধারা নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে কমিশনের চিঠির
জবাবে সেসব ধারার ব্যাখ্যা দেবে জামায়াত। দলটির মতে, 'অহেতুক' সমালোচনার সব
জায়গায় সংশোধন ও পরিবর্তন আনতে হলে দল বিলুপ্ত করে জামায়াতের সকলকে
ধর্মদ্রোহী দল 'কমিউনিস্ট পার্টি'তে যোগ দিতে হবে।নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) এনআই খান জনকণ্ঠকে বলেন, গত সপ্তাহে জামায়াতসহ ১৫টি দলকে কিছু কিছু ধারায় সংশোধনের জন্য চিঠি পাঠানোর কথা ছিল। নানান কারণে তা সম্ভব হয়নি। আজ রবিবার বা সোমবার চিঠিটি কমিশনের অনুমোদনের পর তা দলগুলোর কাযর্ালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তিনি জানান, দলগুলোর কাছে কি ধরনের সংশোধন চাওয়া হবে তা এখনও খসড়ার পযর্ায়ে। কমিশনই এ ব্যাপারে চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম নেবে। কোন কোন দলের গঠনতন্ত্রে ত্রম্নটি এতটাই কম যে, তাদের চিঠি দেয়া হবে কিনা সেটাও কমিশনের মতামতের ওপর নির্ভর করছে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখায়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সব দলকে রাজনৈতিক দল হিসেবেই বিবেচনা করছি। ইসলামী দল হিসেবে কোন দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়নি। যেসব দলের গঠনতন্ত্র গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও'র শর্ত মানেনি বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে, তেমন সব দলকেই কিছু ধারা সংশোধন ও প্রয়োজন অনুসারে কিছু ধারার ব্যাখা চেয়ে চিঠি দিয়েছে কমিশন। সে ধারাবাহিকতায় জামায়াতসহ আর কিছু দলকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল আরপিও অনুযায়ী সংশোধনের জায়গাগুলোতে সংশোধন এনেছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দলের গঠনতন্ত্রেও কিছু ধারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের শর্ত ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা সংশোধনের কথা বলা হবে। সেৰেত্রে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের শুরম্নর দিকে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরিবর্তন করতে বলা হচ্ছে কিনা প্রশ্ন করা হলে নির্বাচন কমিশনার তা স্পষ্ট না করে উল্টো প্রশ্ন করেন, বিষয়টি কি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সেক্রেটারি জেনারেল কামারম্নজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, চিঠি পাওয়ার পর প্রয়োজন অনুযায়ী মজলিশে শূরা বা নির্বাহী পরিষদের বৈঠক করা হবে। তিনি বলেন, এ নিয়ে যতটুকু শুনেছি ততটুকুর ওপরে আমাদের ব্যাখ্যার যথেষ্ট প্রসত্মতি আছে। কমিশনের চিঠির জবাব দেয়ার সময় সে ব্যাখ্যাগুলো সংযোজন করা হবে। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যবস্থায় সমাজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমাদের একটি আদর্শ। প্রত্যেক দলেরই আদর্শ আছে। নির্বাচন কমিশনের আরপিও'র শর্ত অনুসারে তাহলে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলোরও নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। কারণ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ধর্মনিরপেৰতার কথা আছে। আর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর গঠনতন্ত্রে ধর্মের লেশও নেই। দুটোই বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, যেসব বিষয় নিয়ে জামায়াতকে সংবিধানবিরোধী বলা হচ্ছে সেসব বিষয় বাদ দিলে আমাদের আর দল করার প্রয়োজন নেই। আমাদের সবাইকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হবে।
সংশিস্নষ্টদের মতে, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বাভাবিক নিয়মেই শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা ও ফতোয়া বোর্ড গঠনের বিষয়টি চলে আসে। আর এটা হলে সেটা হবে পুরোপুরি সংবিধান লঙ্ঘন। সংবিধানে আলস্নাহর প্রতি বিশ্বাসের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ইসলামী শরিয়াহ আইনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা নেই।
