নিশ্চিহ্ন হওয়াই কি বধ্যভূমির নিয়তি by মমিনুল ইসলাম মঞ্জু
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বয়সে একেবারে তরুণ। মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে আসছেন। এখন তাকে সভা-সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা দিতে হয়। বক্তৃতাও দেন গর্বের সঙ্গে। কেননা মুক্তিযুদ্ধে তার ইউনিয়নের মানুষের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি ছিল হাতিয়ায়। এই ঘাঁটি থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা চিলমারী, উলিপুর এবং কুড়িগ্রামে পাক বাহিনীর ওপর হামলা চালাত। এ ঘাঁটিটি ধ্বংস করতে স্থানীয় পিস কমিটির ৩ সদস্য_ দিঘলহাইল্যা গ্রামের ডা. বাবর আলী, অনন্তপুর গ্রামের মাওলানা আবদুল মজিদ ও হাতিয়া ভবেশ গ্রামের মাওলানা আকবর আলীর প্ররোচনা এবং সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর এই ইউনিয়নে অপারেশন চালায়। এই অপারেশন 'হাতিয়া অপারেশন' নামে পরিচিত। এ অপারেশনে পাক বাহিনী হাতিয়া এবং এর লাগোয়া বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের ৬৯৭ জন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে দাগারকুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আগুন দিয়ে পুড়ে দেয় শত শত বাড়িঘর। ধর্ষণ করে অনেক মা-বোনকে। দু'দিন পর সব শহীদের লাশ এই দাগারকুটিতে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। এদিন পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন গুলজার হোসেন, নওয়াব আলী, আবুল কাশেম কাচু, দেলওয়ার হোসেন, হিতেন্দ্রনাথ ও আবু বকর সিদ্দিক নামে ৬ মুক্তিযোদ্ধা।
এই বধ্যভূমিটি এখন নেই। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান আবুল হোসেন দুঃখ এবং ক্ষোভের সঙ্গে জানান, রংপুর বিভাগের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ও গণকবরটি নদীভাঙনে শুধু বিলীন হয়নি, ইতিহাসের পাতা থেকেও মুছে ফেলা হয়েছে। বধ্যভূমি এবং গণকবরের তালিকায় হাতিয়ার দাগারকুটির নাম তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। শহীদদের মধ্যে ৪১২ জনের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তা সংরক্ষণ এবং অবশিষ্টদের নাম উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শুধু দাগারকুটিই নয়, কুড়িগ্রামের ৭ উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৮টি গণকবর ও বধ্যভূমির মধ্যে ২৪টি এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগার চত্বরের প্রাচীরের পাশে রয়েছে জেলার প্রথম শহীদ ৪ কারারক্ষীর গণকবর। এখন জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। সংরক্ষণ করা দূরে থাক, কোনোদিন জঙ্গল কেটে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের নীলুর খামারে রয়েছে ৭৯ জনের গণকবর। এই গণকবরে এখন হলুদ-আদার চাষ হচ্ছে। সদরের কাঁঠালবাড়ীতে গণহত্যার শিকার ৩৫ জনের গণকবর এখন চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ভুরুঙ্গামারী উপজেলার জয়মনিরহাট মসজিদের সামনে শহীদ লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আসফাকুস সামাদ বীরউত্তমসহ (মরণোত্তর) ৪ বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এলজিইডির স্থানীয় দফতর ২০১১ সালের প্রথম দিকে অনুসন্ধান করে ৭ উপজেলায় ২৮টি গণকবর ও বধ্যভূমি মানচিত্রে চিহ্নিত করে তার তালিকা প্রণয়ন করে। এগুলো হচ্ছে_ উলিপুরের দাগারকুটি, রেলওয়ে স্টেশন, যমুনা বেপারীপাড়া, আনন্দবাজার ও বাকারা; রাজারহাটের ঠাঠমারী, নাকেন্দা ও সেনপাড়া; ভুরুঙ্গামারীর আন্ধারীরঝাড় বাজার; জয়মনিরহাটের সেকেন্দার চৌধুরীর বাড়ি, বাস টার্মিনাল, টিঅ্যান্ডটি অফিস চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা অফিস চত্বর ও জয়মনিরহাট বাজার জামে মসজিদ এলাকা এবং সদরের জেলা কারাগার চত্বর; নাগেশ্বরীর নীলুর খামার, চণ্ডীপুর, থানা চত্বর, পয়রাডাঙ্গা নামদানীটারী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা, হাসনাবাদ, চর বেরুবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, হাসপাতাল চত্বর, বেপারীরহাট বাসস্ট্যান্ড, সরবেশ আলীর বাড়ি, বালাটারী ও বেটটারী; চিলমারীর বালাবাড়ী হাট রেলওয়ে স্টেশন ও রমনাঘাট এবং রাজীবপুরের সাজাই ইসাহাক মাওলানার বাড়ি ও শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ। এগুলোর মধ্যে নাগেশ্বরীর চণ্ডীপুর, রাজারহাটের ঠাটমারী এবং উলিপুরের দাগারকুটি গণকবর ও বধ্যভূমির স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। এ ছাড়াও চিলমারীর বালাবাড়ী স্টেশনের লাগোয়া বধ্যভূমি ও গণকবরে 'মুক্তিযুদ্ধকালীন উলেল্গখযোগ্য ঐতিহাসিক সম্মুখ সমরের স্থানগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে'র আওতায় গণপূর্ত বিভাগ প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ করছে ঢিমেতালে দু'বছর ধরে। কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
এখনও সময় আছে এই গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করার। আর তা করা সম্ভব না হলে হয়তো একদিন এগুলোতে গড়ে উঠবে বসতভিটা, নয়তো পরিণত হবে আবাদি জমিতে। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এগুলো। আগামী প্রজন্ম আর জানতে পারবে না পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে মানুষের আত্মত্যাগের কথা।
মমিনুল ইসলাম মঞ্জু : কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি, সমকাল
এই বধ্যভূমিটি এখন নেই। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান আবুল হোসেন দুঃখ এবং ক্ষোভের সঙ্গে জানান, রংপুর বিভাগের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ও গণকবরটি নদীভাঙনে শুধু বিলীন হয়নি, ইতিহাসের পাতা থেকেও মুছে ফেলা হয়েছে। বধ্যভূমি এবং গণকবরের তালিকায় হাতিয়ার দাগারকুটির নাম তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। শহীদদের মধ্যে ৪১২ জনের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তা সংরক্ষণ এবং অবশিষ্টদের নাম উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শুধু দাগারকুটিই নয়, কুড়িগ্রামের ৭ উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৮টি গণকবর ও বধ্যভূমির মধ্যে ২৪টি এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগার চত্বরের প্রাচীরের পাশে রয়েছে জেলার প্রথম শহীদ ৪ কারারক্ষীর গণকবর। এখন জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। সংরক্ষণ করা দূরে থাক, কোনোদিন জঙ্গল কেটে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের নীলুর খামারে রয়েছে ৭৯ জনের গণকবর। এই গণকবরে এখন হলুদ-আদার চাষ হচ্ছে। সদরের কাঁঠালবাড়ীতে গণহত্যার শিকার ৩৫ জনের গণকবর এখন চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ভুরুঙ্গামারী উপজেলার জয়মনিরহাট মসজিদের সামনে শহীদ লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আসফাকুস সামাদ বীরউত্তমসহ (মরণোত্তর) ৪ বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এলজিইডির স্থানীয় দফতর ২০১১ সালের প্রথম দিকে অনুসন্ধান করে ৭ উপজেলায় ২৮টি গণকবর ও বধ্যভূমি মানচিত্রে চিহ্নিত করে তার তালিকা প্রণয়ন করে। এগুলো হচ্ছে_ উলিপুরের দাগারকুটি, রেলওয়ে স্টেশন, যমুনা বেপারীপাড়া, আনন্দবাজার ও বাকারা; রাজারহাটের ঠাঠমারী, নাকেন্দা ও সেনপাড়া; ভুরুঙ্গামারীর আন্ধারীরঝাড় বাজার; জয়মনিরহাটের সেকেন্দার চৌধুরীর বাড়ি, বাস টার্মিনাল, টিঅ্যান্ডটি অফিস চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা অফিস চত্বর ও জয়মনিরহাট বাজার জামে মসজিদ এলাকা এবং সদরের জেলা কারাগার চত্বর; নাগেশ্বরীর নীলুর খামার, চণ্ডীপুর, থানা চত্বর, পয়রাডাঙ্গা নামদানীটারী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা, হাসনাবাদ, চর বেরুবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, হাসপাতাল চত্বর, বেপারীরহাট বাসস্ট্যান্ড, সরবেশ আলীর বাড়ি, বালাটারী ও বেটটারী; চিলমারীর বালাবাড়ী হাট রেলওয়ে স্টেশন ও রমনাঘাট এবং রাজীবপুরের সাজাই ইসাহাক মাওলানার বাড়ি ও শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ। এগুলোর মধ্যে নাগেশ্বরীর চণ্ডীপুর, রাজারহাটের ঠাটমারী এবং উলিপুরের দাগারকুটি গণকবর ও বধ্যভূমির স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। এ ছাড়াও চিলমারীর বালাবাড়ী স্টেশনের লাগোয়া বধ্যভূমি ও গণকবরে 'মুক্তিযুদ্ধকালীন উলেল্গখযোগ্য ঐতিহাসিক সম্মুখ সমরের স্থানগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে'র আওতায় গণপূর্ত বিভাগ প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ করছে ঢিমেতালে দু'বছর ধরে। কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
এখনও সময় আছে এই গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করার। আর তা করা সম্ভব না হলে হয়তো একদিন এগুলোতে গড়ে উঠবে বসতভিটা, নয়তো পরিণত হবে আবাদি জমিতে। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এগুলো। আগামী প্রজন্ম আর জানতে পারবে না পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে মানুষের আত্মত্যাগের কথা।
মমিনুল ইসলাম মঞ্জু : কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি, সমকাল
No comments