মেডিক্যাল শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ by ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল

কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কী আন্ডারগ্রাজুয়েট কিংবা পোস্টগ্রাজুয়েট! এক কথায় মেডিক্যাল শিক্ষা আজ ধ্বংসের পথে। মানব শরীর নিয়ে যাঁদের কাজ তাঁরা যদি যেনতেন হন তাহলে কী হবে? সৃষ্টির সেরা মানুষ, আর এ মানুষের যাঁরা চিকিৎসা দেবেন তাঁদের হওয়া উচিত সবচেয়ে মেধাবী ও চৌকস।

পৃথিবীর সব দেশেই মেডিক্যাল শিক্ষা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে। এখানে কোনো ছাড় নেই। কারণ এর ব্যত্যয় ঘটলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য, সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে কখন না ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমাদের দেশে মেডিক্যাল শিক্ষার বেহাল অবস্থা। যার যা খুশি তাই করছে। ইচ্ছামতো প্রাইভেট মেডিক্যাল খুলছে, এটা দারুণ একটা ব্যবসা। আমার এক বন্ধু কোনো এক প্রাইভেট মেডিক্যালের লেকচারার থাকার সময় তার প্রফেসর এক স্টুডেন্টকে অনার্স (৭৫ শতাংশ) মার্ক দেয়, আমার বন্ধু অবাক হয়ে তার স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার একই ছাত্র একই পরীক্ষা ঢাকা মেডিক্যালে বসে দিলে তাকে পাস করাতেন কি না? প্রফেসর বললেন, কী করব বল, এ তো কিছু পেরেছে, অন্যরা তো কিছুই পারেনি। চিন্তা করেন আমরা কী সর্বনাশ করছি এ জাতির! প্রাইভেট মেডিক্যালের অগ্রযাত্রা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। এর পেছনে অনেক কারণ। আরো আছে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের স্যারদের অবসর গ্রহণের পর প্রাইভেট মেডিক্যালে যোগদানের খায়েশ। তাই তো দেশের সেরা সন্তানদেরই মেডিক্যালে পড়তে আসা উচিত। সেরা ছাত্ররাই মেডিক্যালে পড়ার বাসনা ও যোগ্যতা রাখেন এবং চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়রে নিয়তি, পড়াশোনা করে কি আর মেডিক্যালে চান্স পাওয়া যায়! চান্স পেতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা দিতে হয়। কী বিচিত্র এই দেশ! অত্যন্ত লজ্জা ও উৎকণ্ঠার বিষয় এই যে প্রায় প্রতিবারই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে ও অযোগ্য ছাত্ররা মেডিক্যালে এসে স্বাস্থ্য শিক্ষার বারোটা বাজাচ্ছেন। এর প্রভাব সমাজে ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে, অদূর ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ তা মহামারি রূপ ধারণ করবে। এই চিকিৎসকরাই ভবিষ্যতে আমাদের সবার চিকিৎসা করবেন। বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পোস্টগ্রাজুয়েট কোর্স চালু করে অভূতপূর্ব এক অধ্যায়ের সূচনা করে। এ রকম দৃষ্টান্ত অতীতে কেউ দেখাতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষায় এমন দুর্নীতি কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এক শ ভাগ দুর্নীতি বললেও ভুল হবে। যে বিষয়ের কোনো সার্কুলার হয়নি বা কেউ পরীক্ষাও দেয়নি সে বিষয়েও দলীয় ক্যাডাররা চান্স পেয়েছে। যত রকম দুর্নীতি হওয়া সম্ভব সব ধরনের দুর্নীতিই এখানে হয়েছে, আজও তার ধারাবাহিকতা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এঁরা অনেকেই পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করে ফেলেছেন ক্ষমতার জোরে। এঁরাই দেশের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসেবার কর্ণধার। যে জাতি তার মেধাবী সন্তানদের মূল্যায়ন করে না, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। বর্তমানে এ দেশে পয়সা আর রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রায় সব হচ্ছে, মেধার কোনো মূল্য নেই। ভর্তি, চাকরি, পোস্টিং, প্রমোশন- কোনো