সহজিয়া কড়চা-তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো জিনিস নিয়ে বেশি ঘাঁটাতে গেলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। কয়েক বছর আগে সার্ক দেশগুলোর নির্বাচন-পদ্ধতি নিয়ে এক সম্মেলন হয়েছিল কাঠমান্ডুতে। নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে কাজ করে এমন এনজিও প্রতিনিধিরাও ছিলেন। তিন-চার দিনব্যাপী সেই সম্মেলনে আমারও যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সম্মেলনের শেষ দিন কেউ একজন বললেন, নেপালের পশমিনা খুব বিখ্যাত, কেনা যেতে পারে। পশমিনা হলো ভেড়ার পশমে তৈরি মেয়েদের একধরনের শাল।
আমরা ওই শাল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করায় কর্তৃপক্ষ আমাদের দোকানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। একটি মাইক্রোবাস ও একজন গাইড আমাদের দেওয়া হয়। পাঁচ-সাতজন আমরা একসঙ্গে যাই। আমাদের দলে ভারতীয় ও পাকিস্তানিও কয়েকজন ছিলেন। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সুন্দরী মহিলাও ছিলেন দুই-তিনজন। বিশেষভাবে মনে আছে একজনের কথা। তিনি হলেন ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মি. লিঙদো। অতি সজ্জন ও চমৎকার মানুষ। বিখ্যাত টি এন সেশান এবং এম এম গিলের পরে তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
দোকানে গিয়ে দেখি পর্যটকদের ভিড়। দোকানের কর্মচারীরা বিভিন্ন রকম পশমিনা বের করে দেখাচ্ছেন। পাঁচ-সাত শ নেপালি রুপি থেকে পাঁচ-সাত হাজার রুপি দামের পশমিনাও আছে। আরও বেশি দামের থাকতে পারে। কিনি বা না কিনি, আমরা নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম। পশ্চিম-দক্ষিণ ভারতীয় মধ্যবয়সী এক মহিলা অতি দামি পশমিনা ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। তাঁর মর্যাদা দোকানে খুব বেশি। তিনি কথাও বলছিলেন বেশি। তাঁর সব কথার জবাব দিতে দোকানি বাধ্য। খদ্দের রূপবতী বলে তাঁর কথার জবাব দেওয়াতেও আনন্দ। একপর্যায়ে তিনি জানতে চাইলেন, এ পশমিনা ভেড়ার কোথাকার লোমের তৈরি।
দোকানের যুবকটি বললেন, নেপালের উত্তরাঞ্চলের কোনো এলাকার।
ভদ্রমহিলা বললেন, না না, তা জানতে চাইনি। আমি জানতে চাইছি, এত মসৃণ লোম ভেড়ার শরীরের কোন অংশের।
এবার দোকানের যুবকটি বললেন, মাফ করবেন ম্যাডাম, বুঝতে পেরেছি। এ পশমিনাটি খুবই মূল্যবান লোমের। এ হলো ভেড়ার টেস্টিকল ও পেটের দিকের লোম থেকে তৈরি। এক আউন্স লোম সংগ্রহ করতে বহু ভেড়ার প্রয়োজন।
তাদের হিন্দিতে কথাবার্তা আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। যুবকটি যখন জানালেন, ওই পশমিনা ভেড়ার অণ্ডকোষের পশমে তৈরি, তখন ভদ্রমহিলা খুশি হলেন কি না বোঝা গেল না, কিন্তু তাঁর গোলাপের সামান্য ম্লান পাপড়ির মতো মুখমণ্ডলে এক কৃত্রিম কৌতুকের আভাস দেখা দিল। তাঁর স্বামী এতক্ষণ পাশে ছিলেন চুপচাপ এবং ভাবছিলেন মানিব্যাগের অবস্থা। এবার কথা বললেন এবং যা বললেন হিন্দিতে, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: তুমি যেখানে যাও সেখানেই সব ব্যাপারে বেশি কলকল করো। কী দরকার তোমার এত কিছু জানার?
