সার বিপণন ব্যবস্থায় অসাধু তৎপরতা by এ এম এম শওকত আলী
১০ মার্চ তারিখে একটি ইংরেজি দৈনিকে সিরাজগঞ্জ জেলার কিছু সার ডিলারদের অসাধু তৎপরতার সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, কিছু খুচরা সার ব্যবসায়ী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় যমুনা সার কারখানার ইউরিয়া সার অবৈধভাবে বিপণন করছেন।
তবে বস্তা বা কেজিপ্রতি মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় কম। কৃষকবান্ধব ব্যক্তিরা বলবেন, এতে দোষের কি আছে। কৃষকরা কম দামে সার কিনতে পারলে ক্ষতি কি। মূল সমস্যা সরকারের। কারণ ইউরিয়া সার একমাত্র সরকারই বিসিআইসির মাধ্যমে আমদানি ও বিক্রয় করে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যথাসময়ে সার বিক্রির জন্য ওই অঞ্চলে ১৪টি গুদামে আপদকালীন মজুদ বা বাফার স্টক বিসিআইসির ব্যবস্থাপনায় বিপণন করা হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী যমুনা সার কারখানার ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে কৃষকরা আগ্রহী। এ কারণে তাঁরা বাফার গুদাম থেকে অন্য দেশের সার কিনতে আগ্রহী নয়। জানা যায়, বিসিআইসি চীন, ইউএই ও সৌদি আরবের সার ওই জায়গার বাফার গুদামে মজুদ করেছে। কিন্তু কৃষকরা তা কিনতে রাজি নন।
বাংলাদেশের সারের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য সরকার নির্ধারিত। আইনের দৃষ্টিতে এ মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা আইনের লঙ্ঘন নয়। বিসিআইসির জন্য সমস্যা হলো, আমদানিকৃত সার বিক্রি না হলে এ সার আগামী বছর বিক্রি করতে হবে। ফলে সমস্যা অধিকতর ঘনীভূত হবে। কারণ একাধিক। কৃষকরা সাধারণত সদ্য প্রস্তুতকৃত সার কিনতে আগ্রহী। এক বছরের অধিক সার মজুদ করার ফলে গুণগত মান হ্রাস পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অধিক সময় ধরে মজুদকৃত সার বস্তার ভেতরে শক্ত হয়ে যায়। অনেকটা ছোট আকারের পাথরের মতো। এতে বিপণনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিসিআইসির জন্য আরো সমস্যা হলো, নগদ অর্থ প্রবাহের চাপ। ইউরিয়া সার অবিক্রিত রইলে এ চাপ বাড়বে। শেষ পর্যন্ত সরকারকেই এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ বিসিআইসির চলতি মূলধনের জোগান দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন। কি কারণে তাঁরা কম দামে ইউরিয়া সার বিক্রি করছেন সে বিষয়টির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সরকার সার কারখানার বস্তাপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করে। তবে বাফার গুদামের সারের নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য কারখানার চেয়ে কিছু বেশি। এ কারণে সব সার ডিলারই কারখানা থেকে সার কিনতে আগ্রহী। জানা যায় যে বিসিআইসি সার ডিলারদের বাফার গুদামের সার কেনা বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে একটি আদেশ জারি করেছে। দেশের সার আমদানিকারক, প্রস্তুতকারক ও ডিলারদের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন। সংক্ষেপে বিএফএ। তবে আজ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে কোনো সার কারখানায় বিনিয়োগ হয়নি। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কম্পানি বা কাফকো অবশ্য বেসরকারি খাতের। এতে বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিসিআইসিরও বিনিয়োগ রয়েছে। কাফকো শতভাগ রপ্তানিমুখী। প্রয়োজনে বিসিআইসি আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে এ কারখানা থেকে ইউরিয়া সার ক্রয় করে।
সার বিপণন কাঠামোর ওপর সরকার ও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অতীতে এ ব্যবসা করার জন্য বিএডিসির একচেটিয়া অধিকার ছিল। বিএডিসি পরিচালিত কাঠামোতে খুচরা সার বিপণনব্যবস্থা উন্মুক্ত ছিল। ২০০৭ সালে এর পরিবর্তন হয়। বর্তমান সময়ে মূলত তিন বা চার ধরনের সার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ ও ডিএপি সার। ইউরিয়া আমদানির একচেটিয়া অধিকার বিসিআইসির। তবে টিএসপি, পটাশ বা ডিএপি সার সরকারি ও বেসরকারি খাতে আমদানি হয়। সরকারি খাতে এ দায়িত্ব বিএডিসির। সরকারি খাতে ইউরিয়া সার দেশব্যাপী বিপণনের জন্য বিসিআইসি ডিলার নিযুক্ত করে। অন্যদিকে পটাশ ও টিএসপির জন্য বিএডিসিও ডিলার নিযুক্ত করে। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন এ পদক্ষেপ চালু করে তার সঙ্গে ইউনিয়নভিত্তিক খুচরা ব্যবসায়ীও নিয়োগ দেওয়া হয়।
ওই সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এ ব্যবস্থা হবে সাময়িক। ২০০৯ সালে সার বিপণন নীতিমালায় ওই সময়ের ব্যবস্থাই স্থায়ীরূপ লাভ করে। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম সারের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটির মাধ্যমেই হয়। এতে অবশ্য বিএফএর প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত। এ সত্ত্বেও সাধারণ ধারণা হলো, সরকারি খাতে চাহিদার চেয়ে বেশি সারই আমদানি করা হয়। সিরাজগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনাই এর সাক্ষ্য দেয়। বিএডিসি ও বিসিআইসির আর্থিক দুরবস্থার এটি একটি প্রধান কারণ।
২০০৯ সাল পরবর্তী সময়ে টিএসপি ও পটাশ সারের বিক্রয়মূল্য সরকার হ্রাস করে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা। ফলে ইউরিয়া সারের চাহিদাও হ্রাস পায়। এর আরেকটি কারণ হলো, গুটি ইউরিয়ার অধিক প্রচলন। বর্তমানে ২২টি জেলায় গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করার জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ইউরিয়া সারের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানির নির্ধারিত চাহিদাও কি হ্রাস করা হয়েছে। বিগত দুই বছরে বাফার গুদামের মজুদকৃত সার কোনো কোনো জেলায় অবিক্রীত থাকার কারণে ডিলাররা তা ক্রয় করতে অস্বীকার করেন। এ ধরনের সংবাদ মিডিয়ায়ও প্রকাশিত হয়। মার্চ ১০ তারিখের সংবাদে প্রতীয়মান হয় যে এ বছরের চিত্রও একই। অন্যদিকে রয়েছে আরেকটি সমস্যা। এ সমস্যা দ্বিমুখী। ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডিলাররা বাধ্যতামূলকভাবে কারখানা থেকে সার ক্রয়ে আগ্রহী নন। কারণ এর ফলে তাঁদের কমিশনের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত সময়মতো সরকার থেকে ভর্তুকি না পাওয়ার কারণে তাঁদের চলতি মূলধনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেকেই সময়মতো আমদানি করতে সক্ষম হচ্ছেন না। সরকার বিষয়টি জানে। আশা করা যায়, এ সমস্যার সমাধান অচিরেই হবে।
চাহিদার অধিক সার আমদানির পেছনে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও একটি কারণ। কোনো সরকারই চায় না যে সার নিয়ে সংকট হোক। সংকট যেকোনো উপায়ে এড়াতে হবে। অন্যথায় এর জন্য কৃষকদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সংকটের ফলে মূল্যবৃদ্ধিও আরেকটি আশঙ্কা। মূলত সংকটের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে। ১৯৯৫ সালের ভয়াবহ ইউরিয়া সার সংকটের বিষয় এখনো অনেকেরই মনে আছে। বর্তমান সরকারের অবশ্যই আছে। কারণ তারা তখন ক্ষমতাসীন ছিল না। তবে যে বিষয়টির সমাধান প্রয়োজন তা হলো, অবিক্রীত মজুদের পরিমাণ যেন অধিক না হয়। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত কোনো সংকট হয়নি। এর জন্য অনেকেই মনে করেন যে সারের পর্যাপ্ত মজুদ ও কৃষকদের প্রাপ্তির সুযোগের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এতে কারো দ্বিমত নেই। তবে চাহিদার তুলনায় অত্যধিক মজুদও সার্বিক দৃষ্টিকোণে কাম্য হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধান কি? সমাধান একাধিক। এ নিয়ে কিছু সাম্প্রতিক সমীক্ষাও রয়েছে। প্রয়োজন হলো, এসব সমীক্ষার গ্রহণযোগ্য সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার বিপণন নীতি ডিলারসহ কৃষকবান্ধব করা। এর সঙ্গে প্রয়োজন বাফার স্টকের মজুদ অধিকতর বাস্তবমুখী করা। সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারের সম্পদের অপচয় এ সীমবদ্ধতাকে আরো অধিক জটিল করে। এ বিষয়ে বিএফএরও দায়িত্ব কম নয়। বিএফএ ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত হলেও এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো, অধিকতর কৃষকবান্ধব হওয়া। সরকারের পাশাপাশি সারের সার্বিক চাহিদা বিএফএরও নির্ধারণ করা উচিত। আর সরকারি কমিটির কাজ হবে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণে বিএফএর নিরুপিত চাহিদা যাচাই করে তা গ্রহণ করা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক চাহিদা অধিকতর বাজারভিত্তিক করাও হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিরাজগঞ্জের ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? মনে হয় না। যদি তা কেউ মনে করেন, তবে তা আত্মপ্রবঞ্চনা। ঘটনার মূল বিষয়বস্তু হলো, অবৈধ সার ব্যবসা। সার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৬ অনুমোদিত ও নিবন্ধিত ডিলার ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি সার বিপণন করতে পারবে না। যদি করে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ- এমনকি খুচরা পর্যায়েও। এটা কৃষকবান্ধব বা বাস্তবমুখী নয়। এর যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ মাঠপর্যায়ে রয়েছে। কৃষকবান্ধব ও বাস্তবমুখী করার জন্য অতীতের মতো খুচরা বিপণন উন্মুক্ত করা ভালো হবে। ১৯৯৬-২০০১ সালেও কোনো নিয়ন্ত্রণ এতে ছিল না। এমনকি উপজেলাভিত্তিক ডিলার প্রথার বিষয় ওই সময় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচিত হলেও তা গৃহীত হয়নি। কৃষকদের জন্য খুচরা বিপণন যত বেশি থাকবে, ততই কেনার সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। অন্য কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণও বাস্তবমুখী নয়। কারণ নীতি অনুযায়ী ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডভিত্তিক উপ-ডিলার প্রথা চালু করা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে অনিয়োগপ্রাপ্ত খুচরা ডিলার সফলভাবে কাজ করেছেন। জেলার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ভেবেচিন্তেই এতে খুব একটা বাধা সৃষ্টি করেনি। কারণ বাধা সৃষ্টি করলে সংকট হতো।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের সারের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য সরকার নির্ধারিত। আইনের দৃষ্টিতে এ মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা আইনের লঙ্ঘন নয়। বিসিআইসির জন্য সমস্যা হলো, আমদানিকৃত সার বিক্রি না হলে এ সার আগামী বছর বিক্রি করতে হবে। ফলে সমস্যা অধিকতর ঘনীভূত হবে। কারণ একাধিক। কৃষকরা সাধারণত সদ্য প্রস্তুতকৃত সার কিনতে আগ্রহী। এক বছরের অধিক সার মজুদ করার ফলে গুণগত মান হ্রাস পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অধিক সময় ধরে মজুদকৃত সার বস্তার ভেতরে শক্ত হয়ে যায়। অনেকটা ছোট আকারের পাথরের মতো। এতে বিপণনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিসিআইসির জন্য আরো সমস্যা হলো, নগদ অর্থ প্রবাহের চাপ। ইউরিয়া সার অবিক্রিত রইলে এ চাপ বাড়বে। শেষ পর্যন্ত সরকারকেই এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ বিসিআইসির চলতি মূলধনের জোগান দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন। কি কারণে তাঁরা কম দামে ইউরিয়া সার বিক্রি করছেন সে বিষয়টির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সরকার সার কারখানার বস্তাপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করে। তবে বাফার