এ প্রসঙ্গে জামায়াত নেতা কামারম্নজ্জামান বলেন, এটা নিয়েও অপপ্রচার চলছে। জোর করে জনগণের ওপর ইসলাম চাপিয়ে দেয়া ইসলাম ধর্মেও নেই। দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার মতো শরীয়াহ আইনেও হত্যা, চুরি, ডাকাতি ও ধষর্ণের ৰেত্রে একই রকম শাসত্মির বিধান আছে; জামায়াত সেটার কথাই তুলে ধরে। আর ফতোয়া বোর্ড গঠনের বিষয়টি পুরোপুরি বানোয়াট। এ ধরনের কোন পরিকল্পনা জামায়াতের নেই।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, আরপিও'র শতর্ানুসারে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পযর্ায় পর্যনত্ম ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত ও সক্রিয় করার কথা বলা হলেও বিষয়টি জামায়াতের গঠনতন্ত্রে অস্পষ্ট। জামায়াতের মজলিশে শূরায় নারী প্রতিনিধি থাকলেও তারা বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারে না। তাদের হয়ে একজন পুরম্নষ প্রতিনিধিত্ব বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেন। কমিশনের চিঠিতে এ বিষয়েও জামায়াতের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলা হবে।
এ ব্যাপারে কামারম্নজ্জামান বলেন, ইসলামের পদর্াপ্রথা অনুসরণ করতে গিয়ে মজলিশে শূরায় সরাসরি নারীদের বক্তব্য নেয়া হয় না। তবে পদর্ার ওপাশে তারা উপস্থিত থাকেন। কমিশনের চিঠির জবাবে এটা আমরা অবশ্যই স্পষ্ট করব।
অমুসলিমদের বিষয়েও জবাব দেয়া হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আগে থেকেই অমুসলিমদের জামায়াতে যোগ দিতে কোন বাধা নেই। তবে এটা ঠিক, কেন্দ্রীয় পযর্ায়ে জামায়াতে কোন অমুসলিম নেতা নেই। কেন্দ্রীয় নেতা তৈরি হয় পযর্ায়ক্রমে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে অমুসলিমরা কখনই কেন্দ্রীয় নেতা হবে না তা নয়। এ ব্যাপারে কমিশন চাইলে তা গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করা হবে।
উলেস্নখ্য, ২০০৮ সালে আরপিও'র শর্ত মেনে গঠনতন্ত্রে সংশোধন এনে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন নেয়ার বিধান চালু করে। শর্ত ছিল, দলগুলোর গঠনতন্ত্র সংবিধান সম্মত হতে হবে। সে সময় জামায়াতের নাম ভারতের একটি দলের অঙ্গ সংগঠনের পযর্ায়ে পড়ায় নামসহ গুরম্নত্বপূর্ণ সব ধারায় তীব্র আপত্তি জানায় কমিশন। নিবন্ধন নেয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সে সময় নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাখে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত দলটি চাপে পড়ে প্রথম বারের মতো মুক্তিযুদ্ধের কথা গঠনতন্ত্রে যুক্ত করে। দলটির মুখবন্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা উলেস্নখ করা হয়। গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদ থেকে বাদ দেয়া হয় আলস্নাহ ও আকিমুদ্দিন শব্দ দু'টি। একাধিক জায়গায় যুক্ত করা হয় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কথাগুলো। যা আগে ছিল না।
সংশিস্নষ্টদের মতে, এর পরও দলটির গঠনতন্ত্র আরপিও'র শর্ত পরিপূর্ণভাবে মানেনি। সংবিধান পরিপন্থীও। তাদের মতে, ইসলামী সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। জীবনের সব বিষয়ে কেবল আলস্নাহর বিধানকেই একমাত্র হিদায়াত হিসেবে মেনে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের লৰ্য ও উদ্দেশ্য অধ্যায়ে ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সব ধরনের বৈদেশিক হুমকি থেকে রৰা করার কথা বলা হয়েছে। সার্বভৌমত্ব শব্দটি ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। নারী-পুরম্নষের বৈষম্য রাখার পাশাপাশি কোন অমুসলিমকে দলীয় পদ দেয়ার বিষয়টি নেই গঠণতন্ত্রে। উল্টো শর্ত দেয়া হয়েছে, আলস্নাহ ও রাসুলকে বিশ্বাস করে একজন অমুসলিমকে দলের সদস্য হতে হবে। এ ছাড়াও আলাদা শপথের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মুসলিম ও অমুসলিমদের জন্য। সেসব বিষয় সংশোধন না করলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত।
এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রমতে, নিবন্ধনের শর্ত পূরণ সাপেৰে গঠনতন্ত্র জমা দেয়া দলের মধ্যে ১২টি দলের তথ্যউপাত্ত যাচাই-বাছাই করে কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে বাছাই কমিটি। এই দলগুলোকে আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন সাপেৰে কমিশনে জমা দেয়ার জন্য শীঘ্রই চিঠি পাঠানো হচ্ছে। যে সব দলের গঠণতন্ত্রে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই ইসলামী দল। সেগুলো হচ্ছে_ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্্রন্ট, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যেজোট ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এই দলগুলো সংবিধানের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলচেতনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে।
No comments