আমি মনে মনে তাঁর উদ্দেশে বললাম, পঁচিশ-তিরিশ বছর যাবৎ এই কলকলানির মধ্যে আছেন। এখন কি আর তা থামবে? পাশে ছিলেন আমার বন্ধু বদিউল আলম মজুমদার। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, সম্ভব হলে এ জিনিস ভাবির জন্য একখানা নিয়ে যান।
বিধাতা আমাদের চেয়ে বেশি রসিক। তাঁর রসবোধ বিপুল। ওই সময় দোকানে আমরা না থেকে শিখ লেখক ও কলাম লেখক খুশবন্ত সিং থাকলে ভালো হতো। পশমিনা তৈরির কাঁচামালের উৎস বা উৎপন্ন স্থান সম্পর্কে ম্যাডামকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারতেন।
বাংলাদেশে আমরা কোনো একটা বিষয় পেলে হলো, তাকে শুধু ঘাঁটা নয়, একেবারে লেম্বু চেপা চিপতে থাকি। যে জিনিস কম কথা খরচ করে এবং বেশি মাথা খাটিয়ে সহজেই সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে উত্তাল ঝড় ওঠে। কিছুদিন যাবৎ সংবিধান সংশোধন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি রাখা না-রাখা নিয়ে শুরু হয়েছে তা-ই। এসব ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে বাংলাদেশে নেমে আসবে সিডর এবং তাতে সিডরবিধ্বস্ত দক্ষিণ বাংলার মতো গোটা বাংলাদেশে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে; যার ধ্বংসলীলার রেশ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না ১০ বছরেও।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে সংবিধান পুনর্লিখন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি বাতিলের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তাতে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেসব এখন শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব লিখিত অঙ্গীকার ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেদিন মনে মনে যে অঙ্গীকার বা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, তা-ই বাস্তবায়নে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। রাজনীতির ময়দানে এখন উড়ছে এমন ধুলা, যা আমাদের দুটি চোখই অন্ধকার করে দিচ্ছে। শুধু দুটি চোখই নয়, বিবেক নামক যে আর একটি অদৃশ্য চোখ রয়েছে, তাকেও দিয়েছে অন্ধ করে। যখন কেউ যুক্তিবিবর্জিত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে, তখন কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। খাদের ভেতরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
আগামী নির্বাচন ঠিক সময় যদি হয়, তাহলে তা হবে অন্তত আড়াই বছর পরে। বিএনপির নেতারা যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছেন এবং সরকারের পদত্যাগ চাইছেন, তা ঘুমের ঘোরে কথা বলার মতো। সংসদে তাঁদের আসনসংখ্যা অতি কম। তাঁরা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারবেন না। সরকার পদত্যাগ করলে তবেই তো মধ্যবর্তী নির্বাচন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেন সরকার পদত্যাগ করবে? অবশ্য এক আওয়ামী লীগ নেতাই ভালো বলেছেন, বেশি হইচই করলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এক মাস বেশি ক্ষমতায় থাকবেন। ল্যাকটোজেন খাওয়া ছোট বাবুদের মতো কথাবার্তা। এসব কথা উপভোগ করা যায়, তবে ভোগ করতে হয় একপর্যায়ে গিয়ে অশেষ দুর্ভোগ।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের কথা ছেড়ে দিলাম। সেটি ছিল সমঝোতামূলক অন্য রকম নির্দলীয় সরকার। যত দূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরও বিজয়ী দল বিএনপির নেতা নাজমুল হুদা তাঁকে এমন ঘাই দিয়েছিলেন যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে আমি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। ব্যারিস্টার সাহেব এই কথা বলেছিলেন যে, ‘মাননীয় বিচারপতির ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা নাই।’ এই অপবাদে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। ঘটনাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো—এ দেশে কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না। উপকার করলেও করে না, অপকার করলে তো কথাই নেই। শুধু মাগুরার উপনির্বাচন নয়, ওই অবিশ্বাস থেকেই তত্ত্বাবধায়কের জন্ম এবং জন্মদাতা আওয়ামী লীগ। এখন আওয়ামী লীগ সন্তান হত্যায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
