বিদ্যুতের সংকট, বৈষম্য-উত্তরাঞ্চলের বোরো চাষিরা বিপাকে by পরিমল মজুমদার আনু মোস্তফা ও রফিকুল ইসলাম
দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি চলছে বৈষম্য। চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগও সরবরাহ না থাকায় পরিস্থিতি 'ভয়ংকর' আকার ধারণ করেছে। রাজশাহীর দুটি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় এ সংকট কাটানো যাচ্ছে না।
শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ কম হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এ পরিস্থিতিতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (লোড ম্যানেজমেন্ট) সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিকে কর্মকর্তারা বিপর্যয় বলে জানিয়েছেন।
সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহে বৈষম্যের কারণে বিপাকে পড়েছেন বোরো চাষিরা। সেচের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে বোরো ক্ষেত।
জানা যায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেয়ে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সড়ক অবরোধ, অফিস ভাঙচুর ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) উত্তরাঞ্চলের সদর দপ্তর রাজশাহীর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার অঞ্চলের আট জেলায় বিদ্যুতের দৈনিক গড় চাহিদা ৬০০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় (বিকেল ৩টা পর্যন্ত) ২১৮ মেগাওয়াট (৭ মার্চ)। এ অবস্থায় লোড ম্যানেজমেন্টের যে ব্যবস্থায় আমরা আগে পরিস্থিতি সামাল দিতাম, সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না।'
পিডিবির এ কর্মকর্তা জানান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে লোকজন ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
সংকট ও বৈষম্য : 'রংপুর পিক আওয়ারে (বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা) চাহিদা ৩২ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাই ১১ মেগাওয়াট- চাহিদার ৪০ শতাংশেরও কম। এখন বুঝে নেন, এই ছয় ঘণ্টায় কতটুকু বিদ্যুৎ পায় আমার গ্রাহক।' এমন খেদোক্তি করলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রংপুরের মহাব্যবস্থাপক কাজী মোহাম্মদ আলী। তাঁর এই খেদোক্তির বিপরীত চিত্র পাওয়া গেল রংপুর শহরে। শহরের ধাপ এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট অশোক চক্রবর্তী জানান, গত এক সপ্তাহে এখানে প্রতিদিন এক ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য লোডশেডিং হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি অভিযোগ করেছে, বিদ্যুতের এ পরিস্থিতিতেও পিডিবি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় তাদের সঙ্গে মারাত্মক বৈষম্য করছে। ফলে পিক আওয়ারে শহরগুলোতে পিডিবির লাইনে বিদ্যুতের সরবরাহ বেশ থাকছে, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে পল্লী বিদ্যুতের লাইনগুলো। কোনো কোনো উপজেলায় সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত দুই দফায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর রাতে তিন দফায় তিন ঘণ্টার মতো পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের এ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন গড়ে ১৫টি সেচপাম্পে পুনঃসংযোগ দেওয়ায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে শুধু তাদের ফিডারগুলোতেই বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু তারা সেচ ও পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ পাচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে খুব বেশি হলে ১২০ মেগাওয়াট। নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা মোট বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ পল্লী বিদ্যুৎকে এবং ৪০ শতাংশ পিডিবিকে বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু তা মোটেও মানা হচ্ছে না বলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও মহাব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
রংপুর বিভাগের জেলাগুলো হলো রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও।
পিডিবির রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর অফিস সূত্রে জানা গেছে, সেচ মৌসুমে এ অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ৩৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে।
রাজশাহী বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী নগরীতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩৫ মেগাওয়াট (৭ মার্চ)। কিন্তু সরবরাহ ছিল ১৯ মেগাওয়াট। অন্যদিকে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুতের আওতায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩৭ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ ছিল ১৬ মেগাওয়াট। গোটা রাজশাহী জেলায় মোট চাহিদা ৭৫ মেগাওয়াটের স্থলে সরবরাহ পাওয়া গেছে মাত্র ৩৭ মেগাওয়াট। একইভাবে নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলেও চাহিদার অর্ধেকের কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ বিভাগের অন্য জেলা সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাটেও একই চিত্র।
জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (বিতরণ) আবদুল ওয়াহাব খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। আর এ কারণে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে চলমান সেচ মৌসুম ও জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে, রাজশাহীর ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের প্রায় চার মাস পরও পুরোপুরি উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। কেন্দ্রটির ছয়টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে বিরতি দিয়ে তিনটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তাও সার্বক্ষণিক নয়। কেন্দ্রটি করেছেন রাজশাহী-৬ (বাগমারা) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সংসদ এনামুল হক।
অন্যদিকে উদ্বোধনের প্রায় ১১ মাস পরও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই দুটি কেন্দ্র উদ্বোধনের দিন থেকেই পুরো উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
রাজশাহীর ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সলিউশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত ২০-২৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে দিচ্ছেন তাঁরা। পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যেতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে বলে পিডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, ফার্নেস অয়েলের জোগান অনিয়মিত হওয়ায় মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ কেন্দ্রটির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সিনহা পাওয়ার লিমিটেডের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
বিপাকে কৃষক : বিদ্যুতের অভাবে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নীলফামারী জেলার কৃষক। এখানে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নীলফামারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক এস এম হাবিবুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, ২৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ছয় থেকে সাত মেগাওয়াট। তিনি আশঙ্কা করে বলেন, সামনে গ্রীষ্মকাল। তখন পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে দিতে হবে। এরপর ঘরে ঘরে পাখা ঘোরা শুরু হলে এ পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত একর জমির বোরো চারা পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোথাও কোথাও সবুজ চারা বিবর্ণ হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুরের সাত দরগা গ্রামের কৃষক সাত্তার মিয়া জানান, তিনি সেচপাম্পের আওতায় নিজেরসহ অন্যের প্রায় ১০ একর জমিতে সেচ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বিদ্যুৎ আসে- কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো আধা ঘণ্টার জন্য। দুই একর জমিতে পানি দিলে আট একর জমি শুকনো পড়ে থাকে।
লালমনিরহাট জেলার তিস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একই সেচপাম্পের আওতায় থাকা জমির কোথাও পানি আছে, কোথাও নেই। এমনই এক জমির মালিক সুরুজ্জামান মিয়া বলেন, বিদ্যুৎ না পেলে অর্ধেক ফসলও ঘরে ওঠার সম্ভাবনা নেই। একই কথা জানালেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নব্দীগঞ্জের কৃষক জহুরুল হক ও নব্দীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস সালাম মিয়া।
কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, সেচের এই দুর্দশা দেখার জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সম্প্রতি কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট এলাকা ঘুরে গেছেন।
অন্যদিকে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুতের মহাব্যবস্থাপক সারোয়ার হোসেন বলেন, 'আমার সমিতি এলাকায় কয়েক হাজার সেচপাম্প রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় দিনের বেলায় পাম্পগুলো চালানো যাচ্ছে না। ফলে বোরো আবাদে সেচের সংকট কিছুটা বেড়েছে।' তবে এখন পর্যন্ত অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি দাবি করেন।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বিদ্যুৎচালিত ২৬ হাজার ৩০০ গভীর নলকূপসহ ৫০ হাজারের বেশি সেচযন্ত্র প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু বলেন, উত্তরাঞ্চলে বিএমডিএর সাড়ে ২০ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে এগুলো ছয় ঘণ্টার বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, সেচ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিএমডিএর পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজশাহী জেলায় এবার চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে ৭৫ হাজার ১৮৩ হেক্টরে জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে চাষ হয়েছে (৪ মার্চ পর্যন্ত) ৭৪ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত জেলায় ধান চাষ হবে। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলেও আশা করা হচ্ছে। তবে এখনই জেলার প্রায় সব কটি উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এত করে বোরো চাষ নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এই অবস্থা আরো প্রকট হলে বোরো চাষ ব্যাহত হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহে বৈষম্যের কারণে বিপাকে পড়েছেন বোরো চাষিরা। সেচের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে বোরো ক্ষেত।
জানা যায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেয়ে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সড়ক অবরোধ, অফিস ভাঙচুর ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) উত্তরাঞ্চলের সদর দপ্তর রাজশাহীর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার অঞ্চলের আট জেলায় বিদ্যুতের দৈনিক গড় চাহিদা ৬০০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় (বিকেল ৩টা পর্যন্ত) ২১৮ মেগাওয়াট (৭ মার্চ)। এ অবস্থায় লোড ম্যানেজমেন্টের যে ব্যবস্থায় আমরা আগে পরিস্থিতি সামাল দিতাম, সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না।'
পিডিবির এ কর্মকর্তা জানান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে লোকজন ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
সংকট ও বৈষম্য : 'রংপুর পিক আওয়ারে (বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা) চাহিদা ৩২ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাই ১১ মেগাওয়াট- চাহিদার ৪০ শতাংশেরও কম। এখন বুঝে নেন, এই ছয় ঘণ্টায় কতটুকু বিদ্যুৎ পায় আমার গ্রাহক।' এমন খেদোক্তি করলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রংপুরের মহাব্যবস্থাপক কাজী মোহাম্মদ আলী। তাঁর এই খেদোক্তির বিপরীত চিত্র পাওয়া গেল রংপুর শহরে। শহরের ধাপ এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট অশোক চক্রবর্তী জানান, গত এক সপ্তাহে এখানে প্রতিদিন এক ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য লোডশেডিং হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি অভিযোগ করেছে, বিদ্যুতের এ পরিস্থিতিতেও পিডিবি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় তাদের সঙ্গে মারাত্মক বৈষম্য করছে। ফলে পিক আওয়ারে শহরগুলোতে পিডিবির লাইনে বিদ্যুতের সরবরাহ বেশ থাকছে, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে পল্লী বিদ্যুতের লাইনগুলো। কোনো কোনো উপজেলায় সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত দুই দফায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর রাতে তিন দফায় তিন ঘণ্টার মতো পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের এ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন গড়ে ১৫টি সেচপাম্পে পুনঃসংযোগ দেওয়ায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে শুধু তাদের ফিডারগুলোতেই বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু তারা সেচ ও পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ পাচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে খুব বেশি হলে ১২০ মেগাওয়াট। নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা মোট বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ পল্লী বিদ্যুৎকে এবং ৪০ শতাংশ পিডিবিকে বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু তা মোটেও মানা হচ্ছে না বলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও মহাব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