কিছুতেই মেধার অণু পরিমাণ মূল্যায়নও নেই। যে যত বেশি ক্ষমতাবান তাঁর পোস্টিং তত ভালো জায়গায়। তাই দেশের শীর্ষ মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো আজ দলীয় লোকের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এখানে পড়াশোনা বাদ দিয়ে অসুস্থ রাজনীতির পরিচর্যা চলছে। এমবিবিএস শিক্ষার অবস্থা খুবই খারাপ, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ ও পোস্টিং ইত্যাদি। তা ছাড়া একই শিক্ষক এমবিবিএস ও পোস্টগ্রাজুয়েটের ক্লাস নেন বলে এমবিবিএসের ক্লাস নেওয়ার সময় পান না তাঁরা। যে এমবিবিএস হলো মেডিক্যাল শিক্ষার ভিত্তি, সেই এমবিবিএস আজ চরম অবহেলিত। ফলে যেসব ডাক্তার বের হচ্ছেন তাঁদের অবস্থা খুবই নাজুক। তাঁদের দোষ সামান্যই, তাঁরা সিস্টেমের শিকার। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।' মেডিক্যাল শিক্ষার ওপর এমনি এক ঘা বসানোর পাঁয়তারা করছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ধুয়া তুলে ধ্বংস করতে চাইছে এ দেশের সর্বজনস্বীকৃত, সবার সমাদৃত, সারা বিশ্ব সমাদৃত, সময়োত্তীর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী কিছু মেডিক্যাল কলেজকে। এমনিতেই এগুলোর অবস্থা শোচনীয়, এর ওপর ইউনিভার্সিটি নাম দিয়ে এগুলোর ধারাবাহিকতা নষ্ট করে এমবিবিএস কোর্সকে আরো ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার হোলিখেলায় মত্ত স্বার্থান্বেষী মহল। এসব স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানকে ইউনিভার্সিটি করে এর ধারাবাহিকতাকে ধ্বংসের মাধ্যমে মেডিক্যাল শিক্ষার মূলোৎপাটন করার উদ্দেশ্য কী তা জাতি নিশ্চয়ই জানতে চায়। অনেকেই তাদের বাড়িতে বাড়িতে একটা করে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি করে বাহবা নিতে চাইছে। কিন্তু অগ্রপশ্চাৎ কিছুই চিন্তা করছে না। এমন তারল্য চিন্তা দেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকারক। চিন্তা করে বলুন সারা দুনিয়ায় কয়টা মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি আছে? খুঁজে দেখুন এরপর উত্তর দিন। মেডিক্যালের অনেক শিক্ষকই ইউনিভার্সিটির পক্ষে কাজ করছেন, অনেকে সাফাই গাইছেন। কিন্তু তাঁদের যদি আপনি বলেন যে ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা প্রাকটিস করতে পারবেন না, তাহলে আপনি তাঁদের কাউকেই ইউনিভার্সিটির পক্ষে পাবেন না। প্রাইভেট প্রাকটিস জমানো, বদলি বন্ধ করা, চাকরির মেয়াদ বাড়ানো, বিভিন্ন পোস্ট বাগানোর ধান্ধায় আজ তাঁরা ইউনিভার্সিটির পক্ষ নিয়েছেন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তাঁদের কেউ যেন বলির পাঁঠা না বানাতে পারে। এই ধ্বংসের হাত থেকে মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করা আমাদের সবার জাতীয় দায়িত্ব। মেডিক্যাল শিক্ষার মানের নিয়ন্ত্রণে আপসহীন হতে হবে। কারণ এটা জাতির বাঁচা মরার ব্যাপার। এখানে কম্প্রোমাইজ করা চলে না, কোনোভাবেই নয়। জাতির কর্ণধাররা চিন্তা করুণ, বিবেককে জাগ্রত করুণ, দেশের কথা ভাবুন, দেশের মানুষের কথা ভাবুন, আর তা না পারলে নিজের সন্তানদের কথা ভাবুন। কার হাতে তুলে দেবেন আপনার সন্তানদের চিকিৎসার ভার। এটা ভাববেন না বিদেশে চিকিৎসা করাবেন বা বিদেশে পাড়ি জমাবেন। মনে রাখবেন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। একদিন না একদিন ধরা খাবেনই। আসুন সবাই মিলে দেশের কথা ভাবি, নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাবি। মেডিক্যাল শিক্ষাকে দল, মত, ব্যক্তিস্বার্থের ঊধর্ে্ব রেখে সবাই মিলে দেশের জন্য কাজ করে যাই।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সার্জারি, বিএসএমএমইউ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.