নেতারা এত দিন মুখে মুখে বলছিলেন কিন্তু সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি রোববার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংসদে সুপারিশ পেশ করেছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক আর থাকছে না। যে ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে ১৯৯৫-৯৬ সালে, যার জন্য এখন ঘুঘু চড়ে বহু ভিটায়, যার জন্য প্রাণ গেছে সংখ্যাহীন মানুষের, সেই ব্যবস্থার এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের কাছে। ওই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন যাঁরা, এখন তাঁদের কাছে দেখা দিয়েছে তার অপরিহার্যতা এবং ওই ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে রিহার্সেল। আবার প্রাণ যাবে অজ্ঞাতনামা যুবকদের, বহু ভিটায় আবার চড়বে ঘুঘু।
এসব হচ্ছে গণতন্ত্রের স্বার্থে নয়, নির্বাচনে বিজয়ী না হতে পারার আশঙ্কা থেকে। কথাবার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনটা আওয়ামী লীগ নিজেই করতে ইচ্ছুক এবং নিজের নির্বাচন নিজে করলে ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হবে। সেই ফলাফল মেনে নেবে—বিএনপি এত বোকা নয়।
আওয়ামী লীগের একালের আমলা-ব্যবসায়ী-নেতারা এবং প্রাজ্ঞ নীতিনির্ধারকেরা একটি কথা স্মরণ রাখেন না যে, গত ৬২ বছরে আওয়ামী লীগ পাঁচবার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। একটি ছাড়া ওই নির্বাচনগুলোর কোনোটিই আওয়ামী লীগের অধীনে হয়নি। সুতরাং আজ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয় কী?
জনসমর্থন যদি থাকে, কোনো দলের বিজয়ই কোনো সরকার ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগ দুবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে প্রথম ভাসানীর নেতৃত্বে। তখন নির্বাচন কমিশনও ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে এবং আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯৭০-এর নির্বাচন করে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা। তারা মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামকে একটি আসনও উপহার দিতে পারেনি। ১৯৭৩-এ আওয়ামী লীগ নিজের নির্বাচন নিজে করেছিল এবং তা করে লাভ হলো এই যে তাকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হলো ২১ বছর। আমি ওই সময় বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ না করলে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫০টির বেশি আসন পেত। বহু মানুষ বিরক্ত হয়ে তাদের ভোট দেয়নি বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ থাকা সত্ত্বেও।
আমাদের ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রধান দলগুলোর অবস্থা হলো, পৃথিবীর কোনো পদ্ধতিই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি না তা তাদের বিজয় সুনিশ্চিত করে। এমন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি গঠিত হয়, যার প্রধান তারেক রহমান; কিন্তু তাতে বিএনপি বিজয়ী হবে ১৩২ আসনে, সে সরকার বেগম জিয়া মেনে নেবেন না। সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যদি আওয়ামী লীগের বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে না পারে এবং অন্তত ১৫০টি আসন পাইয়ে দিতে না পারে, সে সরকারের ওই দলের কোনো প্রয়োজন নেই। বড় দলের গণতন্ত্র হলো বিজয়ের গণতন্ত্র—পরাজয় বলে কোনো শব্দ তাদের অভিধানে নেই। আর থাকলেও সে শব্দটি প্রতিপক্ষের জন্য বরাদ্দ। আমার প্রতিপক্ষকে পরাজিত হতেই হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এখন চারদলীয় জোটের নেতারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মালকোঁচা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন যুদ্ধের ময়দানে। আবার ডাকও দেওয়া হচ্ছে আলোচনায় বসার জন্য। একই সঙ্গে চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচিত্র মামলা-মোকদ্দমা দায়ের হচ্ছে। বাকপ্রতিযোগিতার কথা বাদই দিলাম। এই অবস্থায় সমঝোতা হবে কী করে। সুতরাং সংঘাত অনিবার্য। শামসুর রাহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁকে আরেকটি কবিতা লিখতে অনুরোধ করতাম। শিরোনাম হতো: তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক। সে কবিতায় বলা হতো:
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
বাংলাদেশের মানুষ এখনো বাস করছে বন্দিশিবিরে। সেদিন এ দেশ ছিল হায়েনার খাঁচা। আজ খাঁচা নেই, হায়েনা আছে। চতুর্দিকে শ্বাপদের ভয়াল পদধ্বনি। আজ শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে নিজেই লিখতেন:
তুমি থাকবে বলে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর—
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
শাহবাগে সতেরোটি গাড়ি পোড়ে।
তোমাকে ধাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
কেউ ধাওয়া করে বিএনপি নেতাদের
প্রেসক্লাব, নয়াপল্টন, ফার্মগেটে—
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
হাসপাতালের মর্গ ভরে যায় লাশে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমরা ওই শাল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করায় কর্তৃপক্ষ আমাদের দোকানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। একটি মাইক্রোবাস ও একজন গাইড আমাদের দেওয়া হয়। পাঁচ-সাতজন আমরা একসঙ্গে যাই। আমাদের দলে ভারতীয় ও পাকিস্তানিও কয়েকজন ছিলেন। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সুন্দরী মহিলাও ছিলেন দুই-তিনজন। বিশেষভাবে মনে আছে একজনের কথা। তিনি হলেন ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মি. লিঙদো। অতি সজ্জন ও চমৎকার মানুষ। বিখ্যাত টি এন সেশান এবং এম এম গিলের পরে তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
দোকানে গিয়ে দেখি পর্যটকদের ভিড়। দোকানের কর্মচারীরা বিভিন্ন রকম পশমিনা বের করে দেখাচ্ছেন। পাঁচ-সাত শ নেপালি রুপি থেকে পাঁচ-সাত হাজার রুপি দামের পশমিনাও আছে। আরও বেশি দামের থাকতে পারে। কিনি বা না কিনি, আমরা নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম। পশ্চিম-দক্ষিণ ভারতীয় মধ্যবয়সী এক মহিলা অতি দামি পশমিনা ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। তাঁর মর্যাদা দোকানে খুব বেশি। তিনি কথাও বলছিলেন বেশি। তাঁর সব কথার জবাব দিতে দোকানি বাধ্য। খদ্দের রূপবতী বলে তাঁর কথার জবাব দেওয়াতেও আনন্দ। একপর্যায়ে তিনি জানতে চাইলেন, এ পশমিনা ভেড়ার কোথাকার লোমের তৈরি।
দোকানের যুবকটি বললেন, নেপালের উত্তরাঞ্চলের কোনো এলাকার।
ভদ্রমহিলা বললেন, না না, তা জানতে চাইনি। আমি জানতে চাইছি, এত মসৃণ লোম ভেড়ার শরীরের কোন অংশের।
এবার দোকানের যুবকটি বললেন, মাফ করবেন ম্যাডাম, বুঝতে পেরেছি। এ পশমিনাটি খুবই মূল্যবান লোমের। এ হলো ভেড়ার টেস্টিকল ও পেটের দিকের লোম থেকে তৈরি। এক আউন্স লোম সংগ্রহ করতে বহু ভেড়ার প্রয়োজন।
তাদের হিন্দিতে কথাবার্তা আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। যুবকটি যখন জানালেন, ওই পশমিনা ভেড়ার অণ্ডকোষের পশমে তৈরি, তখন ভদ্রমহিলা খুশি হলেন কি না বোঝা গেল না, কিন্তু তাঁর গোলাপের সামান্য ম্লান পাপড়ির মতো মুখমণ্ডলে এক কৃত্রিম কৌতুকের আভাস দেখা দিল। তাঁর স্বামী এতক্ষণ পাশে ছিলেন চুপচাপ এবং ভাবছিলেন মানিব্যাগের অবস্থা। এবার কথা বললেন এবং যা বললেন হিন্দিতে, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: তুমি যেখানে যাও সেখানেই সব ব্যাপারে বেশি কলকল করো। কী দরকার তোমার এত কিছু জানার?
আমি মনে মনে তাঁর উদ্দেশে বললাম, পঁচিশ-তিরিশ বছর যাবৎ এই কলকলানির মধ্যে আছেন। এখন কি আর তা থামবে? পাশে ছিলেন আমার বন্ধু বদিউল আলম মজুমদার। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, সম্ভব হলে এ জিনিস ভাবির জন্য একখানা নিয়ে যান।
বিধাতা আমাদের চেয়ে বেশি রসিক। তাঁর রসবোধ বিপুল। ওই সময় দোকানে আমরা না থেকে শিখ লেখক ও কলাম লেখক খুশবন্ত সিং থাকলে ভালো হতো। পশমিনা তৈরির কাঁচামালের উৎস বা উৎপন্ন স্থান সম্পর্কে ম্যাডামকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারতেন।
বাংলাদেশে আমরা কোনো একটা বিষয় পেলে হলো, তাকে শুধু ঘাঁটা নয়, একেবারে লেম্বু চেপা চিপতে থাকি। যে জিনিস কম কথা খরচ করে এবং বেশি মাথা খাটিয়ে সহজেই সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে উত্তাল ঝড় ওঠে। কিছুদিন যাবৎ সংবিধান সংশোধন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি রাখা না-রাখা নিয়ে শুরু হয়েছে তা-ই। এসব ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে বাংলাদেশে নেমে আসবে সিডর এবং তাতে সিডরবিধ্বস্ত দক্ষিণ বাংলার মতো গোটা বাংলাদেশে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে; যার ধ্বংসলীলার রেশ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না ১০ বছরেও।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে সংবিধান পুনর্লিখন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি বাতিলের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তাতে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেসব এখন শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব লিখিত অঙ্গীকার ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেদিন মনে মনে যে অঙ্গীকার বা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, তা-ই বাস্তবায়নে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। রাজনীতির ময়দানে এখন উড়ছে এমন ধুলা, যা আমাদের দুটি চোখই অন্ধকার করে দিচ্ছে। শুধু দুটি চোখই নয়, বিবেক নামক যে আর একটি অদৃশ্য চোখ রয়েছে, তাকেও দিয়েছে অন্ধ করে। যখন কেউ যুক্তিবিবর্জিত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে, তখন কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। খাদের ভেতরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
আগামী নির্বাচন ঠিক সময় যদি হয়, তাহলে তা হবে অন্তত আড়াই বছর পরে। বিএনপির নেতারা যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছেন এবং সরকারের পদত্যাগ চাইছেন, তা ঘুমের ঘোরে কথা বলার মতো। সংসদে তাঁদের আসনসংখ্যা অতি কম। তাঁরা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারবেন না। সরকার পদত্যাগ করলে তবেই তো মধ্যবর্তী নির্বাচন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেন সরকার পদত্যাগ করবে? অবশ্য এক আওয়ামী লীগ নেতাই ভালো বলেছেন, বেশি হইচই করলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এক মাস বেশি ক্ষমতায় থাকবেন। ল্যাকটোজেন খাওয়া ছোট বাবুদের মতো কথাবার্তা। এসব কথা উপভোগ করা যায়, তবে ভোগ করতে হয় একপর্যায়ে গিয়ে অশেষ দুর্ভোগ।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের কথা ছেড়ে দিলাম। সেটি ছিল সমঝোতামূলক অন্য রকম নির্দলীয় সরকার। যত দূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরও বিজয়ী দল বিএনপির নেতা নাজমুল হুদা তাঁকে এমন ঘাই দিয়েছিলেন যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে আমি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। ব্যারিস্টার সাহেব এই কথা বলেছিলেন যে, ‘মাননীয় বিচারপতির ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা নাই।’ এই অপবাদে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। ঘটনাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো—এ দেশে কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না। উপকার করলেও করে না, অপকার করলে তো কথাই নেই। শুধু মাগুরার উপনির্বাচন নয়, ওই অবিশ্বাস থেকেই তত্ত্বাবধায়কের জন্ম এবং জন্মদাতা আওয়ামী লীগ। এখন আওয়ামী লীগ সন্তান হত্যায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
নেতারা এত দিন মুখে মুখে বলছিলেন কিন্তু সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি রোববার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংসদে সুপারিশ পেশ করেছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক আর থাকছে না। যে ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে ১৯৯৫-৯৬ সালে, যার জন্য এখন ঘুঘু চড়ে বহু ভিটায়, যার জন্য প্রাণ গেছে সংখ্যাহীন মানুষের, সেই ব্যবস্থার এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের কাছে। ওই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন যাঁরা, এখন তাঁদের কাছে দেখা দিয়েছে তার অপরিহার্যতা এবং ওই ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে রিহার্সেল। আবার প্রাণ যাবে অজ্ঞাতনামা যুবকদের, বহু ভিটায় আবার চড়বে ঘুঘু।
এসব হচ্ছে গণতন্ত্রের স্বার্থে নয়, নির্বাচনে বিজয়ী না হতে পারার আশঙ্কা থেকে। কথাবার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনটা আওয়ামী লীগ নিজেই করতে ইচ্ছুক এবং নিজের নির্বাচন নিজে করলে ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হবে। সেই ফলাফল মেনে নেবে—বিএনপি এত বোকা নয়।
আওয়ামী লীগের একালের আমলা-ব্যবসায়ী-নেতারা এবং প্রাজ্ঞ নীতিনির্ধারকেরা একটি কথা স্মরণ রাখেন না যে, গত ৬২ বছরে আওয়ামী লীগ পাঁচবার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। একটি ছাড়া ওই নির্বাচনগুলোর কোনোটিই আওয়ামী লীগের অধীনে হয়নি। সুতরাং আজ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয় কী?
জনসমর্থন যদি থাকে, কোনো দলের বিজয়ই কোনো সরকার ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগ দুবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে প্রথম ভাসানীর নেতৃত্বে। তখন নির্বাচন কমিশনও ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে এবং আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯৭০-এর নির্বাচন করে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা। তারা মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামকে একটি আসনও উপহার দিতে পারেনি। ১৯৭৩-এ আওয়ামী লীগ নিজের নির্বাচন নিজে করেছিল এবং তা করে লাভ হলো এই যে তাকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হলো ২১ বছর। আমি ওই সময় বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ না করলে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫০টির বেশি আসন পেত। বহু মানুষ বিরক্ত হয়ে তাদের ভোট দেয়নি বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ থাকা সত্ত্বেও।
আমাদের ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রধান দলগুলোর অবস্থা হলো, পৃথিবীর কোনো পদ্ধতিই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি না তা তাদের বিজয় সুনিশ্চিত করে। এমন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি গঠিত হয়, যার প্রধান তারেক রহমান; কিন্তু তাতে বিএনপি বিজয়ী হবে ১৩২ আসনে, সে সরকার বেগম জিয়া মেনে নেবেন না। সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যদি আওয়ামী লীগের বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে না পারে এবং অন্তত ১৫০টি আসন পাইয়ে দিতে না পারে, সে সরকারের ওই দলের কোনো প্রয়োজন নেই। বড় দলের গণতন্ত্র হলো বিজয়ের গণতন্ত্র—পরাজয় বলে কোনো শব্দ তাদের অভিধানে নেই। আর থাকলেও সে শব্দটি প্রতিপক্ষের জন্য বরাদ্দ। আমার প্রতিপক্ষকে পরাজিত হতেই হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এখন চারদলীয় জোটের নেতারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মালকোঁচা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন যুদ্ধের ময়দানে। আবার ডাকও দেওয়া হচ্ছে আলোচনায় বসার জন্য। একই সঙ্গে চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচিত্র মামলা-মোকদ্দমা দায়ের হচ্ছে। বাকপ্রতিযোগিতার কথা বাদই দিলাম। এই অবস্থায় সমঝোতা হবে কী করে। সুতরাং সংঘাত অনিবার্য। শামসুর রাহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁকে আরেকটি কবিতা লিখতে অনুরোধ করতাম। শিরোনাম হতো: তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক। সে কবিতায় বলা হতো:
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
বাংলাদেশের মানুষ এখনো বাস করছে বন্দিশিবিরে। সেদিন এ দেশ ছিল হায়েনার খাঁচা। আজ খাঁচা নেই, হায়েনা আছে। চতুর্দিকে শ্বাপদের ভয়াল পদধ্বনি। আজ শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে নিজেই লিখতেন:
তুমি থাকবে বলে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর—
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
শাহবাগে সতেরোটি গাড়ি পোড়ে।
তোমাকে ধাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
কেউ ধাওয়া করে বিএনপি নেতাদের
প্রেসক্লাব, নয়াপল্টন, ফার্মগেটে—
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে তত্ত্বাবধায়ক,
হাসপাতালের মর্গ ভরে যায় লাশে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments