চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে নৌকাবাইচ by আলম শাইন
বাংলা ও ফরাসি শব্দের সংমিশ্রণে 'নৌকাবাইচ' শব্দের উৎপত্তি। 'নৌকা' বাংলা শব্দ, অন্যদিকে 'বাইচ' ফরাসি শব্দ। বাইচ শব্দের অর্থ হচ্ছে 'বাজি'। সে অনুযায়ী পুরো শব্দের অর্থ দাঁড়ায় নৌকার বাজিখেলা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, খেলাটা বেশ রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক। সেই সঙ্গে বলা যায়, এটি আমাদের আবহমান গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা।
সঙ্গে এও যোগ করে বলতে হয়, নৌকাবাইচ শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেরই জনপ্রিয় খেলা। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়, এটি আন্তর্জাতিক খেলার আওতায় পড়ে। খেলাটার ধরন একই রকম হলেও তফাতটা শুধু নামকরণেই। দেশেভেদে একেক ধরনের নাম ব্যবহার করা হয় শুধু। যেমন কোনো কোনো দেশে রোয়িং বোট রেস, কাইয়াক বোট রেস, সোয়ান বোট রেস, ড্রাগন বোট রেস ইত্যাদি নামে ডাকা হয়েছে। প্রতিটি দেশেই নৌকাবাইচের জন্য ভিন্ন আঙ্গিকের নৌকা তৈরি করা হয়। আমাদের দেশেও বাইচের নৌকা সচরাচর ব্যবহৃত নৌকার চেয়ে আলাদা আদলে তৈরি হয়। নৌকাগুলোর দুই প্রান্ত থাকে অনেকটা সুঁচালো। পেটের দিকটা খানিকটা চওড়া। আকৃতিতে বেশ লম্বা। অঞ্চলভেদে মাপের মাত্রাটাও ভিন্ন। তবে বেশির ভাগই ১৫০ থেকে ২০০ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রস্থে ৬ থেকে ৮ ফুট। নৌকাগুলো শাল কাঠের তৈরি। অন্যান্য গাছের কাঠ দিয়েও বানানো যায়, তবে টেকসইয়ের দিক দিয়ে শাল কাঠের নৌকাই এগিয়ে থাকে। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ৬০ জন মাল্লা থাকেন। নৌকার আকৃতিভেদে মাঝিমাল্লার সংখ্যাও বাড়াতে হয়। সেটা অবশ্য নির্ভর করে প্রতিযোগিতার ধরন বা আয়োজনের ওপর। দেখা গেছে, প্রতিটি নৌকায়ই সর্দারগোছের একজন মাঝি থাকেন। মূলত তাঁর নেতৃত্বে নৌকা চালানো হয়। তিনি নৌকার মাঝখানে অবস্থান করেন। প্রথমে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে পিতলের বেলে ঘণ্টা পিটিয়ে মাঝিদের জোরে বৈঠা চালাতে উৎসাহিত করেন। চমকপ্রদ এই খেলার একটি ইতিহাস রয়েছে। সূত্র মতে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্ব্বীদের জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার সময় যাত্রীদের নিয়ে শত নৌকার সমাগম হতো তখন এবং তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতো গন্তব্যে পৌঁছার। এ প্রতিযোগিতা থেকেই পরবর্তী সময়ে প্রচলন হয় আজকের এ নৌকাবাইচের। দেখা যায়, একপর্যায়ে খেলাটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর জনপ্রিয়তা দেখে উপমহাদেশের রাজ-রাজড়ারাও খেলাটির আয়োজন করতেন তখন। এভাবে নৌকাবাইচ খেলাটি একসময় আমাদের জাতীয় জীবনে জড়িয়ে পড়ে। খুশির কথা হচ্ছে, খেলাটিকে ধরে রাখতে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে নৌকাবাইচের আয়োজনও করা হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে। তার পরও নৌকাবাইচ খুব দ্রুত হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের দেশ থেকে। কারণ দুটি- এক. এটি ব্যক্তি পর্যায়ে খুব কমই খেলা হচ্ছে (ব্যয়বহুল বিধায় কেউ ইচ্ছা করলেই খেলতে পারছেন না); দুই. খেলার মানসিকতা থাকলেও জলের স্বল্পতার কারণে নৌকাবাইচ খেলা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বলা যায়, আমাদের নদী, হাওর-বাঁওড় নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় নৌকাবাইচ হারিয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। কাজেই সময় থাকতে আমাদের সাবধান হতে হবে। তাহলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যটা ধরে রাখা সম্ভব হতে পারে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
আলম শাইন
আলম শাইন
No comments