রংপুর বিভাগের জেলাগুলো হলো রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও।
পিডিবির রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর অফিস সূত্রে জানা গেছে, সেচ মৌসুমে এ অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ৩৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে।
রাজশাহী বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী নগরীতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩৫ মেগাওয়াট (৭ মার্চ)। কিন্তু সরবরাহ ছিল ১৯ মেগাওয়াট। অন্যদিকে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুতের আওতায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩৭ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ ছিল ১৬ মেগাওয়াট। গোটা রাজশাহী জেলায় মোট চাহিদা ৭৫ মেগাওয়াটের স্থলে সরবরাহ পাওয়া গেছে মাত্র ৩৭ মেগাওয়াট। একইভাবে নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলেও চাহিদার অর্ধেকের কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ বিভাগের অন্য জেলা সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাটেও একই চিত্র।
জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (বিতরণ) আবদুল ওয়াহাব খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। আর এ কারণে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে চলমান সেচ মৌসুম ও জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে, রাজশাহীর ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের প্রায় চার মাস পরও পুরোপুরি উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। কেন্দ্রটির ছয়টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে বিরতি দিয়ে তিনটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তাও সার্বক্ষণিক নয়। কেন্দ্রটি করেছেন রাজশাহী-৬ (বাগমারা) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সংসদ এনামুল হক।
অন্যদিকে উদ্বোধনের প্রায় ১১ মাস পরও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই দুটি কেন্দ্র উদ্বোধনের দিন থেকেই পুরো উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
রাজশাহীর ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সলিউশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত ২০-২৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে দিচ্ছেন তাঁরা। পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যেতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে বলে পিডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, ফার্নেস অয়েলের জোগান অনিয়মিত হওয়ায় মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ কেন্দ্রটির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সিনহা পাওয়ার লিমিটেডের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
বিপাকে কৃষক : বিদ্যুতের অভাবে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নীলফামারী জেলার কৃষক। এখানে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নীলফামারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক এস এম হাবিবুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, ২৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ছয় থেকে সাত মেগাওয়াট। তিনি আশঙ্কা করে বলেন, সামনে গ্রীষ্মকাল। তখন পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে দিতে হবে। এরপর ঘরে ঘরে পাখা ঘোরা শুরু হলে এ পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত একর জমির বোরো চারা পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোথাও কোথাও সবুজ চারা বিবর্ণ হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুরের সাত দরগা গ্রামের কৃষক সাত্তার মিয়া জানান, তিনি সেচপাম্পের আওতায় নিজেরসহ অন্যের প্রায় ১০ একর জমিতে সেচ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বিদ্যুৎ আসে- কখনো এক ঘণ্টা আবার কখনো আধা ঘণ্টার জন্য। দুই একর জমিতে পানি দিলে আট একর জমি শুকনো পড়ে থাকে।
লালমনিরহাট জেলার তিস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একই সেচপাম্পের আওতায় থাকা জমির কোথাও পানি আছে, কোথাও নেই। এমনই এক জমির মালিক সুরুজ্জামান মিয়া বলেন, বিদ্যুৎ না পেলে অর্ধেক ফসলও ঘরে ওঠার সম্ভাবনা নেই। একই কথা জানালেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নব্দীগঞ্জের কৃষক জহুরুল হক ও নব্দীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস সালাম মিয়া।
কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, সেচের এই দুর্দশা দেখার জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সম্প্রতি কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট এলাকা ঘুরে গেছেন।
অন্যদিকে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুতের মহাব্যবস্থাপক সারোয়ার হোসেন বলেন, 'আমার সমিতি এলাকায় কয়েক হাজার সেচপাম্প রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় দিনের বেলায় পাম্পগুলো চালানো যাচ্ছে না। ফলে বোরো আবাদে সেচের সংকট কিছুটা বেড়েছে।' তবে এখন পর্যন্ত অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি দাবি করেন।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বিদ্যুৎচালিত ২৬ হাজার ৩০০ গভীর নলকূপসহ ৫০ হাজারের বেশি সেচযন্ত্র প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু বলেন, উত্তরাঞ্চলে বিএমডিএর সাড়ে ২০ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে এগুলো ছয় ঘণ্টার বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, সেচ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিএমডিএর পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজশাহী জেলায় এবার চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে ৭৫ হাজার ১৮৩ হেক্টরে জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে চাষ হয়েছে (৪ মার্চ পর্যন্ত) ৭৪ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত জেলায় ধান চাষ হবে। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলেও আশা করা হচ্ছে। তবে এখনই জেলার প্রায় সব কটি উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এত করে বোরো চাষ নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এই অবস্থা আরো প্রকট হলে বোরো চাষ ব্যাহত হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
No comments