প্লাবনের প্রস্তুতি by শেখ রোকন

চৈত্রের গোড়ার বিকেলে একপশলা বৃষ্টি বেমানান নয়। এ আর নতুন কী যে, বাংলার বসন্তকাল বরাবরই ক্ষণস্থায়ী। ফুল, পাখি আর নতুন পাতাগুলো ফাল্গুন মাসেই কোনো রকমে নমো নমো করে ঋতুরাজের পূজা সারে। চৈত্র মাস পড়লেই প্রকৃতি যেন পাততাড়ি গোটাতে গোটাতে গ্রীষ্মের পানে আড়চোখে চায়।

আসন্ন সে ঋতুও সব সময় কাঠফাটা রোদ্দুরের শাসন মেনে চলে না। আমাদের গ্রীষ্ম মানে ঝড়-জল আর তাপদাহের মিলনমেলা। গ্রীষ্ম মানে বৃষ্টিসম্ভবা আকাশ। দিনভর ঘরহারা মেঘের ডাকাডাকি। সোঁদা গন্ধ ছড়ানো শনিবারের বৃষ্টি বোধহয় এরই আগমনী সঙ্গীত।
বসন্তে ভাগ বসিয়েও অবশ্য গ্রীষ্মের গোলা ভরে না। এর লাভের গুড় খেয়ে যায় বর্ষার পিঁপড়া। জ্যৈষ্ঠ মাসেই কখনও কখনও ঘনঘোর বর্ষা নামে। আকাশ ছেয়ে আষাঢ় আসার আগেই খাল-বিল ভরে যায়। মাঠে পানি ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশীয় সমতলভূমি, হাওর-বাঁওড় ও বিল অঞ্চলে উঁকি দেয় আগাম বন্যা। নিদেনপক্ষে কাদামাখা পথঘাট। সেই যে জ্যৈষ্ঠে বর্ষা শুরু হয়, বরাদ্দের আষাঢ়-শ্রাবণ শেষ করেও থামে না। বাংলার ঋতুচক্রে ভাদ্র মাসও কার্যত বর্ষাকাল। পঞ্জিকায় শরৎকাল এলেও এতে ভাদ্রের ভরা নদী ঢাকা পড়ে সামান্যই।
বর্ষা বাংলার দীর্ঘতম ঋতু। কেবল দৈর্ঘ্যের কারণে নয়, বর্ষার আগ্রাসী চরিত্রের কারণেও এর জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়। আগাম বন্যা থেকে থেকে ফসল বাঁচাতে হাওর অঞ্চলের বাঁধ মেরামত করতে হয়। নজর দিতে হয় সারাদেশের কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাটের দিকে। কয়েক বছর পরপর বন্যা হয়। তাও আমাদের জন্য নতুন নয়। এ জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি এবং অবকাঠামোগত প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। আগাম কিছু প্রস্তুতি ঠিকঠাক নিতে পারলে বর্ষার প্লাবন ও প্রকৃতি মনোরমই বৈকি।
অনেকে বলেন, ইন্দোনেশিয়ার বর্ষা আরও গরবিনী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গীয় বর্ষার 'সঙ্গীতে তাহার সমারোহে, তাহার অন্ধকারে তাহার দীপ্তিতে, তাহার চাঞ্চল্যে তাহার গাম্ভীর্যে' মুগ্ধ বটে। ইন্দোনেশিয়ার বর্ষাকাল আরও রাজসিক। সেখানে অঞ্চলভেদে সাত-আট মাস বর্ষাকাল থাকে। নিয়ম করে বৃষ্টি ঝরে প্রায় সর্বত্রই। ইন্দোনেশিয়ার চোখজুড়ানো সবুজ আসলে বর্ষারই অবদান। সবুজ কেবল নয়, আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত এ দ্বীপমালার পাহাড়ি আবহাওয়া সহনীয় রেখেছে প্রায় বছরভর বৃষ্টি। সেখানকার বনজসম্পদ, কৃষি, পর্যটন_ সবই বর্ষার দান।
বিড়ম্বনাও আছে, বিশেষ করে প্রকৃতির স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে যেসব কৃত্রিম বসতি গড়ে উঠেছে, সেসব শহর অঞ্চলে তুমুল বর্ষা জলাবদ্ধতা ডেকে আনে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার যানজট ও জলাবদ্ধতা একসময় কুখ্যাত ছিল। উত্তম নিষ্কাশন ব্যবস্থার বদৌলতে গত কয়েক বছরে দ্বিতীয়টি প্রায় দূর করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু শঙ্কা কাটছে না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। পাশের জাভা সাগর থেকে জাকার্তার উচ্চতা ১০ মিটারেরও কম। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে জাকার্তা সহসাই হয়তো তলিয়ে যাবে না; কিন্তু পানি নিষ্কাশন কঠিন হয়ে পড়বে। নগরবিদরা তাই এখন থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজধানী শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৩টি নদীর ১০টিই খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকককে ঘিরে। গত বছরের শেষ দিকে সেখানকার দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কারণ হিসেবেও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশিয়ার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর, যেমন ম্যানিলা, হো চি মিন সিটি, সিউল একই ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এ নিয়ে ইকনোমিস্টের চলতি সংখ্যায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বলা বাহুল্য, সমুদ্র সমতলের সামান্য উচ্চতায় অবস্থিত ঢাকা, কলকাতা ও মুম্বাইয়ের ঝুঁকি যে আরও বেশি, সে হুশিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়েছে। প্রস্তুতি কতখানি তা অবশ্য ব্যাংকক বা জাকার্তার মতো লেখা নেই। মুম্বাই, কলকাতার খবর জানি না। ঢাকায় কি নতুন ধরনের সেই জলাবদ্ধতা মোকাবেলার প্রস্তুতি চলছে? চোখে অন্তত পড়ছে না!
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.