ভিন্নমত-তবু তো যোগাযোগমন্ত্রী চেষ্টা করে যাচ্ছেন by আবু আহমেদ

আজকাল মানুষের ওপর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যাদের একসময় সৎ লোক মনে করতাম, তারা পদের অধিকারী হয়ে বড় চোরের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তবু সৎ মানুষ খুঁজি। পাই না। পদ পেলে একটা লোক সৎ থাকে কি না সেটাই আসল কথা। আমার কাছে যোগ্য মানুষের দুটি চিহ্ন আছে। এক. সততা, দুই. পরিশ্রমী।


অবশ্য এর সঙ্গে দক্ষতাকে যোগ করে নিতে হবে। অনেক সময় ভাবি লেখাপড়া জানা লোকগুলো বুঝি সৎ। কিন্তু সেখানেও সম্প্রতি বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। বড় বড় পদের লোকদের খবর সংবাদ মাধ্যমে যাও একটু-আধটু বের হচ্ছে তাতে বারবার হতাশই হচ্ছি। দল বলে কোনো কথা নয়। সমাজে যদি এসব কথিত বিখ্যাত লোকদেরই এই অধঃপতন হয়, তাহলে কম শিক্ষিত অল্পবিত্তের লোকদের নয়-ছয়কে দোষ দিয়ে কী লাভ। আমি লোকের অধঃপতন দেখলে অনেক কষ্ট পাই, ক্ষেত্রবিশেষে খেপেও যাই।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য রাগ-বিরাগটাও কমছে। ভাবি একটা লোক পদের অভাবে ৬০ বছর পর্যন্ত 'সৎ' ছিল। আর যেই মাত্র পদ ও তদবির করার সিঁড়ি খুঁজে পেল, অমনি কয়েক মাসের মধ্যে তার পূর্বের ঘোষিত সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে লাগল। কত হাজার হাজার কেসস্টাডি আছে এ ধরনের- এই সমাজে গুনেও হয়তো শেষ করা যাবে না। তারপর ভাবি এই যে লোকে বৃদ্ধ বয়সে এসে এসব অপকর্ম করছে, এগুলোর ভার থেকে এসব লোক মুক্তি পাবে কিভাবে! আসলে এরা হলো আমার নজরে মস্তবড় বেকুবের দল। একজন লোকের ভালোভাবে চলার জন্য তো তার সৎ পরিশ্রমের অর্থই যথেষ্ট। কিন্তু সে কেন দুর্নীতিতে লিপ্ত! তার পরিবারের সদস্যদের জন্য? এই বেকুবেরা একবারও চিন্তা করে দেখল না তার দুষ্কর্মের ভার তার পরিবারের অন্যরা বহন করবে না। একদিন জবাবদিহি শুধু তাকেই করতে হবে। আর কে বলেছে দুষ্কর্মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থকড়ি দিয়ে তার ছেলেমেয়েরা ভালো থাকবে? আসলে এসব লোক নিজেরা তো কলুষিত হয়েছেই নিজেদের পরিবারের অন্যদেরও কলুষিত করছে। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য দোয়া করলেও দিল খুলে দোয়া করবে না। এ বেকুবরা কি দেখে না সিঙ্গাপুরের আর ব্যাংককের হাসপাতালগুলোতে জিন্দা থাকতে কিছুদিন দোজখের স্বাদ কারা নিচ্ছে? অপেক্ষাকৃত গরিব কিন্তু সৎ লোকটাও তো অনায়াসেই অনেকটা সুস্থ অবস্থায়ই ৭০-৮০ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। দেখে শিক্ষা হবে না। পড়েও হবে না। তাহলে কে এবং কিসে তাদের শিক্ষা দিবে। পদ পেয়ে যারা দানব হয়েছে, তাদের জন্য হেদায়েতের উপায় কী! সমাজটাতে অধঃপতন ডেকে এনেছে তারাই। এখন ছোট স্তরের কর্মকর্তারাও দুষ্কর্ম করতে কেয়ার করে না। চলছে এক প্রতিযোগিতা। সেটা কিসের? বেচারা দুর্নীতি দমন কমিশন। তুমি কত লোককে জিজ্ঞেস করবে। আর করলেই বা কি। তোমার ক্ষমতা আছে কাগজে-কলমে, বাস্তবে তুমি দন্তহীন। কামড়ের ভান করো। কামড় দাও না বা পার না। তাহলে আমাদের নালিশ কোথায়? সেই আসমানে। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী অনেক চেষ্টা করছেন রেল ও জনপথগুলোকে উন্নত করার জন্য। আজ চট্টগ্রামে, তো কাল ঢাকায়, তার পরের দুদিন উত্তরবঙ্গে। কিন্তু বেচারা মন্ত্রী কী করবেন। যে দিকেই দেখেন, সবই কাদায় ভর্তি। রেলপথটা একদিন আমাদের সবার শখের ছিল। সেই ১৯৬৭ সালে গ্রিন অ্যারোযোগে আমি প্রথম ঢাকায় আসি। তারপর পুরো ছাত্রজীবনটাই গ্রিন অ্যারো আর উল্কা নামের ট্রেন দুটি করে বাড়িতে যাওয়া-আসা। ট্রেনে খাওয়ার একটা কম্পার্টমেন্ট ছিল, নাম, ব্যুফে। কত ভালো খাওয়া ছিল সেই ব্যুফেতে! পকেটে টাকা থাকত না বলে প্রতিবার খেতে পারতাম না। আর এখন শুনছি অপেক্ষাকৃত উঁচু শ্রেণীর লোকরা ট্রেনে কিছু খেতে চায় না। পাছে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়। এই যে ট্রেনের এত বড় দুর্গতি, তা এক দিনে হয়নি। বয়স্কদের মনে আছে, পাকিস্তান আমলে জাতীয় বাজেটের সময় আলাদা একটি রেলওয়ে বাজেটও পেশ করা হতো। আর এখন রেলওয়ের জন্য বরাদ্দ হয় যদি অর্থ থাকে। রেলওয়ে দেখার জন্য কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নেই। দেখার অভাবে রেলওয়ের অনেকেই লিপ্ত হয়েছে এই গাভিটার শেষ দুধটুকু নিজ বালতিতে নেওয়ার জন্য। রেলওয়ের জমি গেছে, ইঞ্জিন গেছে, বগি গেছে- সবই গেছে। রেলওয়ে সর্বহারা। এ অবস্থায় এটা চলছে কিভাবে, সেটা ভেবেই পাই না। না চলার মতো চলছে, যেভাবে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান চলছে। একসময় রেলওয়ে কম্পানি ছিল। সেই কম্পানি থেকে এখন রেলওয়ে হয়ে গেছে পুরোদস্তুর সরকারি এন্টারপ্রাইজ (Enterprise)। SOE হিসেবে রেলওয়ে কি চলতে পারবে? আমার হিসাবমতে পারবে না। মন্ত্রী মহোদয় বিকল্প দেখতে পারেন। তিনি রেলওয়ে ও জনপথকে উন্নীত করার জন্য অনেক সংগ্রাম করছেন। এতে দেশবাসী খুশি এ জন্যই যে একজন ওবায়দুল কাদের তো অন্তত চেষ্টা করছেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.