গুদামের সারের নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য কারখানার চেয়ে কিছু বেশি। এ কারণে সব সার ডিলারই কারখানা থেকে সার কিনতে আগ্রহী। জানা যায় যে বিসিআইসি সার ডিলারদের বাফার গুদামের সার কেনা বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে একটি আদেশ জারি করেছে। দেশের সার আমদানিকারক, প্রস্তুতকারক ও ডিলারদের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন। সংক্ষেপে বিএফএ। তবে আজ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে কোনো সার কারখানায় বিনিয়োগ হয়নি। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কম্পানি বা কাফকো অবশ্য বেসরকারি খাতের। এতে বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিসিআইসিরও বিনিয়োগ রয়েছে। কাফকো শতভাগ রপ্তানিমুখী। প্রয়োজনে বিসিআইসি আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে এ কারখানা থেকে ইউরিয়া সার ক্রয় করে।
সার বিপণন কাঠামোর ওপর সরকার ও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অতীতে এ ব্যবসা করার জন্য বিএডিসির একচেটিয়া অধিকার ছিল। বিএডিসি পরিচালিত কাঠামোতে খুচরা সার বিপণনব্যবস্থা উন্মুক্ত ছিল। ২০০৭ সালে এর পরিবর্তন হয়। বর্তমান সময়ে মূলত তিন বা চার ধরনের সার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ ও ডিএপি সার। ইউরিয়া আমদানির একচেটিয়া অধিকার বিসিআইসির। তবে টিএসপি, পটাশ বা ডিএপি সার সরকারি ও বেসরকারি খাতে আমদানি হয়। সরকারি খাতে এ দায়িত্ব বিএডিসির। সরকারি খাতে ইউরিয়া সার দেশব্যাপী বিপণনের জন্য বিসিআইসি ডিলার নিযুক্ত করে। অন্যদিকে পটাশ ও টিএসপির জন্য বিএডিসিও ডিলার নিযুক্ত করে। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন এ পদক্ষেপ চালু করে তার সঙ্গে ইউনিয়নভিত্তিক খুচরা ব্যবসায়ীও নিয়োগ দেওয়া হয়।
ওই সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এ ব্যবস্থা হবে সাময়িক। ২০০৯ সালে সার বিপণন নীতিমালায় ওই সময়ের ব্যবস্থাই স্থায়ীরূপ লাভ করে। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম সারের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটির মাধ্যমেই হয়। এতে অবশ্য বিএফএর প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত। এ সত্ত্বেও সাধারণ ধারণা হলো, সরকারি খাতে চাহিদার চেয়ে বেশি সারই আমদানি করা হয়। সিরাজগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনাই এর সাক্ষ্য দেয়। বিএডিসি ও বিসিআইসির আর্থিক দুরবস্থার এটি একটি প্রধান কারণ।
২০০৯ সাল পরবর্তী সময়ে টিএসপি ও পটাশ সারের বিক্রয়মূল্য সরকার হ্রাস করে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা। ফলে ইউরিয়া সারের চাহিদাও হ্রাস পায়। এর আরেকটি কারণ হলো, গুটি ইউরিয়ার অধিক প্রচলন। বর্তমানে ২২টি জেলায় গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করার জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ইউরিয়া সারের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানির নির্ধারিত চাহিদাও কি হ্রাস করা হয়েছে। বিগত দুই বছরে বাফার গুদামের মজুদকৃত সার কোনো কোনো জেলায় অবিক্রীত থাকার কারণে ডিলাররা তা ক্রয় করতে অস্বীকার করেন। এ ধরনের সংবাদ মিডিয়ায়ও প্রকাশিত হয়। মার্চ ১০ তারিখের সংবাদে প্রতীয়মান হয় যে এ বছরের চিত্রও একই। অন্যদিকে রয়েছে আরেকটি সমস্যা। এ সমস্যা দ্বিমুখী। ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডিলাররা বাধ্যতামূলকভাবে কারখানা থেকে সার ক্রয়ে আগ্রহী নন। কারণ এর ফলে তাঁদের কমিশনের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত সময়মতো সরকার থেকে ভর্তুকি না পাওয়ার কারণে তাঁদের চলতি মূলধনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেকেই সময়মতো আমদানি করতে সক্ষম হচ্ছেন না। সরকার বিষয়টি জানে। আশা করা যায়, এ সমস্যার সমাধান অচিরেই হবে।
চাহিদার অধিক সার আমদানির পেছনে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও একটি কারণ। কোনো সরকারই চায় না যে সার নিয়ে সংকট হোক। সংকট যেকোনো উপায়ে এড়াতে হবে। অন্যথায় এর জন্য কৃষকদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সংকটের ফলে মূল্যবৃদ্ধিও আরেকটি আশঙ্কা। মূলত সংকটের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে। ১৯৯৫ সালের ভয়াবহ ইউরিয়া সার সংকটের বিষয় এখনো অনেকেরই মনে আছে। বর্তমান সরকারের অবশ্যই আছে। কারণ তারা তখন ক্ষমতাসীন ছিল না। তবে যে বিষয়টির সমাধান প্রয়োজন তা হলো, অবিক্রীত মজুদের পরিমাণ যেন অধিক না হয়। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত কোনো সংকট হয়নি। এর জন্য অনেকেই মনে করেন যে সারের পর্যাপ্ত মজুদ ও কৃষকদের প্রাপ্তির সুযোগের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এতে কারো দ্বিমত নেই। তবে চাহিদার তুলনায় অত্যধিক মজুদও সার্বিক দৃষ্টিকোণে কাম্য হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধান কি? সমাধান একাধিক। এ নিয়ে কিছু সাম্প্রতিক সমীক্ষাও রয়েছে। প্রয়োজন হলো, এসব সমীক্ষার গ্রহণযোগ্য সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার বিপণন নীতি ডিলারসহ কৃষকবান্ধব করা। এর সঙ্গে প্রয়োজন বাফার স্টকের মজুদ অধিকতর বাস্তবমুখী করা। সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারের সম্পদের অপচয় এ সীমবদ্ধতাকে আরো অধিক জটিল করে। এ বিষয়ে বিএফএরও দায়িত্ব কম নয়। বিএফএ ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত হলেও এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো, অধিকতর কৃষকবান্ধব হওয়া। সরকারের পাশাপাশি সারের সার্বিক চাহিদা বিএফএরও নির্ধারণ করা উচিত। আর সরকারি কমিটির কাজ হবে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণে বিএফএর নিরুপিত চাহিদা যাচাই করে তা গ্রহণ করা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক চাহিদা অধিকতর বাজারভিত্তিক করাও হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিরাজগঞ্জের ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? মনে হয় না। যদি তা কেউ মনে করেন, তবে তা আত্মপ্রবঞ্চনা। ঘটনার মূল বিষয়বস্তু হলো, অবৈধ সার ব্যবসা। সার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৬ অনুমোদিত ও নিবন্ধিত ডিলার ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি সার বিপণন করতে পারবে না। যদি করে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ- এমনকি খুচরা পর্যায়েও। এটা কৃষকবান্ধব বা বাস্তবমুখী নয়। এর যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ মাঠপর্যায়ে রয়েছে। কৃষকবান্ধব ও বাস্তবমুখী করার জন্য অতীতের মতো খুচরা বিপণন উন্মুক্ত করা ভালো হবে। ১৯৯৬-২০০১ সালেও কোনো নিয়ন্ত্রণ এতে ছিল না। এমনকি উপজেলাভিত্তিক ডিলার প্রথার বিষয় ওই সময় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচিত হলেও তা গৃহীত হয়নি। কৃষকদের জন্য খুচরা বিপণন যত বেশি থাকবে, ততই কেনার সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। অন্য কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণও বাস্তবমুখী নয়। কারণ নীতি অনুযায়ী ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডভিত্তিক উপ-ডিলার প্রথা চালু করা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে অনিয়োগপ্রাপ্ত খুচরা ডিলার সফলভাবে কাজ করেছেন। জেলার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ভেবেচিন্তেই এতে খুব একটা বাধা সৃষ্টি করেনি। কারণ বাধা সৃষ্টি করলে সংকট হতো।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments